0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতীম মল্লিক

Posted in




পেরুতে বেড়ুবেড়ু [ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী- পর্ব ৪]
দীপ্ত প্রতীম মল্লিক

পুনো, কুজকো

পুনো হচ্ছে প্রায় ৩০০ কিমি দূর আরুকিপার থেকে। কিন্তু দূরত্ব এখানে অন্তরায় নয়, অন্তরায় হচ্ছে উচ্চতা। আরুকিপার উচ্চতা ছিলো আট হাযার ফুটের তলায়, সেখানে পুনো হচ্ছে ১২৭০০ ফুট উচ্চ্তায়। শুধু কি তাই? মাঝে পার হতে হবে ১৫০০০ ফুটের একটি পাস। অতএব চিন্তা ছিলো উচ্চতা-জনিত কোনও বিপদের সম্মুখীন না হই। পেরু হপ বাস আসার কথা ছিলো সকাল ৫-১৫তে। কিন্তু বাস এলো খানিক পরে। ফলে জলখাবার খাওয়ার যে বিরতি ছিলো সেটা হলো কাটছাঁট। দশ মিনিট একটা সুপার মার্কেটের সামনে বাস দাঁড়াতে ওখান থেকে কিছু খাবার ও জল কেনা হলো। জল নাকি এ পথে অতি প্রয়োজনীয়। উচ্চতার সঙ্গে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে জল।

বাস উঠতে শুরু করলো। উঠছে তো উঠছেই। পথের দু পাশে ন্যাড়া পাহাড়। গাছপালা প্রায় নেই। ঠাণ্ডা, বরফ পড়া ও উচ্চতা হয়ত বা এই তিন কারণে এখানে সব পাহাড় ন্যাড়া। অবশেষে বেলা দশটায় বাস থামলো একটি শৃঙ্গর কাছে। গাইড জানালেন এখানে প্রচুর লেগুন আছে। বাস থেকে নেমে এগুতে গিয়ে দেখি কি বিপদ! পা যেন এগুতেই পারছি না! বিরাট বিরাট শ্বাস নিচ্ছি, কিন্তু তাতেও যেন হচ্ছে না- কোথায় যেন অসুবিধা হচ্ছে। আমার একার নয়, সবারই এক অবস্থা। বুঝলাম এ হচ্ছে উচ্চতা-জনিত অসুবিধা। অতএব সাবধান - ধীর পদক্ষেপে চলো আর কোনও তাড়াহুড়া নয়। শ খানেক মিটার এগিয়ে ছিলো লেগুনের ভিউ পয়েন্ট। প্রায় পাঁচশো ফুট নীচে বিরাট লেক। গ্লেসিয়ার আর বৃষ্টির জল এর উৎস। অজস্র পাখী, কেউ বা লেকের জলে চক্কর কাটছে, আবার অনেকেই নিছকই উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রাণভরে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এবার ফিরে যাওয়া। ঐ একশো মিটার যেন কয়েক কিলোমিটার ! লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে বাসে ফিরে এলাম।

বাস আবার চলা শুরু করলো। ক্রমে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বারবার জল খাচ্ছি, বুঝতে পারছি অক্সিজেনের অভাব শরীর মেনে নিতে পারছে না। বাইরে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে শরীরের কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছি। এইভাবে কেটে গেলো কয়েক ঘন্টা। অবেশেষে বেলা একটায় গাইড ঘোষণা করলেন আমরা পুনোয় এসে গিয়েছি। পুনোতে বড়ো বাস ঢুকবে না, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা গাড়ী আছে।

আমাদের বুকিং ছিলো হোটেল তিয়েরা ভিভা পুনোতে। প্রচণ্ড সরু সরু পাথরে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে এলাম “প্লাজা দ্য আরমাস”। এর পিছনেই আমাদের হোটেল। চেক ইন করা গেলো। মালপত্র ওরা পৌঁছে দিলো। এখানে উচ্চতার জন্য লাগেজ হোটেলের লোকেরাই পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে। শুধু এখানে নয়, আরুকুপা থেকে কুজকো সব জায়গাতে এই নিয়ম মানতে দেখেছি। যেটা আমাদের- মানে সমতল এলাকার লোকেদের প্রভুত সাহায্য করেছে।

পুনোয় খাওয়াদাওয়ার পর ধীরে ধীরে মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো। মাথার যন্ত্রণা, শ্বাস নিয়ে মন ভরে না –প্রাণপণ শক্তিতে শ্বাস নিয়েও যেন মনে হচ্ছে কিসের অভাব। অভাবটা যে অক্সিজেনের সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছি। অতএব অলস ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকা। যেন মনে হচ্ছে প্রচণ্ড জ্বর হয়েছে - এমন কষ্ট আর যন্ত্রণা। ভেবেছিলাম, যে জন্য পুনোয় আসা – সেই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু লেক(যেখানে বোট চলে) একবার দর্শন করবো। ১২৫০০ ফুট ওপরে ১২০ মাইল লম্বা আর ৫০ মাইল চওড়া এই লেক পেরু ও বলিভিয়ার অংশ। কথিত যে প্রথম ইনকা সম্রাট মাংকো কাপাক এই লেক থেকেই উঠে আসেন। আরো কথিত যে যখন সোনার লোভে স্প্যানিশরা সোনার লোভে কুজকোর কোরিকাঞ্চা মন্দিরের সোনা লুটতে ব্যাস্ত, তখন পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যর অনেক সোনা এই হ্রদের জলে ফেলে দেওয়া হয় যাতে বিদেশীরা এর সন্ধান না পায়। মোদ্দা কথা প্রচুর রহস্যে ঘেরা এই হ্রদ দেখার প্রবল বাসনা থাকতেও শরীর করলো বিরোধিতা, অতএব আজ থাক, কাল দেখা যাবে। 

সারা রাত ছট ফট করতে করতে অবশেষে ভোরের দিকে ঘুম এলো।

১৫ই এপ্রিল ২০১৯- উরোস(UROS) ও তাকিলা(TAQUILE) দ্বীপ ভ্রমণ

সকালে উঠে বুঝলাম কষ্ট অনেক কম। এককাপ গরম চা খেয়ে মাথার কষ্টটা গেলো। আজ আমাদের সারাদিনের বোট ট্রিপ আছে- কাল ভাবছিলাম সেটা বোধহয় এ যাত্রা হলো না। কিন্তু আজ সকালে মনে হলো- হ্যাঁ ,পারবো। সকাল আটটা থেকে সারাদিনের বোট ট্রিপ। ফিরবো বিকাল পাঁচটা। আমাদের বোট ট্রিপ প্রথমে নিয়ে যাবে আধঘন্টার রাস্তা উরোস আইল্যান্ড। এক্ষেত্রে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে উরোস একটা জাতি, যারা বহু বছর আগে (হাজার বছর তো হবেই) আমাজনের দিক থেকে এখানে আসে ও লেক তিতিকাকার ধারে বসবাস শুরু করে। ৫০০ বছর আগে ইনকা রাজার আমলে এরা ধীরে ধীরে লেকের জলে দ্বীপ ভাবখানা এই যে আমরা কারুর অধীন নয়। লেকের জলে প্রচুর বড়ো বড়ো ঘাসের মতো গাছ জন্মায়, যার গোড়া খুব শক্ত ও জলে ভাসে। কয়েকটি উরোস পরিবার দিবারাত্র পরিশ্রম করে লেকের জলের ঐ ঘাসের জঙ্গল মাপমতো কাটে। ঐ রকম কয়েকটি জঙ্গল যেগুলো ৬০/৭০ ফুট লম্বা চওড়া সেগুলি একসঙ্গে জুড়ে ও তারপর তার ওপর আবার ফুট তিনেক ঐ ঘাস বিছিয়ে নিজেদের থাকার জায়গা বানায়। এক একটি দ্বীপে ঐরকম পাঁচ ছটি পরিবার যৌথভাবে থাকে। এক একটি দ্বীপের আয়ু পনেরো কুড়ি বছর। তার মধ্যে আবার নতুন দ্বীপ বানিয়ে ওরা অন্যত্র সরে যায়। এই দ্বীপ ভাসমান, তাই দ্বীপগুলো ভালোভাবে জলে খুঁটি পুঁতে আটকানো থাকে। উরোসদের যা কিছু সবই লেক তিতিকাকার থেকে। এই হলো উরোস জাতির ইতিহাস। উরোসরা এখন এখানে শ'খানেক দ্বীপ বানিয়ে থাকে- কাজেই তার একটা দেখবো- সে তো ভাগ্যের কথা।

আটটায় আমাদের বোট ছাড়লো। সব মিলে জনা ত্রিশ বিভিন্ন দেশের লোকজন। প্রধানত লাটিন আমেরিকার লোকই বেশী। আধঘন্টায় এলাম উরোসদের একটি দ্বীপে – শ খানেক ফুট লম্বা চওড়া।


এখানে শুনলাম উরোসরা কিভাবে দ্বীপ বানায়।



ওদের জীবন যাত্রা সম্বন্ধে একটা সম্যক আইডিয়া পেলাম। উরোসরা নৌকাও বানায় ঐ ঘাস দিয়ে। মিনিট কুড়ি উরোসদের বানানো নৌকায় নৌকাবিহার করা হলো। রঙ্গীন উরোস যেন আমাদের মনকেও রাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলো।





















উরোসের পর আবার আমাদের যাত্রা শুরু। এবার চলেছি তাকিলে দ্বীপে। তাকিলে এখান থেকে ৩০ কিমি। বোটের সময় লাগবে দেড়ঘন্টা। তা লাগুক, সেই ফাঁকে বরং তাকিলে সম্বন্ধে কিছু লেখা যাক।

তাকিলে আর একটি উপজাতি, যারা কুচুয়া ভাষায় কথা বলে- যে ভাষা ইনকা আমলের। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা আর দেড় কিলোমিটার চওড়া এই ছোট্ট দ্বীপে হাজার দুই উপজাতির লোক এখনো আছে। দ্বীপটি পাহাড়ী এবং ১৩৪০০ ফুট ওপরে এর সর্বোচ্চ্য অংশ।

বোটের ঠাণ্ডা হাওয়া যথেষ্ট আরাম লাগছিলো। শুনেছিলাম পুনোতে খুব ঠাণ্ডা হবে। রাত্রে ঠাণ্ডাও ছিলো, তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিলো ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। তাই এখানে এসেছিলাম সোয়টার, জ্যাকেট পরে। কিন্তু দেখা গেলো বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম লাগছে, অতএব জ্যাকেট খুলে হাতে নেওয়া।

বেলা বারোটা নাগাদ আমরা এলাম তাকিলে। গাইড বললেন মিনিট কুড়ি হেঁটে একটা আর্চ পড়বে, ওখানে দাঁড়াতে। উরোস দ্বীপে হাঁটাহাঁটি ছিলো না বলে কোনও কষ্ট অনুভব করিনি, কিন্তু এখানে কুড়ি মিনিট হাঁটা বেশ কষ্টর, বিশেষ করে যখন চড়াই উঠতে হচ্ছিলো। তবে কাল যেমন একদমই হাঁটতে পারছিলাম না, আজ দেখছি কষ্ট হলেও পারছি।





কুড়ি মিনিট হেঁটে এলাম একটা সমতল জায়গায়। এখানে তাকিলে জীবনযাপন ও ইতিহাসের সাথে পরিচিতির পর তাকিলেদের বানানো লাঞ্চ এলো। গরম কর্ন সূপ ও মাছ বা কিনোয়া অমলেট, সব্জী ও আলুভাজা।

খাওয়ার পর বসলো গান বাজনা ও নাচের আসর। তাকিলে ছেলেমেয়েরা নাচতে শুরু করার পর কেন জানি না আমায় পছন্দ করলো, ফলে ওদের সাথে হাত ধরে বেশ খানিকক্ষণ নাচতে হলো । ভালো লাগছিলো খুবই কিন্তু তেরো হাজার ফুট ওপরে নাচা সত্যিই শক্ত, নাচ শেষ হতে যেন বাঁচলাম।

এরপর গাইড নিয়ে চললেন পুরো দ্বীপ পরিভ্রমণে যারা ইচ্ছুক, তাঁদের নিয়ে। আমরা কয়েক জন ছাড়া অনেকেই গেলো। আমার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। এই তেরো হাজার ফুট ওপরে দু কিলোমিটার চড়াই ভাঙ্গার ক্ষমতা নেই। ফলে আমরা কজন ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলে এলাম বোটে।



বিকাল পাঁচটায় বোট ফিরে এলো পুনো- শরীর তখন সুস্থ আর মন রঙ্গীন।

১৬ই এপ্রিল ২০১৯ – কুজকোর পথে

পেরু হপের বাস ধরে চলেছি পুনো থেকে কুজকো। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা, বাস ছেড়েছে সকাল ১১টা। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন ভগবান উজার করে দিয়েছেন এই চারশো কিলোমিটার রাস্তায়। এখানে পাহাড় আর ন্যাড়া নয়, সবুজে সবুজ- মাঝে মাঝেই ভুট্টার ক্ষেত, রাখাল বালক বালিকারা ল্লামা চরাচ্ছে- সবমিলে বার বার মনে হচ্ছে ইনকা আমলের পেরুর কথা। একসময় এই “সোনার দেশের” সন্ধানেই স্পেন থেকে ফ্রানসিসকো পিজারো অভিযান চালিয়েছিলেন- অবশেষে তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় পিজারো পেয়েছিলেন সোনার দেশের সন্ধান। তখন ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা, সঙ্গে তাঁর হাজার হাজার অনুচর ও সৈন্য সামন্ত। কিন্তু পিজারো আতাহুয়ালপাকে নিমন্ত্রণ করে তাঁকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে, কামান দেগে আর অশ্বরোহী সৈন্যদল লাগিয়ে- দুশোর কম সৈন্য নিয়ে লাখ লাখ ইনকা সৈন্য আর প্রজাদের দিশেহারা করে একতরফা যুদ্ধ জিতে নেন। হয়তো বা আতাহুয়ালপা আর তাঁর ভাই হুইসকারের পারস্পরিক বিদ্বেষ খানিকটা সাহায্য করেছিলো পিজারোকে- না হলে কোনও প্রতিরোধ কেন এলো না ইনকা দলপতি বা প্রজাদের থেকে? শুধু তাই নয়, অজস্র সোনা( যার আজকের দাম ২০০০ লক্ষ পাউন্ড) ভেট দেওয়া সত্ত্বেও আতাহুয়ালপা মুক্তি তো পেলেনই না, উলটে তাঁকে মেরে তাঁর শরীর জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। অপরাধ? উনি ক্রীশ্চান হতে অপরাগ, তাই ওঁর মৃত্যুর পর শরীর মামি করতে দেওয়া হয়নি। যাকগে- সে সব হলো ইতিহাস- আর সেই ইতিহাস বারবার চোখে যেন জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে যত এগিয়ে চলেছি কুজকোর দিকে। একটা নদী আমাদের সঙ্গ নিয়েছে, আসছে অজস্র গাছপালা, কোথাও বা মাইলের পর মাইল ভুট্টার ক্ষেত। এভাবে তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে এসে গেলো মারাঙ্গানী- মাঝরাস্তায় একটি গ্রাম। এখানে একটি রেস্তোঁরাতে বুক করা বুফে লাঞ্চ খাওয়া হলো। মারাঙ্গানী দেখে মনে হলো এই সেই জায়গা যেখানে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া যায়। সবুজে মোড়া পাহাড়, নীল জলের হ্রদ- কি নেই?



অবশেষে আবার বাসের চলা শুরু ও সন্ধ্যা আটটায় বাস থেকে নেমে আমাদের হোটেলে প্রবেশ। হোটেলের নাম “এ্যান্টিগা সান ব্লাস”। হোটেলে বিছানার মধ্যে আবিষ্কার করলাম গরম হট ওয়াটার ব্যাগ। নরম বিছানা, গরম ঘর আর আরও গরম হট ব্যাগ নিয়ে আরামের নিদ্রা। উচ্চতা-জনিত অসুবিধা সব দূর হয়েছে কাজেই এক ঘুমে সকাল।

(চলবে)

0 comments: