0

ছোটগল্প: শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in



ছোটগল্প



খোপ
শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়






তিন্নি দিদির বাবা, মানে আমাদের দিবাকর জেঠু, বেশ একটু রাশভারী মানুষ । এই বয়েসেও সুন্দর সুঠাম চেহারা । গম্ভীর গমগমে গলা । একটা অদ্ভুত শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব নিয়ে ঘোরাফেরা করেন । আমাদের অঞ্চলের জমিদার বংশের উত্তরসূরী । তিন্নি দিদিদের বাড়িটা আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম । সেটা বাড়ি নয়, মহল । তবে সে সময় তার ভগ্নদশা । দেয়ালে দেয়ালে বট অশ্বত্থ ডালপালা মেলেছে । অত বড় বাড়ি আজকালকার বাজারে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নাকি ! তা শেষমেষ তিন্নি দিদির দাদারা প্রমোটার ধরে সেখানে ফ্ল্যাট তোলার পরিকল্পনা করলো । এতটাই জায়গা, যে বেশ বড়সড় দুটো এপার্টমেন্ট হোল । তারই একটার গোটা তিনতলা নিয়ে জেঠুরা থাকতে লাগলেন । কি একটা কারণে তিন্নি দিদি বাপের বাড়ি এসেছে শুনে দেখা করতে গেলাম । একসময় সামনে জেঠু । বললাম – 

- ভেঙে পড়া বাড়িটার চেয়ে এ বেশ ভালই হয়েছে, বলুন জেঠু ? 

নীল রক্তের অহংকারী মানুষটার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । বললেন – 

- হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি ! বাড়ির বদলে একটা পায়রার খোপ হয়েছে । 

মনে মনে বললাম – সেও তো বাড়ি । পায়রার বাড়ি । হলই বা খোপ । কম কি ! তোমার খোপ, আমার খোপ । খোপের আমি, খোপের তুমি । খোপ দিয়ে যায় চেনা ।

এই খোপ ব্যাপারটা শুনতে যত ছোটই হোক না কেন, এর গুরুত্ব কিন্তু অসীম । মানুষের মূল তিন চাহিদার অন্যতম এই খোপ । অতএব খোপ নিয়ে যে ক্ষ্যাপামি থাকবেই, তাতে আর আশ্চর্য কি ! ক্ষ্যাপার খোপ লাগে না । স্বাভাবিক হলেই খোপ চাই । তিনি মেষ, কর্কট, সিংহ, যাই হন না কেন ! মনের মত খোপ চাই । বেশ শক্তপোক্ত । যাতে ঝড় ঝপটা থেকে আড়ালে সেঁধিয়ে থাকা যায় । কারও দরমার বেড়া খড়ের চাল, কারও সাতমহলা । সাপ ইঁদুরের গর্ত, বাঘ সিংহের গুহা । আচ্ছা হাতি কি গুহায় থাকে ? না না যাঃ, অত বড় গুহা হয় না কি ! এই ধরেছি রে – ঐরাবতই সম্ভবত একমাত্র গুহাহীন প্রাণী । তাও বা আবার বলি কি করে ! জিরাফের যে খোপ হয় এমনটাও তো কখনও শুনিনি । যাক সে কথা । তবে পাখিরাও যে এ বিষয়ে মানুষের মতই সমান পারদর্শী, সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই । কোন নীড় কখনও ভেঙে পড়তে দেখেছেন ! পড়ে গিয়ে ভেঙে যায় হয়তো বা । তা সে তো ভূমিকম্পে ইমারতও ধসে পড়ে । কিন্তু নীড়......কি শক্ত তাঁর বাঁধন ! নিজের চোখে দেখেছি । জানালার বাইরের তুলসীগাছটাকে একেবারে নেড়া করে দিলো ! তার কচি কচি ডালপালা দিয়ে সে কি অসাধারণ বিনুনি ! মানুষ বানাক তো দেখি অমন প্রাকৃতিক মিষ্টি গন্ধযুক্ত খোপ ! বাবুই দিদির তো আবার কথাই আলাদা । চমকে দেবার মত Front Elevation দিয়েই ক্ষ্যান্ত থাকে না, সে খোপে আলোও জ্বলে । সামান্য একটু গোবর এনে রাখে, আর জোনাকি বেরোলেই খপ্‌ করে ধরে এনে তাতে গেঁথে দেয় । ঝিকমিক করে ওঠে তার খোপ ।

তিন্নি দিদির কথা বলছিলাম । তিন্নি দিদির শ্বশুরবাড়ি লখনউ শহরে । নবাবদের জায়গা । মানুষের বোলচালই আলাদা । সভ্য-ভদ্র-নম্র-বিনয়ী । অটোচালকরা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে – ‘জনাব কাঁহা চলেঙ্গে ?’, বা শ’তিনেক চিকন দেখে, যখন একটাও না-পসন্দ হওয়ায় বাতিল করে উঠে আসছি, পেছন থেকে দোকানি ছেলেটার গলা শুনতে পাওয়া যায় – ‘ফির আইয়েগা জরুর’ ! কলকাতার সাথে কোন মিলই নেই । অটোচালকের খেঁকানি আর দোকানির পাঁচনগেলা বেজার মুখের কথা শুনে অভ্যস্ত বাঙালি, কেমন যেন নার্ভাস লাগে । সুযোগের গন্ধ শোঁকা অভ্যেস, মনে হয় – এই রে, কোন মতলব নেই তো ! তা এ হেন শহরে গিয়ে পড়ল তিন্নি দিদি । তার শ্বশুর-শাশুড়িরও সেই একই অবস্থা । একমাত্র সন্তান সেখানে চাকরি পেয়েছে, তাই কলকাতার চকমিলান বাড়িতে তালা দিয়ে ভিনশহরের ফ্ল্যাটে থাকতে হচ্ছে । তা কি আর করা, নিয়তি কে ন বাধ্যতে । আছেন । 

আছেন, কিন্তু কদিন খুব ঝামেলার মধ্যে আছেন মাসিমা । কাকের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে খোলা ব্যালকনিতে গ্রিল দিয়ে প্রায় জেলখানা বানিয়ে ফেলা হোল । তাতেও রেহাই নেই । কাপড়-চোপড় মেলার জন্যে বাইরের দিকে দড়ি বেঁধে নিয়েছেন, কিন্তু সেখানে কিছুতেই কাপড় মেলতে পারছেন না । মেলতে গেলেই কাক এসে হাতে ঠুকরে দিচ্ছে । কিরকম প্রতিশোধপরায়ণ ভাবুন একবার । যেহেতু ব্যালকনি নোংরা করতে দেয়া হয়নি, তাই ওরাও আর কাপড় মেলতে দেবে না । এমনকি ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই ঘাড় ফুলিয়ে সে কি কা-কা চিৎকার ! ভয় দেখায় । বোধহয় বলে – ‘একবার হাত বাড়িয়েই দেখো, ফুটো করে দেবো একেবারে’ ! আচ্ছা, শেষ পর্যন্ত কাকের ভয়ে মানুষ কাপড় মেলতে পারবে না ! ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকবে একেবারে ! অনেক ভেবে, তিন্নিদিদি একটা উপায় বার করেছে । কাপড় কেচে সন্ধ্যে হবার অপেক্ষা করে । যখন তাদের আর দেখা যায় না, তখন আগের দিনেরগুলো তুলে নিয়ে, নতুনগুলো মেলে দেয় । এ একটা জীবন হোল ! এক একদিন মাসিমা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে নিজেও ওদের সাথে কা-কা করে চেঁচাতে থাকেন । বোঝাতে চান – দেখ, আমি আদৌ ভয় পাচ্ছি না । তবে কখনই বাইরে হাত বাড়ান না । কাক ঠুকরে দিলে যে বেশ লাগে, তা তিনি জানেন । ভুক্তভোগী কি না ! তারপর একদিন তিন্নিদিদিরই নজরে পড়ল – তাদের ব্যালকনির ঠিক ডানদিকে নিচের ফ্ল্যাটের একটা জানালার ছাদ । তাতেই বাসা বেঁধেছে একজোড়া কাক । সংসার পেতেছে । পরিবার গড়ে তুলেছে । সেখানে সদ্য জন্মানো গুটিকয়েক ছানাপোনা নিয়ে তাদের বসবাস । মেলা কাপড় বাতাসে উড়ে তাদের সেই খোপে যখন ঝাপট মারে, তখন তাদের পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে । তাই এতো রাগ । তাই শাশুড়ি-বৌ তাদের চক্ষুশূল !

অনেকদিন পর সেদিন তিন্নিদিদিদের বাড়িতে গেলাম । বিয়ের পর বহুদিন যাওয়া হয়নি । এ একধরণের নেমকহারামী । আমি ওবাড়ির এতটাই ঘনিষ্ঠ যে অনেকেই জানেন ওটাই আমার বাড়ি । সেই আমি, নিজের কাজের চাপে মেয়ের বিয়ে দেবার পর জেঠু-জেঠিমা যে কেমন আছেন, সে খবরও নেবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি । পৃথিবীটা বোধহয় এমনই শঠ । যাইহোক, গিয়ে বেশ ভালই হোল । দেখলাম বড়জেঠু এসেছেন । বড়জেঠু মানে তিন্নিদিদির জেঠু । ৭০ এর ওপর বয়েস । অকৃতদার । ছোটোখাটো চেহারার অত্যন্ত পরিশীলিত মানুষ । বিদেশ থেকে পড়াশুনো করে এসে এক বিদেশী কোম্পানিরই বড়কর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন চাকরির পর রিটায়ার করেছেন । ফোন করে ‘কেমন আছেন’ প্রশ্ন করলেই সপ্রতিভ জবাব পাওয়া যায় – ‘Physically fit, mentally alert’ । দারুণ গপ্পে মানুষ । নানান দেশের নানা খবর তাঁর ভাঁড়ারে সর্বদাই মজুত । গল্প করতে বসলে যেন নিজেকেই শিক্ষিত করা হয় । কাছে পেয়ে প্রশ্ন করে বসলাম – আচ্ছা জেঠু, আগে তো তুমি খুব ব্যস্ত থাকতে, এখন কি করে সময় কাটাও ? একটুও না ভেবে বললেন – ‘I am still very busy, young man. কি রকম বলি শোনো, ঘুম থেকে উঠি ঠিক পাঁচটার সময় । প্রাতঃকৃত্য সেরে ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় আসনে বসি । ঘড়ি ধরে ঠিক এক ঘণ্টা । সাড়ে ছটার সময় মুখে-নাকে রুমাল বেঁধে শুরু হয় বিছানা ঝাড়া । থপ্‌-থপ্‌ আওয়াজে যারা তখনও ঘুমাচ্ছিল তারাও উঠে পড়ে । তারপর টানটান করে কাচা চাদর দিয়ে বিছানা পাতা হবে । ততক্ষনে সকালের চা আর খবরের কাগজ এসে গেছে । তা নিয়ে বসা গেল । সেও এক ঘণ্টা চলবে । সাড়ে সাতটা নাগাদ দাড়ি কেটে বাথরুম । মোগলাই স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে তৈরি হতে হতে সাড়ে আটটা । এবার ব্রেকফাস্ট । একটু গল্পগুজব । দশটা নাগাদ আবার খবরের কাগজের বাকি অংশ । সাড়ে বারোটা নাগাদ লাঞ্চ সেরে দেড়টা নাগাদ দিবানিদ্রার তোড়জোড় । ঠিক সাড়ে চারটের সময় উঠে পড়া । মুখ-হাত-পা ধুয়ে আবার হাল্কা বিছানা ঝেড়ে টিফিন করে নেওয়া । এবার একটু পায়চারিতে বেরিয়ে পড়ি । একটা দাতব্য স্কুলে সামান্য শিক্ষাদানপর্ব । সাতটা নাগাদ ফিরে আসা । একটু TV দেখা । ঠিক সাড়ে আটটার সময় ডিনার সেরে সাড়ে নটায় শয়নে পদ্মলাভ । .........আমার সময় কোথায়’ । আমি বাকরুদ্ধ ! বৃদ্ধাশ্রমের খোপেও যে কোন মানুষ এমন নিজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে অসীম শান্তিতে থাকতে পারেন, তা আমার স্বপ্নাতীত !!

আমার আবার এই এক ঝামেলা । এক কথা বলতে গিয়ে সাত কথা ফেঁদে বসি । ভাবলাম তিন্নিদিদির খোপের গল্প শোনাবো, কথায় কথায় আরও কত খোপ এসে হাজির । তা যে কথা বলছিলাম । দেখবেন লক্ষ্য করে, শিশুতে-শিশুতে আর বৃদ্ধতে-বৃদ্ধতে বন্ধুত্ব হতে খুব একটা সময় লাগে না । তিন্নিদিদির শ্বশুরেরও লাগলো না । বাড়ির কাছকাছি একটা পার্ক আছে । রোজ বিকেলে সেখানে দুই বৃদ্ধের দেখা হয় । আরও অনেক বেঞ্চ আছে । সেখানেও বৃদ্ধেরা বসেন । কিন্তু এই দুই বৃদ্ধের জন্যে যেন একটা আলাদা বেঞ্চ বরাদ্দ । আসলে দুই শহরের নীল রক্ত কি করে যেন একে অপরকে চিনে নিয়েছে । সে ভদ্রলোকও ছোটোখাটো একজন নবাবজাদা । ক্রমে বন্ধুত্ব গাঢ় হোল । ভদ্রলোক প্রায়ই তাঁর বাড়ি যাবার অনুরোধ জানান । তা একদিন সকালে তিন্নিদিদির শ্বশুর ভাবলেন – এতো করে বলে লোকটা, যাই আজ ঘুরে আসি । যা ভাবা তাই কাজ – পৌঁছে গেলেন । মোড়ের পান দোকানে জিজ্ঞেস করায় যে বাড়িটা দেখল, তা দেখে ওনার চোখ কপাল ছাড়িয়ে টাকে ওঠার যোগাড় ! শোভাবাজারে নিজেদের বাড়িটাকে এতদিন বড় বাড়ি ভাবতেন । এ তো তিনটে অমন সেঁধিয়ে যাবে ! ঢুকব কি ঢুকব না ভাবতে ভাবতে একসময় সাহসে বুক বেঁধে ঢুকে পড়লেন । নবাবজাদা তো দারুণ খুশী । ‘আইয়ে আইয়ে, গরিবখানা মেঁ তশরিফ লাইয়ে’ বলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন । মুরগির পালের মত কলকল করে একরাশ নাতি-নাতনি এলো । ‘কলকত্তা কা জমিনদার’ বলে তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন । তারা নবাবজাদা, জমিনদার কখনও দেখেনি । ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জরিপ করতে থাকলো । ধুতিটাতে যেন আকর্ষণ একটু বেশী বলে মনে হোল । তিন্নিদিদির শ্বশুর বেশ আমোদ পেলেন । এই প্রথম শহরটাকে তাঁর ভালবাসতে ইচ্ছে করলো ।

নিজের নিজের খোপ মানুষের জীবনে অদ্ভুত দাগ রেখে যায় । মানুষকে দোমড়ায়, মোচড়ায়, নেঙড়ায়......নিজের মত করে তৈরি করে নেয় । শোভাবাজারের বাড়িটা ছিল বড় খোপ । ঘন মাথার খোপ । পাশের বাড়ির খাজাঞ্চিবাবুকেও অনায়াসে আত্মীয় ভাবা যেত । লখনৌএর প্রথম বাড়িটা ভাড়া বাড়ি হলে কি হয়, একটু বাগান-টাগান ছিল । খোপের চারপাশে একফালি সবুজ । মনটা একেবারে গুটিয়ে যায়নি । ফ্ল্যাটে তুমি আর আমি’র সংসার । খোপটা ছোট হতে হতে প্রায় আঙুলের বিত্তার মধ্যে আটকে গেছে । মনটাও । এভাবেই কি আমরা ক্রমশ গর্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছি ?! হারিয়ে যাচ্ছি ?! মানুষজন তো বটেই, এমন কি নিজের বিবেকের থেকেও দূরে সরে যাচ্ছি ?! হাট করে দরজা খুললেই যদি দখিনা বাতাস সব এলোমেলো না করে দেয়, জানালার পর্দা সরালেই যদি এক মুঠো সোনারোদ আছড়ে পড়ে আমাদের উজ্জ্বল না করে দেয়, হাত বাড়ালেই যদি বন্ধু’র শরীরের স্পর্শ না পাই, চোখ মেললেই যদি নীল আকাশ হাতছানি না দেয়, তাহলে নিতান্ত খোপের ছলনায় মাথাকুটে মরি কিসের আশায় ?!!

তা যে কথা হচ্ছিল । Return Gift জানেন নিশ্চয় । বাড়ির খুদেটার জন্মদিনে অন্য যে খুদেগুলো সমস্ত লণ্ডভণ্ড করার জন্যে আসে, তাদের আসা আর সেই মহান কর্মকাণ্ডের পুরষ্কার হিসেবে নাকি দিতেই হয় । নাহলেই নিজেরটার মুখ হাঁড়ি । সেই Return Giftএর মতই এক সকালে সেই নবাবজাদা তিন্নিদিদিদের ফ্ল্যাটে হাজির । টুং-টাং শব্দ শুনে তিন্নিদিদি দরজা খুলে দেখে এক অচেনা বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে । সোনার দাঁতে ঝিলিক দিয়ে একমুখ হাসি ঝরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – ‘বেটি, আব্বু মিয়াঁ হ্যাঁয়’ ? তিন্নিদিদির শ্বশুর ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন । প্রায় আঁতকে উঠে চীৎকার করে উঠলেন – ‘আরে নবাব সাহেব, আসুন আসুন, কি সৌভাগ্য আমার......’ ইত্যাদি ইত্যাদি । তিন্নিদিদিকে বললেন – ‘বৌমা, ইনি হলেন নবাব শার্দুল......’ । নবাব সাহেব শুধরে দিয়ে বললেন – ‘শাহ্‌দুল আবু বখ্‌তিয়ার সলিম কাস্‌মি’ । শ্বশুর মশায় বললেন – ‘হ্যাঁ, ঐ কাস্‌মি......তা নামের ওজন দেখেই নিশ্চয় মানুষটার ওজন বুঝতে পারছ’ ? তারপরেই নবাব সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন – ‘জানেন, আমি ভাবতেই পারিনি যে আপনি কখনও আমার এই পায়খানায় আসবেন’ ! নবাব সাহেব জিভ কেটে কান মুচড়িয়ে বলে উঠলেন – ‘তৌবা তৌবা, এ আপ ক্যা কহ রহেঁ হ্যাঁয় জনাব’ !! তিন্নিদিদির শ্বশুর তাতে দমবার পাত্র নন । বাড়ি কাকে বলে তা তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন ! বললেন – ‘ঠিকই বোলতা । আপনারটা যদি ‘গরিবখানা’ হয়, তাহলে আমারটা ঐ যা বললাম তাই খানা । তিন্নিদিদি আর সেখানে থাকতে পারেনি । মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দম্‌কা হাসি চেপে দৌড়ে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি ।

কার খোপ কে সামলায় ! কারও ‘গরিবখানা’, কারও বা ‘দেবদেউল’ । বেশ ছিলেন তাঁরা কৈলাসের কোন নাকি এক রাজ্য জুড়ে । আমাদের তা সইল না । সারা দেশজুড়ে ছোট বড় নানান খোপ বানিয়ে বলে দিলাম – এই তোমার গেরস্থালী । আমি রইলাম তোমার মালঞ্চের মালাকর হয়ে । রাখো মারো, সবই পারো । তুমি থাকো আমাদেরই মাঝে । চূড়ায় নয়, সমতলে । উচ্চাসন দেবো । দুধ-ঘি, ছানাটা, ননীটা, চাই কি সোনা-দানাও যে যেমন পারি দেবো । তাবলে চোখের আড়ালে থেকে বাজী মাত করবে, সে হতে দেবো না । যা করার দৃষ্টির মধ্যে থেকে কর । এইখানে স্থানু হয়ে থাকো । তোমার খোপ, আমার মন্দির । আমি মাথা নোয়াবো, সে আমার অধিকার । সে নোয়ানো মাথায় হাত রাখবে না পা, সে তোমার দায় । তোমার খোপের সামনে আমি কীর্তন গাইব, আগমনী গাইব, ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজাব, ধুপ-দীপ-ধুনো সব দেবো । কিন্তু রাখবো ঐ খোপে ! আমাদের এই সংসারের খোপে পুরে, নিজে স্বাধীন হয়ে পাহাড়ের চূড়ায়-চূড়ায় ঘুরে বেড়াবে, সেটা হতে দেবো না । এমন কি বছর বছর ম্যারাপের বাহারি খোপ বাঁধব তোমার জন্যে । মাঝে মাঝে হু-লালা হু-লালা বলে নাচব ঠিকই, কিন্তু তোমাদের ভীষণ ভয় পাই তো, তাই সেই খোপগুলোকে খুব সামলে-সুমলে রাখবো । আজকাল তো আর কালাপাহাড় নেই, তাই চিন্তাও নেই ! আজান দেবো, ক্যারল গাইবো, সুর করে গুরুগ্রন্থ পড়বো, কিন্তু সব ঐ খোপে । তোমার খোপে তুমি, আমার খোপে আমি । তবু একটা বন্ধন থাকবে । একটা সেতু, যা দেখা যায়না কখনও, কিন্তু থাকে ।

আর একটা খোপের খবর জানি আমি । আসলে সেটা একটা ধাঁধা ! খোপটা সর্বক্ষণ আমাদের সাথে সাথেই থাকে । সেথা প্রাণ বাস করে । বাউল বাউল শোনাল ? শোনাক না, ক্ষতি কি ! নাহয় আরও একটু পিছিয়ে গেলাম । সেই ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী’র গল্পে । সেই কৌটো’র মধ্যে ভোমরার খেলা । প্রাণ ভোমরা । দেহটা হোল খোপ, আর ভ্রমর হোল প্রাণ । পাখিটা একই থাকে, শুধু খাঁচাটা বদলে বদলে যায় । কোন শূন্য থেকে আসে, কোন শূন্যে বিলীন হয়, কেউ তা জানি না । তবু এই খোপ নিয়ে ঘোরা-ফেরা, তবু এই খোপের কত না যত্ন-আত্তি । একটু উল্টে নিয়ে বলা যেতে পারে, গাছ আছে তাই পাখী নীড় সাজায় । খোপ আছে, তাই প্রাণ খেলা করে । খোপটা আধার, প্রাণ হোল আধেয় । আর গুরুত্ব এতটাই, যে একজনের অন্যজন ছাড়া চলে না । দেহ ছাড়া প্রাণ বাঁচে না । প্রাণ বিনে দেহ, একটা জড় পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয় । জানি এ খোপ নশ্বর । জানি সব ফেলে রেখে একদিন চলে যেতেই হয় ! তবে সেদিন যখন একদল আঁটো জিন্‌স পরা আধুনিক যুবক রিক্সা আটকে চাঁদা চাইলো, আর কারণ জিজ্ঞেস করায় বুক ফুলিয়ে বলল – ‘যম পুজো’, তখন প্রায় প্রতিবাদ করতে গিয়েও সুড়সুড় করে টাকা বার করেছিলাম । আসলে আমার খোপটা আমার বড় প্রিয় । যমবাবুর পুজোয় চাঁদা না দিয়ে আমার পরাণপক্ষীটি আমার খোপ ছেড়ে পালাক, তা কখনই কাম্য নয় ।

দেখলেন তো, কি কথায় কোন প্রসঙ্গ এনে ফেললাম ! এই আমার দোষ । তিন্নিদিদির গল্পটা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি । অথচ সেটা না বললে খোপের সাত-কাহনে মস্ত ফাঁক থেকে যাবে । তখনও তিন্নিদিদিদের সেই বংশানুক্রমিক মস্ত খোপটা ভাঙা হয়নি । তিন্নিদিদির বিয়ের ঠিক হোল । শোভাবাজারের বিশাল জমিদার বংশ । রাজা উপাধিটা নাকি কি একটা কারণে পেতে পেতেও ফস্কে গেছে । তা সে যাই হোক, এমন একটা বনেদী বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী । শিক্ষিত, মার্জিত, বড় কম্পানি’র বড় চাকুরে......সব ঠিক ছিল । নীল রক্তের সাথে নীল রক্তের গাঁটছড়া । কোথাও কোন বাধা নেই । একটাই সমস্যা ছিল । দেবজ্যোতি’দা লখনৌ শহরে Posted । দিবাকর জেঠু সামান্য আপত্তি জানিয়েছিলেন বটে, কিন্তু দুই ছেলের অকাট্য যুক্তির কাছে সহজেই নতি স্বীকার করেছিলেন । অতয়েব তিন্নিদিদির খোপবদল পাকা হয়ে গেল । বিয়ের দিন সারা বাড়িটাকে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছিল, তা বলে বোঝাতে পারবো না । নাচমহলের ঝাড়বাতিগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল । মনে হচ্ছিল – এই বুঝি কেউ পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নেচে উঠবে । নানান রঙ-বেরঙের আলোয় সেজে ওঠা খুব চেনা খোপটাকেও অন্য জগত বলে মনে হচ্ছিল । আর তিন্নিদিদি ? সেই প্রথম বুঝলাম – রাণী বলতে কি বোঝায় ! সিঁদুর দানের সময় ফর্সা নাকের পাটায় তা গড়িয়ে পড়েছিল । কমলা-ঠাক্‌মা বলেছিলেন – ‘মেয়ে আমাদের স্বামীসোহাগী হবে রে......’ । কিন্তু বিয়ের বছর দুই পরও যখন দেবজ্যোতিদা বউকে নিয়ে যেতে চাইছে না, তখন একদিন তিন্নিদিদিকে সাথে নিয়ে তার শ্বশুর-শাশুড়ি ট্রেনে চেপে বসলেন । আর মাস ছয়েকের মধ্যেই জানা গেল, দেবজ্যোতিদা’র সেখানে একটা আলাদা সংসার আছে, একটা ছেলেও আছে । তিন্নিদিদির নিজস্ব খোপ বাঁধার স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে গেল । তিন্নিদিদি এখন খোপ ভাঙার তাগিদে আইনি সাহায্য নিচ্ছে । বাপের বাড়ির নতুন ফ্ল্যাটে একটা দশ-বাই-দশ খোপ তার জন্যেও বরাদ্দ হয়েছে । সেখানেই সেই বন্যার মত হাসিখুশি মেয়েটা মাঝে মাঝে লুকিয়ে কেঁদে নেয় ।

0 comments: