মুক্তগদ্য: শমীক জয় সেনগুপ্ত
Posted in মুক্ত গদ্য
মুক্তগদ্য
নষ্টগদ্য- স্মার্ত
শমীক জয় সেনগুপ্ত
স্মৃতি বড় একটা সঙ্গ ছাড়ে না আমার। আর আমার সাথে তার যত বোঝাপরা হচ্ছে তত মজবুত হয়ে উঠেছে সম্পর্কগুলো। এখন ঘুমের মধ্যে খুব বেশী কিছু দেখতে পাই না, তবে মন ভালো না থাকলে মনে হয় আম্মা আর আমার ছ্যাপ ছড়ানো খাটে এক্ষুণি হামানদিস্তার শব্দ শুনতে পাব। আর আধশোয়া হয়ে ঝুলতে ঝুলতে আবার গলা জড়িয়ে ধরে আব্দারের সুরে বলবো "এই বুড়ি তারপর-"
তার আর পর হয় না। ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখলে যেমন সব কিছু মনে হয় ছুটে পালাচ্ছে, তা সে ঘর বাড়ি গাছ আকাশ যাই হক না কেন তেমনিভাবে দৃশ্যপট বদলে যায়। বড়দিদি স্কুল থেকে ফিরে আম্মাকে বলে- "মাসিমা, আস্তে বলুন।মণি জেগে যাবে।"
আমি বড়দিদির কোলের মধ্যে মুখ ঘস্টাতে থাকি। বড় বেশী মনে পরে যায় আজকাল।
দাদু তখন পিয়ারলেসে ভর্তি। মা বাবা আম্মা সবাই ব্যস্ত, সমো আমায় নিয়ে একাডেমী গেল। জীবনে নিজের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শণী। একটা গাছ, তাতে একটা দোলনাতে দোল খাচ্ছে একটা ছেলে আর মেয়ে। দুটোই রোবট রোবট দেখতে আর গাছটা এলোমেলো। বড়দির বাড়ি থেকে আমার জীবনে প্রথম এক্সিবিশন। কত আর বয়স তখন, বছর সাতের হব।
মামার ডাক দিচ্ছে "ডাকু-" যেমন এখনো দেয়, আর চোখ খুললেই আমি বলি ঝাপ দেব। মা যেন দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই আমায় কত কাছ থেকে দেখছে, এত কাছ থেকে যে আমিও নিজেকে দেখতে পাই না।
আজ আম্মা নেই, বড়দিও না। আমি এখন এতটাই বড় যে চেয়েও ইচ্ছে মত বলতে পারিনা কি চাই।
এক এক সময় পিসিমণির বাড়ির পিছনের পুকুরটাকে মনে পড়ে। ওদের তখন কাঠের বাড়ি, টিনের চাল ছিল। আমি নাকি ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম "ঠাম্মা, তোমরা হাটে (hut) থাকো?"
ঠাম্মা। পিসামণির মা। আম্মার পরে ঠাম্মার ওপর আমার জোড় ছিল অনেকটা। ঠাম্মা আমারা যাব জানলে মুড়ির মোয়া বানিয়ে রাখত। জানত তার গুবলাই মোয়া ভালবাসে খুব।
কোথায় কোথায় একটু আধটু চোখ লেগে এলেই মন বলছে সব ফিরে পাব। আচ্ছা, ভাই কি দেখতে পায় ছোটদাদান ওর সাথে ক্যারাম খেলছে। পাওয়াটা ত উচিৎ কারন ওর সব কিছুই যখন আমার মত। আসলে ছোটদাদান ভাইকে বেশী ভালবাসত, আর দিদান আমায়। আমার ভাই, আমার সব থেকে আদরের। মিমি আর ভাই ওরা না এলে আমি কোনদিন দাদা হতে পারতাম না। এতগুলো ভাই-বোনকে ভালোবাসতেও পারতাম না। কুট্টি আর আমি আমরা পিঠাপিঠি ত' তাই আমাদের বন্ডিংটা যতটা ভাই-বোনের ততটাই বন্ধুত্বের। ছেলেবেলা থেকে এটা জেনেই বড় হয়েছি আমরা যমজ। ওখানে টান আছে, ভাল মন্দের ভাবনা আছে, কিন্তু দরকারের দাদাগিরিটা নেই। আম্মার ছেলে ভুলানি গল্পে দুর্গাষষ্ঠীতে গনেশ ঠাকুর এল মা বাবার কৈলাসে। কিন্তু বোন ছাড়া সে কোথাও যায় না, তাই লক্ষ্মী ঠাকুরনকে চটপট কোজাগরীর রাতে চলে আসতে হল। নইলে পাছে ভায়ের অসুবিধা হয়।
কি লিখছি কেন লিখছি এত কথা নিজেও জানি না। আমি ত ডাইরী লেখা ছেড়ে দিয়েছি বহুকাল হয়। তাই কি হাঁপিয়ে উঠছি। আসলে নষ্ট মন নষ্ট কলমে আর যাই হক দেবতার পূজো হয় না। আমি কি তবে সত্যি ফুরিয়ে যাচ্ছি?
মনে হচ্ছে কি যেন তাল কাটছে। আমি জানি না। আসলে ক্যাওরাতলার সামনে দিয়ে আসার সময় আজকাল গন্ধটা খুব নাকে লাগে। খৈ, ধূপ অগঢ়ু কোন কিছুই তাকে ঢাকতে পারে না। গন্ধটা শিক-কাবাবের। আগেও গন্ধটা আসত, খালি বুঝতে চাইতাম না। এখন বুঝি কি না বলতে পারি না তবে গন্ধের মধ্যে ছেলেবেলার দুটোদিন খুব বেশী মিশে আছে। যেদিন দাদুকে সবাই নিয়ে গিয়ে ঐ ফার্নেসে ঢুকিয়ে দিল সেদিন আমি জানলাম মৃত্যু কি? আমি নাকি অনেকদিন গুম মেরে ছিলাম বেশ কিছুদিন।
আম্মার সময় সব কাজ কর্ম করলেও আমার পৃথিবী যে একটা জায়গায় এসে থমকে গেছে বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে মা বাবা মামা আর সুভাষমামা ছাড়া, আমার বড়দি আর আমার আম্মা আমার সব ছিল।
বড়দি কোন সুযোগ দিল না, চলে গেল। কেন জানি না আজ খুব খেই-হারা এই সব কথা মনে হচ্ছে। স্মৃতিকেও আজ বিশ্রাম দিতে হবে, সে পাগল হয়ে গেছে তাই ফ্ল্যাশব্যাকে আমি আর আমার শৈশব কৈশোর সব আসছে ফিরেফিরে। ঠিক আমার মামীর একচুল-দুচুল গল্পের মত। ভয় হচ্ছে একসাথে সব কিছু না জানি আবার বিস্মরণে চলে যায়।।
0 comments: