প্রচ্ছদ নিবন্ধ: শ্রীশুভ্র
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
‘বহিরাগত’ তত্ত্ব: নেপথ্যের সমীকরণ
শ্রীশুভ্র
[“The strength of the government lies in the people’s ignorance , and the government knows this, and will therefore always oppose true enlightenment.” --LEV TOLSTOY.]
সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও উত্তাল ছাত্র আন্দোলের রাশ টানতে রাষ্ট্রশক্তি যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব! অবরূদ্ধ উপাচার্যকে ঘেরাও মুক্ত করতে নিরীহ নিরস্ত ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশি তান্ডবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। আর সেই প্রেক্ষিতেই সমগ্র পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে প্রশাসন থেকে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব আমদানী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে বসাতে হয়েছে পুলিশি পিকেট। বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অধিকার। আর সেইখান থেকেই শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক! যার অভিমুখ মূলত দুইটি, একটি হল কে বহিরাগত আর কে বতিরাগত নয়! অপরটি হল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনকে সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করা কতটা পরিমাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার অনুসারী!
সুখের কথা এই বিতর্কে ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে পাশে পেয়েছে তাদের অধ্যাপক অধ্যাপিকা থেকে শুরু করে প্রাক্তন শিক্ষাবিদদের অধিকাংশের, তার একটা সুস্পষ্ট ইতিবাচক প্রতিফলন পড়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের থেকে শুরু করে সাধারণ জনমানসেও। এই প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস সুপ্রিয়া চৌধুরী, কোনও অবস্থাতেই ‘বহিরাগত’ শব্দটির ব্যবহার সমর্থনযোগ্য নয় জানিয়ে বলেছেন, আসলে বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি স্থান, যেখানে সমাজের নানা পরিচয়ের মানুষকে স্বাগত জানানো আমাদের কর্তব্য। সকলের মত বিনিময় হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের মধ্যে। তাই পুলিশের পিকেট বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ছাত্র শিক্ষকদের প্রবেশ আটকানো কোনভাবে কাম্য নয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দিকে পাঁচিল তোলা যে আদতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণারই পরিপন্থী সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অমিতা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “সারা বিশ্বে কেনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা পাইনি। তা ছাড়া আমাদের পুরানো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো জনসাধারণের অর্থানুকূল্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ তো সাধারণের সম্পদ। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কখনও বেঁচে থাকতে পারে কি?” এই বিষয়ে যাদবপুরেরই প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় তো প্রোটেক্টটেড এরিয়া হতে পারে না! তাঁর কথায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই পড়তে আসে। শিখতে আসে। বিভিন্ন বিভাগে সেমিনার হয়, শুনতে আসে। বর্তমানে ছাত্র-গবেষক যেমন উপস্থিত থাকে, তেমনই প্রাক্তনী বা সেই বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন বহু মানুষই আসেন সেখানে। সে ক্ষেত্রে কাউকে ‘বহিরাগত’ বলা যায় কি? প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন উপাচার্য নিজেই! তাই তাঁর কাছে এই ‘বহিরাগত’ কথাটি সম্পূর্ণ অর্থহীন প্রলাপের মতোই মনে হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের জিজ্ঞাস্য, বহিরাগত কারা? যাদবপুরের খোলামেলা পরিবেশে বহিরাগত তত্ত্বের স্থানই বা কোথায়? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ত্রিগুণা সেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতেন, তা ছিল উন্মুক্ত ও অবাধ। সকলের প্রবেশাধিকার রয়েছে সেখানে। তাঁর মতে, ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে তাই যাদবপুরে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জড়ো হওয়াকে বহিরাগতের জমায়েত বলা শুধু অযৌক্তিক নয় অভিসন্ধিমূলকও বটে। খুবই প্রনিধানযোগ্য আনন্দদেব বাবুর এই শেষ কথাটি।
“সমস্ত সভ্যদেশ আপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে জ্ঞানের অবারিত আতিথ্য করে থাকে। যার সম্পদে উদ্বৃত্ত আছে সেই ডাকে অতিথিকে। গৃহস্থ আপন অতিথিশালায় বিশ্বকে স্বীকার করে। নালান্দায় ভারত আপন জ্ঞানের অন্নসত্র খুলেছিল স্বদেশ বিদেশের সকল অভ্যাগতের জন্য। ভারত সেদিন অনুভব করেছিল, তার এমন সম্পদ পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে সকল মানুষকে দিতে পারলে তবেই যার চরম সার্থকতা। পাশ্চাত্য মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই বিদ্যার এই অতিথিশালা বর্তমান। সেখানে স্বদেশী-বিদেশীর ভেদ নাই। সেখানে জ্ঞানের বিশ্বক্ষেত্রে সব মানুষই পরস্পর আপন। সমাজের আর-আর প্রায় সকল অংশেই ভেদের প্রাচীর প্রতিদিন দূর্লঙ্ঘ্য হয়ে উঠেছে; কেবল মানুষের আমন্ত্রণ রইল জ্ঞানের এই মহাতীর্থে। কেননা এইখানে দৈন্যস্বীকার, এইখানে কৃপণতা, ভদ্রজাতির পক্ষে সকলের চেয়ে আত্মলাঘব। সৌভাগ্যবান দেশের প্রাঙ্গণ এইখানে বিশ্বের দিকে উন্মুক্ত”। বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে প্রায় বিরাশি বছর পূর্বে, ১৯৩২ এর ডিসেম্বরে। আর সেখানে প্রায় এক শতাব্দী পরে যাদবপুরের স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব প্রচার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের স্বাধীনতাকে খর্ব করে একে একটি সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করতে। রবীন্দ্রনাথের এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেসের ডিরেক্টর ও শিক্ষক অভিজিৎ গুপ্তর কথায়। প্রসঙ্গত শ্রী গুপ্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্রও বটে। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় বা ক্যাম্পাস শুধু ছাত্র, শিক্ষক বা কর্মচারীদের সমষ্টি নয়, তাদের বলয়ের মত আলিঙ্গন করে থাকে বৃহত্তর এক সম্প্রদায় বা কমিউনিটি। এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে তিনি আরও বললেন, “শুষ্ক, আত্মকেন্দ্রিক, পুঁথিসর্বস্ব বিদ্যাভ্যাসের কবল থেকে মুক্তির প্রাথমিক শর্ত যে দ্বারোদঘাটন, তার সামনে ভীষন রাক্ষসের মতো পথ রোধ করে দাঁড়ায় সীমান্ত, কাঁটাতার, পাসপোর্ট পরীক্ষক। এই অমঙ্গল সরিয়ে দিতে না পারলে আমাদের বিদ্যাভাস আরও দীর্ণ, আরও ক্লিষ্ট, আকার ধারণ করবে”। বিরাশি বছর আগে জ্ঞানের যে মহাতীর্থের প্রাঙ্গণকে বিশ্বের দিকে উন্মুক্ত রাখার উপরেই জোর দিয়েছিলেন বিশ্বকবি দ্যর্থহীন ভাবে।
জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সেই মিলনতীর্থের প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত পরিসরকে প্রশাসনিক কলকব্জা দিয়ে আবদ্ধ করার এই যে অপপ্রয়াস, এর পশ্চাতে আদতেই কোনো দূরভিসন্ধিমূলক গভীর ষড়য়ন্ত্র আছে কিনা সময়ই তা স্পষ্ট করে দেবে হয়ত, কিন্তু আশঙ্কার জায়গাটি হল; ততদিনে এই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ত তার এতদিনের স্বাধীন অর্জনের উৎকর্ষতাটুকু হারিয়ে ফেলবে! শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সজীব সংযোগের পরিসর ও তাদের স্বাধীন চিত্তবৃত্তির মৌলিক বিকাশের জন্য আবিশ্ব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এত সুনাম; সেইটি অবরূদ্ধ হলে সেটি শুধু যাদবপুরেরই ক্ষতি নয়, সে ক্ষতি দেশ কাল জাতির গন্ডী ছাড়িয়ে মানুষের সমাজ সংসারেরই ক্ষতি হয়ে দাঁড়াতে পারে একদিন। শুভবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই আজ এইটি আশঙ্কা করে শঙ্কিত! ঠিক যে কারণে এই বহিরাগত তত্ত্বকে অভিসন্ধিমূলক বলতে বাধ্য হয়েছেন আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদও! কিন্তু কেন এই বহিরাগত তত্ত্ব? কেনই বা যাদবপুরকে একটি সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করার এই আশু প্রয়াস!
সেইটি বুঝতে হলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। এরাজ্যে ভুতপূর্ব সরকারের প্রায় সাড়ে তিন দশকের শাসনকালে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে সরকারী দলের ছত্রছায়ায় নিয়ে এসে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সেগুলিকে দলীয় কর্মী সমর্থক তৈরীর কর্মশালায় পরিণত করার কাজটি প্রায় শিল্পের পর্যায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল! ভুতপূর্ব প্রশাসকরা বুঝতে পেরেছিলেন রাজ্যের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীকে নিজেদের পক্ষে স্থায়ী ভাবে ধরে রাখতে গেলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর থেকেই তাদেরকে নিজেদের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ আমাদের এই রাজ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাচর্চার চাবিকাঠিটি ঐ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতেই। আর এই সরল সত্যটি তাদের বুঝতে আদৌ দেরী হয়নি। এবং হয়নি বলেই একটানা সাড়ে তিন দশক তারা চুটিয়ে রাজত্ব করে যেতে পেরেছিলেন। রাজ্যে পরিবর্তনের পর বর্তমান শাসকদল একেবারেই মুখস্থবিদ্যার মতো সেই তত্ত্বটিকে অন্ধআনুগত্য অনুসরণ করতে প্রথমাবধি মরিয়া হয়ে ঝাঁপিযেছেন। কিন্তু তারা খেয়াল করেননি ভুতপূর্ব শাসক দলটি কতো অধ্যাবসায় সহকারে কতো সুচিন্তিত সুবিন্যস্ত পরিকল্পনায় কত দিনের নিরলস প্রয়াসে নিপূণ ধৈর্য্যের সাথে এবং দৃঢ় সাংগঠনিক দক্ষতায় সেই তত্ত্বকে বাস্তবে সফল করে তুলেছিলেন। খেয়াল করেননি, কারণ তাদের অতশত সময় নেই। বাম আমলের সাড়ে তিন দশকের ননী মাখন তাদের সাড়ে তিন বছরেই হাসিল করতে হবে। সেটাই সার সত্য তাদের কাছে। সময় সাপেক্ষ বিষয়কে অতি দ্রুত বাস্তব করতে গেলে তা যে সাদা চোখে উৎকট লাগতে পারে, খেয়াল করেননি তারা সেটাও। পাখির চোখের মতো তাদের একটাই লক্ষ্য; যেনতেন প্রকারেণ ভুতপূর্ব শাসকদলের অর্জিত সাড়ে তিন দশকের সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আধিপত্য! আর সেই আধিপত্যের স্বপ্নেই হঠাৎ জোর ধাক্কা দিয়ে গেছে গত ২০শে সেপ্টেম্বরের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত সেই বৃষ্টিস্নাত মহামিছিল!
এরাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিসরে ছাত্র আন্দোলনগুলি সংগঠিত পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে মূলত রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক স্বার্থেই। সেই আন্দোলনের অভিমুখও ঠিক করে দেওয়া হয় রাজনৈতিক দলগুলির কার্যালয় থেকেই। এবং এই রাজনৈতিক দলগুলি আপামর ছাত্রসমাজকে নিজেদের ছত্রছায়ায় ধরে রাখতে নিজেদের মধ্যে দড়ি টানাটানি করতেই অভ্যস্ত। ফলে ছাত্রসমাজও বিভক্ত থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে। আর ছাত্রসমাজের মধ্যেকার এই বিভাজন নিশ্চিন্তে রাখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই। এবং সেই প্রক্ষাপটেই যখন যে দল শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে, তার প্রাথমিক লক্ষ্যই যে হবে বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা, সে আর বিচিত্র কি? কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই, বিশেষত প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত কোন দলই ছাত্রসমাজকে এই রাজনৈতিক দলাদলির উর্দ্ধে উঠে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভিন্নতা ভুলে যুথবদ্ধ আন্দোলনে জোট বাঁধতে দেখতে চাইবে না কোন অবস্থাতেই! আর ঠিক এইখানেই ২০শে সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিভেজা ঐতিহাসিক সেই মহামিছিল আদতেই পিলে চমকিয়ে দিয়েছিল প্রশাসনের। সমস্ত রাজনৈতিক ভেদাভেদের উর্দ্ধে উঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের ছাত্রছাত্রীরা সেদিন যে যূথবদ্ধ প্রত্যয়ে যাদবপুরের অপমানিত ছাত্রছাত্রীদের পাশে এসে পা মিলিয়ে প্রতিবাদের মিছিলকে স্বতঃস্ফূর্ত মহামিছিলে পরিণত করে তুলেছিল; তা এই রাজ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক কথায় অভুতপূর্ব! রাজনৈতিক দলগুলির মিছিল গড়ে তোলার মেকানিজম ছাড়াই যে এতবড় মহামিছিল সংগঠিত হতে পারে, সে কথা ধারণার অতীত ছিল সব দলেরই। আর এইখানেই নড়েচড়ে বসতে হয়েছে বর্তমান শাসক দলকে। কেননা বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে কখন কি ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না! সেই ঝুঁকি ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে কোনো দলই নিতে পারে না। এই বিষয়ে সব দলই সমান। কোনো দলই ব্যাতিক্রম নয়।
আর তাই অঙ্কুরেই এই ঝুঁকি বিনষ্ট করতে শাসকদল যে দ্রুত তৎপর হয়ে উঠবেন সেটাও খুবই স্বাভাবিক। ঠিক সেইকারণেই এই ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব! সেইকারণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করার অভিসন্ধি, যে অভিসন্ধির ইংগিত করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। ছাত্রসমাজের এই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীন বিকাশকে কোনো রাজনৈতিক দলই মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে তো নয়ই। ছাত্রসমাজকে যত বেশি বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত ও আবদ্ধ করে রাখা যাবে, ততই তাদেরকে দলতন্ত্রের স্বার্থে ব্যবহার করা সহজ ও নিস্কন্টক হবে। এই বিষয়ে সব দলেরই এক রা। আর সেইখান থেকেই প্রশাসনিক ক্ষমতা বলে বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে নিজ শিবিরে নিয়ে আসতে সব শাসকদলই সদা তৎপর। ঠিক এই জায়গাতেই শাসকদলের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে যাদবপুর। এই রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সব ব্যাপারেই নেতৃত্ব স্বরূপ। ফলে আজকে যাদবপুরের এই রাজনৈতিক শিবির নিরপেক্ষ স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন কালকে যদি সারা রাজ্যই একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়ায় তবে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে তা যে ঘোর অশনি সঙ্কেত, সেতো বলাই বাহূল্য! সেই অশনি সঙ্কেতই শাসকদলকে তাদের প্রশাসনিক কলকব্জাগুলিকে সক্রিয় করে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎপর করে তুলেছে। তারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে যাদবপুরকে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ থেকে এখনই বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে ভবিষ্যৎ রাজনীতির পক্ষে সমূহ বিপদ। সেই বিচ্ছিন্ন করারই প্রাথমিক পদক্ষেপ স্বরূপ এই ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব, ও বিশ্ববিদ্যালয়কে সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করে তাকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রয়াস।
এখন দেখার, এই রাজ্যের বৃহত্তর ছাত্রসমাজ ও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক সমাজ কি ভাবে যাদবপুরের পাশে দাঁড়ায়। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরাই বা কি ভাবে এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। এবং সময়ই শেষ কথা বলবে, এরাজ্যের ছাত্র আন্দোলনে যাদবপুর ও ২০শে সেপ্টেম্বরের স্বতঃস্ফূর্ত সেই ঐতিহাসিক মহামিছিল কোনো নতুন ধারার সৃষ্টি করতে পারে কিনা।
0 comments: