2

গল্প - প্রতিভা সরকার

Posted in

মনের বাঘ
প্রতিভা সরকার


ট্রেণের জানালার বাইরে একটা অপরূপ সন্ধ্যার সন্ধ্যা হয়ে ওঠা দেখছিল রণ। নীলচে কালো মেঘের থোপার আড়ালে লুকোনো সূর্য, আবার খানিক বাদে তার বেরিয়ে আসা, ক্রমে কমলালেবু হয়ে লাইনের পাশের মোটা তারে ঝুলতে ঝুলতে ট্রেনের সঙ্গে খানিকটা ছোটা, এইসব দেখতে দেখতে রণ খেয়াল করেনি ছুটন্ত লাইনের পাশের গাছ, ঘরবাড়ি আগে কালো হয়ে গেল। পেছনের আকাশে তখনো কিন্তু ফিকে রঙ লেগে আছেই। ওপরে মোটা কালো লম্বা তার আর নীচে চকচকে লোহার পাত যেন আপনমনে কাটাকুটি খেলছে। এই ছুঁয়ে ফেলে পরস্পরকে, আবার এই সরে সরে যায়। 
মাঝে মাঝে এমন সুন্দর লাগছিলো, কাচের ওপাশে কমলা রঙে ভাসাভাসি গাছের মাথা, কোথাও নদীর সবুজ জল, মুগ্ধ হতে হতে রণ ভাবে সত্যি কি এসবের কোনো মানে আছে, কোনো সার্থকতা ? এসব মানে, এই রণ রক্ত সফলতার ? 

পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলে এরকম চিন্তা হয় সকলেরই, বিশেষত সেই পুরুষের যে কবিতার মনোযোগী পাঠক আর যার বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে সেতো আজ নয়, প্রায় পনের বছর আগে, তবু এতো টাটকা ক্ষত যেন পুঁজ রক্তে টাটিয়ে আছে। বাইরে জানালা জুড়ে অন্ধকার নামছে, ভেতরেও রণকে কী করে যেন তা ছুঁয়ে ফেলে। 
নিশা নিজে গেল যাক, সুমন রণ-র থেকে ঢের বেশি প্রতিষ্ঠিত, কলকাতার বনেদী পরিবারের ছেলে, হাঁকডাকে তাকে অনেকেই চেনে। কিন্তু রিণিকেও নিয়ে গেল। 
সুমনকে দেখলেই মনে হবে কী চেহারা ! লম্বা, দবেজ হাতের পাঞ্জা, গায়ের রঙ টকটকে লাল। গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় বাঘ ডাকছে। ওর পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা নেই রণ-র। নিজেই সে এটা জানে। তাই যেদিন নিশা জানালো ডিভোর্স চায়, কারণ সুমন, রণ কিছু তেমন বলতেই পারেনি। যেমন অনেকদিন ধরে টের পেয়েও নিশাকে কিছু বলতে পারা যায়নি, চোটপাট তো দূরের কথা। বরং তুমুল ঝগড়াঝাটির আশায় নিশার উত্তেজিত চঞ্চল চোখ, নাকের ওপর দুফোঁটা ঘাম আর কাফতানের বড় গলার ফাঁকে অনেকটা লালচে মাংস দেখতে দেখতে, রণ-র মনে হয়েছিল এটাই স্বাভাবিক। নিশার জায়গায় সে থাকলেও এটাই হতো। নিশার অনর্গল খিঁচুনিতে আর রেগে গেলে বস্তি-জুবানে রণ-র মতো মেয়েলি, ভাবুক, মিনমিনে, নিকম্মা অপদার্থ পুরুষের সঙ্গে সুমন চৌধুরীর কী তুলনা! চাঁদে আর পোঁদে। 

সত্যি সত্যি, এই তুলনাটা নিশা একদিন ব্যবহার করেছিল। রণ ঝগড়াঝাটি ছাড়াই ডিভোর্স দিতে রাজি হয়ে গেল এও যেন তার এক পরাজয়। রাতদিন উঠতে-বসতে কথা শোনাতো রণকে। এরকম হেরো ম্যান্দামারা পুরুষ সে দেখেনি কোথাও। কোনো মেয়ে এর সঙ্গে থাকতে রাজি হবে না। রিণিকে সে সঙ্গে নিয়েই যাবে। নিজের সন্তানকে ভালবাসে না এমন বাপ যেন ন্যাকা সেজে তার মেয়েকে দেখতে না আসে প্রতি হপ্তায়, কোর্ট পারমিশন দিলেও যেন না আসে। আর ছুটিছাটায় এনে রাখা, সে প্রশ্নই তো ওঠে না। নিশা কুৎসিত ইঙ্গিত করে। মেয়েরা বাপের কাছেও নিরাপদ নয়। এমন বাপের কাছে তো নয়ই। 'এমন' শব্দটায় স্বর নামিয়ে একটু মোটা করে এমন গমক লাগায় নিশা, সে মূহুর্তে রণ প্রতিজ্ঞা করে ফেলে সে রিণিকে কোনদিন কোনভাবে চাইবে না। একদিন দূরের কথা, এক ঘন্টার জন্যও না। 

তবু প্রথম প্রথম ঘুরঘুর করেছে রণ ছলছুতোয় সুমন চৌধুরীর গলিতে। যদি মেয়েটাকে এক ঝলক দেখা যায়। দু একদিন দেখেওছে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে মেয়েটা বন্ধুদের সঙ্গে। যেন একটা উড়ুক্কু প্রজাপতি। মায়ের মতো ডাকসাইটে সুন্দরী হবে রিণি। তার খাড়া নাক, টলটলে চোখ আর কালো বাঁকা আঁখিপক্ষ্ম যেন সেই কথাই বলে। শুধু গায়ের রঙটা। নাহলে রণের কোন ছায়া থাকতো না মেয়েটার শরীরে। নিশা-সুমনের মেয়ে বললেই সবচেয়ে মানানসই হতো। 

রিণিও তাকে দেখেছে এ কথা অন্তত একবার রণের মনেই হয়েছে। কিন্ত পরক্ষণেই মেয়েটা যেন চোখ ফিরিয়ে নিলো।
হয় এরকম হয়। জাজমেন্টাল হতে না চেয়ে রণ ভাবে। ছোটবেলা থেকে কাউকে অপদার্থ বলে ক্রমাগত চিনিয়ে এলে তাকে আর অন্যভাবে চেনা যায় না। শিশু যে ! তবে শিশুরাও ঘুষ খায় কিন্তু। প্রচন্ডভাবে খায়। এটা রণ-র থিয়োরি। যে যতো খেলনা, জামা, চকোলেট দেবে, বাচ্চা তাকে ততই চিনবে। টিন এজে মোবাইল, হাত খরচের মোটা টাকা। জন্মদিনে ভালো হোটেলে বন্ধুদের নিয়ে পার্টি। একটা বাচ্চাকে ভোলাতে এর বেশি কিছু দরকার হয়না এখন। আর রণ- র মতো বাবা এই রেসে নেমে বেশিদূর ছোটার আগেই মুখ থুবড়ে পড়বে জেনে রণ খেলার মাঠে চকের সাদা দাগের সামনে পা বাড়িয়ে দাঁড়ায়নি কোনদিন। স্টার্টারের বাঁশি শোনা তো দূরের কথা।

ভাবনার এই পয়েন্টে এসে রণ শুনলো প্যাসেজের ওপাশে কেউ ডাকছে বাবা, বাবা। 

এই ট্রেণটা ইদানীং বেশ ফাঁকা যাচ্ছে রণ ভাবলো। যাবার সময়ও এইরকম দেখেছে। আজ যেমন তার ক্যুপেতে চারটের মধ্যে তিনটে বার্থই ফাঁকা। সাইড লোয়ারে একটি অল্প বয়েসী লম্বা ছেলে থেকে থেকে খুকখুক করে কাশছে। তার মাথার ওপরেও কেউ নেই। নীল রেক্সিনে মোড়া খালি বার্থগুলোকে দেখলেই মনে হচ্ছে ওগুলো খুব বিষণ্ণ, যেন কারো শরীরের উষ্ণতা পায়নি বলে আরো হিম ঠান্ডা হয়ে আছে।

খাবার দেয় এই ট্রেনে। রুটি, জিরে ভাত, পনির, ড্রাই ভেজের নামে বরবটি, গাজর, ভুট্টা দানা, দিয়ে একটা মাখামাখা তরকারি চামচে দিয়ে মুখে তুলতে তুলতে রণ শোনে আধো গলায় কেউ বায়না ধরেছে, বাবা আমি তোমার ছঙ্গে ওপরে ছোব। 
নীল পর্দার ফাঁকফোকরে দেখলো পরের ক্যুপের সাইড লোয়ারে একটা পুরো পরিবার খেতে বসেছে। কী করে বসেছে কে জানে, তবে একটা ছোট মেয়ে বাবার কনুইয়ের কাছে বসে বার বারই বলছে, আমাল পেট ভরে গেছে। সামনে বসে রাগত মা বলছে, নকশাবাজি মারবি না বেশি। জোর করে খাইয়ে দেব। সকাল না হতে নাহলে বায়না ধরবি।
বাবা বরং কাকুতিমিনতি করছে, এবারেরটা নে, আর দেব না। আর দামাল বিচ্ছুটি কেবলই বলে যাচ্ছে, আমি অনেক খেয়েছি। আন্না। 
নিজের খাবার শেষ হতে রণ টয়লেটে গেল। আড়চোখে দেখে গেল ফ্যামিলিটাকে। মা জিনসের সঙ্গে শাঁখাসিঁদুর রেখেছে। একটু রাফ কথাবার্তা, অল্পবয়সী মেয়ে একটা। বাবাটিরও বয়স কম। বাচ্চাটার ফুলো গাল, ছোট করে ছাঁটা চুল, বয়স চার তো হবেই, সেই তুলনায় যেন একটু বেশি আধো আধো। রণকে দেখে হঠাত ডানহাতটা সোজা বাড়িয়ে দিল, যেন এঁটো হাতেই লুকোচুরি খেলার ইচ্ছে। বাবা বকলো, এ কিরে দুষ্টু, জেঠুর গায়ে এঁটো লাগাবি নাকি ? 
পাত্তা না দিয়ে ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগলো রাই। 

নামটা অনেক পরে জেনেছিল রণ। 

খাওয়াদাওয়ার পর তিনি বেড়াতে এলেন রণের খোপে। মুখে মিচকে হাসি। এসেই রণের মোবাইলটা হস্তগত করার চেষ্টা। ভাগ্যিস মা পেছন পেছন এসেছিল, ওরে তুই নোংরার মধ্যে খালি পায়ে যাচ্ছিস কেন ! মেয়ে বলছে, কোথায় নোংলা, ঝাড় দিলো তো রেলকাকুটা। 
সবদিকে নজর আছে পুঁচকের, আর অনর্গল কথা। 
-জেঠু তোমাল ব্যাগ কোথায় ! বার কলো না দেখবো। জেঠু আমাকে তুলে দাও ওপলেরটায়। আমি ছাতে উঠব। 
একটু পরেই আবার, জেঠু নামিয়ে দাও, ভয় কচ্ছে, ভয় কচ্ছে, টেরেন কাঁপছে। 

তারপর আবার সামনের বার্থে। এমনি করেই ক্যুপের ভেতরের ঠান্ডা যেন একটু কমে গেল। নীল বার্থগুলোর রঙ যেন একটু ফিকে হলো। বাচ্চাটা অনেকদিন পর রণকে একটা ভুলে যাওয়া আনন্দ, একটা হারিয়ে ফেলা সুখের আবছা আভাস এনে দিতে লাগলো। নিশা, রিণি সবাই থেকে থেকেই চক্কর মেরে যেতে লাগলো। রান্নাঘরের ঠুংঠাং আওয়াজ, টেবিলে গরম স্যুপের বাটি নামাবার শব্দ আর ধোঁয়া ওঠা গন্ধ। মুসুর ডালে শুকনো লংকা কালোজিরে ফোঁড়নের গন্ধ তার এতো প্রিয় ছিল, হঠাত পনের বছর পর এই ট্রেনের কামরা যেন তাকে তা ফিরিয়ে দিলো। নিশা তাকে অর্থপূর্ণভাবে হেসে ডাকলো, এসো আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি। রিণি এসে বললো, বাবা আমাকে তোমার পায়ের পাতার ওপর নিয়ে হাঁটাও না বাবা। নিজের ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে মা যেন মৃদু হেসে বললো, বনের বাঘে খায় না বাবা, মনের বাঘে খায়। 

রণ-র এই এক শহর থেকে আর এক শহরে, এয়ারপোর্ট আর স্টেশনে স্টেশনে সময়-কাটানো নেড়িকুকুরের জীবন করজোড়ে হঠাৎ তার কাছেই ছুটি চাইতে লাগলো। 

কী থেকে কী হয়ে গেল, হঠাৎ বিকট স্বরে নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে রণ চেঁচিয়ে উঠল, 
-বাচ্চাটাকে নিয়ে যান তো। আমি ক্লান্ত, ঘুমুব এখন।
এতো কর্কশ শোনালো তার কথা যে বার্থের ওপর সাদা চাদর কুঁচকে ধাঁই ধাঁই করে লাফানো রাই ধপ করে বসে পড়ল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সদ্য পাওয়া জেঠুর মুখের দিকে। ওপাশ থেকে তার বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, 

- সরি সরি মেয়েটা আপনাকে ডিস্টার্ব করছে। রাই, আয় আয় বলছি। 

মেয়ে তো কিছুতেই যাবে না। ওপরের বার্থ ধরে ঝুলে রইল। বাবা আর না পেরে ঠাস করে চড় মেরে দিল মেয়ের গালে। টানতে টানতে নিয়ে গেল মায়ের কাছে। প্রবল চিৎকার ছাপিয়ে রণ শুনতে পেল মা'টি বলছে, মারলে, তুমি রাইকে মারলে? একটা অভদ্র লোকের জন্য...। 

বাবা কথা শেষ হবার আগেই বলল, চুপ করো। অন্যকে অভদ্র ডাকবার আগে নিজের মেয়েকে ভদ্রতা শেখাও। 

বিছানা ঠিকঠাক হয়ে গেছিল। আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লো রণ। ওসব দূর থেকে আসা শব্দ গন্ধ সব দূর হয়েছে। ওগুলো খুব অপ্রতিরোধ্য। ওদের সঙ্গে লড়া যায় না। এখন রইল নিশার তীব্র ঝগড়া আর রিণির কান্নার আওয়াজ শুধু। এসব ট্যাকল করবার জন্য দরকার শুধু ঘুম। অভ্যেসমতো ঘুমের ওষুধ খেতে যাবার সময় ট্যাবলেটটা জিভে ঠেকে গেলে আর একটু জল খেল রণ। তেতো নয়, বিস্বাদ, কেঠো। 
তারপর কম্বলের তলায় সুখী মানুষের মতো সেঁধিয়ে গেল। 

ট্রেনের এসিটা বেজায় জোরে চালিয়েছে এটেন্ড্যান্ট।

2 comments:

  1. গল্পের চড়টি যেন সেফটি ভালব। দারুণ লিখেছো দিদি। খুব জীবন্ত বিবরণ, যেন চোখের সামনে সব ঘটে চলেছে। ব্রেভো 💕

    ReplyDelete
  2. পরিণতি আমাদের আপনিই আসে আপনিই চলে যায়!
    বড় ভালো লাগল গল্পটি।

    ReplyDelete