0

ছোটগল্প: মৌসুমী দাস

Posted in




ছোটগল্প




তেতো স্বাদ 
মৌসুমী দাস 



দু ঘণ্টা দশ মিনিট লেটে ট্রেনটা স্টেশনে এসে পৌঁছল । ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে দশ। ব্যাগ পত্র নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালো রজতাভ। এই রাতের অন্ধকারেও সে বেশ বুঝতে পারছে, যে আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে কোন সময় ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। তাড়াতাড়ি স্ট্যান্ড থেকে বাইকটা ছাড়িয়ে নিয়ে রওনা দিল। যাতে বৃষ্টি শুরুর আগেই বাড়ি পৌঁছে যেতে পারে। আজ আবার রেইন কোটটা সঙ্গে করে আনতে ভুলে গেছে। বেরুনোর সময় যা হুড়োহুড়ি করতে হয়! আর ওর তিন বছরের মেয়ে তিতলি যা বাপের নেওটা হয়েছে! বাবাকে পেলে ওর আর কিছু চাইনা। কিছুতেই মেয়ের চোখের সামনে দিয়ে বেরুতে পারে না রজতাভ। আর বাইক নিয়ে বেরুলে তো কথাই নেই, ওকে একবার চড়াতেই হবে বাইকে। আর সকালবেলা অফিস বেরুনোর সময় তো এ সব আবদার মেটানো সম্ভবই না। 


রজতাভের বাড়ি থেকে স্টেশন প্রায় ৫ কিমির মত হবে। এই পথটা ও বাইকেই আসে। তারপর স্টেশনের বাইক জমা রাখার স্ট্যান্ডে বাইকটা জমা রেখে ও সকাল আট টার ট্রেন ধরে হরিশ্চন্দ্রপুর যায়। ওখানে একটা গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি করে সে। ব্যাংকে স্টাফ খুব কম। ওরা যে কজন আছে, তাদের ওপরই কাজের চাপটা বেশি। প্রায় প্রতিদিনই সমস্ত কাজ গুছিয়ে বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যা ছয় টা বা সাড়ে ছয়টা বেজে যায়। তাই বাড়ি ফেরার জন্য সন্ধ্যে সাতটার ট্রেন ধরে সে। নটার মধ্যে স্টেশন পৌঁছে, সাড়ে নয়টায় বাড়ি ঢুকে যায়।আজ প্রায় দুঘণ্টা লেটে এসেছে ট্রেনটা। প্রচণ্ড ঘামে আর গুমোট গরমে এক বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। 


আকাশে ঘন মেঘ দেখে সন্ধ্যে বেলা রজতাভের স্ত্রী নূপুর, রজতাভকে ফোন করে বলেছিল, আজ রাতের মেনু হবে খিচুরি আর ডিম ভাজা। নূপুর খিচুরি খেতে খুব ভালবাসে, তাই সুযোগ পেলেই নানা অছিলায় খিচুরি রাঁধবেই রাঁধবে। আর বৃষ্টি বাদলের দিন হলে তো কথাই নেই। রজতাভ খুব একটা পছন্দ না করলেও খিচুড়িতে আপত্তি করে না। যাক সন্ধ্যা বেলা নূপুরের ফোনে রাতের মেনু জেনে ভেবেছিল, বাড়ি ফিরে গরম গরম খিচুরি খাবে। তা ফিরতে এত দেরি হল যে মেজাজটাই চটকে গেল। এখন বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে খেয়ে শুতে শুতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে যেতে পারে। রোজকার মত আবার কাল সকালে আঁটটায় ট্রেন ধরতে হবে। বিরক্ত লাগছে রজতাভর। রোজকার এই একঘেয়েমি ভাল লাগছে না আর। দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে কোথাও যে একটু ঘুরে আসবে তার ও উপায় নেই। কারণ অফিসে স্টাফ কম । 


বাইকটা নিয়ে কিছুদূর এগোতেই প্রথমে ঝির ঝির তারপর ঝমঝম করে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মহা জ্বালা! এইরকম বৃষ্টিতে তো এগোনোও যাবে না! আর এই বৃষ্টিতে ভিজলে তো অবধারিত জ্বর। এইসময় আবার ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যাথা লেগেই আছে। তাছাড়া রজতাভর আবার বৃষ্টিতে ভিজলে মাথা যন্ত্রণা হয়। কাজেই কোথাও দাঁড়াতে হবে। স্টেশন রোড সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি ঘুপচি দোকানঘর আছে। এত রাতে কিছু দোকান বন্ধ, কিছু দোকান খোলা রয়েছে। রজতাভ একটি বন্ধ দোকানের সামনে বাইকটা রেখে, টিনের চালার তলায় দাঁড়ালো। কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট এসে প্রায় সারা শরীর ভিজিয়ে দিতে লাগল। কেবল মাথাটা ভেজার হাত থেকে রক্ষা পেল। রাস্তা ঘাটে একেবারে লোকজন নেই বলা চলে। মাঝে মধ্যে দু একটা সাইকেল আরোহী, বা বাইক আরোহী খুব জোরে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। দু তিনটা চার চাকা গাড়িও হুস করে বেরিয়ে গেল। পাশের বন্ধ দোকানের চালার নিচে তিনটা কুকুর গুড়িসুড়ি মেরে শুয়ে আছে। পথবাতি গুলো সব জ্বলছে। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য আলোগুলো ঝাপসা হয়ে আছে। পরিষ্কার করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। দু একটা চায়ের দোকান খোলা আছে। খদ্দেরও আছে ভেতরে পর্দার পাশে। আসলে এরা খদ্দের বেশে এলাকার উঠতি সমাজ বিরোধী। এলাকার সবাই জানলেও বাইরের সাধারন মানুষ মনে করে এইটা বুঝি চায়ের দোকান। আসলে সাধারণ মানুষকে চা বিক্রি করলেও, কিছু বাঁধা খদ্দের আছে তাদের চায়ের গ্লাসে করে দেশি মদ বা তারি বিক্রি করে। আর এই খদ্দেররা হল এলাকার উঠতি সমাজ বিরোধী। পুলিশ এসব ব্যাপার সব জানে। কিন্তু মাসে মাসে মোটা টাকা পায় বলে কিছু বলে না। অনেকবার এলাকাবাসীর আবেদনে পুলিশ এসে দোকান গুলি বন্ধ করে গেছে। কিন্তু সব লোক দেখানো ব্যাপার। পুলিশ চলে গেলে আবার কিছুদিন পর দোকান খুলে রমরমা ব্যবসা চলে। দিনের বেলা এই এলাকাটা জমজমাট থাকে, কিন্তু সন্ধ্যার পর সমাজবিরোধীদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। তখন কোনও মেয়ে বউ ওই পথ দিয়ে যেতে ভয় পায়। যদি বা প্রয়োজনে ঐ পথ দিয়ে যায়, মাতাল গুলো টিটকিরি দেয়। অশ্লীল কথা বার্তা ছুঁড়ে দেয়। 


উফ! দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। বৃষ্টি থামার কোনও নাম নেই। টেনশন শুরু হল রজতাভর। বুক পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। নূপুর ফোন করেছে, কি গো, কোথায় তুমি? 


- এই ত দেখো না দাঁড়িয়ে আছি একটা দোকানের নিচে। 


- এই বৃষ্টি কমবে বলে ত মনে হয় না। তুমি একটু কষ্ট করে চলেই এস না। অনেক রাত হয়ে গেল যে। তিতলি এখনও তোমার জন্য জেগে বসে আছে।


- আরে বৃষ্টি যে খুব জোরে পড়ছে। ভিজে যাব যে! তিতলি সোনাকে শুয়ে পড়তে বল। আমি আর একটু দেখেই রওনা দিচ্ছি। 


- দেখ রাত যে অনেক হয়ে গেল, তুমি আর দেরি না করে মাথাটা ভাল করে বেঁধে চলে এস। বাড়ি এসে ভাল জলে স্নান করে নিও। 


- মাথা কি দিয়ে বাধবো, রুমাল দিয়ে বাঁধলে ত সেই একই ব্যপার। 


- টিফিন বক্স আর জলের বোতল বড় পলিপ্যাক দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলাম দেখ, সেই পলিপ্যাকটা ভাল করে মাথায় বেঁধে নাও, আর বেরিয়ে পড়।


- আচ্ছা দেখছি।


তিতলির জন্য মনটা কেমন করে উঠল। এই মেয়েটা বাবাকে এত ভালবাসা দিয়ে আঁকড়ে রাখে! রজতাভ ওকে সেভাবে সময় দিতেই পারে না। কিন্তু যতটুকু সময় কাছে পায় ততটুকু সময়ই তিতলিকে উজাড় করে দিতে চায়। খুব ভাবনাও হয় ওর জন্য। যা দিনকাল পড়েছে, যৌন হেনস্থার হাত থেকে ছোট শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না এখন। এই ঘুণধরা সমাজে কি ভাবে তিতলিকে সুস্থভাবে মানুষ করবে?-এই ভাবনা ভাবায় সবসময়। চা এর দোকানে তিন চার জন বসে বসে চা রূপি তারি সেবন করছিল, আর রজতাভর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করছিল। রজতাভর বেশ ভয় ভয় করছে। নির্জন রাস্তা, কেউ আশেপাশে নেই। ওর হাতে দুটো সোনার আংটি, হাতঘড়ি, পার্স ব্যাগ, মোবাইল রয়েছে। এখন যদি সেই মাতালগুলো এসে এসব কেড়ে নেয় ! বা যদি প্রমান লোপাট করতে এসব কেড়ে নেওয়ার পর ওকে মেরে ফেলে!আর বেশি ভাবতে চায় না রজতাভ। এখুনি রওনা দিতে হবে। ভাল করে পলিপ্যাকটা মাথায় বেঁধে নিয়ে বাইকটা স্টার্ট দিল। 


এমন সময়, -বাবু কিছু খাবার থাকে তো দাও না। রজতাভ ঘুরে তাকিয়ে দেখে এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক। এত রাতে কোত্থেকে এল? তেমন ভেজেওনি। বিরক্তি নিয়ে বলল, এই বৃষ্টিতে তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?


- ওই দোকানের চালের নিচে শুয়ে ছিলাম বাবু। কিছু খাবার যদি দেন তো, বড় ভাল হয় বাবু, এই বৃষ্টিতে কোথায় বা যাবো।...


বিদ্যুৎ চমকে রজতাভ দেখল বুড়িকে। ৬৫ বা ৭০ বছর বয়স হবে হয়ত। শীর্ণ দেহ, মায়ামাখা মুখ খানি দেখে মায়া হল রজতাভর। এই বৃদ্ধাও তো কারো মা বা দিদিমা। যখন শরীর সচল ছিল, তখন কত না করেছেন সংসারের জন্য, সন্তানদের জন্য। আর আজ যখন সে অচল হয়েছে, তখন তাকে দু বেলা দু মুঠো ভাত দেবার কেউ নেই। নিজের পেট টা চালানোর জন্য বৃদ্ধাকে পথে বেরুতে হয়েছে, লোকের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। মনে পরে গেল, আজ অফিসে সেনদা, ওনার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিঙয়ে ভাল ফল করেছে, সেই আনন্দে সবাইকে খাওয়ার জন্য বেশ বড় মিষ্টির প্যাকেট দিয়েছিলেন। রজতাভ মিষ্টি পছন্দ করে না, তাই শুধু চপ টা খেয়ে মিষ্টি সহ বাকি প্যাকেটটা ব্যাগেই রেখে দিয়েছিল। সেইটা বের করে বৃদ্ধাকে দিল, আর সঙ্গে দশ টা টাকাও দিল। 


আর দেরি করা ঠিক হবে না দেখে রজতাভ বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে রাতে ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে শুতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। পরদিন সকাল ছয়টার ঘড়িতে বেল দেওয়া ছিল, তবু বিছানায় এপাশ ওপাশ করে বেশ কিছুক্ষণ কাঁটালো রজতাভ। পাশে তিতলি ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত তিতলিকে একটু আদর করল। নূপুর উঠে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এই সকালবেলাটা ওর খুব চাপ । রান্না সারা, রজতাভর টিফিন, জলের ব্যাগ গোছানো, কাজের লোককে দিয়ে দেখে শুনে কাজটা এগোনো ইত্যাদি ইত্যাদি। এরই মধ্যে নূপুর চা করে এনে রজতাভকে ডেকে তুলল। রজতাভ নূপুরকে টিভিতে লোকাল চ্যানেলটা চালিয়ে দিতে বলল। কারণ আজ দেব বাবুর মেয়ে তুহিনার গান আছে ওই চ্যানেলে। দেব বাবু বিশেষ অনুরোধ করেছেন মেয়ের গান শোনার জন্য। তুহিনাও খুব সুন্দর গাইছে আজকাল। নূপুর টি ভি চালিয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল। রজতাভ চা খেতে খেতে গান শুনতে লাগল আর গানের ফাঁকে ফাঁকে ব্রেকিং নিউজের হেড লাইনে চোখ বোলাতে লাগল। 


তুহিনা গাইছে, “সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে”। মনটা ভরে গেল। এত টুকু বাচ্চা মেয়ের গলায় কী দরদ! হঠাৎ সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে রজতাভর! গা গোলাচ্ছে, মাথাটা বড় ঝিমঝিম করছে রজতাভর! একটা খবরের লাইনে চোখ আটকে গেছে যে! খবরটা ছিল “গতকাল রাতে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এক পথচারী বৃদ্ধার রক্তাক্ত, বিবস্ত্র মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মাথায় কিছু ভারি জিনিস দিয়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। সম্ভবত ঐ বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।“ রজতাভর চোখের সামনে যেন বৃদ্ধার সেই করুণ মুখটা ভেসে উঠল, “বাবু কিছু খাবার থাকে তো দাও না!” রজতাভর সামনে ঘটনার দৃশ্যপট গুলি যেন একে একে পরিবর্তিত হতে লাগল। রজতাভ বুড়িকে খাবারের প্যাকেট আর দশ টাকা দিয়ে বাইকে চলে আসা ......মুষলধারে বৃষ্টির মাঝে একাকী বুড়ি দোকানের চালার নিচে আশ্রয় ...... উল্টো দিকের দোকানে জনা কয়েক দুষ্কৃতির মদ্যপান......... আর তার পর রাত আর একটু বাড়লে উন্মত্ত পশুগুলো অসহায়, অবলা দিদার বয়সী এক নিরাশ্রয় বৃদ্ধাকে......উফ!! আর ভাবতে পারছে না রজতাভ। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতে লাগল! কিন্তু সে ই বা আর কি করতে পারত? ওখানে থেকে বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত বুড়িকে কি পাহারা দিতে হত? না কি বাড়ি নিয়ে আসা উচিত ছিল? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তাছাড়া পথেঘাটে এমন ত কতই পথচারী ভিক্ষুক দেখা যায়! খুব জোর দু চারটা খুচরো পয়সা ছুঁড়ে দেয় তাদের। ঘুরে তাকানোর অবকাশ নেই কারো। আর যেখানে সরকারও এ ব্যাপারে উদাসীন সেখানে সাধারন মানুষ কি বা করবে? রজতাভ ভাবল, যদি ঐ মদের দোকানগুলো না থাকত তাহলে কি আজ বুড়িকে এভাবে প্রাণ দিতে হত? কিছু ভাবতে পারছে না আর! চা টাও যেন তেতো লাগছে কেমন! শুধু কাঁপা কাঁপা দুহাত দিয়ে তিতলিকে বুকে জড়িয়ে ধরল রজতাভ।

0 comments: