0

ছোটগল্প: দেবাশিস ঘোষ

Posted in





ছোটগল্প



সংশয়
দেবাশিস ঘোষ


সেই ভোর থেকে নাক টানছে সজল । ঘুম ভেঙে গেছে, তবু বিছানায় পড়ে আছে । বেলা কত হল, একবার তাকিইয়েও দেখতে ইচ্ছে করছে না ঘড়ির দিকে । শরীর আর মন দুটোই খারাপ । কাকভেজা ভিজেছে কাল রাতে । বাড়ি ফিরবার সময় । ধরা গলায় অন্য দিকে তাকিয়ে বললেও কিন্তু বলেছিল টিনা, বাড়ি গিয়ে যেন একবার চান করে নেওয়া হয়, প্রেফারেবলি গরম জলে । তখন মাথায় আগুন, তাই ফিরেও তাকায় নি সে । রাগে গজ গজ করতে করতে বাড়িমুখো হাঁটা দিয়েছে । ভিজে সপসপে জামাকাপড়, শরীরটাও এমন ভিজে ন্যাতন্যাতে যে ভেজা দেশলাই কাঠির মত সেটাও তেমন জ্বলে উঠতে পারছিল না । রাগের গজগজানি তাই হচ্ছিল না ঠিক মতো । সজল ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেকটাই, বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলতে শুনেছিল টিনাকে, পৌঁছে যেন একবার ফোন করা হয় । সজল সেটা শুনতে পায় নি, ব্যাস্‌ । বাড়ি ফিরে এসে তাই কোনোটাই করে নি । ফোনও করে নি, চানও করে নি । করবে না সে, তার খুশি । তাতে কার কী ? 

সকাল থেকেই বৃষ্টি । রাতে বোধ হয় থেমেছিল কিছুক্ষণের জন্য । না হলে এতক্ষণে জল দাঁড়িয়ে যেত বাড়ির সামনে । কপালে একবার হাত দিয়ে দেখল, যেভাবে মাকে দেখতে দেখেছে জ্বর এসেছে কিনা । কিন্তু প্যারামিটার না জানা থাকলে বুঝবে কেমন করে । হাতে কতখানি গরম ঠেকলে থার্মোমিটারে কতখানি তাপমাত্রা দেখায় সে অনুমান অভ্যাসলব্ধ । সজলের সে সুযোগ হয় নি । সুতরাং সঠিক অনুমান তার পক্ষে অসম্ভব । উপায় একটাই, পাশের ঘর থেকে থার্মোমিটার আনিয়ে দেখা । কিন্তু কোন তাকের কোন খোপে যে তা গুঁজে রাখা আছে তা সে জানে না । খুঁজতে গেলে ধরা পড়ে যেতে হবে, বিস্তর কৈফিয়ত দিতে হবে, কী করে হল, কেন হল, ইত্যাদি । তাহলে আর মার কাছে লুকোনো থাকল কেমন করে ? মা জানতে পারলে অবধারিত বিকেলে আর বেরোতে দেবে না । অথচ আজ তাকে বেরোতেই হবে । এটা জিদের প্রশ্ন, টিনার কাছে সে কখনই হার মানতে পারে না । 

মাথার বালিশের পাশে দেখল একটা সিগারেট পড়ে আছে । আশ্চর্য ! কী করে এল ? কাল রাতে ফিরবার পথে সিগারেটের দোকান খোলা পায় নি । খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিল তখন । অন্তত দুখানা সিগারেট যে তার লাগেই, রাতে শোয়ার সময় একটা, আর সকালে বাথরুমে যাওয়ার সময় একটা । খানিক আগে তখন ঠান্ডায় না পেরে অবশিষ্ট একখানা সিগারেট ধরাবে বলে প্যাকেটটা ফেলে দিয়েছিল । ভাসতে ভাসতে সেটা চলে যেতে দেখেছে । কিন্তু সিগারেটটা ধরাতে পারে নি তখন । দেশলাইযের কাঠি একের পর এক নষ্ট হয়েছে, জ্বলে নি । শেষে একটা যখন জ্বলল, তখন সিগারেটটা ধরল না । ভিজে একসা তখন সেটা । পকেটে রুমালের যে অংশ শুকনো ছিল তখনো, সেই অংশ দিয়ে মুড়িয়ে রেখে ছিল প্যান্টের পকেটে । পরে তার কথা আর খেয়াল ছিল না । মেজাজ খারাপ করে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল । তার প্রথম কারণ টিনা, দ্বিতীয় কারণ সপসপে ভিজে জামাকাপড়ের নীচে শরীরটা তখন থকথকে কাদা, তা যেন আর দাঁড় করিয়ে রাখা যাচ্ছিল না । তৃতীয় কারণ, খালি হাতে বাড়ি ঢোকা, সাথে সিগারেট নেই । মুখের চেহারা দেখে কেউ আর কিছু বলে নি । পকেট থেকে রুমাল, পার্স এবং আর যা সমস্ত কাগজপত্র ছিল সব বার করে ভিজে জামাকাপড় দডিতে মেলে দিয়, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গিয়েছিল সে । কি খেয়েছে আর কি খায় নি, এখন সেসব কিছু মনে নেই । শুধু মনে আছে শোয়ার সময় টেবিলের উপর থেকে রুমালটা নিয়ে এসেছিল, লাগতে পারে মনে করে । বেশ একটা অস্বস্তি টের পাচ্ছিল তখন । রুমালে তখনো ভিজে ভাব, সুতরাং বিছানায় রাখা ঠিক হবে না । খাটের নিচে চালের বালতির পাশে একটা খালি জুতোর বাক্স ছিল । একসময় রেখে দিয়েছিল, জুতোয় গোলমাল বেরোলে ফেরত দেওয়ার সময় লাগবে বলে । সেইটা টেনে বার করে মাথার বালিশের পাশ বরাবর ঠিক নীচে রেখে, ভেজা রুমালটা তার উপর রাখবার সময় রুমালের মধ্যে থেকে গড়িয়ে পড়ল সিগারেটটা । হঠাৎ দেখার বিষ্ময় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কেটে গেল যখন ঘটনাটা মনে পড়ল পর পর । সবটুকু জল রুমাল শুষে নিয়েছে বলে এখন সেটা আবার চাঙ্গা । গুমোট ঘরে একটু যেন হাওয়া খেলল । অনুচ্চারিত একটা আরামের শব্দ যেন বেরিয়ে এল কোথা থেকে, সজল শুনতে পেল । জুত করে ধরাবে বলে অপেক্ষা করতে লাগল কিছুক্ষণ । বিছানা থেকে উঠে টেবিলের ড্রয়ার গুলো ঘেটে দেখবে দুএকটা কাঠি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা দেশলাইযের । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঠি খোঁজাও হয় নি, সিগারেট ধরানোও হয় নি । সজল ঘুমিয়ে পড়েছিল । 

বিছানা থেকে নেমে টেবিলের উপর থেকে দেশলাইটা নিয়ে দেখল শুকিয়ে গেছে । খানিক আগে যে হাতে গায়ের জ্বর মাপার চেষ্টা করছিল, সেই হাতে পরীক্ষা করে দেখল কাঠি গুলো সব কয়টা শুকনো । শরীর একটু ভালো হয়ে গেল কি? জ্বর জ্বর ভাবটা তো আর নেই ! মেলে দেওয়া জামাকাপড় রোদে শুকোবার পর যেমন একটা খড়মড়ে ভাব থাকে, ঠিক সেই রকম যেন এখন মনটা । দিনটা আজ কেমন যায় দেখা যাক ।

ততটা না হলেও, এখনো খারাপ হয়ে যায় মনটা কালকের কথা মনে পড়লে । অতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সজল একা একা, লেকের ধারে যেখানে টিনার জন্য দাঁড়াবার কথা ছিল তার । বৃষ্টিতে ভিজছিল একা একা । তবু নড়ে নি সে, পাছে টিনা এসে খুঁজে না পায় তাকে । বৃষ্টি হতে হতে জল দাঁড়িয়ে গেল, সজল তবু নড়ল না । পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সেই জলের মধ্যে, একান্ত অপেক্ষায় । টিনা এল অনেক পরে, বৃষ্টি থেমে যাওয়ারও অনেক পর, প্রীতম বোসের গাড়িতে করে । তখন অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ ঘন হয়ে । প্রথমে তাই দেখতে পায় নি সজল । অন্ধকারে কাউকে যেন সে তার নাম ধরে ডাকতে শুনল । এদিক ওদিকে তাকিয়ে যখন সে খোঁজ করছে তখন মেয়েলি গলায় কাউকে বলতে শুনল " আরে বাবা এইতো, গাড়িতে ।" কাছে এগিয়ে গেল সজল । টিনা বলল , " এই জলের মধ্যে নামব কেমন করে ? তুমিই বা দাঁড়িয়ে আছ কেমন করে ?" । তখন ভিতর থেকে এক ভদ্রলোকের গলা পাওয়া গেল , " গাড়িতে উঠে আসুন না , সামনে নামিয়ে দিচ্ছি ।" টিনা তখন আলাপ করিয়ে দিল । জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে, গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করল সজল । অনুরোধে কৃতার্থ হয়ে বলল, " না না, ধন্যবাদ, আমার জামাকাপড় সব ভিজে, গাড়িতে উঠব না, সিট ভিজে যাবে । আপনারা বরং একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ান, আমি আসছি " 

প্রীতম বোসের নাম আগে শুনেছে সে, টিনার মুখে । টিনার বাবাকে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন যে ডাক্তার বাবু, প্রীতম বোস তার ছেলে । সে নিজেও নাকি ডাক্তার, এখন এম ডি করছে । যে তিনটে দিন যমে মানুষে টানাটানি চলেছে টিনার বাবাকে নিয়ে, প্রীতম বোস সারাদিন সারারাত ছিল টিনা আর টিনার মায়ের সাথে । প্রতিমুহূর্তে সান্ত্বনা দিয়েছে, মনোবল যুগিয়েছে । টিনা যখন এসব গল্প করত, মন দিয়ে শুনতে হত সজল কে । মাঝে মাঝে বিষ্ময় প্রকাশ করতে হত, মাঝে মাঝে বলতে হত গ্রেট, কারণ, সে নিজে তো কিছু করতে পারে নি টিনার বাবার জন্য । প্রীতম বোস যখন টিনা দের সাথে রাত জেগেছে, সজল তখন ছিল ঘরে বিছানার আরামে, নিদ্রাসুখে । তাই প্রীতম বোসের কথা উঠলে তাকেও তারিফ করতে হয়, নইলে ভয় হয় টিনা যদি আবার সেই কমপ্যারিজিন টেনে আনে, আবার যদি তাকে পদে পদে ছোট হতে হয় প্রীতম বোসের কাছে । প্রীতম বোস ডাক্তার, প্রীতম বোস গাড়ি মেইনটেইন করতে পারে, নিজের ইচ্ছেমত গাড়ি চালিয়ে কাউকে ড্রপ দিতে পারে, যেখানে সে চায় সেখানে । সজল এর কোনোটাই পারে না । 

গাড়ি চলে গেলে পায়ে পায়ে জল ঠেলে এগোতে শুরু করল সজল । কিছু দূর যেতে হবে এই ভাবে, তারপর স্থলরেখা । টিনা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, পরিপাটি পোষাকে । টিনার কাছ থেকে ধন্যবাদ জেনে ডাঃ বোস যদি এতক্ষণে চলে না যেয়ে থাকেন, তাহলে বাধিত টিনা তার মুখের দিকে তাকিয়ে এখন হাসছে, চমকিত হয়ে উঠছে তার প্রতিটি কথায় । যত দীর্ঘায়িত হবে সে আলাপচারিতা ততই হারিয়ে যেতে থাকবে টিনা, বিভোর হতে হতে । সজল এখন আর পারেনা তেমন বিভোর করতে । আগে পারত, আগে বিভোর হত টিনা তার কথায় । তখন সম্বল ছিল সজলের । দিনে দিনে তা হারিয়ে গেছে, আর সে খুঁজে পায় না । এমনই কোনো বৃষ্টিতে যেন ধুয়ে মুছে গেছে সব । না, তা নয়, হয়তো সবই আছে কিন্তু এখন আর তা বিভোর করতে পারে না টিনাকে, ছেলেবেলার ল্যাবেন্চুষে যেমন বড়ো বেলায় ভোলে না কেউ । টিনা এখন আরো অনেক কিছু দেখে ফেলেছে চারিদিকে, এখন নতুন থেকে নতুনতর না হতে পারলে চোখ টানা যাবেনা তার । 

টিনা একলাই দাঁড়িয়ে ছিল । তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে ডাক্তার বাবু । টিনা বলল, দরকারি কাজ আছে বলে দেরী করতে পারল না, চলে গেল । সজল হাসতে হাসতে বলল, " থাকতো, কিন্তু তোমার টেস্ট দেখে আরো পারল না, চলে গেল ।"
- টেস্ট ? টেস্টের ব্যাপার এল কেমন করে এর মধ্যে ? 
- টেস্ট নয় ? গাড়িতে চড়িয়ে যার কাছে সে নিয়ে এল তোমায় পৌঁছাতে সে দাঁড়িয়ে আছে থৈ থৈ জলের মধ্যে ভেজা কাক হয়ে । এমন যার বন্ধু বান্ধব , তার টেস্ট তাহলে কেমন, বোঝা যায় । আর তার সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করা যায় এক মুহূর্ত ? কখনো না । তা ছাড়া কাকভেজা একটা লোক এলে তার সাথে তখন শুধু হাই হ্যালো করে বিদায় নেওয়া যায় না । তাই তার আগেই সরে পড়তে হয় ।
- বুঝলাম । কোন দিকে যাবে চল । 

সজল চোখের ইশারায় নিজের শরীরের দিকে ইঙ্গিত করল । নিজেও একবার দেখল নিজের চেহারা । বলল, দেখতে পাচ্ছ তো । অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলাম আর জল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কয়েক বার ফোন করলাম তোমায়, ধরলে না । তখন ঠিক করলাম অকারণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে লাভ নেই, বাড়ি চলে যাই 

সজলের কথা থামিয়ে টিনা জিজ্ঞেস করল, ফোন করেছিলে তুমি ? রিয়েলি ? সরি, হাসপাতালের মধ্যে ছিলাম বলে সাইলেন্ট করা ছিল । সরি । 
- সরি শুধু ঐ টুকুর জন্য ? নিজে ফোন করতে পারতে না ? তুমি তো জানতে কখন আসার কথা ছিল ! আমার এতক্ষণ দাঁডাবার কথা ছিল না, আমি নিজে নিজের পরীক্ষা নিচ্ছিলাম । দেখছিলাম তোমার জন্যে কতটা আমি পারি । বৃষ্টি না থামলে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতাম । তুমি যতক্ষণ না আসতে, দাঁড়িয়ে থাকতাম । আমার পরীক্ষা হয়ে গেছে টিনা, রেজাল্ট ও বেরিয়ে গেছে, আর তো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই । বলো, কোথায় যাবে । আমি এখন বাড়ি যাব । চাইলে, তোমায় পৌঁছে দিয়ে যেতে পারি, কোথায় যাবে তা যদি বল । খুব দূরে কোথাও হলে পারব না, এই অবস্থায় বেশী দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে । 

এতক্ষণ চুপ করে ছিল টিনা । এখনও তাই । চেয়ে থাকল মুখের দিকে । সজল আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে ? তাড়াতাড়ি বল, আমি বাড়ি যাব । এইবার মৌনতা ভাঙল টিনার । বলল, তোমায় আর থাকতে হবে না, তুমি যাও । মনে করে নাও আমি আসি নি । 
- না, কখনও না । তুমি না আসলে আমি চলে যেতাম না । দাঁড়িয়ে থাকতাম । তবু না হলে বাড়িতে যেতাম দেখতে, কী হল যে ফোনটাও ধরতে পারলে না । তুমি আসো নি মনে করলে এখন সেই তোমাদের বাড়িতেই যেতে হয় । কিন্তু দেখা হওয়ার পর তো আর একলা যেতে পারি না । টিনা তখন বলল, বেশ, তাই চলো । 

ফাঁকা ট্রাম । লেডিজ সিট ছেড়ে দিয়ে পিছন দিকে গিয়ে বসল টিনা। পাশে জায়গা ছিল, তবু বসল না সজল । সামনে দাঁড়িয়ে থাকল মাথার উপরের রড ধরে । টিনা মুখ তুলে তাকালো উপরের দিকে । জিজ্ঞেস করল, বসবে না ? 
- না , জামাকাপড় সব ভিজে ।
- বেশ তো আমি সরে বসব, তাহলে তো আর জামা কাপড় ভিজবে না আমার ।
- সিট ভিজবে ।
- যদি অন্য কেউ ভিজে জামাকাপড়ে এসে বসে পড়ে, বারণ করতে পারবে তাকে ? 

ট্রাম একেবারেই ফাঁকা, তবু চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিল সজল, কেউ দেখছে না তো । তারপর গলা নামিয়ে বলল, সেসব আমার হাতে নেই টিনা, কে তোমার পাশে এসে বসবে বা তুমি কার পাশে গিয়ে বসবে । ওখানে বসবার জন্য ঝোঁক থাকত এক সময় । নিজেকে তখন মনে হত বিশেষ একজন, বিশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী । আজ আর তা মনে করবার সুযোগ কোথায় ? আমি যে তুচ্ছ অতি, তা তো বুঝলাম । তবু তোমাকে ধন্যবাদ, আমার প্রতি এই অনুগ্রহ টুকু দেখাবার জন্য । 

ভাবতে ভাবতে চা শেষ করে ফেলেছে সজল । এইবার সেই মুহূর্তটা এসেছে সিগারেটটা ধরাবার, আশ্চর্যজনক ভাবে যেটা থেকে গেছে এখনো, খরচ না হয়ে । খরচ হয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল সিগারেটটা । তখন ঠান্ডা হয়ে আসছিল শরীরটা, উত্তাপের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তখন ধরানো গেল না সিগারেটটা । তাই থেকে গেল রাতে শোয়ার সময়ের জন্য । অবশ্যম্ভাবী ভাবে তখন তা খরচ হয়ে যাওয়ার কথা, তবু হল না, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল বলে । এখন ধরাবে সে । 

মাথার ভিতরে হঠাৎ একটা আইডিয়া ঘুর ঘুর করতে লাগল । যখন যেখানে বাধা পেলাম তখন তো সেখানে হতাশ হয়েছিলাম, ভাগ্যকে দোষ দিয়েছিলাম, ভাগ্য যে ভবিষ্যতের জন্য মজুত করে রেখে থাকতে পারে, সে কথা তো কখনো ভাবিনি । কালকের বঞ্চনা না থাকলে আজ এই মুহূর্তের এই সুখ, এই আয়েশ কোথায় পেতাম ! হঠাৎ মনে হল এসব আবার কি ভাবছি ! হঠাৎ শরীরটাই বা এমন চনমনে হয়ে উঠল কেমন করে ! ঠান্ডা লাগার দরুন সেই নাক টানার ব্যাপারটাও এখন প্রায় নেই। 

দরজার পাশে প্লাক পয়েন্ট থেকে চার্জারের তার ঝুলছে, রাতে চার্জে বসাবার পর খোলা হয় নি মোবাইল । তাড়াতাড়ি খুলতে গিয়ে দেখল দুখানা মিস্ কলের চিহ্ন আর দুখানা এস এম এসের । চেনা নম্বর, বুঝতে তাই অসুবিধা হল না যে , যে অসম্ভবের আশা গোপনে এসে মনের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল সে কোন অজানা সিঁড়ি বেয়ে সম্ভব হয়ে উঠে এসেছে । মিস্ কল এবং মেসেজ দুটোই এসেছে টিনার কাছ থেকে । 

একটা মেসেজ কাল রাতে এসেছে, আর একটা আজ সকালে । কাল রাতের মেসেজে লেখা "ফোন করে জানাতে বলেছিলাম । কেবল খবর নেওয়ার জন্যই বলেছিলাম, প্রেম করার জন্য নয় " । এসেছে রাত একটা উনত্রিশে । সকালের মেসেজে লেখা , " কাল তো ফেল । আর একবার পরীক্ষা দেবে নাকি আজ ? "। হঠাৎ আসা খুশি যেন দরজা থেকেই ফিরে গেল । এখনও সেই একই সুর টিনার কথায় ? কাল আমার পরীক্ষা নিয়েছিল সে ? । না না, সে নিজেই তো একবার বলেছিল যে নিজের পরীক্ষা নিয়েছে সে । বলেছিল, রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে । কিন্তু একবারের জন্যও বলে নি কেমন রেজাল্ট হয়েছিল, পাশ না ফেল । মিস কল এসেছে কাল রাতে একটা, একটা পনেরোয়, আর সকাল বেলায় আজ সাতটার সময় । কী কথা বলতে চেয়েছিল ? ঐ পরীক্ষা নেওয়ার কথাই কি ? একবার ফোন করে দেখবে কি ? 

হঠাৎ মোবাইলে মেসেজ টোন । মেসেজে এলো । কার কাছ থেকে ? কার কাছ থেকে আবার , সেখানে সেই চেনা নম্বর ! টিনার । " ডাহা ফেল, কাল ডাহা ফেল । পরীক্ষার্থী কখনো নিজেই পরীক্ষক হতে পারে না । শরীর কতটা সইতে পারে, জিদ কতক্ষণ টিকে থাকে সেই পরীক্ষায় অবশ্য পাশ, কিন্তু মন কতটা সইতে পারে -সে পরীক্ষায় যে একেবারে গোল্লা । অন্য আর একজনের সাথে গাড়িতে করে আসা এবং যখন সেই অন্য মানুষটা একজন পুরুষ মানুষ এবং যুবক, তখন আর মন একদম সইতে পারল না, তাই না । জলের মধ্যে অমনি ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলে বলে তোমার মনে হয়েছিল ছোটো হয়ে গেছ তুমি ডাঃ বোসের কাছে । অতখানি ছোটো মনে হত না যদি ডাঃ বোস জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসত । গাড়ি টাই যত মুশকিল করল ! আমি কিন্তু তখন ঐ তোমার বড় মানুষটার কাছ থেকে তোমার কাছেই গিয়েছিলাম, গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় । আর কি কোনো সংশয় থাকবার কথা ছিল ?" 

বিছানার পর সিগারেটের ছাই ! ছিঃ দেখে নি সে ? অ্যাশট্রে টা হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়ে আসার কথা না হয় ভুলেই গিয়েছিল, তাই বলে বিছানাটা সামলানোর কথাও ভুলে যাবে ? ছাইয়ের সাথে যদি আগুন থাকত, কী হয়ে যেত এতক্ষণে ? । না, আগুন ছিল না, শুধুই ছাই । খুব স্বস্তি বোধ করছে সজল, হাত দিয়ে ঝারলেই পরিষ্কার । এতটুকু দাগ পর্যন্ত থাকবে না কোথাও । সেটুকু সে পারে, অনায়াসেই পারে ।

0 comments: