0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in


বনবাংলো, শব্দটা মনে করলেই গত শতাব্দী ভেসে আসে। খানসামা, বাবুর্চিরাও আসে পিছুপিছু। ঢালু চালের একটা বাড়ি। লাল ইঁটের দেওয়াল। বারান্দায় মোটা মোটা শাল কাঠের থাম। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জ্যাকারান্ডা গাছ, বাংলায় আদর করে পারুল ডাকে সব্বাই। ওপাশে জোড়া নিম গাছ। ফাল্গুন চৈত মাসে ভালবেসে বাংলোর চালের ওপর তারা বিছিয়ে দেয় আপন কুসুম। ভেতরে মস্ত দুখানা ঘর। মেহগনি কাঠের কুচকুচে ইংলিশ খাট, জানলার সামনে লেখার টেবিল, উঁচু ভারী চেয়ার। জানলা দিয়ে শেষ চৈত্রের বাতাসে শুকনো রঙচটা পাতা ভেসে এসে গা এলিয়ে দেয় লেখার সাদা কাগজে। পাশেই শোয়ানো কালো কালির ঝর্ণা কলম। মোটা নিব। রাতে সোহাগ করে বিছানার সাদা চাদর আর নির্জন অনাবৃত দেহে চুমু খেয়ে যায় হিম জোছনা। ঝিমঝিম নেশা। এলোঝেলো বাতাসে সজনেফুলের গন্ধ। কষাটে জংলা বুনো লতার সুবাসে ভরে ওঠে রাত্রির অভিসার। অস্পষ্ট চিকণ কুয়াশাবৃত অরণ্য। নিমবৃক্ষের কোটরে হুট হুট করে গম্ভীর গলায় ডেকে ওঠে এক কালপেঁচা। তন্দ্রা ভেঙে আসে।দু চোখ জঙ্গলের সবুজ আঠায় চ্যাটচ্যাট করে। 

বাংলোর হাতায় পরদিন সকালে পাতা হয় ছোট টেবিল। ফটফটে সাদা লেসের কাজ করা জামা পরেছে। ক্যাম্প চেয়ার। পায়ের তলায় ছটফটে সবুজ ঘাস, গোড়ালি অবধি ডুবে যায়। দুটো তলতলে কুসুম নিয়ে সাদা পোচ হাজির। ধবধবে সাদা পোর্সিলিনের প্লেটে শুয়ে আছে। সাহেবরা বলে, সানি সাইড আপ! নরম পাউরুটি। হলদে মাখন। টি পটে ফার্স্ট ফ্লাস,মকাইবাড়ি। খাঁকি দুপকেটওয়ালা হাফ প্যান্ট আর সাদা হাওয়াই শার্ট পরে বসে আছেন হয়তো এক স্কটিশ সাহেব। নাম,ধরা যাক, রবিন! পায়ের কাছে রাখা ম্যানলিকার শুনার রাইফেল! পয়েন্ট তিনশো আটত্রিশ বোরের উইনচেস্টার ম্যাগনাম। নিঁখুত পাল্লা আর ভারী মার। গত কদিন ধরেই একটা বাঘ উৎপাত চালাচ্ছে আশেপাশের গাঁয়ে। সম্ভবত জোয়ান। দুটো সোমত্থ সাঁওতাল যুবতিকে নিয়েছে পরপর দুটো শুক্কুরবারে। শেষজন এখনও পড়ে আছে দুটো শিমূল গাছের মাঝখানে, একটা সরু নালার পাশে। এই ভরা চৈতে নালা শুকনো খটখটে। আজ মড়ির ওপর রবিন মাচায় বসবে। শিমূল গাছে মাচা বাঁধার কাজ শুরু হয়েছোট এতক্ষণ। আকাশে চাঁদ থাকবে তখন। বাংলোয় তৈরি থাকবে বেলজিয়াম কাট গ্লাস,স্কচ আর ফ্লাইং ডাচ তামাক ভরা হাতির দাঁতের পাইপ! 

এসবই আজ চৈত্রের হু হু বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে দিগন্তে। বাংলোর সেই জলুসও আর নেই। ইংলিশ খাটের বদলে সস্তার ডিভান। চাদরে বালিশে ভ্যাপসা গন্ধ। দৈবাৎ কোনও ফরেস্টার বাবু একরাতের জন্য এলে চৌকিদার রাম ডিমের ঝোল ভাত রেঁধে দেয়। কাঁচা জিরের গন্ধওলা ঝোল আর মোটা চালের ভাত। ইদ্রিশ মিঁয়া বাবুর্চি গত শতকের খোয়াব মাত্র। গোল কাঠের টেবিলে ঝকঝকে ডিনার সেটে ক্যারামেল পুডিং, শম্বরের কচি রাং-রোস্ট বিগতযৌবনা রুপপোজীবির বাসনার মতোই। দু একটা গাছ শুধু থেকে গেছে। শতাব্দীর জীর্ণ ছায়া তাদের শরীরে। আর থেকে গেছে লেখার টেবিল।

তা ওসব সাহেবদের কায়দা নাই তো নাই! কী হয়েছে! এমনিই বনবাসের ইচ্ছা জাগে। সেবার চৈত্র মাসের মাঝামাঝি ক’টা দিন কাটিয়ে এসেছিলাম রাজাভাতখাওয়ার ওই বনবাংলোয়। বক্সাটাইগার লজ, খাতায় কলমে বাঘের জঙ্গল, যদিও বাঘ আর নাই। বাংলো থেকে একটু হেঁটে গেলেই ভারী সুন্দর যাদুঘর আছে একখানি। কেউই প্রায় যায় না, যত্ন করে ডুয়ার্স অরণ্যের সুবাস ধরে রাখা আছে সেখানে। উল্টোপানে জয়ন্তীর দিকে কিছুটা এগোলেই বালা নদী, জীর্ণ নদীখাতে বালুর ওপর লেপার্ডের টাটকা পায়ের ছাপ দেখেছিলাম, তখন অপরাহ্ন বেলা, পিটার গাড়ি করে নিয়ে গেছিল।

পিটার হেমব্রমের কথা মনে পড়ছে। ডুয়ার্সে লাল বোলেরো চালায়। ভাড়ার ড্রাইভার। এক মধ্য চৈত্রে জঙ্গলের সরু রাস্তায় আমরা এলোমেলো ঘুরেছিলাম। ওসব অঞ্চলে ফাল্গুন চৈত মাসেও রাতের দিকে অল্প ঠাণ্ডা পড়ে, মিহি কুয়াশা লেগে থাকে গাছপালার শরীরে। তারপর যত বেলা বাড়ে উষ্ণ হয়ে ওঠে বনভূমি। ছায়া পড়ে থাকে পথের ধুলোয়। গামহার,খয়ের,শাল গাছের মিছিল দুপাশে। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে ছুটে যায় হয়তো কোনও শম্বর। অরণ্য কখনও চুপ করে থাকে না মানুষের মতো। দিন ও রাতের একেক সময়ে বেজে ওঠে বিচিত্র শব্দে। কান পেতে শুনলে বোঝা যায়,কী যেন বলছে! 


আমি আর পিটার খুব ভোরে বেড়িয়ে পড়তাম। তখনও ঝুঁঝকো আঁধার লেগে চারপাশে। যেন নীল রঙের পাতলা সর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে একেকদিন পিটার নিয়ে যেত আমাকে চাপড়ামারির দিকে। আবার কোনওদিন ডায়না রেঞ্জে। এলিফ্যান্ট ক্যাম্পের দিকেও যেতাম একেকদিন। আলো ফোটার আগে গাড়ির স্টার্ট হেডলাইট বন্ধ করে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতাম। চোখ সওয়া অন্ধকার। একটানা ঘন্টাপোকা ডেকে চলেছে। খুব কাছে কর্কশ ক্যাঁও স্বরে চিৎকার করে উঠল ময়ূর। গাছেদের নিঃশ্বাস শোনা যায় এমন সময়। কত পুরনো সব গাছ,কত বছরের স্মৃতি। এখানেই আশেপাশে ধনেশ পাখিদের একটা আড্ডা আছে,পিটার জানে, কিন্তু দেখতে পাইনি এখনও। 

একটু বেলা বাড়লে দিনের আলোয় স্পষ্ট হয়ে যেত আবার সবকিছু। চকচকে রোদ্দুর পিছলে যাচ্ছে তখন পিচ রাস্তায়। খুনিয়া মোড়ের কাছে চা দোকানের উনোনে আঁচ পড়েছে। বাজার বসছে একটু একটু করে। চটের বস্তা বিছিয়ে কী যেন একটা শাক নিয়ে বসেছে এক বুড়ি। তাদের গায়ে লেগে আছে টাটকা জলের দাগ। বড় রাস্তা ছেড়ে আমরা ঢুকে পড়তাম সরু গেমট্র্যাকে। গাড়ির টায়ারের নিচে শুকনো পাতার দল। মচমচ শব্দ করে এগিয়ে যেতাম। পিটারের ভয় শুধু হাতির দল। ওরা বলে মহাকাল। কোনওদিন একটু বেলা করে চলে যেতাম বিন্দুর দিকে, ভুটান বর্ডার। জঙ্গল ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায়। বাঁকে বাঁকে অর্কিড আর ফার্ন। এরকমই একেকটা বাঁকে আমার জীবনে,ছেড়ে এসেছি কত মানুষ মানুষী। তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না কোনওদিন। খাদের পাশে ছোট্ট দোকানে বসে গরম গরম মোমো ঝাল ঝাল লঙ্কার আচার দিয়ে খেতাম দুজনে। আমি আর পিটার। ছোট ছোট চোখের নেপালি মেয়ে দোকানের মালকিন। পিটার গল্প করত। আমি শুনতাম। তারপর আবার ফিরে আসা বক্সা বাঘ-বাংলোর দিকে।

এক ভরদুপুরে পিটার মালবাজারে ওর বাড়ি নিয়ে গেল। মা বাবা আর ভাইকে নিয়ে সংসার। অল্প জমি আছে,পিটারের বাবা যোসেফ চাষবাস করে। পিটারের ভাই, ম্যাথু মালবাজারের মণিহারী দোকানে কাজ করে। ওদের মায়ের নাম কি মেরী? জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনও! শুয়োরের মাংস,অসম্ভব ঝাল দিয়ে রাঁধা,আর গরম ভাত খেলাম পাত পেড়ে। দেওয়ালে যীশুবাবার ছবি। বাংলায় লেখা বাইবেল। খাওয়ার আগে সবাই মিলে বললাম,আমাদের আজকের অন্ন গতকালের কর্মের ফল! আমি ওদেরকে বললাম,ওঁ ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্মার্হবি ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতম! দিব্যি বলল। শুনলাম চার্চ থেকে রেশন দেয় সপ্তাহে,টাকা পয়সা দরকার হলে তাও দেয় সময় অসময়ে। ব্রহ্ম নিয়ে ওরা কি মাথায় দেবে? না গায়ে মাখবে?! 

একদিন জয়ন্তী রেঞ্জ থেকে ফেরার পথে হাতির পাল্লায় পড়লাম। সন্ধে হব হব। সেদিন আকাশে চৈত মাসের ভাঙা চাঁদ। রুপোর পাতের মতো চিকচিক করছে চরাচর। হেডলাইটের আলোয় দেখলাম দূর থেকে একদল হাতি রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে। মায়ের পেটের কাছে কচি ছানা। পিটার আলো নিভিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, মহাকাল! দুপাশে ঘন জঙ্গল। মায়া রাজ্যের দ্বারভূমি। ছায়া ছায়া পথ। বুনো ফুলের গন্ধে মাথা ভারী হয়ে আসছে। দাঁতালটা ডেকে উঠল একবার। হঠাৎ শুনি নীচু গলায় পিটার বলছে, মারাংবুরুয় চিয়ালেৎ হো বির দিশম দ! 
মনে মনেই হাসলাম আমি একটু। মারাংবুরুর হাতি তাহলে ওরা ?কী জানি হবেও বা। এই চন্দ্রাহত সন্ধ্যায় এই নিবিড় অরণ্যে যা কিছু ঘটে,সে আমার মতো শহরচারী মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য। দু হাত জড়ো করে মারাংবুরুকে প্রণাম জানালাম। জাহের বুড়ি কে নমস্কার জানালাম।তাঁদেরই তো দুনিয়া এই সবুজ মায়ারাজ্য। 
আমি অনুপ্রবেশকারী মাত্র। 

বিকালের দিকে বাংলোর বারান্দায় চুপ করে বসে থাকি।নির্মেঘ আকাশেও দু এক টুকরো ছিন্ন মেঘের দল কোথা থেকে যেন এসে জড়ো হয়েছে। গোলাপি আভায় তারা উজ্জ্বল। প্রকাণ্ড মহানিমগাছের পেছনে দিকচক্রবাল রেখার দিকে দ্রুত পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছে দিবাকর, সেই কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। গাঢ় কমলা রঙ তার সাদা জামায়। নিভু নিভু আলো চরাচরে। রাজাভাতখাওয়া বাংলোর হাতায় শিমূল গাছে ফিরে আসছে সাদা বকের দল। রুদ্রাক্ষ গাছের মাথা আলো করে রেখেছে বুনো টি য়ার ঝাঁক। দু একটা ধণেশ পাখি ঠোঁটে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে লোকালয় ছাড়িয়ে আরও নিবিড় অরণ্যের দিকে ফিরে যাচ্ছে । 

ওই যে মেহগনি গাছ,বাংলোর হাতার বাইরে,কত কত নির্জন দ্বিপ্রহরে বয়ে গেছে উদাসী বাতাস তার পত্রে শাখায়,কত জ্যোৎস্নালোকিত নিশীথে অজানা বন্য কুসুমের সুবাসে শিহরণ উঠেছে তার দেহকাণ্ডে। কত বর্ষার সজল বারিধারায় সিক্ত হয়েছে ওই প্রাচীন বৃক্ষের হৃদয়। যেন এক শতাব্দী প্রাচীন নট, অবিচল স্থির বহমান জীবনধারার নিকট। কার্তিকের দিনান্তে কতবার হেমন্তের বিদায়ী সূর্যের অস্তালোকে বিষণ্ণ হয়েছে তার স্মৃতি। 

আমার কেন জানি না তাকে মনে হয়,একজন বহুশ্রুত কথাসাহিত্যিক। যেন বিভূতিভূষণ স্বয়ং। আর তার পাশে যে বুনো লতার ঝোঁপ, যে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে আছে ওই মহাবৃক্ষকে, সে যেন তরুণী গৌরীদেবী। সেই মনসাপোঁতার রাত্রি! তেমনই সজল আষাঢ়ের বারিধারায় স্নান করেন তাঁরা আজও, এই নিবিড় অরণ্যে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। 

একদিন সকাল হওয়ার আগেই, পিটার তখনও গাড়ি নিয়ে আসেনি, গাছেদের ভিড়ে ঠাসা সরু সুঁড়িপথ ধরে এগিয়ে যাই। শুকনো প্রাণহীন পাতা পায়ের তলায়। সকালের আলো এখনও এসে পৌঁছায়নি এই নিশ্চুপ বনপথে। শিরশিরে বাতাস বইছে মৃদু। রাম মুর্মু বলেছে, খানিকটা এগোলেই ছোট একটা দিঘী দেখতে পাব,টলটলে জল, দুপাশে পুটুস আর ঢেঁকি শাকের ঝোপ। মাকড়সারা জাল বুনে রেখেছে গাছের ডালে, মুখেচোখে এসে লাগে চলার সময়। হাত দিয়ে মিহি জাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে চলেছি। বিগত কোন যুগের বৃক্ষরাজি দুপাশে। প্রাচীন শালগাছের গোড়ায় উইয়ের ঢিপি। গামহার খয়ের শিরীষ অর্জুন, শেষ নাই গাছের,আশ্চর্য লাগে, মনে হয় একজন্মে কোনও মানুষ উদ্যত লোভী কুঠার হাতে নিয়েও শেষ করে যেতে পারবে না এই গাছ মিছিল। আরেকটু পরেই তাদের মাথা ছুঁয়ে মাটিতে নেমে আসবে দিনের আলো। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছায়া তৈরি হবে। কত পিঁপড়ে ছোট ছোট লাল পোকা হন্তদন্ত হয়ে ডাল বেয়ে কোথায় যেন চলেছে! পাখিরা বেরিয়ে পড়েছে আরও আগে, ফিরে আসবে সেই দিনান্তে। বিচিত্র শব্দে তখন ভরে উঠবে বনস্থলী। দিনমানে পাখিদের ফেলে যাওয়া ঘর সংসার আগলে বসে থাকে গাছের দল। 

ওই দিঘীর জলে মস্ত পদ্ম নাকি ফুটে ওঠে এমন সকালে। রাম বলছিল কদিন ধরেই। বাংলোর ম্যানেজার সে,শুধু ম্যানেজারই নয়,রাঁধুনী খানসামা চৌকিদার, যে নামেই ডাকি না কেন, রাম মুর্মুই ওই বাংলোর প্রাণ। কেউ বড় একটা আসে না এদিকে। আমার ঘরের সামনে খোলা বারান্দা, মাথায় করোগেটের চাল। চারপাশে গাছের ব্যারিকেড। বারান্দায় তেঁতুল গাছের ডালপালা নুয়ে পড়ে বাতাসে। থোকা থোকা তেঁতুল ঝমরঝমর করে দোলা খায়। 

একটা ছোট ফুলের বাগান তৈরি করেছে রাম সামনে বাংলোর হাতায়। কত রকমের যে ফুল! যেন একমুঠো রঙপেন্সিল কে যেন ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দিয়েছে। সবুজ গেটের মুখে কাগজফুলের ঝাড়। এখানে দুরাত কাটালে মনে হয়,কোথাও যাওয়ার নেই আর। কী হবে অনর্থক ছুটে বেরিয়ে জীবনে, এই ছায়াঘেরা একফালি ঘরে চুপ করে বসে থাকার নামই বেঁচে থাকা। খর নিদাঘ দ্বিপ্রহরে কত চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যায় কত বর্ষণক্ষান্ত বৈকালে যখন সজল মেঘের আড়াল থেকে শাণিত বল্লমের ফলার মতো ছুটে আসে অস্তসূর্যের কমলা বর্ণের আলোকগুচ্ছ তখন ওই বৃক্ষদলের শরীরে নেচে ওঠে আনন্দ গান। সবুজ ছায়ায় মুখরিত হয় রাজাভাতখাওয়া বনবাংলো। আবার গভীর রাত্রে নক্ষত্রের আলোয় ওই গাছের দল ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে। কান পাতলে শোনা যায়,তারা বলছে,এসো এসো! দ্যাখো,তোমার বেঁচে থাকা অতটাও খারাপ কিছু নয়। 

রামের কথা শুনেই আজ চলেছি সেই পদ্মের খোঁজে। পা জড়িয়ে ধরছে বুনো লতা। গাঁদাল পাতার ঝোপ থেকে দু চারটে পাতা তুলে পকেটে রাখি। কতরকমের ফার্ন। পরজীবি লতার দল জড়িয়ে ধরে আছে বড় বড় গাছের শরীর। ঘন নীল রঙের বুনো ফুল ফুটে আছে একজায়গায়। তাও তুলে মুঠোয় রাখি। এত নীল তাদের দেহে মনে হয় আমার চামড়ায় লেগে যাবে সেই রঙ। মুখ হাঁ করে বসে আছে কলসপত্রী। সেই ছেলেবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম পতঙ্গভুক ওই গাছের কথা,আজ দেখলাম। মরচে রঙা বটফল ফুটেছে থোকা থোকা। বুনো আমড়া গাছ একপাশে দাঁড়িয়ে। লজ্জাবতী লতার ঝোপ উন্মুখ হয়ে জেগে আছে,হাত ছুঁয়ে দিলাম! খিলখিল করে কিশোরীর মতো হেসে গড়িয়ে পড়ল ভুঁয়ে। কয়েকটা বনটিয়া উড়ছে পাক খেয়ে মাথার ওপর। গুনগুন করে একটানা কোনও যন্ত্র চলার মতো শব্দ ভেসে আসছে। মস্ত মৌমাছির চাক একটা খয়ের গাছে। কাছেই তো সেই পদ্মদিঘী, এ তাহলে নিশ্চয় পদ্মমধুর চাক ! 

ফাঁকা একটু সমতল ভূমি নজরে আসছে। ধ্যানগম্ভীর বৃক্ষের পর যেন কোনও উচ্ছল শিশু হাত পা মেলে খেলা করছে আকাশের তলে। দিনের প্রথম নরম আলো কোন সুদূর হতে এসে পড়েছে দীঘির জলে। মৃদু বাতাসে জলের ঢেউয়ে চিকচিকে আভা। দুপাশে বড় বড় বন কচুর সারি। রঙবেরঙের কুচি কুচি ফুল ঘাসের ডগায়। সারা রাত শেষে সদ্য ফুটেছে। বিশাল কাপাস তুলোর গাছ দিঘীর পাশেই। নিজের মনেই বড় বড় খোসা ফেটে তুলোর মিহি দানা খেলা করছে বাতাসে। এ যেন চেনা কোনও জগত নয়। নিশুত রাত্রে নিশ্চয় চাঁদের আলো পাখায় মেখে স্নান করতে নামে এখানেই ছোট্ট ছোট্ট পরীর দল। 

কিন্তু একটিও পদ্ম তো নেই দিঘীর জলে ! রাম যে তবে বলল এত করে! দিঘীর ওপারে একটা ছোট বেদি। ভাঙা ভাঙা ইঁট। বেদির ওপর শুকনো পাতা পড়ে আছে এলোমেলো। কয়েকটা টাটকা বুনো ফুল। এ কি তবে বনদেবীর থান? কী জানি! হয়তো কেউ সবার চোখের আড়ালে উপাসনা করে দেবীর। এই নির্জন অরণ্যে ওই বেদির ওপর দীপ নেই ধূপ নেই ষোড়শপচারে পূজা নেই, তবুও কোন এক অপরূপ মায়া স্পর্শ করে যায় নিমেষে। দিঘীর জলে হাতমুখ ধুয়ে জুতো খুলে বেদির ওপর উঠে শুকনো পাতা সরাই একটা একটা করে। কচু পাতা তুলে এনে পুরনো ধুলো পরিস্কার করি। সেই তুলে আনা নীল ফুল সাজিয়ে দি যত্ন করে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি না,শুধু মাথা নীচু করে মনে মনে বলি, ভালো থেকো! ভালো থেকো! মন আলো করে থেকো আজীবন! 

সেদিন বনবাংলোয় ফিরে জিজ্ঞেস করেছিলাম রাম কে। ওই বেদির কথা। কিছুই বলতে পারেনি সে। আজ বাইশ তেইশ বছর আছে রাম,কতবার গেছে ওখানে,পদ্ম তুলে এনেছে দিঘী থেকে,কিন্তু কস্মিনকালেও ওইরকম কোনও বেদি তার চোখে পড়েনি। 

কী জানি তবে কী দেখলাম। হয়তো আমারই মনের ভুল!

ক’টা তো মাত্র দিন, দ্রুত শেষ হয়ে আসে আমার স্বেচ্ছা নির্বাসনার জীবন! কোনও বনবাংলো বাসের শেষ রাতে আমি কখনও ঘুমাই না। অবাক চোখে দেখি কেমন রাত্রি নামে নিঝুম বাংলোয়। চৈত্রের হাওয়া কেঁদে কেঁদে মরে জানলার গরাদে। জোছনা নেমে আসে এই মরপৃথিবীর বুকে। বন্ধ দুয়ার থেকে ফিরে যায় আবার। এমন রাত্রেই তো পরীর দল নামে। তাদের পাখাদুটো নরম চাঁদের আলোয় বোনা। তারা এই জগতের কেউ নয়। তাদের ভালবাসায় চন্দ্রাহত হয় নশ্বর মানুষ মানুষীর দল।

জানলার দিকে মুখ করে চেয়ে আছে সেই লেখার টেবিলটি। শুধু ওই টেবিলটিই রয়ে গেছে। কোনও কাগজ কলম নেই তার পাশে। তবুও সে অপেক্ষা করে থাকে। যদি কোনওদিন কেউ এসে বসে তার কাছে। যদি খোলা হয় জানলার পাল্লা,যদি পরীর দল লুটোপুটি খায় তার শরীরে। কোনও অনাগত ভবিষ্যতের যুবক বা যুবতী তার সেই দেহের ওপর লিখতে শুরু করে জীবনের গল্প! 

প্রতীক্ষা আর শেষ হয় না! আর কে না জানে প্রতীক্ষার আয়ু অসীম।


0 comments: