ছোটগল্প: ঈশানী রায়চৌধুরী হাজরা
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
দরজা খোলার পর
ঈশানী রায়চৌধুরী হাজরা
ইংল্যান্ডের উইন্ডসর শহর | এপ্রিলের শেষ | এক দম্পতি এসেছে বেড়াতে | প্রতিবার তারা এদিক সেদিক গেলে হোটেলে ওঠে | ঝামেলা কম | এবার এক্সপেরিমেন্ট করা যাক | ইচ্ছেমতো থাকার একটা আলাদা মজা আছে | ষ্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট | নিরিবিলি রাস্তা | এই বাড়িটার সামনে খোলা জায়গা খানিকটা | গাড়ি রাখার জন্য | মোট ছ'টা আস্তানা | সাদা রঙের বাড়ি | এদের পছন্দ করা ফ্ল্যাট একতলায় | মেয়েটি একতলায় থাকতে চেয়েছিল, কারণ বৈঠকখানার লাগোয়া একটা রুমালের মত লন আছে | তাতে কিছু ক্যাকটাস, আর তিনটে ঝাঁপালো বড় বড় ফুলগাছ | সাদা, হলুদ আর গোলাপী | লাল টুকটুকে ইঁটের পাঁচিল তোলা রাস্তার দিকে | দুটো সাদা রং করা রট আয়রনের চেয়ার আর মাঝে একটা টেবিল পাতা আছে বাগানে | মেয়েটি নেটে ছবি দেখেছিল |
চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার পর ...মেয়েটি যেই পা রাখল সরু করিডোর-এ, মনে হল কী ভীষণ চেনা সবকিছু | একটা বড় শোবার ঘর, পাশের ঘরে একচিলতে খাট আছে বটে ...কিন্তু স্টাডি বলাই ভালো | দুটো ঘরের মাঝে বাথরুম | করিডোর এরপর পৌঁছে দেয় বসার ঘরে আর লাগোয়া বাগানে | ঘর আর বাহির ... মাঝে একটা কাচের দরজা | এই ঘরের একপাশে খাবার টেবিল পাতা | রান্নাঘরে ....সব সরঞ্জাম আছে | বাজার কর, রান্না কর আর খাও | মেয়েটি কিছুই দোকানপাট চেনে না | বিকেল হয়ে এল | কিন্তু সে ঠিক চিনে নেবে সুপারমার্কেট | একা একা | আসলে দরজা খোলার পরই কোন মন্ত্রবলে সে মনে মনে জাদুগালিচায় চেপে পৌঁছে গেছে আমেরিকার সেই শহরে | যেখানে কিছুদিন এমনই অস্থায়ী সংসার পেতেছিল এক স্বপ্ন দেখা কমজোরি পকেটের বাঙালি কবি আর তার ঘুমোনোর মতো ভালোবাসা, তার বিহানবেলার আলো ..ফরাসি মেয়ে মার্গারিট | প্রেমিকা বলা উচিত ছিল কি ? নাহ | প্রেমিকা শব্দটিতে বন্ধনের হাঁসফাঁসানি লুকিয়ে আছে কোথাও | মার্গারিট তার আয়না আর আশ্রয় |
এই খেলাঘরের ঘরকন্নায় ক'টা দিন মেয়েটি মনে মনে একবার সেই বাঙালি কবির হাত ধরবে, আর একবার মার্গারিটের | তার বর ? এ ক'টা দিন জীবন্ত আসবাব হয়েই না হয় থাক ! মেয়েটি মনে মনে রঙিন সুতোয় পাকে পাকে জড়িয়ে নিক দুই মহাদেশকে | দরজা খোলার পর |
" দরজায় চাবি দিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায় | ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে | বেশ মোলায়েম | রাস্তায় আলো জ্বলে উঠলেও দিনের আলো মেলায়নি | ছবির মতো বাড়ি , গাড়ি , গ্যাসলাইন , টেলিফোন ...."
আইওয়া সিটি | এবং উইন্ডসর | মেয়েটি সুপারমার্কেটে আসে | এক আনাড়ি বাউন্ডুলে কবির হাত ধরে | (এবং যথার্রীতি ফেরার পথে রাস্তা গুলিয়ে ফেলে | কার সঙ্গে গেছে দেখতে হবে তো !)
এখানেও কংক্রিটের রাস্তা | এরা বলে কান্ট্রিসাইড | গ্রাম ? আইওয়া সিটিকেও তাই বলেছিল না ? " গ্রাম হবে জয়নগর মজিলপুর চম্পাহাটির মতো |"
মেয়েটির সঙ্গে শুধু কবি | সে কবির কথামতো কিনে ফেলে ডিম , সসেজ , ফল , রুটি | আর চাল |
কবি ফিসফিস করে বলে , "আলু পেঁয়াজ নুন মাখন | "
মেয়েটি কটমট করে তাকায় , "এত মাল বইবে কে ? ডোরি ? "
শক্ত কাগজের প্যাকেটে দুধ | একেবারে সটান খাবার মতো |
কবি কানে কানে বলে, " আমারও মন খারাপ হয়েছিল খুব | কখনো কোনো ভালো জিনিস খেলে কিংবা একটা ভালো বই পড়লে ইচ্ছে হয় অন্যদেরও তার ভাগ দিতে | একলা একলা কি কোনো জিনিস ভালো লাগে ? যাচ্ছেতাই !"
এ বাড়িতেও বইয়ের তাক আছে | শূন্য | মার্গারিট হতাশ হয়েছিল | মেয়েটি ব্যাগ হাতড়ে দুটো পেপারব্যাক, তিনটে পত্রিকা আর একটা খবরের কাগজ বার করে | নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো |
চাল কিনে আনা হয়েছে |
মেয়েটি কবিকে বলে , " আমি ভাত রান্না করতে পারি |"
কবি মুচকি হাসে , "আলু পেঁয়াজ ভাজা ?"
মেয়েটি নুনের প্যাকেট খোলে , " ভুল হয় না আমার |"
মেয়েটি ডিম ভাজে মন দিয়ে |
কবি বলে , " খিচুড়ি হলে..."
মেয়েটি মুখ ঝামটা দেয় , " ওই সব বায়না ছাড়ো | তারপর তো রাতে খিচুড়ি আর পরের দিন ফ্রিজে রেখে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নোনতা কেক !"
এইরকম বাড়িতে থাকলে কবিতা পড়তে হয় | মার্গারিট শিখিয়েছিল আপোলিনেয়ারের কবিতা ....মেয়েটি নেট খোলে |
Vienne la nuit sonne l'heure
Les jours s'en vont je demeure
"ফরাসী কবি যা বলতে চান...যদি তা আমি নিজের মতো করে বলি ? তাতে কি ভালোবাসার রং বদলে যায় ? "
মেয়েটি আনমনা |
রাত এসে হাত রাখে দিন ফুরনোর জানালায়
মুহূর্তসুখ যত চেনা নদীজলে ভেসে যায়...
এখানেই বাউন্ডুলে কবি জেনেছিল ...মার্গারিটের সান্নিধ্যে ...." ভালোবাসা সেই সুন্দর ফিনিক্স পাখির মতো , এক সন্ধেবেলা তার মৃত্যু হলে পরের সকালটিই তার পুনর্জন্ম দেখে..."
মেয়েটি মনে মনেই না হয় ... আজ...এবং এই ক'টা দিন...
তার মন প্রসারিত হয়ে শরীর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল এক নিমেষেই | সে শব্দগুলিকে চোখে দেখছে আর দেখছে মার্গারিটের রূপ ...যেন গানের মতন |
জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় সে | দেশ কত দূরে ? উইন্ডসর থেকে ? আইওয়া সিটি থেকে ?
মেয়েটি পৌঁছে যাচ্ছিল ভালোবাসার সেই সব - পেয়েছির দেশে ...যেখানে " ব্যাপারটা যেন শুধু লোভ হয়ে না যায় | সব সময়েই খাঁটি আনন্দ থাকে | লোভহীন আনন্দ | ঝরনার জলের মতো নির্মল | "
এই বাড়ির টেবিলেও ড্রয়ার আছে | কিন্তু খালি | সে তার হাতব্যাগ উপুড় করে দেয় | পাউন্ড , শিলিং , পেন্স | ডলার | আলাদা | অথচ এক | এগুলো এখানেই থাক | দু'দিনের খেলাঘরে | ওদের দু'জনের যেমন থাকত |
এই বাড়িতেও মার্গারিট মিশে আছে | অবয়বহীন |
" ঈষৎ উঁচু করা চিবুক , বুকের ওপর এসে পড়া নীলাভ আলো , কাছাকাছি অন্ধকার ...এ যেন অলৌকিক এক দৃশ্য | চোখ ভ'রে যায় , কাছে বসে থাকতে ইচ্ছে হয় | ভালোবাসার মধ্যে কতখানি যে মায়া ! এই দেবোপম শরীর দেখেও তো ঠিক লোভ হয় না ! মনে হয় একটা পাহাড়ে লুকোনো ঝর্ণা | এখানে নিরালায় অবগাহন করি |"
তিনদিন | পাঁচদিন | সাতদিন | মেয়েটি ছিল মনে মনে | ওদের দু'জনের সঙ্গে |
ফিরে আসার সময় এল | দরজায় ইয়েল লক টেনে মেয়েটি চোখ রাখল আকাশে |
" মার্গারিট , আমি যাচ্ছি | তুমি তাকাবে না আমার দিকে ? কবি তুমি ? হাত ধরে রাস্তা পার করে দেবে না আমায় ? "
বাতাস ফিসফিস করে বলল , "আছি |"
ফিরে আসতে আসতে মেয়েটি ভাবছিল , কখনো মার্গারিট , কখনো নীরা , কখনো বন্দনাদি , রেণু , তুতুল বা মধুবন ...তাকে এভাবেই ডাক দিয়ে যায় ...দেশে ও বিদেশে .. নির্জন রাতের প্ল্যাটফর্মে, , ভরা হলঘরে , বাসস্টপে অথবা অচেনা রাস্তায় ...যখন খুব হাওয়া বয় আর ঝুরঝুরিয়ে শুকনো পাতা আর কুচো ফুল বিছিয়ে থাকে কালো পীচের রাস্তায় |
মনে মনে এই আজন্ম বাউন্ডুলে কবির যত নীরা আর নারী ...তাদের
"চোখের জলে ঝলসে ওঠে
শিল্পের কিরণ
যে শিল্প মধুর কিন্তু ব্যক্তিগত...''
এইসব নারীদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই দেখা হয় , কথা হয়...বুকের গভীরে | অসহ্য আর্তিতে এদের কাছেই বারবার জানু পেতে বসা ...
" যমুনা, আমার হাত ধরো ! স্বর্গে যাব,
এস, মুখে রাখো মুখ, চোখে চোখ, শরীরে শরীর
নবীনা পাতার মতো শুদ্ধরূপ , এসো
স্বর্গ খুব দূরে নয়...."
এরা থাকে আয়নায় , এরা থাকে চোখের তারায় ...তবু কবি....নিয়তি পার করে লিখেই যায়...লিখেই যায়...
দুরন্ত অভিমানে সে লেখে ....
" বিচ্ছেদের কথা মনে পড়ে
খুঁড়ে তোলা মাটি থেকে জমে ওঠে নিকৃষ্ট পাহাড়
চোখের সম্মুখে তুমি দাঁড়ালেও স্বচ্ছ বাতাসের ব্যবধান
আমার এমনই রাগ , আমি সেই স্বচ্ছতাকে শত্রু বলে ভাবি !"
জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে পুড়তে সেই ভালোবাসার গ্রীবায় ঠোঁট ছোঁয়ায় নির্জন তাপস এক ... আর বলে ,
" এ রকম পূজা হয়, দেখো ত্রিশিরা ছায়ায় কাঁপে ইহকাল
এমন ছায়ার মধ্যে রূপ তুমি, রূপের কঠিন ঋণ বিশাল মেখলা
আমি ঋণী , আমি ক্রীতদাস নই, আরাধনা মন্ত্রে আমি
তোমাকে সম্পূর্ণ করে যাবো |"
ঈশানী রায়চৌধুরী হাজরা –র ‘দরজা খোলার পর’ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে লেখা একটি মুক্তগদ্য। অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি বশতঃ সেটি ছোটগল্প বিভাগে প্রকাশিত হওয়ায় আমরা আন্তরিক দুঃখিত। এমতবস্থায় পাঠকের ক্ষমাশীলতাই একমাত্র ভরসা।
ReplyDeleteonnorokom lekha bhalo laglo
ReplyDelete