সম্পাদকীয়
Posted in সম্পাদকীয়
অতিথি সম্পাদকের কলমে
দেবাশিস কাঞ্জিলাল
ঋতবাকের সম্পাদিকা তাঁর এই পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় আমাকে একটি সম্পাদকীয় লিখে দেবার দাবী জানিয়েছেন।
আমি প্রধানত একজন পাঠক, সামান্য যা একটু লেখালিখি করার সকুন্ঠ প্রয়াস করি তাতে অতিথি-সম্পাদকের গুরু-দায়িত্ব বহনের যোগ্যতা আমার আছে কি না তা নিয়ে আমি নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান।
তবু স্নেহের দাবী এড়ানো কঠিণ বড়ো! তাই কিছু মনের কথাই এখানে বলে যাই, জানি না এখানে ধান ভানার বদলে শিবের গীত গেয়ে গেলাম কিনা ।
আজকাল সে ছাপা-পত্রিকা হোক বা অন্তর্জাল-পত্রিকাই হোক, সেখানে বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকার বেশ অভাব দেখি। অধিকাংশই সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা ধরণের পত্রিকা, সেখানে রান্না-বান্না, সাজন-গোজন, অসুখের দাওয়াই-বর্ণনা, সিনেমা-থিয়েটারের নটনটীদের প্রচ্ছন্ন বিজ্ঞাপন সহ আরো কত-শত-কিছু সাহিত্যকে সরিয়ে সুয়োরানী হয়ে বসে থাকে ।
যাঁরা পত্রিকা-ব্যবসায়ী তাঁদের এই প্রয়াসের ব্যখ্যা পাওয়া যায়, তাঁরা সব ধরনের লোকের কাছে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে তাঁদের লাভের কড়ি বাড়িয়ে নিতে চান । কিন্তু অন্তর্জাল-পত্রিকা তো এখনও সেই অর্থে ব্যবসায়িক হয়ে ওঠে নি । তবে তার সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা হবার কারণ কি ?
আমার ধারণা, অন্তর্জাল-পত্রিকা এখনো তেমন ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে নি নানান কারণে। প্রথমত, লোকে এখনও ছাপা লেখা পড়তে বেশি স্বচ্ছন্দ । আসলে ছাপা লেখার সাথে যে আত্মীয়তা আমাদের বহু যুগ ধরে গড়ে উঠেছে তা পরিবর্তন করা দুরূহ এখনো বেশ। ফলে নেট-পত্রিকার পাঠক সংখ্যা তুলনায় বেশ কম এখনো।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই পত্রিকার পাঠক তুলনায় কম, তাই এখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা লেখা দিতে ততটা আগ্রহী নন । তবু কিছু ভালো লেখকেরা যাঁরা এখনো ততটা নামী হয়ে ওঠেন নি, প্রধানত তাঁরাই লেখা দিয়ে সম্বৃদ্ধ করেন বিভিন্ন নেট-পত্রিকাকে ।
তৃতীয়ত, সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা করতে পারলে তা বেশী লোকে খাবে, সেই আশা নিয়েও বহু নেট-পত্রিকা বাঁচার চেষ্টা করে।
কিন্তু সেক্ষেত্রে এই নেট-পত্রিকা নিজেকে বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা দাবী করার অধিকার হারায়। সৌভাগ্যের বিষয় অল্প হলেও কিছু পত্রিকা বেশ কিছুদিন ধরে নিজেদের সাহিত্য-পত্রিকা বলে দাবী করার যোগ্যতা বজায় রেখে চলেছে । অন্তর্জাল-সাহিত্য-পাঠকেরা তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকিবহাল। তাই তাদের নামোল্লেখ থেকে এখানে বিরত রইলাম। যদি কোন পাঠক তাদের নাম জানতে চান, তবে আমাকে জানালে সেই সব পত্রিকার নাম পাঠানো যাবে ।
সদ্যোজাত এই ঋতবাক পত্রিকাটির জন্মলগ্নে আমি যতদূর জানি, সম্পাদিকা তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের সাথে আলোচনা-সাপেক্ষে স্থির করেছিলেন, এই পত্রিকা একটি সম্পূর্ণ সাহিত্য-পত্রিকাই থাকবে, সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা হবে না । আশা করি, তিনি তাঁর সেই শুভ প্রয়াস আপোষহীন ভাবেই জারী রাখবেন এবং লেখার সংখ্যার চেয়ে মানের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখবেন ।
সেই উৎকর্ষতা বজায় রাখতে যদি একটিমাত্র লেখা দিয়েও কোন সংখ্যা প্রকাশ করতে হয়, তিনি তাই করবেন, যা পত্রিকাটিকে একটি বিশেষ পাঠক-বৃত্তের কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয় করে তুলবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আরেকটি ছন্নচিন্তা মাথায় এলো শরৎচন্দ্রের একটি লেখার কথা মনে পড়ে । চিরকাল সাহিত্যে সমাজের যে প্রতিফলন ঘটে তা কিন্তু শুধুমাত্র সমাজের সব আঙ্গিনার ভালোমন্দ দুঃখ-সুখের ফটো মাত্র নয়, তা লেখকের মননে জারিত করে সামাজিক উত্তরণের পথনির্দেশের আঁকা ছবি।
আজকাল এমন আঁকা ছবি সংখ্যায় ক্রমশঃ ক্ষীয়মাণ। শুধু নর্দমার ফটো যথাযথ বাড়ছে । তা স্বার্থসংশ্লিষ্টদের আর্থিক উপঢৌকনের বিনিময়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনা-মননকে নষ্ট করে, মেরুদন্ডহীন করে দিয়ে যে সামাজিক অবক্ষয়ে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ।
এই অশুভ প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে লেখকেরা আরো বেশি করে সমাজমুখী লেখা লিখলেই তা সম্ভব, যে লেখা মানুষকে স্বার্থপরতা থেকে বিমুখ করে পরার্থপর হতে শেখাবে । প্রতিটি মানুষকে একটি মহাদেশের অংশ হতে শেখাবে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হতে নয় !
আর এইখানেই ঋতবাক অনেক কিছু করতে পারে। তার লেখক ও পাঠককুলকে নিয়ে নিয়মিত আলোচনা-সভা, মত-বিনিময়, বিষয়-কেন্দ্রীক আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তাই ঋতবাক শুধুমাত্র একটি পত্রিকা না থেকে নিজেকে একটি সাহিত্য-আন্দোলনে পরিণত করুক, এই কামনা নিয়েই আমার এই লেখনীকে স্তব্ধ হতে বললাম।
- অলমিতি
0 comments: