0

প্রবন্ধ: অরুণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



দুর্গাপুজোঃ 
ধর্ম, উৎসব, সমাজ-সংস্কৃতি নাকি শুধুই ব্যবসা আর বিনোদন ?
অরুণ চট্টোপাধ্যায়




পিতৃসত্য রক্ষা করতে ১৪ বছরের জন্যে বনবাসে এলেন অযোধ্যার যুবরাজ দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্র। সঙ্গে এলেন সাধ্বী স্ত্রী জানকী সীতা আর ভ্রাতৃভক্ত ভাই লক্ষ্মণ। সীতা যে সঙ্গে আসবেন এমনটা কিছু অন্যায় বা অবাস্তব নয় । কারণ তিনি যে রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গিনী ও ধর্মসঙ্গিনী । আর সে যুগে সাতপাকের বন্ধন যে কত দৃঢ় ছিল তা বিভিন্ন শাস্ত্র বা লোকাচারের গল্প থেকেই আমরা জানতে পারি ।কিন্তু লক্ষ্মণের তুলনাহীন ভ্রাতৃভক্তি তাকে টেনে এনেছিল এই বিপদ-সংকুল জঙ্গলে । এখানে লংকার (বর্তমান শ্রীলংকা) রাজা রাবণ রামপত্নী সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করে নিয়ে গেল মায়াবী রাক্ষস মারীচের সহযোগিতায় । প্রাণপ্রীয়া সীতাকে উদ্ধারের ব্রত নিয়ে মা দুর্গার তপস্যা করেন রামচন্দ্র । তখন ছিল শরৎকাল । ভক্তের ভক্তি-বৎসলতার আর পত্নী-প্রেমের পরীক্ষা নিতে চাইলেন দেবী । দুর্গা বললেন ১০৮টা নীলপদ্ম দিলে তবেই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে সীতা-উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন । অতিকষ্টে নানা জায়গা থেকে সেগুলি জোগাড় করলেন রামচন্দ্র । এদিকে দেবীর ইঙ্গিতে দেবরাজ ইন্দ্র ছল করে একটি পদ্ম করলেন চুরি । অবশিষ্ট রইল মাত্র একশ সাতটি পদ্ম যা দিয়ে দেবীর আরাধনা সম্ভব নয় । হতাশ রাম তাঁর নিজের একটি চোখ উপড়ে ফেলার জন্য নিজের হাতের তীর নিজের চোখের দিকেই নিবদ্ধ করলেন । আসলে রামের চোখদুটি ছিল ঠিক নীলপদ্মের মত । রামের ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে রামকে নিবারিত করলেন দেবী । আর কাঙ্ক্ষিত বর দিলেন যাতে সীতা-উদ্ধার সহজতর হয় ।

দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তখন থেকে ঘটা করে দুর্গাপুজো চালু করলেন রামচন্দ্র । সে সময়টা ছিল শরৎকাল । সেই থেকেই ধরতে গেলে দুর্গাপুজার মহিমামন্ডিত প্রচলন । আর তাই দুর্গা পুজোকে বলা হয় শারদীয়া পুজো । আগে দুর্গাপুজো হত চৈত্রমাসে । এখনও সে প্রথা অবশ্য অবলুপ্ত হয় নি । তবে সেটা বাসন্তী পুজোয় হয়েছে নামান্তরিত । 

এর আগে বা পরে আরও অনেক কিছু থাকলেও মূল ভিত্তি-কাহিনী কিন্তু এটাই । সুতরাং দুর্গাপুজোর ধর্মীয় ভিত্তি যে বেশ শক্তপোক্ত তা বোঝাই যাচ্ছে । স্বয়ং রামচন্দ্র যেখানে পুজোর প্রবর্তক সেখানে ধর্মীয় আবেগ যে একটা বিশাল মাত্রায় তা অস্বীকার করার যো নেই । সারা ভারতবর্ষেই বিশেষভাবে উত্তরভারতে, প্রায় বেশ কটি বড় রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায় এমনকি দক্ষিণ ও উত্তরপূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যেও রাম এবং হনুমান দেবতা হিসেবে পূজিত হন । আর রামায়ণ যে কি বিশাল মাত্রায় বিশেষভাবে হিন্দুদের মনে প্রাণে গেঁথে আছে তা বলাই বাহুল্য । 

শুধু ধর্মীয় আবেগ নয় সামাজিক আবেগও । রাম আর সীতা আজও হিন্দু তথা বাঙ্গালীর মনে সুস্থ এক সমাজের নায়ক ও নায়িকা । মনে রাখবেন যে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে মহর্ষি বাল্মীকী রামায়ণ রচনা করেন, আধুনিক এমন কি অত্যাধুনিক লেখকরাও চমৎকৃত হয়ে যান । মহাকাব্যই বলুন বা মহা-উপন্যাস, এই আদিকবির তুলনা স্বয়ং তিনি নিজে । এটি শুধু রামের কাহিনী নয়, তৎকালীন গোটা ভারতবর্ষের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি । শুধু তৎকালীন কেন আজও যা ঘটে চলেছে মনে হয় যেন সেই রামায়নের যুগেও এগুলো ঘটত । আর ভবিষ্যতেও সেগুলো ঘটবে ।

রাম ছিলেন বীর, পণ্ডিত, ধর্মজ্ঞ, বিবেচক । আবার তিনি ছিলেন একজন আদর্শ প্রেমিক ও স্বামী । স্ত্রীকে উদ্ধারের জন্য তাঁর উদ্যোগে ভাঁটা পড়ে নি কখনও । এমন কি তার জন্য অনেক কূট কৌশলও অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন (একটি উদাহরণঃ সুগ্রীবকে দোসর করার জন্য অনৈতিক বালি-বধ) । রাম একজন আদর্শ রাজা ও প্রজাপালক ছিলেন । আবার তিনি একজন উপযুক্ত প্রশাসকও ছিলেন । কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে বহু বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে যুগের পর যুগ ধরে । রামায়ণের প্রকান্ড কান্ড আর তার শাখা-প্রশাখাগুলি  নিয়ে তার গভীর আর চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে । সে সব তো অন্য কথা । আমাদের বিষয় হল দুর্গাপুজো নিয়ে । যা বর্তমানে বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশাল উৎসব ।

যদিও দুর্গাপুজো সারা ভারতবর্ষে এমন কি ভারতের বাইরেও প্রচলিত তবু বলতে হবে এই পুজো আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙ্গালীর সবচেয়ে বড় জাতীয়, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব । এত বড় আকারে আর এতদিন ব্যাপী আর কোনও উৎসব শুধু ভারতের অন্য কোথাও কেন, সারা পৃথিবীর কোথাও নেই । অন্য কোনও ধর্মে এমন কি হিন্দু ধর্মেও এত দীর্ঘ দিনব্যাপি উৎসব দেখাই যায় না । 

শুধু এই চারদিন তো নয়, পুজোর প্রায় মাসাধিক কাল আগে থেকেই বাঙ্গালীরা যে আশা আর আনন্দ বুকে সঞ্চয় করে রাখেন তা এক কথায় অপূর্ব । এটা যদি শুধুমাত্র একটা ধর্মীয় উৎসব হত তার ব্যাপ্তি আর বিশালতা এমন হত না । খেয়াল করে দেখুন বিশ্বকর্মা পুজো থেকে অন্নপূর্ণা বহু পুজো কিন্তু হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান । সেগুলো সব পুজো কিন্তু কেউ উৎসব নয় । উৎসব বললে আমরা সচরাচর সেই জিনিসটাই বুঝি যেখানে অসংখ্য মানুষ বিনা প্ররোচনায় আনন্দে সামিল হয় । উৎসাহে উন্মাদ হয়। অবশ্য ব্যাতিক্রমী কিছু মানুষ সর্বদাই থাকবেন যারা হয়ত এই আনন্দ-জোয়ারে তেমন করে মন ভাসাবেন না । কিন্তু সে অন্য কথা । নিয়মের অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যাতিক্রম থাকবেই । সংখ্যায় এঁরা অপ্রতুল ও প্রায় উপেক্ষণীয় । 


দুর্গাপুজো ও ধর্ম 

পুজো এই শব্দটার সঙ্গে ধর্ম এই শব্দটা যেন শক্ত একটা গিঁট দিয়ে বাঁধা । একটা বললে আর একটা এসে পড়ে আপনিই । পুজো মানে হল আরাধনা অর্থাৎ সিদ্ধিলাভের আশায় কাউকে একমনে ডাকা । এই ডাক নির্দিষ্ট মন্ত্রের উচ্চারণেই হোক বা আপন হৃদয় আর মনের ভাষাতেই হোক সেটা বড় কথা নয় । আসল কথাটা হল ডাকা বা আরাধনা করা । কে আমার সিদ্ধি ঘটাতে পারবে আর তাকে কি ভাবেই বা ডাকা হবে সেটা ঠিক করতে হবে আগে । তাই মানুষ কল্পনা করেছে নানা দেব-দেবীর । এই দেব-দেবীরা হলেন মানুষের আদর্শ । তাঁদের অনুসৃত পথ মানুষ অনুসরণ করলে, তাঁদের উপদেশ পালন করলে ভাল ফল পাবে, এইটাই মানুষ ভেবে এসেছে । শুধু ভারতবর্ষেই নয়, আমরা ইতিহাসে আরও অনেক দেশের কথা পড়েছি যাঁরা দেবতার কল্পনা করে তাঁদের পুজো করেছেন । এ বিষয়ে গ্রীকপুরাণ তো আমাদের অনেকেরই জানা । গ্রীকপুরাণ প্রায় হিন্দুপুরাণের মতই নানা দেবদেবীর সুন্দর সুন্দর উপাখ্যানে পূর্ণ । এইসব কাহিনী আর উপদেশ মানুষকে বিভিন্ন যুগে পথ দেখিয়েছে আর দেখাবে এটা হয়ত বেশ কিছু মানুষের বিশ্বাস । আগেই বলেছি দুর্গাপুজো আগেও হত কিন্তু তা ছিল কেবল পুজোই অর্থাৎ হিন্দুদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান । কিন্তু তা হয়ত উৎসবের মর্যাদা ও গুরুত্ব পায় শ্রীরামচন্দ্রের শারদীয় অকালবোধনের পর । সুতরাং বর্তমান দুর্গাপুজোর ধর্মীয় বাতাবরণ অস্বীকার করা যায় না একেবারেই ।


দুর্গাপুজো ও সামজিক প্রেক্ষাপট 

একটি সমাজ মানে হল বেশ কিছু মানুষের সম্মীলিত এক মঞ্চ । এককালে এক একটি ধর্ম বা বিশ্বাস বা পথ নিয়ে এক একটি সমাজ গঠিত হত । যেমন হিন্দু সমাজ, ক্রিশ্চান সমাজ, মুসলিম সমাজ, বৌদ্ধ সমাজ, পার্শি সমাজ, রবীন্দ্রনাথের যুগে ও তৎপরবর্তী কালে ব্রাহ্ম সমাজ প্রভৃতি । পরবর্তী ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষ কিন্তু বিভিন্ন যুগে এই সামাজিক ধ্যান-ধারণার সংকীর্ণ গণ্ডী অতিক্রম করেছে আর করেই যাচ্ছে । শিক্ষা, প্রয়োজন আর আধুনিকতা মানুষকে আজ বৃহত্তর এক গন্ডীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে । তাই এক একটি ধর্মীয় সমাজের সুখ-দুঃখের ভাগীদার অন্য একটি সমাজ নিচ্ছে না বা মন থেকে নিচ্ছে না - এ কথা কি বুক ঠুকে আজ বলা যায় ? শিক্ষা, প্রয়োজন, ভ্রাতৃত্ববোধ আর মানবিকতা আজ যেন বিভিন্ন সমাজকে এক করে দিতে বদ্ধ পরিকর । তাই আজ ঈদ উৎসবে মুসলিম পড়শিভাইয়ের আনন্দে অরুচি কি কোনও হিন্দু ভাইয়ের হয় ? ২৫ শে ডিসেম্বরের বড়দিনে যারা মাতোয়ারা হন তাঁরা কি শুধুই ক্রিশ্চান ? ঠিক তেমনই হল দুর্গাপুজো । এটি বাঙ্গালীদের এক মহামিলনোৎসব – জাতে বাঙ্গালী, ধর্মে নয় । নানা ধর্ম, নানা বর্ণ আজ মিলেমিশে একাকার এই দুর্গাপুজো উৎসবে । অর্থাৎ এখানে সমাজ কিন্তু একটাই আর তা হল বাঙ্গালী দুর্গাপুজো সমাজ । তবে মনে রাখতে হবে এই পুজো বাঙ্গালী অধ্যুষিত হলেও অন্য ভাষাভাষী মানুষ কিন্তু এখানে ব্রাত্য নয়, বরং অধিকতর আদরণীয় । তাই সমাজ একটাই তা হল শারদীয় মহোৎসব সমাজ । সবাই এখানে আনন্দ করে, নিজের নিজের সাধ্য মত খায় বা পরে বা ঘোরে । 


পুজোর একাল-সেকাল

সেকালে বললে বেশী আগের কথা অর্থাৎ আমার জন্মের আগের কথা হয়ত বলতে পারব না তবে ছেলেবেলার কথা বলতে পারি । তখন পুজোয় একটা অপূর্ব ধর্মীয় গাম্ভীর্য বজায় থাকত । পঞ্চমীর গভীর রাতে লরি করে পাড়ার ঠাকুর আসত আর আমরা ঘুম ভেঙ্গে ঘুমচোখে দেখতাম । বুকের মধ্যে আনন্দের এক ঝড় । বাকি রাত আগামী ষষ্ঠীর সকালের কল্পনায় না ঘুমিয়েই কেটে যেত । পরের দিন মুখ ধোবার আগেই ছুটে যেতাম নিরাড়ম্বর এক প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে । কেমন হয়েছে ঠাকুর, কেমন হয়েছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক আর গণেশ । কেমন হয়েছে অসুর, সিংহ, ময়ূর, প্যাঁচা বা ইঁদুর । এরপর এক অন্তহীন অপেক্ষা যেন ঢাকের সেই মধুর আওয়াজ শোনার । তখন ষষ্ঠীর দিন রাত্রে ঠাকুরের হাতে অস্ত্র আর গয়না পরান হত (এখন এগুলি মহালয়ার আগেই সম্পন্ন হয়ে যায় )। মাইকে কখনও বাজত স্তোত্র বা সুমধুর বাংলা সঙ্গীত । হিন্দীগান যে বাজত না তা নয় । তবে তার ছন্দে হৃদয় নাচত শরীর নয় । ধূপ আর ধুনোর গন্ধে চারিদিক মশগুল । দূরে থাকার সুবাদে যাদের দেখা পাওয়া যেত না তাদের দেখতাম এইদিন । কেমন যেন নতুন নতুন লাগত । কেমন যেন একটা সুন্দর সুন্দর গন্ধ ভাসত বাতাসে । আকাশের কি সুন্দর রং । সব নতুন – সব কিছু। পুজোয় সবাই বেশ সামাজিক ও ধর্মীয় আচার পালন করত । মহাষষ্ঠী, মহাষ্টমীতে নিরামিশ, মহানবমীতে মাংস (বলা বাহুল্য, তখন পাঁঠার মাংসই সুপ্রচলিত ছিল, মুরগী বা চিকেন ছিল প্রায় ব্যাতিক্রমের তালিকায় । বিশেষভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণরা এটি গ্রহণ করতেন না )। এর মধ্যে মহাষ্টমীতে ময়দা অর্থাৎ লুচি, ছোলার ডাল, সুজি বা মোহনভোগ বাধ্যতামূলক ছিল বলতে গেলে । নবমী-নিশীথে বাড়ি ফিরতে দেরি হত আর স্নেহের বকুনিও বরাদ্দ ছিল । দশমী ছিল একদিকে দুঃখের আর একদিকে আনন্দের । পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে এই দুঃখের সঙ্গেই আনন্দের বিষয়টা হল মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারটা । তখন বিজয়ার মিষ্টি বলতে নারকোলের ছাপা, নাড়ু, চন্দ্রপুলী, ময়দার গজা, বোঁদে, মিহিদানা ইত্যাদি । ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এগুলোই ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টি । তবে এর মধ্যেই জিভে মিষ্টির একঘেয়েমী স্বাদ বদলের জন্য তৈরি হত নারকোল কুরো দিয়ে ঈষৎ ঝাল ঘুঘনি । আমাদের মধ্যে যারা একটু প্রাপ্তবয়স্ক তারা সিদ্ধির শরবত খেয়ে সামান্য টাল খেত । এই একটি দিন নাকি টাল খাওয়াটাও অনুমোদিত ছিল । আজকাল অবশ্য সিদ্ধি কথাটা একমাত্র দুর্গাপুজোর পুরোহিতের ফর্দেই শুধু স্থান পায় । আর স্কচ-হুইস্কি খাবার জন্যে বিজয়া দশমীর দরকার হয় না। এখানে “আমাদের” শব্দটা একটা সার্বজনীন মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে । লেখক এক্ষেত্রে শুধুই একজন প্রতিবেদক মাত্র (অর্থাৎ তিনি নিজের কথা বলছেন না) । পাড়া এবং বহু দূরের লোক একজন অন্য জনের বাড়িতে যেত । বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা ছিল নীতিগতভাবে প্রায় বাধ্যতামূলক । আর বড়রা মাততো পারস্পরিক কোলাকুলিতে । এই এক উৎসব যার আদি আর অন্ত দুইই এক স্নিগ্ধ মিলনের উন্মাদনায় পরিপূর্ণ।


একালের পুজো

দেখতে দেখতে মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর অনেক উন্নতি হল । সারা দেশের সঙ্গে উন্নতিতে ভাগ পেল পশ্চিমবঙ্গও । মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল তার সার্বজনীন পুজোয় চাঁদা দেবার ক্ষমতাও । বাড়ল মানুষের অনুকরণপ্রিয়তা । দেবীর মূর্তি হতে লাগল নানা আকারের । দেবী চলে এলেন মানুষের সমাজের বহু কাছে । ধর্মের মোড়ক খুলে একটু যেন বিনোদনের প্যাকেটে ভরা হতে লাগল পুজোটাকে । দেবী প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গেই আকারে আর প্রকারে বাড়তে লাগল প্যান্ডেল ও অন্যান্য অনুসঙ্গ । আগে যেমন মানুষ শুধু তার পাড়া আর আশপাশের কিছুটা ঘুরে আসত পুজো দেখার জন্যে । এখন সেই সঙ্গে বাড়তে লাগল তার নিজেকে দেখানোর প্রবণতা আর প্রতিযোগিতাও । প্রতিমা দেখার চৌহদ্দি বেড়ে গেল অনেক । সময় আর সাহস দুটোই । এখন হেঁটে যেমন মানুষ যায় তেমনই অসংখ্য মানুষ যায় গাড়িতে করে – ভাড়া বা নিজের । এরপর এল থিমপুজো । প্যান্ডেলগুলো আর প্যান্ডেল রইল না । কেউ হল গুজরাটের সোমনাথের মন্দির তো কেউ হল রাজস্থানের মাউন্ট আবু । আবার কেউ কেউ দেওয়ালে অজস্র ক্ষতচিহ্ন আর বটগাছের বেষ্টনী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতাব্দী বা তারও বেশী প্রাচীন জমিদার বাড়ী। মানুষ কে আর শখ করে এসব পুরোন বাড়ী দেখতে যায় ? তাই থিমের মধ্যেই এসব দেখে সে ভারি মুগ্ধ । একই অঙ্গে এত রূপ – দেখিনি তো আগে ? তাই আজ পুজোশুরুর অনেক আগে থেকেই সন্ধ্যা আর রাত্রে রাস্তায় পা ফেলাই দূরুহ। সারা রাস্তা আলোকিত । একটা প্যান্ডেলের আলো শেষ হলেই শুরু হচ্ছে আর একটার আলো। ফুচকা, ভেলপুরি, মোগলাই, এগরোল, ফিসফ্রাই, চিকেন রোল আর রেজালা আর কোল্ড ড্রিংসের সুসজ্জিত সমাহার রাস্তার দুধারে । গয়না আর পোশাক নিয়ে প্রতিযোগিতা । - ঠাকুর কতটা দেখব বা দেখতে পাব জানি না (অনেক প্যান্ডেলে আবার তিরুপতি মন্দিরের মত দু ঘন্টা লাইন দিয়ে দু মিনিট ঠাকুর দেখার ব্যবস্থা) তবে, আমি দেখছি তোমাদের, আমাকেও দেখ তোমরা !!


কালের প্রভাব

নামে শারদীয় পুজো । কারণ শরৎকালে হয় বলে । বর্ষার অন্ত । শীতের একটু দেরি আছে । গাঢ় নীল আকাশে ধবধবে সাদা মেঘ ভাসছে । আহা যেন সদ্য ছানা কাটানো হয়েছে । গাঢ় নীল ছানার জলে সাদা সাদা ছানার টুকরোগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে । মাঠে ভরা সাদা কাশফুল। শিউলির গন্ধে চারিদিক আমোদিত । নাতি-বর্ষা-গ্রীষ্ম-শীত এ কাল বড় সুখের । বড় আমোদের । এমন সময় যে কোনও উৎসব তো প্রাণের উৎসব, মনের উৎসব । তাছাড়া আকাশভরা ঐ যে সোনা গলা মিষ্টি রোদ্দুর । ভোরে ঘাসের ডগায় স্বল্প শিশিরের আভাস । নানা জলাশয়ে শালুক আর পদ্মের সুমধুর উদ্ভাস । কল্পনা করুন তো এ সময় যদি কানে আসে ঢাকের মিঠে আওয়াজ, নাকে ঢোকে ধূপ আর ধূনোর গন্ধ ? আপনি পাগল হয়ে যাবেন। উৎসব আপনাকে পাগল করে দেবেই । বিশেষভাবে চারদিন ব্যাপী যে উৎসব । যার একটা দিনের শেষ কিন্তু উৎসবের শেষ নয়, আর একটা দিনের আগাম আভাস মাত্র । 


উৎসব ও পর্যটন

বাঙ্গালী জাতি হিসেবে ভ্রমণপ্রিয় হবার সুখে বড় সুখী । তার এই ভ্রমণপ্রিয়তা আজ ভিন্ন প্রাদেশিক জাতির প্রায় মুখে মুখে উচ্চারিত । ইংরেজ, আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটালিয়ান, চিনা, জাপানী সব জাতির সঙ্গে এক সারিতে ভ্রমণপ্রিয়তায় যে জাতির নাম তা হল বাঙ্গালী । তারা খেতে আর খাওয়াতে যেমন ভালবাসে তেমনই ভালবাসে যেতে আর নিয়ে যেতে । পুজোর এই শরৎকাল কিন্তু তার ভ্রমণপ্রিয়তায় বেশ কিছুটা আনুকূল্য ঢেলে দিয়েছে । না গরম, না শীত, না বর্ষা এই কালটা বেড়ানোর পক্ষে সত্যি বড় প্রকৃষ্ট । আর চারদিনের একটানা ছুটির সুবর্ণ সুযোগ কে আর হাতছাড়া করে বলুন ? আবার স্কুল, কলেজ, কোর্টকাছারি এমন বহু প্রতিষ্ঠানে ছুটির ভাঁড়ার বেশ একটু স্ফীত । অনেকে এ সময় কেউ পুজো-বোনাস পায় বা কেউ পুজো- এডভান্স বা এক্সগ্রাসিয়া বা অন্য কিছু । কেউ কেউ আবার প্ল্যান করে ব্যাংক বা অন্য আর্থিক সংস্থায় রেকারিং জমা করে থাকেন এই সময়ে ম্যাচিওর করার জন্য । এ সময় প্রচুর ট্রেন বাড়তি দেওয়া হয় সেটা অবশ্যই একটা সুযোগ যা বছরের অন্য সময়ে পাওয়া যায় না । তাই শুধু ভ্রমণপ্রিয় বাঙ্গালীরাই নয় ভ্রমণ সংস্থাগুলোও এ সময় বেশ একটু লাভের মুখ দেখে তা বলাই বাহুল্য । 


দুর্গাপুজো ও ব্যাবসা

দুর্গাপুজোয় নানা খাতে মানুষ প্রচুর খরচ করে থাকে । এর মধ্যে প্রয়োজনের থেকেও প্রাধান্য পায় বিনোদন । ভোগ করব বললেই কিন্তু ভোগ করা যায় না । ভোগের একটা উপযুক্ত সময় আর মাধ্যম চাই । দুর্গাপুজো মানুষের কাছে সেই “সময় আর সুযোগ” এনে দেয় । তাই এ সময় সে কোনও কিছুতেই হিসেবের বাইরেও খরচ করতে কার্পণ্য করে না । এই সুযোগ নেয় অবশ্যই ব্যবসায়ীরাও । বহু জিনিসের দাম এ সময় অনেক অনেক গুণ বেড়ে যায় । অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের ভাষায় যাকে “দাঁও মারা” বলে আর কি । সারা বছর যে পোশাক ঝুলে থাকে দোকানের হ্যাঙ্গারে তাই হয়ত এ সময় শোভা পায় কোনও পোশাকবিলাসীর গায়ে । তাছাড়া “থিমের” দৌলতে এমন বহু জিনিস হয়ত আলেকালে প্রয়োজন হত সেগুলি এখন দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠে । যেমন ধরুন নারকোল ছোবড়া দিয়ে প্যান্ডেল হবে । আগে যদি নারকোল ছোবড়া গদি তৈরির দোকানে ছাতা পড়ত এখন তা লরি লরি আনতে হচ্ছে প্যান্ডেলে ফলে এই “পড়ে থাকা চোদ্দ আনা” পুরো ষোল কেন বত্রিশ এমন কি পুরো পঞ্চাশ আনায় উশুল হয়ে যাচ্ছে । আনাজপাতি, ফলমূল, নানা খাদ্যদ্রব্য, অন্যান্য দরকারি- অদরকারি বহু জিনিস, ফুল (বিশেষভাবে পদ্মফুল), শোলা ও আরও অসংখ্য জিনিস পাওয়া আর দেওয়া নিয়ে প্রায় মারমার কাটকাট অবস্থা । ভ্রমণ সংস্থা, হোটেল ও হলিডে হোম ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ীর পক্ষে এই উৎসব হল বড় সুখের সময় ।


অনাকাঙ্ক্ষিত উপসংহার

বছরের পর বছর আমাদের এই মহা-উৎসব দুর্গাপুজো ক্রমেই বিশাল আকার ধারণ করছে । পুজোর সময় তো বটেই পুজোর অনেক আগে থাকতেই কেনা কাটার জন্য শহর বিশেষভাবে কোলকাতার রাস্তাঘাট জনাকীর্ণ হয়ে উঠছে । রাস্তায় যানজট, কোথাও পা ফেলার একটু জায়গা নেই । দোকানে দোকানে মিষ্টিকে ঘেরা পিঁপড়ের স্তুপের মত মানুষের ভীড় । আর পুজোর দিনগুলির কথা তো বলার নয় । শহর কোলকাতা দূরে থাক ছোট ছোট শহরগুলি ও শহরতলি আক্ষরিক অর্থেই যেন জন-সমুদ্রে পরিণত হয় । যে সমস্ত মানুষ হেঁটে ঠাকুর দেখতে পারেন না তাঁদের পক্ষে গাড়ী ভাড়া করেও বেশী দূর যাওয়া সম্ভব হয় না কারণ গাড়ী চলার মত রাস্তাই থাকে না । প্যান্ডেলে প্যন্ডেলে 
উচ্চতা, জমক- প্রদর্শন আর পুরস্কার পাওয়ার প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে । জিনিসের দাম ক্রমশঃ ঊর্ধমুখী এমন কি সাময়িক দুস্প্রাপ্যতাও গ্রাস করে । দর্শনীয় স্থানগুলিতে স্থানাভাব এ তো লেগেই আছে । মনে হচ্ছে যেন উপলক্ষ লক্ষকেও ছাড়াবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে । হয়ত সময়ই বলবে মিলনের উৎসব কোন দিকে যাচ্ছে – ব্যর্থতা কিংবা সাফল্য ।

0 comments: