প্রবন্ধ: অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
তামাক যুদ্ধ
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
সিগারেটের প্যাকেটের ওপর জ্বলজ্বল করে একটি সাবধানবাণী – Smoking Kills। সঙ্গে থাকে মানবদেহের অভ্যন্তরের একটি ছবি। ফুসফুসে লাল বৃত্তের মধ্যে লাল তির নির্দেশ করছে ক্যান্সারের আক্রমণ। বলাই বাহুল্য, সিগারেট কোম্পানিগুলি শুভবুদ্ধির দায়ে তাদের মুনাফার ধনটিকে এমন লালিমালিপ্ত করে বাজারে ছাড়ছে না। এটা তাদের বাধ্যতা। এই বাধ্যতা, সঙ্গে আরও অনেক নিয়ন্ত্রণ-বিধি বিনা যুদ্ধে তারা স্বীকার করেনি। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক সেই যুদ্ধের কাহিনিই বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বড় লড়াইটি জিতে দেশটি ক্রমশই দৈত্যরূপ ধারণ করতে চলেছে। দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যটি দিনে দিনে পুষ্টতর; অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবসা তো আছেই। তার ওপরে তামাকের ব্যবসা ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী। সিগারেট বিক্রি বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছুঁতে চলেছে। বিজ্ঞাপনে সিগারেট কোম্পানিগুলি শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করছে। তামাক উৎপাদক দক্ষিণী রাজ্যগুলি এবং সিগারেট কোম্পানিগুলি মিলে যে তামাক লবি – সেটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটি মূল স্তম্ভ। মার্কিন কংগ্রেসে তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি। আবার, আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর বার্ষিক অধিবেশনে ডাক্তারদের বিনামূল্যে সিগারেট বিতরণ করে তারা। চিকিৎসকেরা তামাক বুথে লাইন দিয়ে সেই সিগারেট সংগ্রহ করেন। মেডিক্যাল জার্নালগুলিতে নিয়মিত সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে। ফিলিপ মরিস মার্লবোরো ব্র্যান্ডের ফিল্টার্ড সিগারেট বাজারে ছাড়লেন ‘অনেস্ট টোব্যাকো’ ছাপ্পা মেরে। ওই ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিক্রি শতকরা ৫০০০ ভাগ বেড়ে গেল।
অন্য দিকে ক্যান্সার রোগটি সারা দেশে ক্রমবর্ধমান। সারা পৃথিবী জুড়ে এই রোগটির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, যুক্তরাষ্ট্র বহুলাংশে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি – সব ধরনের জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলি ক্যান্সার চিকিৎসার গবেষণায় কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। শল্য চিকিৎসা, রেডিয়াম থেরাপি, কেমোথেরাপি নিয়ে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন চিকিৎসাবিদরা এই যুদ্ধে। অধিক কার্যকরী চিকিৎসার জন্যে গবেষণা চলছে বিস্তৃত ক্ষেত্রে। কিন্তু রোগটিকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। রোগটির কারণ খুঁজে বের করতে চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন বিভাগ আলাদা আলাদা করে অন্বেষণ করছেন, কিন্তু সদুত্তর মিলছে না কোনমতেই। গত বেশ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা বিভাগের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু বিজ্ঞানী ফুসফুসের ক্যান্সারে ধূমপানের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করছিলেন। বিভিন্নভাবে তাঁদের অভিমত মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হতে দেখে সুসংগঠিত তামাক লবির অনুমান করতে অসুবিধে হয়নি যে তারা অদূর ভবিষ্যতে অঙ্কোলজিস্ট সহ সব ধরনের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলির আক্রমণের লক্ষ্য হতে যাচ্ছে। সিগারেটে ফিল্টার লাগিয়ে সেটিকে নিরাপদ আখ্যা দেওয়া সেই আক্রমণ ঠেকানোর প্রথম পদক্ষেপ।
তামাক লবির আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না বছরখানেকের মধ্যেই তার আঁচ পাওয়া গেল। ব্রিটেনে গত দু-দশকে ফুসফুসের ক্যান্সার পনের গুণ বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার তার কারণ অনুসন্ধানে বিখ্যাত জৈব পরিসংখ্যানবিদ অস্টিন ব্র্যাডফোর্ড হিল-এর ওপর গবেষণার দায়িত্ব দেন। হিল, রিচার্ড ডল নামে এক প্রতিভাবান চিকিৎসা-গবেষকের সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে আট বছর গবেষণা চালিয়ে তার ফল প্রকাশ করলেন ১৯৫৬ সালে। দেখা গেল, ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচ থেকে দশগুণ বেড়ে যায়। কেবল ফুসফুসই নয়, ধূমপানের ফলে ঠোঁট, গলা, জিভ এবং অন্ননালিতেও ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ে।
এদিকে আমেরিকাতেও আর্নস্ট ওয়াইন্ডার নামে এক তরুণ সার্জনের মনে ফুসফুসের ক্যান্সারে নিকোটিনের ভূমিকা নিয়ে সংশয় জাগে। এই নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে নিয়ে তিনি সার্জন জেনারেলের দ্বারস্থ হলেন। সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি যখন হতাশ তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন সেন্ট লুই হাসপাতালের দক্ষ শল্যবিদ ইভার্টস গ্রাহাম যিনি প্রতি সপ্তাহে ডজন ডজন ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগির অস্ত্রোপচার করেন এবং যাঁকে কদাচিৎ জ্বলন্ত সিগারেট ছাড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওয়াইন্ডারের গবেষণায় তাঁর আগ্রহের কারণ ছিল ক্যান্সারের সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্কটি প্রমাণ করা নয়, বরং সেটি অপ্রমাণ করা। কিন্তু অনুসন্ধানের গভীরে ঢুকে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস অন্তর্হিত হল। তিনি ধূমপান ত্যাগ করলেন এবং ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত তাঁর এক প্রবন্ধের উপসংহারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ধূমপানের বিরুদ্ধে অন্তত একটি সতর্কবাণী উচ্চারণের আবেদন রাখলেন। এখানেই শেষ হল না ব্যাপারটা। ১৯৫৬ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন গ্রাহাম। আবিষ্কৃত হল ফুসফুসে ক্যান্সার এবং দু-মাসও লাগল না তাঁর জীবনশিখাটুকু নিভে যেতে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই তিনি তাঁর এক বন্ধুকে চিঠি লিখে জানিয়ে গেলেন, তাঁর পঞ্চাশ বছরের ধূমপান মধ্যরাতের তস্করের মত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রাণ।
তামাক-ক্যান্সার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই দুই গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হলেও, এমনকি গ্রাহামের সাবধানবাণী ও মৃত্যু সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি জনস্বাস্থ্য দপ্তর, দেখা গেল, অবিচলিত। উল্টো দিকে তামাক লবি এই গবেষণার ফল প্রকাশের দু-বছর আগে থেকেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠল। তাদের দায় দুটো; এক, চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ‘অপপ্রচার’ নস্যাৎ করে উপভোক্তাদের অভয় দান; দুই, ভবিষ্যতে সম্ভাব্য তামাক-বিরোধী আইন প্রণয়ন ঠেকানো। ১৯৫৩ সালের ২৮শে ডিসেম্বর নিউইয়র্কের প্লাজা হোটেলে বিভিন্ন কোম্পানির মাথাগুলি এক হয়ে ‘খোলামেলা কথা(Frank Statement)’ শিরোনামের এক বিজ্ঞাপনের খসড়া তৈরি করলেন। ১৯৫৪ সালে সেটি সব ধরনের গণমাধ্যমে ঢাক-ঢোল সহযোগে প্রচারিত হল। প্রকৃত প্রস্তাবে খোলামেলা কথায় তথ্যগুলিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল আর তামাকের ক্যান্সার সংযোগ নিয়ে এক শ্রেণির বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে সংশয় ছিল তার ওপর ইচ্ছেমত রং চড়ানো হল। জনসাধারণের মনে সংশয় সৃষ্টি করার এই কৌশলটি এমন কিছু অভিনব নয়। কিন্তু তাদের শেষ চালটি হল সত্যিই মোক্ষম। তামাক-ক্যান্সার সংযোগ নিয়ে গবেষণাকে উপেক্ষা না করে এ ব্যাপারে তাঁরা আরও বিস্তৃত গবেষণা করার জন্যে বিজ্ঞানীদের সমস্ত রকম সাহায্য ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। অর্থাৎ কিনা, জনস্বার্থে আরও গবেষণা করার প্রয়োজন আছে, যেহেতু বিষয়টির নির্দিষ্ট কোন ফয়সালা হয়নি; সুতরাং গবেষণা চলতে থাকুক, জনসাধারণের তামাকু-সেবনও অবাধে চলুক। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা টোব্যাকো ইন্সটিটিউট রিসার্চ কমিটি(T I R C) নামে একটি সংস্থাও গঠন করে ফেললেন। বোঝা গেল এই সংস্থার কাজ হবে যুযুধান দুই পক্ষ (চিকিৎসা সংগঠন ও তামাক লবি) এবং বিভ্রান্ত জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন করা। খুঁজে পেতে তাঁরা এই কমিটির পরিচালক পদের জন্যে একজন উপযুক্ত লোকও জোগাড় করে ফেললেন। ইনি হলেন অ্যামেরিকান সোসাইটি ফর দ্য কন্ট্রোল অব ক্যান্সার (A S C C ) এর একদা প্রেসিডেন্ট ক্লারেন্স বুক লিটল, যিনি মনে করতেন ক্যান্সারের জন্যে সিগারেটকে দায়ী করা আর বৃষ্টি পড়ার জন্যে ছাতার ওপর দোষারোপ করা একই জিনিস।
এইভাবে যুদ্ধের উপক্রমণিকাটি তৈরি হয়ে রইল। আসল যুদ্ধ শুরু হতে কেটে গেল আরও সাতটা বছর। কারণ, প্রথম পক্ষটি (তামাক লবি) সংগঠিত ও শক্তিশালী হলে কি হবে, বিরোধী পক্ষটি বহুধা; এর মধ্যে যেমন আছে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদ অধ্যুষিত সরকারি ও বেসরকারি জনস্বাস্থ্য সংস্থা, তেমনি আছেন এককভাবে বহু আইনবিদ ও সাধারণ নাগরিকও। এদের মিত্রশক্তিতে পরিণত হওয়ার প্রয়াসের কোন সম্ভাবনাও ছিল না। কাজেই শক্তির বিচারে তামাকশিল্প দানব হলে অন্য পক্ষ নেহাতই কয়েকটি ছাগশিশু ও পিপীলিকা। মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দপ্তরগুলি আমাদের দেশের মতো সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতা জাহির করতে পারে না। অ্যামেরিকান গণতন্ত্রে কোন নাগরিকের বা কোন সংস্থার অধিকার খর্ব করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় সংস্থার নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা লড়েও দ্বিতীয় পক্ষ লড়াইটা জমিয়ে দিল।
হিল-ডল রিপোর্ট, গ্রাহামের সাবধানবাণী ও তাঁর মৃত্যু আমেরিকার স্বাস্থ্য-সচেতন জনমানসে বড় আকারে না হলেও ছোট ছোট আলোড়ন তুলেছিল। বিচ্ছিন্ন সেই সব আলোড়নের অভিঘাত পাঁচ বছর ধরে সরকারকে ধাক্কা মারার পর অবশেষে সরকার একটুখানি নড়েচড়ে বসল। ১৮৬১ সালে অ্যামেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এবং ন্যাশানাল টিউবারকুলোসিস অ্যাসোসিয়েশন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কেনেডির কাছে একটি যৌথ স্মারকলিপি পেশ করল। তাতে ধূমপানের সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করার জন্যে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করার আবেদন জানানো হল। বলা হল, কমিশনের উদ্দেশ্য হবে তামাকশিল্পের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির তামাকুসেবনের সুখ যতটা সম্ভব কম খর্ব করে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান করা; অর্থাৎ, এমন একটা কিছু করা যাতে সাপও মরে অথচ লাঠিটিও না ভাঙ্গে। সুতরাং কেনেডিও তড়িঘড়ি করে সেই সোনার পাথরবাটিটি তৈরি করার দায়িত্ব সার্জন জেনারেল লুথার টেরির ওপর চাপিয়ে দিলেন। উপযুক্ত লোক সন্দেহ নেই। আলাবামার বাসিন্দা টেরির ছোটবেলা কেটেছে তামাকখেতে তামাকপাতা তুলতে তুলতে, আবার ডাক্তারি পাশ করার পর কর্মজীবনের বেশিটাই কেটেছে বিখ্যাত সব ক্যান্সার চিকিৎসকের সান্নিধ্যে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেখতে দেখতে। তো, টেরির সামনে ছিল তিনটি বিকল্প। এক, বিষয়টিকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া; সম্ভাব্য ফলঃ দেশের তিনটি প্রধান চিকিৎসা-সংস্থাকে চটিয়ে দেওয়া। দুই, তামাকজাত দ্রব্য স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক – এই ঘোষণা সম্বলিত একটি বিবৃতি একতরফাভাবে তাঁর অফিস থেকে প্রকাশ করা; সম্ভাব্য ফলঃ তামাক লবি-ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিগুলির একজোট হয়ে সেই বিবৃতিকে নস্যাৎ করা। তিন, ফলের কথা না ভেবে বিজ্ঞানের তুলাদণ্ডে তামাকের সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্কটি মেপে জনসাধারণের চোখে তা তুলে ধরা।
প্রথমটায় দ্বিধাগ্রস্ত হলেও টেরি ক্রমশ দৃঢ় পদক্ষেপে তৃতীয় পথে এগোলেন। তিনি দশ সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করলেন যাঁরা ধূমপানের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারের যোগসূত্রের সাক্ষ্যগুলি পরীক্ষা করবেন।
তের মাস ধরে নয় দফায় সারা দেশ জুড়ে সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন দশজন বিশেষজ্ঞ সদস্য আলাদা আলাদা করে। এমন বিশদ এবং অভিনব নিরীক্ষা ক্যান্সার epidemiology (রোগবিস্তার সম্পর্কিত বিদ্যা)’র ইতিহাসে বিরলতম। ধূমপানের রিস্ক ফ্যাক্টর নির্ণয় করতে এই পরীক্ষাগুলিতে এক অভিনব গাণিতিক প্রজ্ঞা (insight) প্রযুক্ত হয়েছিল। বিশদ ব্যাখ্যা সহ কমিটির সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত অবশেষে জমা পড়ল সার্জন জেনারেল লুথার টেরির কাছে। তিনি ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতল সকালে সাংবাদিক পরিপূর্ণ স্টেট অডিটোরিয়ামের রুদ্ধদ্বার কক্ষে ৩৮৭ পৃষ্ঠার ‘বম্বশেল’ টি ফাটালেন। শেলটির নির্যাস এই যে ‘কারণ’ শব্দটি যদি সংঘটক ও সংশ্লিষ্ট অসুখের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর সম্পর্ক বোঝায়, তাহলে ধূমপান অবশ্যই ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি বা একটি প্রধান কারণ। এই একটি বাক্যই তিন দশকব্যাপী সন্দেহ ও বিতর্কের অবসান ঘটাল।
ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো একটি প্রধান ক্যান্সারের প্রধানতম কারণ ধূমপান, যা কিনা সহজেই বন্ধ করা সম্ভব – এমন একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য আমেরিকার মতো কর্কটাতঙ্কে ভোগা দেশে যে রকম আলোড়ন তুলবে বলে ভাবা গিয়েছিল সেরকমটা কিন্তু ঘটল না। পরের দিন সমস্ত ধরনের মিডিয়ায় এটি লিড নিউজ হল ঠিকই কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এমন কিছু প্রতিক্রিয়ার প্রাবল্য দেখা গেল না যার ফলে দেশের তামাক বিরোধী শক্তিগুলি তাদের অস্ত্রে শাণ দিয়ে মাঠে নামতে পারে।(এখানে একটি কৌতুককর তথ্য উল্লেখ করার লোভ সামলানো গেল না -- কমিটির দশজন সদস্যের মধ্যে ঠিক অর্ধেক, অর্থাৎ পাঁচজন ছিলেন ধূমপায়ী; এই সিদ্ধান্তে আসার পর তাঁরা ধূমপান ত্যাগ করেছিলেন বলে শোনা যায়নি।) তবে কি, কমিটির এই সিদ্ধান্ত তামাক বিরোধীদের হাতে একটি বড় অস্ত্র ধরিয়ে দিল। কিন্তু তামাকশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে সরকার? ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা আছে বটে কিন্তু সিগারেটকে অল্পের জন্যে ড্রাগের সংজ্ঞায় ফেলা যাচ্ছে না। সুতরাং সিগারেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে পড়ে রইল একটি মাত্র তালপাতার সেপাই – দ্য ফেডারেল ট্রেড কমিশন বা এফ টি সি।
এই সংস্থাটির জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জন্যে। বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য বা অবাস্তব দাবি যাতে কোন উৎপাদক সংস্থা না করে সেটা দেখাই ছিল এর কাজ। কিন্তু ক্রমশ গুরুত্ব হারাতে হারাতে সংস্থাটির তখন মুমূর্ষু অবস্থা। কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে, কর্মচারী অপ্রতুল। বিজ্ঞাপনে কোন্ শব্দের পরিবর্তে কোন্ শব্দটি সুপ্রযুক্ত হবে সেটা স্থির করার মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ। এই অবস্থায় সার্জন জেনারেল টেরির রিপোর্টটি এফ টি সি-র পক্ষে টনিকের কাজ করল। সংস্থাটিতে তাজা রক্তের সঞ্চার করতে শৃঙ্খলাপরায়ণ তরুণ আইনবিদদের নিয়োগ করা হল। তাঁরা তৎক্ষণাৎ তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণে নেমে পড়লেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ঘোষণা করলেন, যেহেতু সার্জন জেনারেলের রিপোর্ট অনুযায়ী ধুমপানে ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে, অতএব উৎপাদকদের বিজ্ঞাপনে এই ঝুঁকির কথা স্বীকার করে উপভোক্তাদের সাবধান করতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে সিগারেটের প্রতিটি প্যাকেটে এই সাবধানবাণীটি ছেপে দেওয়া – সতর্কবার্তাঃ ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। এটি ক্যান্সার এবং অন্যান্য অসুখে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। [ Caution: Cigarette Smoking is Dangerous to Health. It may Cause Death from Cancer and Other Diseases.] সিগারেটের প্রতিটি বিজ্ঞাপনের সঙ্গেও এই সতর্কবার্তাটি রাখতে হবে।
সর্বনাশ! তালপাতার সেপাইটির দাঁতে এত বিষ কে জানত! তামাক লবি নড়েচড়ে বসল। এফ টি সি জগন্নাথের রথের চাকা যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে। প্রেসিডেন্ট জনসনের বন্ধু ও আইনি উপদেষ্টা অ্যাবে ফোর্টাস (অল্পদিন পরেই ইনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হবেন) এবং টি আর সি সি-র ডিরেক্টর ও কেনটাকির প্রাক্তন গভর্নর আর্ল ক্লিমেন্টস-এর শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। এই দুজনের পরামর্শে তামাককর্তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখলেন, এফ টি সি-র বদলে বরং কংগ্রেসই আইন প্রণয়ন করে তামাকশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করুক। মরতেই যদি হয় রামের হাতেই মরব, রাবণের হাতে কদাচ নয়।
জুয়ার দান মনে হলেও আসলে খুব হিসেব করেই চালটি দেওয়া হল। প্রথমত, কংগ্রেস চিরকালই তামাক উৎপাদকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। দক্ষিণী রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটিই হল তামাক। তামাক লবি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক নেতাদের উৎকোচ প্রদান এবং তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে অর্থ সাহায্য করে আসছেন। সুতরাং তামাকশিল্পের পক্ষে চরম ক্ষতিকর কোন ব্যবস্থা তাঁরা নেবেন এমন সম্ভাবনা অকল্পনীয়। দ্বিতীয়ত, এফ টি সি-র এই একতরফাভাবে নেওয়া কঠোর সিদ্ধান্ত রাজনীতির কারবারিদের যারপরনাই বিরক্তি উৎপাদন করেছিল। ফলে হিসেব বলছিল এই সুযোগে কংগ্রেস যা করবে তা এফ টি সি-র দাওয়াই-এর থেকে নরম হতে বাধ্য।
হলও তাই। তামাক শিল্প নিয়ন্ত্রণে কংগ্রেস যে আইনটি প্রসব করল তার নাম হল ফেডারেল সিগারেট লেবেলিং অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইজিং অ্যাক্ট (F C L A A of 1965) । এই আইনে গঠিত কমিটি-সাব কমিটির শুনানির পর এফ টি সি প্রস্তাবিত সতর্কবার্তাটিকে তরলস্য তরলম করে যে রূপটি দেওয়া হল সেটি এই রকমঃ- সতর্কবার্তাঃ ধূমপান আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে (Cigarette smoking may be hazardous to your health)। অর্থাৎ এফ টি সি প্রস্তাবিত সতর্কবার্তা থেকে ভয়াবহ তিনটি শব্দ – ‘ক্যান্সার’, ‘কারণ’, এবং ‘মৃত্যু’ – বাদ দিয়ে দেওয়া হল। অস্যার্থ, রাজনীতিবিদগণ জনস্বাস্থ্যের বৃহৎ স্বার্থ অপেক্ষা তামাক লবির সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষা করতেই অধিকতর আগ্রহী। বোঝা গেল সিগারেট উৎপাদকদের সর্বোত্তম ফিল্টার কংগ্রেস – সিগারেটে অন্য কিছু ফিল্টার লাগানো বাহুল্য মাত্র! এইভাবে এফ টি সি-র সৈনাপত্যে প্রথম যুদ্ধটিতে তামাক-বিরোধী শক্তির মোটামুটি পরাজয়ই হল বলা চলে। ‘মোটামুটি’ বললাম এই কারণে যে এই যুদ্ধের ফলে তামাক শিল্পের পায়ে একটি আইনি নিয়ন্ত্রণের বেড়ি অন্তত পরানো সম্ভব হল।
এর বছর দুয়েকের মধ্যেই সদ্য আইন পাশ করা এক তরুণ এটর্নি তামাক-বিরোধীদের সেনাপতির ব্যাটনটি নিজের হাতে তুলে নিলেন। হঠাৎ-ই একদিন জন ব্যানজাফের নজর পড়ল প্রায় অপ্রচারিত একটি আইনি ধারার ওপর । ১৯৪৯ সালে প্রণীত ‘বৈষম্যহীনতার নীতি’ (Fairness Doctrine) নামের এই ধারাটির মোদ্দা কথা হল এই যে বায়ুতরঙ্গ যেহেতু জনসাধারণের সম্পত্তি অতএব এর মাধ্যমে কোন বিতর্কমূলক বিষয় সম্প্রচারিত হলে তার বিরুদ্ধ মত সম্প্রচারেও সমপরিমান সময় ওই মাধ্যমকে দিতে হবে। এই ধারাটি পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া আছে ‘ফেডারেল কম্যুনিকেসন কমিশন’ বা এফ সি সি নামক এক সংস্থার ওপর । ১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে ব্যানজাফ এফ সি সি-র কাছে নিউ ইয়র্কের একটি দূরদর্শন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র পাঠিয়ে দিলেন। অভিযোগ এই যে ওই কেন্দ্রটি তামাক বিরোধী কোন বিজ্ঞাপন না দেখিয়ে কেবলই তামাকের বিজ্ঞাপন প্রচার করে চলেছে। এমন অসাধারণ অভিযোগটিতে যে কাজের কাজ কিছু হবে তা ব্যানজাফ নিজেও ভাবতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কপাল ভালো। কারণ সে সময় এফ সি সি-র কাউন্সেল জেনারেল হেনরি গেলার নিজেও তামাক বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। তিনি অবিলম্বে ব্যানজাফকে লিখিতভাবে জানালেন, ধূমপান অবশ্যই বিতর্কের বিষয়। সুতরাং দূরদর্শন কেন্দ্রটির অবশ্য- পালনীয় কর্তব্য -- ধূমপান যে কতখানি উপভোগ্য সেটা বিজ্ঞাপিত করার পাশাপাশি ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের কতখানি ক্ষতি হতে পারে সেটাও সম্প্রচার করা। উৎসাহিত ব্যানজাফ গেলারের অনুমতি নিয়ে কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন আদালতে। প্রত্যাশিতভাবেই তামাক কোম্পানিগুলি তারস্বরে প্রতিবাদ জানাল; বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা তো বাক্-স্বাধীনতার ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত! সুতরাং তারা এই আইনি লড়াইএর শেষ দেখে ছাড়বে। দীর্ঘায়িত আদালত-যুদ্ধের আশঙ্কায় ব্যানজাফ অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি, অ্যামেরিকান লাঙ অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু কেউই সাহায্যের হাত বাড়াল না তাঁর দিকে। মরিয়া ব্যানজাফ একলাই লড়ে গেলেন তামাক লবির তাবড় তাবড় আইন-বিশারদদের বিরুদ্ধে। ১৯৬৮ সালে আদালত যখন মামলার রায় ঘোষণা করল, তামাক কোম্পানিগুলি বিস্ময়াহত! তাদের অত্যুচ্চ পারিশ্রমিকওয়ালা বাঘা বাঘা সব আইনজীবীরা কিনা ওই না-সাবালক উকিলটার কাছে কুপোকাৎ! আদালত রায় দিল, -- তামাক ও তামাকবিরোধী বিজ্ঞাপনের জন্যে ‘সমানুপাতে সম্প্রচার সময়’ দিতে হবে।
ব্যস্, মাঠে নেমে পড়লেন গেলার এবং তাঁর এফ সি সি। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শোনা গেল কমিশনের দৃপ্ত ঘোষণা – এখন থেকে ‘সমানুপাতিক বিজ্ঞাপনের সময়’-এর ওপর তারা নিয়মিত নজরদারি করবে। শুধু তাই নয়, জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে দূরদর্শনে সিগারেটের বিজ্ঞাপন একেবারে বন্ধ করে দেওয়াটাই হবে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
তামাক কোম্পানিগুলি আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পর আপিল করল কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কোন আপিলই গ্রহণ করল না। ফলে বানজাফ-রায়ই চূড়ান্ত হয়ে থাকল। তাই কোম্পানিগুলির বিজ্ঞাপনে এবার নতুন কৌশল লক্ষ্য করা যেতে লাগল; তারা সিগারেটের ক্ষতিকারক প্রভাবটির ওপর ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে বিজ্ঞাপন বানাতে লাগল। পাল্টা দাওয়াই বের করতে তামাক-বিরোধীদের সময় লাগল না। তারা একের পর এক বিজ্ঞাপনে তামাক কোম্পানির ‘সংশয়’-কে ‘ভয়’ দিয়ে ঢেকে দিতে শুরু করল। প্রবীণ অভিনেতা উইলিয়াম টলম্যান এমনই এক বিজ্ঞাপনে বললেন, ধূমপানের ফলে তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে মরতে বসেছেন। ধূমপানের এইসব নেতিবাচক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তামাক লবি অবশেষে তাদের সমস্ত বিজ্ঞাপন দূরদর্শন থেকে তুলে নিতে বাধ্য হল। কারণ সহজবোধ্য; সিগারেটের বিজ্ঞাপন না থাকলে ভয়-দেখানো এই সব ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর বিজ্ঞাপনগুলিও আর থাকে না। ১৯৭১ সালের ১লা জানুয়ারি তামাক কোম্পানির শেষ বিজ্ঞাপনটি দূরদর্শনে প্রচারিত হয়েছিল। এভাবেই এক সময়ের অমিততেজা তামাকদানবটিকে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে হল। ফল হল এই যে যুক্তরাষ্ট্রে ছ’টি দশক ধরে ক্রমশ বাড়তে থাকা সিগারেট বিক্রির পরিমাণ সাতের দশকে এসে মাথাপিছু বার্ষিক চার হাজারে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
যুদ্ধ কিন্তু শেষ হল না। তামাক লবি রণাঙ্গন ছাড়লে কি হবে, তামাকবিরোধীরা তাদের পিছু ছাড়ল না। এতদিন তারা লড়াই চালাচ্ছিল নিরাবয়ব সব ‘তামাক-বলি’দের হয়ে। বিমূর্ত শিকার এবার মূর্তি ধারণ করে তামাকদানবকে তাড়া করল। বিমূর্ত ভিক্টিমদের প্রথম মূর্ত প্রতিনিধি রোজ সিপোলোন। ১৯৪২ সালে বয়ঃসন্ধির রোজ প্রথম স্বাদ নেয় সিগারেটের । ওই সময়টিকে তামাক শিল্পের ‘মোহিনী’ যুগ বলা যেতে পারে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সালে এসে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। পুরো কৃতিত্বটাই ছিল বিজ্ঞাপনের। অ্যামেরিকান সমাজে মেয়েরা তখন চূড়ান্ত চাপের মধ্যে; আত্মপরিচয়, শিশুপালন, গৃহস্থালি ও কর্মক্ষেত্র – এই চার পরস্পর বিরোধী ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে। বিজ্ঞাপন বলতে লাগল এই চাপের মুখে স্নায়ু শীতল রাখার চমৎকার দাওয়াই হচ্ছে সিগারেটে টান। আরও বহু মহিলার মতো রোজও তা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিল। আর্থিক মন্দা-র কবলে পড়ে একদিন রোজকে পড়াশুনায় ইতি টেনে কাজে নামতে হল। এক স্কার্ফ ফ্যাক্টরিতে প্রথমে প্যাকার, পরে বিলিং ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতে করতে তার ধূমপানের নেশা বেড়েই চলল। অ্যান্টনি সিপোলোনের সঙ্গে বিয়ের পর রোজের মনে একটা টানাপড়েন শুরু হল। অ্যান্টনি তামাক বিরোধী; সে প্রতিদিন ধূমপানের ক্ষতিকারক দিকগুলি বিভিন্নভাবে রোজের সামনে তুলে ধরতে লাগল। রোজ চেষ্টা শুরু করল অভ্যাসটি ছাড়ার, কিন্তু ছাড়ার কয়েকদিন পরেই আবার ধরে এবং তখন তার ধূমপানের ওপর নির্ভরতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে; বাড়িতে সিগারেট ফুরিয়ে গেলে অ্যাসট্রে ঘেঁটে পোড়া সিগারেটের টুকরো খুঁজতে থাকে। পরের ধাপে সে ধূমপান ছাড়ার ভাবনা ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ ফিল্টারের সন্ধানে একের পর এক ব্র্যান্ড পরিবর্তন করতে থাকে।
১৯৮১ সালের শীতকালে ঠাণ্ডা লাগার চিকিৎসা করতে গিয়ে এক্সরেতে টিউমার ধরা পড়ল রোজের ডান ফুসফুসে। বায়োপ্সি রিপোর্ট পজিটিভ। দু-বছরের মধ্যে ক্যান্সার ফুসফুস থেকে লিভার ও হাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। কেমোথেরাপিতে কোন সাড়া মিলল না। ক্যান্সার- কোষে ছেয়ে গেল মজ্জা, মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়া। মরফিনে আচ্ছন্ন শয্যাশায়ী রোজ সিপোলোন ১৯৮৪ সালের ২১ শে অক্টোবর সকালে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল।
নিউ জার্সির এক এটর্নি, মার্ক এডেল, রোজের মৃত্যুর এগারো মাস আগে জানতে পারেন তার কর্কটাক্রান্ত হওয়ার কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি এডেলের গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল ক্ষতিপূরণের মামলায়। তামাকের বিরুদ্ধে আইনি আক্রমণ চালানোর জন্যে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি এমনই এক ব্যক্তির খোঁজে ছিলেন যে হতে পারে ধূমপানের বলির মূর্ত প্রতিমা। রোজ সিপোলোন খাপ খেয়ে গেল তাঁর পরিকল্পনায়। সিপোলোনদের রাজি করিয়ে ১৯৮৩ সালে এডেল ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করলেন তিনটি প্রধান তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে, প্রধানত যাদের ব্র্যান্ডের সিগারেটে অভ্যস্ত ছিল রোজ। তার আগে, বিগত তিন দশকে তামাক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা কম হয়নি। সেসব মামলার বিচার ও নিস্পত্তি হয়েছিল একটা বাঁধা গতে। বাদিদের বক্তব্য ছিল, ধুমপানে যে বিপদের ঝুঁকি আছে সেটা তারা ব্যক্তিগতভাবে জানত না; উলটো দিকে কোম্পানির যুক্তি, বাদিরা যদি বধির ও অন্ধ না হয় তাহলে তাদের এই যুক্তি ধোপে টেঁকে না। প্রত্যেকটি মামলার রায়ই যায় কোম্পানিদের পক্ষে। জুরিদের মতে সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ছাপা সতর্কবার্তা ধূমপায়ীদের সাবধান করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট; অর্থাৎ, তারা জেনে শুনে বিষ পান করেছে – কাজেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
রোজ সিপোলোনের মামলাটিকে কিন্তু সম্পূর্ণ উলটো কক্ষপথে বসিয়ে দিলেন ধুরন্ধর এডেল। তিনি বললেন, তাঁর মক্কেল ধূমপানের বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। শুধু তাই নয়, তার স্বামী তাকে বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও সে ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। কিন্তু একমাত্র সেটাই আদালতের বিবেচ্য হবে কেন, ধূমপান জনস্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ – সে ব্যাপারে সিগারেট-উৎপাদক কোম্পানিগুলো কতটা কী জানে সেটাও আদালতের জানা উচিৎ। অর্থাৎ, একজন না হয় জেনেশুনে বিষ পান করেছে; অন্যজন জেনেশুনে বিষ দিয়েছে কিনা সেটাও আদালতের বিবেচ্য হওয়া উচিৎ। এডেলের এই অভিনব যুক্তি আদালতকে বাধ্য করল কোম্পানিগুলির অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও তার ফলাফলের রিপোর্ট-সম্বলিত ফাইলগুলিতে এডেলের প্রবেশাধিকার মঞ্জুর করতে। যেন খুলে দেওয়া হল প্যান্ডোরার বাক্স। এডেল কোম্পানির গর্ত থেকে টেনে বের করতে লাগলেন একের পর এক বিষধর সাপ। দেখা গেল, তামাক থেকে ক্যান্সারের সম্ভাবনা এবং নিকোটিনের নেশাগ্রস্ত করে তোলার ক্ষমতা তাদের গবেষণার ফলাফলে স্পষ্ট তো বটেই, উপরন্তু সেই ফলাফল লুকিয়ে রাখতে কোম্পানির অন্দরমহলে এমনভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় যে কিছু বিবেকবান কর্মচারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। জানা গেল কোম্পানির নীতিহীন ত্রিমুখী বিপণন-নীতি – (১) তামাক যে স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক তা সরাসরি অস্বীকার না করে সে ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি করা, (২) ধূমপানের অভ্যাসে উৎসাহ না দিয়েও জনগণের ধূমপান করার অধিকারের স্বপক্ষে প্রচার করা এবং (৩) তামাক স্বাস্থ্যের পক্ষে যথার্থ ক্ষতিকর কিনা তা স্থির করার লক্ষ্যে নৈর্ব্যক্তিক গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া। আরও জানা গেল, মানবশরীরে তামাক-নির্গত নিকোটিনের প্রভাব কতটা শক্তিশালী ও বিচিত্রগামী তা কোম্পানিগুলির থেকে ভালো আর কেউই জানে না। রোজের পক্ষে ধূমপান ত্যাগ করাটা যে কঠিন ছিল তার কারণ এই নয় যে তার ইচ্ছাশক্তি দুর্বল ছিল; আসলে নিকোটিন তার ইচ্ছাটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাইরের লোক না জানলেও কোম্পানিগুলি বুঝে গিয়েছিল নিকোটিনের এই ধর্মই তাদের ব্যবসাটিকে চিরজীবী করবে।
কোম্পানির এই ভ্রষ্টাচারকে শাণিত বিদ্রূপে কীভাবে আদালতে উন্মুক্ত করেছিলেন এডেল, তার একটুখানি নমুনা তুলে ধরা যাক –
এডেলঃ আপনাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্যটা ঠিক কী ছিল? কোম্পানি কর্তাঃ ইঁদুরের পিঠের টিউমার কমানোর চেষ্টা... এডেলঃ তাহলে মানুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক কিনা? কোম্পানি কর্তাঃ তা ঠিক... এডেলঃ তাহলে এটার উদ্দেশ্য ধেড়ে ইঁদুরদের রক্ষা করা। ঠিক? না কি নেংটিদের? আপনারা পাঁচ মিলিয়ন ডলার খরচ করলেন কেবলমাত্র নেংটিদের টিউমারের সমস্যার সমাধান করতে!
তামাক কর্তাদের ভণ্ডামির গভীরতা যে অতলস্পর্শী - এডেলের দিনের পর দিন জেরায় তা প্রতিপন্ন হতে দেখে কোম্পানি-নিযুক্ত আইনজীবীরাও আতঙ্কে শিউরে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি তামাক কোম্পানির গোপন ফাইলে অন্যের প্রবেশাধিকারের আদেশই এই মামলার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে প্রতিপন্ন হল। কেননা দীর্ঘ চার বছর আইনি যুদ্ধের পরে ১৯৮৭ সালে যখন মামলার রায় বেরোল, তখন ঠিক বোঝা গেল না জয়টা কার হল। সিপোলোন পরিবার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই পেলেন। কিন্তু তার পরিমাণ এই চার বছর মামলা চালানোর ব্যয়ের কাছে নস্যিতুল্য। তাদের রায়ে জুরিরা রোজের ক্যান্সারের জন্যে তাকেই শতকরা আশি ভাগ দায়ী করলেন। বাকি কুড়ি ভাগ দায়ী হল একটিমাত্র কোম্পানি যাদের ব্র্যান্ডের সিগারেট ১৯৬৬ সালের আগে পর্যন্ত রোজ ব্যবহার করত। অর্থাৎ, সিগারেটের প্যাকেটে যেদিন থেকে সাবধানবাণী দাগানো হল সেদিন থেকে কোম্পানির আর কোন দায় নেই। ফলে বাকি দুটি কোম্পানি বেবাক ছাড় পেয়ে গেল। মামলা চলাকালীন কোম্পানিকত্তাদের বেজায় হেনস্থা হচ্ছিল। তাঁরা জিততে পারবেন না বুঝেই গিয়েছিলেন। জিতলেনও না; কিন্তু অপর পক্ষের নাক-কাটা জয়টি দেখে বিলক্ষণ উৎফুল্ল হলেন। তবে শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয়কে তুচ্ছ করে এই লড়াই আলোকিত করল অন্য একটি বিষয়কে। ধূমপান-বিড়ম্বিত, দুর্বলচিত্ত রোজ সিপোলোন তার কবরে শুয়ে থেকেও হয়ে উঠল তামাকের বলি অসংখ্য নেশাগ্রস্ত দুর্বল মানুষের মূর্ত প্রতিমা।
এরপর ঢেউএর মতো আদালতে আছড়ে পড়তে লাগল একের পর এক ক্ষতিপূরণের মামলা। মিসিসিপি রাজ্য বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে তামাক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল। তার পিছনে পিছনে এল ফ্লোরিডা, টেক্সাস এবং মিনোসাটা। তাদের বক্তব্য – তোমরাই স্বাস্থ্যহানির কারণ; তার মূল্য তোমাদেরই চুকাতে হবে। কোম্পানিগুলি সিগারেট প্যাকেটের সতর্কবার্তাটি পতাকার মতো দোলাতে দোলাতে মামলা লড়তে লাগল ঠিকই, কিন্তু জনমানসে হেয় প্রতিপন্ন হতে হতে হতোদ্যম হয়ে এবং বিরূপ প্রচারের হাত থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত তারা রণে ভঙ্গ দিল। এক অভিনব পদক্ষেপে চারটি সর্ববৃহৎ সিগারেট উৎপাদক সংস্থা ‘মাস্টার সেট্লমেন্ট এগ্রিমেন্ট’ বা এম এস এ নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সামিল হল। এই চুক্তির দলিলে ধূমপানের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছিল - সবই স্বীকার করে নেওয়া হল। ধূমপান যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এবং তার দায় যে উৎপাদক সংস্থাগুলির ওপর বর্তায় – সেটাও মেনে নেওয়া হল। তামাকের বিজ্ঞাপনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এই চুক্তিতেই বলবৎ করা হল। অভ্যন্তরীণ গবেষণার ফলাফলে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হল। এখানেই শেষ নয়; চুক্তিতে তামাকের অপকারিতা সম্বন্ধে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে একটি জাতীয় মঞ্চ তৈরি করার প্রস্তাব রাখা হল। ১৯৯৮ সালের এই চুক্তিতে পরবর্তীকালে বিশ্বের আরও সাতচল্লিশটি কোম্পানি সামিল হয়।
এই ঐতিহাসিক চুক্তিটিতে রোজ সিপোলোনের জয় সম্পূর্ণ হল, নাকি আমেরিকার বাজারে ম্রিয়মাণ হয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিশাল বাজারে দীপ্যমান হয়ে ওঠার সূচনা করল তামাক কোম্পানিগুলি, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমেরিকার মাটিতে তামাক যুদ্ধের সূচনার সময় সে দেশে বছরে সিগারেট বিক্রি হত জনপ্রতি ৪১৪১ টি। যুদ্ধের শেষে তা নেমে দাঁড়ায় ২৫০০ টি-তে। তার বিলম্বিত ফল এই যে রোজ-মামলা শুরুর বছরে আমেরিকায় এক লক্ষ পুরুষে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০২। ২০০২ সালে সেই সংখ্যা হল ৭৭। রোজের প্রজন্মের মহিলারা বোধ হয় এখনও তেমনভাবে ধূমপান পরিত্যাগ করতে পারেননি। কেননা, পরিসংখ্যান অনুযায়ী মহিলাদের মধ্যে লাংস ক্যান্সারাক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি।
তামাক যুদ্ধের কাহিনি এখানেই শেষ। কাহিনিটি ধার করলাম সিদ্ধার্থ মুখার্জির পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্ত গ্রন্থ ‘দ্য এম্পারার অব অল ম্যালাডিজ’ নামক ক্যান্সার-মহাভারত থেকে। ধার বললাম এই কারণে যে এটি আক্ষরিক অনুবাদ একেবারেই নয়, ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে; কিছু ক্ষেত্রে তথ্য অবিকৃত রেখেও কিছুটা বেশি স্বাধীনতা আমি নিয়েছি। পরিশেষে সামান্য একটু মৌলিক সংযোজন করি। এই লেখাটি পড়ে একজনও ধূমপায়ী-পাঠক যদি ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করেন, তাহলে অনেকগুলি সিগারেটের ধোঁয়ার বিনিময়ে তৈরি এই লেখাটির প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হতে পারে। সব কিছু জেনেও যে আমি এই ক্ষতিকারক অভ্যাসটিকে সযতনে পুষে রেখেছি তার কারণ এই যে বিশ্বের তাবৎ ছিট্গ্রস্ত মানুষের মতো আমারও এ ব্যাপারে একটি মৌলিক ধারণা আছে। এটা সত্য যে প্রত্যেকটি মানুষের ক্রোমোজোমের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ক্যান্সারের বীজ(অঙ্কোজিন)। কার ক্ষেত্রে সেটি অঙ্কুরিত হবে আর কার ক্ষেত্রে হবে না সেটি কিন্তু এখনও অজানা। যেটুকু জানা তা হল বিশেষ বিশেষ পদার্থ(কার্সিনোজেন) বিশেষ বিশেষ ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। সেই পদার্থগুলি এমনই এক সংকেতবাহী যে-সংকেতে মুহূর্তেই অঙ্কোজিন সক্রিয় হয়ে উঠে কোষ বিভাজন শুরু করে দেয়। লাংস ক্যান্সারের ক্ষেত্রে নিকোটিন হল কার্সিনোজেন। তবুও সব ধূমপায়ীর যে ক্যান্সার হয় না তার কারণ তাদের পূর্বপুরুষ আগাম অনুমানে ক্যান্সারসম্ভব জিনটিকে অসংবেদি করে রাখেন। আমার পূর্বপুরুষও তাই করে রেখেছেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এমন বিশ্বাস আরও বহু কল্পবিলাসীর আছে বলেই না তামাক বিক্রেতাদের ব্যবসাটি এখনও রমরম করে চলছে!
0 comments: