ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ছুটিকথা ২
নন্দিনী সেনগুপ্ত
গরমের ছুটি মানেই মামাবাড়ি। ছোটমামার তখনও বিয়ে হয়নি, বাড়িটাও দোতলা হয়নি। ছোটমামা আসানসোলে থাকত চাকরিসূত্রে, প্রতি সপ্তাহান্তে সোদপুরে আসত। ছোটমামা আধঘণ্টা অন্তর অন্তর হাঁক মারতো, ‘চা, একটু চা হবে নাকি?’...দিদা তৃতীয়বারের বার বলতো, ‘হুঃ’, বলে ঠাকুরঘরে ঢুকে যেতো। দাদুভাই ফোড়ন কাটতেন, ‘চা, চা চাই, চা য্যান অমৃত-সুধা!’ ন’মামী নিঃশব্দে পরম প্রশ্রয়ে ছোট দেওরের সামনে চায়ের কাপখানি ধরে দিতেন। ছোটমামা হারমোনিয়াম নামিয়ে একের পর এক গেয়ে যেতেন মান্না দের হিট গানগুলো। পাড়ার লোকজন অনেকেই এসে জড়ো হত বাড়ির পূর্বপ্রান্তে কোণার ঘরের আড্ডায়, কেউ আবার তবলায় সঙ্গত করতো। ন’মামীও মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে এসে যোগ দিতেন; তার রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়কী ভারি সুন্দর। একজনকে কেউ বিশেষ গাইতে বলতো না, কিন্তু আমার মতে তার গলার টেক্সচার ভারি সুন্দর আর কণ্ঠ খুব সাবলীল, সে হল আমার ন’মামু। ন’মামু একবার সাধলেই ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ দিব্যি গেয়ে দিত, কিন্তু লোকজন তাকে পারিবারিক বা বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় গানের ব্যাপারে মোটেই সিরিয়াসভাবে বিবেচনা করতো না। তুলনামূলকভাবে ছোটমামার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, কারণ ছোটমামা রোম্যান্টিক গান বা দুঃখের গান বেশি গায়। বাঙ্গালী চিরকালই খুব দুঃখবিলাসী জাত, তাই তার কাছে এসব গানের কদর বেশি। ছোটমামার ঘন ঘন চায়ের সঙ্গে সিগারেটের তেষ্টাও পেতো। তখনি ছোটমামা ছাতে উঠে যেতো চায়ের কাপ নিয়ে। কোনদিন দাদুভাইয়ের সামনে সিগারেট খেতে আমি ছোটমামাকে দেখিনি। একদিন সন্ধেবেলায়, ছোটমামা চায়ের কাপ নিয়ে ছাতে উঠলো, আর দাদুভাই হঠাৎ বলে উঠল, ‘শিবুর চা খাইতে ছাতে যাওন লাগে ক্যান?’ ... ন’মামী ভারি মৃদুস্বরে বলে উঠলো, ‘বাবা, শিবু, ঐ একটু ছাতে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে ভালবাসে তো, তাই!’ আমি আরেকটু হলেই বলতে যাচ্ছিলাম, ‘মোটেই না, ছোটমামা তো...’, ভাগ্যিস ন’মামী আমার মুখটা চেপে ধরে বললো, ‘চ, তোকে আমার বিয়ের এ্যালবামটা দেখাই’।
ছোটমামা একটা রবিবার দুপুরে আমাকে বলল, ‘চল, তোকে সিনেমা দেখিয়ে নিয়ে আসি, প্রফুল্ল হলে ‘লালু-ভুলু’ চলছে। আমার তো চিরকালই কোথাও যাওয়ার নামে কাঁধে ডানা গজায়; অতএব, ছোটমামার বলতে যতটুকু সময় লেগেছিল, আমার তৈরি হতে ততটুকুও লাগেনি। খাওয়া-দাওয়া হয়েই গিয়েছিল, আমিও রেডি। এমনসময় ছোটমামা ফিসফিস করে গিয়ে ন’মামীকে বলল ‘বৌদি, তুমি কও!’ ন’মামী দুচোখ কপালে তুলে বললো, ‘মানে? সর্বনাশ! তুমি এখনও বাবার পারমিশান নাও নি?’ তার উত্তরে ছোটমামা বিড়বিড় করে কি একটা বললো, সেইটা আমি ঠিক শুনতে পেলাম না।
একটু পরেই দাদুভাই আমাকে ডেকে বলল, ‘দিদিমণি, অখন ঠাস কইরা শুইয়া পড়ো, একখান ঘুম দাও’। শুনেই আমার ভারি কান্না পেলো; সেজেগুজে ফ্রকের সঙ্গে ম্যাচিং ক্লিপ লাগিয়েছি মাথার চুলে, সিনেমা দেখতে যাবো কিনা তাই। আর এখন দাদুভাই বলে কিনা ‘ঘুম দাও’! আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে মাটিতে পিঁপড়ের সারি দেখতে লাগলাম। ওদের কি মজা! ওরা যেখানে খুশি যাচ্ছে সার বেঁধে। দলে দলে পায়ে পায়ে ভ্রমণ, গন্তব্য সর্বত্র! কেউ কি ওদের ডেকে বলে, ‘যাইও না, ঘুম দাও!’ দাদুভাই আমাকে বোঝাতে লাগলো, ‘কি গরম, কি গরম! এমন গ্রীষ্মে নি মাইনষে বাইর হয়, অসুস্থ অইয়া পড়বা হ্যাষে, তখন কি অইবো? ঠাকুমায় কি কইবো, ভাবসো নি!’ এমনসময় ঘরের অন্যপ্রান্তে বসে পান সাজতে সাজতে দিদা হঠাৎ বলে উঠলো, ‘আইসে মামাবাড়ি বেড়াইতে, একদিন যদি সিনেমা দেখতে যায়, দোষের কি আসে? পোলাপান, সাইজ্যাগুইজ্যা... একা তো আর যাইতাসে না, শিবু লইয়া যাইতাসে। আর ও তো শান্ত মাইয়া, দুরন্ত নয়, যে, শিবু সামলাইতে পারবো না অরে। যাইতে চাইসে, যাউক!’ ছোটমামা ঘরের বাইরে থেকে নেপথ্যভাষণে বলে উঠলো, ‘হ, হ, কোনও সমস্যা হবে না’। তাতে দাদুভাই আরও জোরগলায় ছোটমামাকে এক ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘হ, হ, তুই থাম! ঐ সিনেমায় আসেটা কি? একটা খঞ্জ, একটা অন্ধ, হ্যারা গান গায় । এই দেখনের লেইগ্যা...’ এই কথার মধ্যেই দিদা ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে হেঁটে এল দাদুভাইয়ের ঠিক সামনে, একবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল, তারপর নিজের গালে একটা পান গুঁজে দিল। ছোটখাট মানুষ, অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন আমার দিদা; ঐ মুহূর্তে দিদার গায়ের স্বর্ণবর্ণ যেন খাপখোলা তরোয়ালের মত ঝিকিয়ে উঠলো, কপালের লাল টকটকে সিঁদুরের টিপটা যেন তৃতীয় নয়নের মত দপ করে জ্বলে উঠল। দাদুভাই স্বর পাল্টে বলে উঠলো, ‘আইচ্ছা, যাউক তাইলে!’
আমরা এগুচ্ছি, ছোটমামা জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে নিচু গলায় ন’মামীকে বলে উঠলো, ‘আইচ্ছা, একটা খঞ্জ, একটা অন্ধ, হ্যারা গান গায়...ফিল্মের গল্পখান বাবায় জানলো কেম্নে, আমারে একটু বুঝাইয়া কইবা বৌদি?’ ন’মামী মুখে আঁচল চাপা দিলো, দুচোখ ভর্তি কৌতুক!
durdanto bhison bhalo laglo
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ।
Delete