0

ছোটগল্প: ডঃ সুজাতা ঘোষ

Posted in




ছোটগল্প



আদুরে অহং
ডঃ সুজাতা ঘোষ



এখন সকাল ছ’টা, সূর্য চোখ খুললেও বিছানা ছাড়তে পারে নি এখনও। শীতের সকালে কোন প্রটেকশান ছাড়াই আমি সুপ্রিয় মুখার্জি, যাদবপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি হাওড়া যাওয়ার জন্য ট্যাক্সির অপেক্ষায়। আজ যেহেতু অফিসে যাব না তাই গাড়ি নিয়ে বার হই নি। হাওড়া থেকে অনেকটা দূরে, জায়গাটার নাম ত্রিবেনী, আমাকে যেতে হবে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। প্রায় আট মিনিট দাঁড়াবার পরে একটা ট্যাক্সি পেলাম।


সাঁই সাঁই করে দৌড়াচ্ছে । হাওড়া পৌঁছতে মনে হয় তিরিশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। ঠাণ্ডা হাওয়াটা গায়ের জোর ফলাচ্ছে আমার উপর। ভ্যানহুসেনের শার্ট ভেদ করে গায়ে আঁচড় কাটছে। বাধ্য হয়েই একটা সিগারেট ধরালাম। প্রথম ধোঁয়াটা বের করতেই অদ্ভুত একটা চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল শরীরের মধ্যে। 


কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টেশন চত্তরে পৌঁছে গেলাম। মাটির ভাঁড়ে চা হাতে নিয়ে ট্রেনে জানলার ধারে একটা সিট বেছে বসে পড়লাম। ট্রেন ছুটে চলেছে সামনের দিকে সবুজকে পিছনে ফেলে। মনে হচ্ছে সবুজকে চিরে আমি এগিয়ে চলেছি, বেশ লাগছে। 


আমি দক্ষিণ কোলকাতার ছেলে। আমার জন্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যাদবপুরের একটা থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাটকে কেন্দ্র করে। বাবা – মা, আমি আর ব্রাউনি, আমাদের অ্যালসেসিয়ানটা। ওর লোমগুলো ব্রাউন কালারের। আমার মায়ের খুব প্রিয়। 


আমার বাবা উত্তর কোলকাতার বনেদী বাড়ির বড় ছেলে। নিজের পছন্দে অন্য গোত্রের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য বাড়িতে মায়ের যে স্থান হওয়া উচিত ছিল, তা মা পাননি বলে বাবা সেই যুগে ঠাকুরদাকে উপেক্ষা করে একান্নবর্তী পরিবার থেকে আলাদা হয়ে আধুনিকতার চরম স্থান দক্ষিণ কলকাতায় এসে ঘর ভাড়া নেন। এরপর বাবার কর্মোন্নতি, ফ্ল্যাট কেনা, আমার জন্ম। আমাকে নামী কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা শিখিয়ে আজকের ভাষায় “স্মার্ট গাই” বানিয়ে তুলেছেন। 


আমি বর্তমানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, আই. বি. এমে বেশ মোটা সেলারিতে ভাল পোস্টে সসন্মানে চাকরি করে চলেছি। আমার নীচে এবং উপরে যারা আছেন প্রত্যেকেই যথেষ্ট ভেবে চিন্তে আমার সাথে কথা বলেন, কারণ আমার যোগ্যতা। 


আজ যার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চলেছি, আমি তাঁর খুবই স্নেহধন্য। ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে দুবার গেছিলাম সেখানে, এরপর আর যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। বড় হয়ে ভাল রেজাল্ট করার জন্য তাঁর সাথে ধীরে ধীরে ফোন মারফত আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। 


উনি সম্পর্কে আমার দাদু হন, মায়ের কাকা। বেশ রাশভারী মানুষ, তবে আমাকে এত স্নেহ করেন যে, বাবা – মায়ের অনুপস্থিতিতে আমি অফিস বন্ধ করেও ছুটে চলেছি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ট্রেনে যেতে যেতে মনের ভিতর নানা রকম অনুভুতি আসা যাওয়া করছে। বোধ হয় ভালোবাসা, সংকোচ আর ভয়। এত বছর ধরে যে ভালোবাসার সংযোগ তৈরি হয়েছে তাতে তাকে দেখার লোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া ভয়ের কারণটা বেশ ভয়ের। এতদিন ধরে যে ধারনা আমার সম্বন্ধে ওনার মনে তৈরি হয়েছে তা যদি আমি রক্ষা করতে না পারি তবে আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব। 


সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আমার নামার ষ্টেশন এসে গেছে। ষ্টেশনে নেমে চারপাশটাতে আলতো করে চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার। অন্য জগতে এসে পড়েছি আমি। আমার গড়ে ওঠা প্রকৃতির চেয়ে এ একেবারেই আলাদা। অনেক বেশী কোমল আর আশ্রয়দাত্রী। মনটা নরম হয়ে গেল। 


রিক্সা নিয়ে ঠিকানা খুঁজে বের করে পৌঁছে গেলাম যথাস্থানে। কঞ্চির দরজা ঠেলে ভিতরে পা রেখে পরের পা ফেলতে ভুলে গেলাম। বিশালাকার একটা সাদা বাড়িকে চারপাশের অন্তহীন সবুজ যেন আদরে আগলে রেখেছে। এত বড় জায়গা নিয়ে নিজস্ব বাড়ির কথা ভাবাই যায় না। আমি যখন বেশ স্তব্ধ তখন ছোট্ট একটি ছেলে দৌড়ে এসে জানতে চাইল, আমি কার কাছে যেতে চাই। 


শ্রী যোগেশ নারায়ণ চৌধুরী, নামটা বলা মাত্রই ছেলেটি বলে উঠল – ও, বড় দাদু? উনি তো উপরের ঘরে আছেন। ডান দিকের সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে দ্বিতীয় ঘর। চলে যান না। 


আমি সংকোচ কাটিয়ে ঘরটি খুঁজে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বয়স্ক ভদ্রলোক গায়ে হলুদ ধুতি জড়িয়ে পাথরের মেঝেতে বসে আছেন। সমস্ত চুল সাদা হয়ে বয়সকে জানিয়ে দিতে চাইলেও শরীরের শক্ত কাঠামো বলে দিচ্ছে উনি এখনও রোজ যোগ ব্যায়াম অভ্যাস করেন। ওনার শরীর থেকে বের হওয়া জ্যোতি আমার বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।


দু – একজন নিমন্ত্রিত ব্যাক্তি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের মধ্যেই একজনের দৃষ্টিগোচর হওয়াতে তিনি আমাকে বলেন, আপনি কাকে চাইছেন? তখনই আমার হুঁশ ফিরে আসে। আমি চৌধুরী মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ভদ্রলোক আমাকে ইসারায় দেখিয়ে দেন ওনার দিকেই, যার দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত। আমি পায়ে পায়ে ওনার সামনে এগিয়ে গিয়ে বলি – আমি সুপ্রিয় মুখার্জী, যাদবপুর থেকে আসছি। 


শোনা মাত্র উনি আমাকে অকৃত্রিম আন্তরিকতার সঙ্গে কাছে ডেকে নেন এবং নিজের পাশে বসতে বলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে মিষ্টির প্যাকেটটা ওনার হাতে দিয়ে প্রনাম করি। উনিও আশীর্বাদপূর্ণ দুটো হাত আমার মাথার উপর রেখে শুভ কামনা করে পিঠের উপর স্নেহের স্পর্শ ছড়িয়ে দিয়ে কুশল সংবাদ জানতে চান। 


যে মানুষটাকে চোখে না দেখেই মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম কাছে পেয়ে আমার সমস্ত বুদ্ধি লোপ পাওয়ার উপক্রম। কিভাবে যে প্রকাশ করব কিছুই বুঝতে পারি না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা মুখোমুখি বসে। তারই ফাঁকে পুজোর প্রসাদ, জলখাবার দিয়ে গেলেন বাড়ির এক ভদ্রমহিলা এসে। এর পর নানা বিষয় নিয়ে বাক্যালাপ চলতে থাকল দুপুর পর্যন্ত। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর আমরা দুজনে বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। একসময় সন্ধ্যের ঢল নেমে এল। অনেকক্ষণ কথার পর উনি আমাকে “তুমি” করে সম্বধন করতে শুরু করেন। তখনই আমি বুঝতে পারি এবার আমাকে উঠতে হবে। আমার কোন কথায় উনি আঘাত পেয়েছেন। যখনই উনি রেগে যান তখনই আমাকে “তুই” থেকে “তুমিতে” সরিয়ে দেন। আমি সজাগ হলাম। আমি উঠে দাঁড়াতেই উনি হাঁক দিলেন – “অনির্বান” ...। একটি ছেলে এসে সামনে হাজির হয়ে বলল – দাদামশাই, ডাকছিলেন? উনি ছেলেটিকে ইশারায় কাছে ডেকে আমাকে বললেন – সুপ্রিয়, তুমি তো ভালোই, কিন্তু এই ছেলেটি আমাদের হুগলী মহকুমার গর্ব। এবার উচ্চ মাধ্যমিকে এই অঞ্চলে প্রথম স্থান পেয়েছে। 


আমার কান দুটো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লজ্জায়। আমি একজন সুশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ; যা আমার কোন ব্যবহারে প্রকাশ পেয়েছে ওনার সামনে। সেই অহংকারকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য কোন কথা ছাড়াই শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীকে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। লজ্জায় আমার চোখদুটো পায়ের কাছে নেমে এল। এবারে ভদ্রলোক আমাকে দেখিয়ে ছেলেটিকে বললেন, ইনি তোমার মামা হন সম্পর্কে। ওনাকে ঠিক মতন ট্রেনে তুলে দিয়ে এস। 


এই কথার পড়ে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ানো নির্লজ্জের কাজ। আমি শ্রী যোগেশ নারায়ণ চৌধুরীকে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। 


রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই দেখি অনির্বান ছেলেটি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ষ্টেশন পৌঁছে দেবার জন্য। আমি কাছে যেতেই বলল, একটু দাঁড়ান আমি এক্ষুনি আসছি। মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এসে আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজে হাতে একটা উলের মাফলার আমার গলায় জড়িয়ে দিয়ে বলল – মামাবাবু, এটা না হলে আপনার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমার এবার লজ্জা থেকে বেড়িয়ে অবাক হবার পালা। 


এবারে বাইকে করে সোজা ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আমার টিকিট কেটে দিল আমার শত 'না' সত্বেও। প্রতি মুহূর্তে আমার অহংকারে ঘা লাগছে। আমি একটা বাচ্চা ছেলের কাছে আন্তরিকতায় হেরে যাচ্ছি।


আমার এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে একটা গ্রমের ছেলের কাছে। ট্রেন আসতে একটু দেরি আছে, ছেলেটিও দাঁড়িয়ে আছে আমাকে সঙ্গ দিতে এই ঠাণ্ডার মধ্যে। আমি যতই চলে যেতে বলি না কেন, কিছুতেই ও আমাকে ছেড়ে যাবে না। কারণ, আমার দাদু ওকে বলে দিয়েছেন, আমাকে সাবধানে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে। 


ছেলেটিকে যত দেখছি তত ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার কিসের অহংকার? আমার বাবা আমাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, সেভাবেই আমি তৈরি হয়েছি। তাহলে কি এই ভদ্রতা, আন্তরিকতা, দায়িত্ববোধ এসব কোন কিছুই তৈরি হয় নি আমার আধুনিক শিক্ষায়! প্রতি মুহূর্তে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে গ্রামের শিক্ষার কাছে আমার শহরের আধুনিক শিক্ষা। আমি হেরে যাচ্ছি ওর কাছে। 


আমার ট্রেন এসে গেছে, ওকে বললাম – আসি, এই ঠাণ্ডায় আর দেরি করো না বাড়ি ফিরতে। ছেলেটি হেসে উত্তর দিল – আপনি এই নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা গ্রামের ছেলে, ঠাণ্ডায় থাকার অভ্যেস আছে। মনে হল কথাটা যেন আমার গালে চর মারল।


ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমি ওকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। ও এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ... এবারে দৃষ্টির বাইরে। 


আমার ভালোবাসা, আন্তরিকতা এই অনুভূতিগুলো ভিজে ভিজে যাচ্ছে ক্রমশ। ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছে মনের আনাচে কানাচে। কোথায় গেল সেই “ আদুরে অহং ” !

0 comments: