0

অনুগল্প: মমতা দাস (ভট্টাচার্য)

Posted in




অনুগল্প




মন
মমতা দাস (ভট্টাচার্য)



সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। হাঁটা তো দূর, দাঁড়ান-ই কষ্টকর ! শোভা দত্ত, ... সুগৃহিনী, শিক্ষিতা, নীরব। বয়েস কালে অতি নিপূণ হাতে ঘর-বার দুদিক সামলেছে। স্বামী চাকরির খাতিরে প্রায়-ই টুরে থাকত। সংসারের সব দায় অতএব শোভার ছিল, ছেলে, সংসার, বাজার-হাট সব একা সামলাত হাসি মুখে, একটা কৃতজ্ঞসূচক শব্দ অবশ্য কখনো শোনেনি। যতদিন পেরেছে টেনেছে, এখন শরীর ছেড়ে দিয়েছে, বয়সের তুলনায় বুড়ো হয়ে গেছে, শরীর ভেঙ্গে গেছে, ...যেন মুক্তি চায় এবার !


স্বামী আর যুবক পুত্র হুইলচেয়ার –এ বসিয়ে নিয়ে এসেছে, এপোলো হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে। বাড়ির ডাক্তার, পাড়ার ডাক্তার, পাড়ার নার্সিংহোম, কাছের হাসপাতাল- সব ফেল, ধরতেই পারেনা কি হয়েছে ! অতএব শেষ ভারসা এপোলো। যথা সময়ে ডাক পড়ল। হুইল চেয়ার সমেত ওরা ভিতরে গেল। খুব ভালো করে চেকআপ করলে ডাক্তার। তারপর বসলেন পুরনো সব কাগজপত্র, MRI রিপোর্ট, x-ray রিপোর্ট নিয়ে। ভাল করে দেখে বললেন, ..."আপনি বাইরে বসুন, আমি এদের বুঝিয়ে দি কি কি করতে হবে, কেমন ?" ... তারপর ছেলেটিকে বললেন, “মাকে বাইরে বসিয়ে আবার এসো , কথা আছে। " 


ছেলে মা-র হুইলচেয়ার ঠেলে, মাকে বাইরে জায়গা মত বসিয়ে ফিরে এল। 


মুহূর্তে রাগে ফেটে পড়লেন ডাক্তার, ... "বাড়িতে যে এই মহিলা থাকেন জানেন আপনারা বাপ-ছেলে ? জানেন ওনার কি চাওয়া ? কি অনুভব ?" 


বাপ-ছেলে হতভম্ব, ডাক্তারের হঠাৎ রাগের মানেই বোঝেনা ! এ-ওর মুখ দেখে অবাক হয়ে। 


আবার মুখ খুলে রাগত স্বরে ডাক্তার বলেন ..."ওনার কিচ্ছু হয়নি জানেন ?" 


...কিচ্ছু হয়নি ? বাপ-ছেলে অবাক। ..."হয়নি ? মানে?"... 


"আর মানে" বিরক্তি ডাক্তারের ..."মানে উনি সম্পূর্ণ সুস্থ। ওনার কোনো অসুখ নেই, সব ঠিক আছে"... 


বাপ ছেলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ... "তাহলে এত ব্যাথা ?"... 


সব মানসিক, ঝটিতি জবাব ডাক্তারের,... "মানসিক ?"... 


আরো অবাক প্রশ্ন,... "কেন ?"... 


"কেন তার আমি কি জানি ? আপনাদের কাছে দাম পাননা, ভালবাসা পান না নিশ্চয়, তাই " ... 


"তার মানে ?" ... ছেলের আমতা আমতা প্রশ্ন, ... 


"মানে?" ... গর্জে ওঠেন ডাক্তার,... " মানে, তোমরা দেখোনা ওঁকে। মা কি খায়, কখন খায়, আদৌ খায় কিনা, জিগ্গেস করেছ কখনো? মার মনে কি আছে জানতে চেয়েছ ? বসেছ মা-র কাছে দুদন্ড, গল্প করেছ? নিজেকে নিয়েই তো মত্ত সবাই সারাদিন। আরেক জন মানুষ যে আছে, সে খেয়াল থাকে ?" .. .কথা থামিয়ে রাগে ফুলতে থাকেন, ... 


"না তা নয়, তবে কোনো অসুখ না থাকলে এত কষ্ট, হাঁটতে পারেনা, সেটা " ... হাল ধরার চেষ্টা করে বাবা। 


এবার ডাক্তারের রাগের ঝাপটা আছড়ে পড়ে বাপের উপরে, ... "আপনি কোনো কথা বলবেননা। চেয়ে দেখেছেন কখনো ঘরের মানুষটার দিকে? জানতে চেয়েছেন সে কি চায়, কি ভালবাসে ? ছেলেকে শিখিয়েছেন মাকে ভালবাসতে, মা-র মন বুঝতে ? আসল দোষীতো আপনি। সারা জীবন যে মানুষটা নিজেকে মুছে দিয়ে, শুধু আপনাদের খুশির কথা ভাবলেন, আপনাদের সুখের ব্যবস্থা করলেন, তার খোঁজ নিয়েছেন কোনদিন ?" একটু থামেন, তারপর ... "একদিন বাইরে নিয়ে গেছেন খাওয়াতে? সিনেমা দেখিয়েছেন ? কিনে দিয়েছেন কোনো শখের জিনিস ? ওনার কিচ্ছু হয়নি। আমার কোনো চিকিৎসার ওনার দরকার নেই। এই বয়সে এসে ওনার মন আর পারছেনা। চাইছে একটু যত্ন, একটু খেয়াল, আর অনেক ভালবাসা। ওটাই ওঁর চিকিৎসা। ওঁকে কিছু বলার দরকার নেই, আমি কালসিয়াম আর ভিটামিন লিখে দিচ্ছি, আর একটা সিম্পল MRI করতে দিচ্ছি। কিন্তু আসল দায়িত্ব আপনাদের। যদি পারেন ঠিক মত, উনি সেরে যাবেন, নইলে শুধু মনের অসুখে উনি শয্যাসায়ী হয়ে পড়বেন।" ... অনেক কথা বলে থামেন ডাক্তার। নিস্তব্ধ ঘর, বাপ-ছেলে লজ্জিত, দু:খিত, মাথা নিচু করে বসে থাকে স্তব্ধ হয়ে!

0 comments: