অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা
Posted in অনুবাদ সাহিত্য
অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ২
প্রেম বিষয়টি যেমন সর্বজনীন আর সর্বকালীন, প্রেমের কবিতাও তাই। যখন থেকে ভাষার শুরু, ঠিক তখন থেকেই ভাষার মাধ্যমে প্রেমের বহি:প্রকাশ এবং প্রেম নিবেদন। তার প্রতিফলন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রচিত প্রাচীন মহাকাব্যে -- প্রেম এবং প্রেমতাড়িত আত্মত্যাগ ও প্রতিশোধ সেখানে নিয়মিতভাবে উপস্থিত। অনেক যুদ্ধ, রক্তপাত ও সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে অসফল প্রেমের ফলশ্রুতি হিসেবে।
এবারের কিস্তিতে সংকলিত হ’ল আটজন কবির কবিতা। ইয়োরোপ ও আমেরিকার কবিদের সঙ্গে যুক্ত হলেন নতুন দুটি অঞ্চলের কবিরা -- ১) মধ্যপ্রাচ্য: পৃথিবীর এই অঞ্চলটি যেমন মানব সভ্যতার আঁতুড়ঘর, ঠিক তেমনি প্রেম বিষয়ক কাব্য ও কবিতারও। মধ্যপ্রাচ্যের দুজন কবি -- একজন লেবাননের আর অন্যজন তুরস্কের। দুজনেই দীর্ঘজীবী এবং জনপ্রিয়। একজন শতবর্ষ পেরিয়েছিলেন আর অন্যজন পৌঁছেছিলেন তার খুবই নিকটে ২) অস্ট্রেলিয়া -- যদিও দেশটিতে মানুষের বসবাস চলেছে পয়ঁষট্টি হাজার বছর ধরে, নতুন করে তার আবিষ্কার সপ্তদশ শতাব্দীতে; সেই নতুন দেশের এক জনপ্রিয় মানবীকবি যোগ দিয়েছেন আমাদের প্রেমের কবিতা সংকলনে।
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। সেই ফাঁদের অন্যতম উপাদান প্রেমের কবিতা ……..
রাফায়েল আলবের্তি: (স্পেন, ১৯০২-৯৯)
নিবিড় প্রকৃতিতে ফিরে আসে প্রেম
আমাদের বিশ্বাস, হে প্রেম, ওই প্রকৃতি ছিল
আমাদের অন্তরে ঘুমন্ত অথবা মৃত
অনেক বছর ধরে, আমাদের বাস তাদের গর্তে;
বৃক্ষেরা হারায় স্মৃতি এবং
রাত মিলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে
সেইজন্যেই সুন্দর তারা, হয়তো বা অমরও।
কিন্তু একটি পাতার সামান্য দোলনই যথেষ্ট,
খ’শে পড়া তারাটি নি:শ্বাস ফেলে হঠাৎই,
দ্যাখে আমাদের, সুখী প্রেমিকজোড়া
বেঁচেবর্তে রয়েছে পৃথিবীর নিবিড় আলিঙ্গনে।
তোমার ঘুম ভাঙলো আজ, হে প্রেম, আমার পাশে,
লুকিয়ে রাখা আঙুর আর স্ট্রবেরির আসঙ্গে,
অরণ্যের অন্তরালে সুদৃঢ় অবস্থান আমাদের।
চাদরের মতন ঘিরে রাখে আর্দ্র শিশির,
কাঠের কুচি বিছিয়ে টাটকা শয্যা তোমার,
কেশবাসের সজ্জা দেখে মোহিত হয় পরিরা
আর গাছের উঁচু ডাল থেকে রহস্যময় কাঠবেড়ালি
পত্রপুষ্পের বৃষ্টি ঝরায় তোমার ঘুমন্ত শরীরে।
গাছের পাতা, সুখী হও; কোনোদিন তোমায় যেন
ঝরতে না হয় হেমন্তে, তোমার মৃদু খশখশ কাঁপুনিতে
অনেক অন্ধ উজ্জ্বল সময়ের
স্মৃতি ও সুগন্ধ এনে দাও। আর তুমি
হে ক্ষুদ্রতম উদাসী নক্ষত্র, খুলে দিয়েছ
আমাদের প্রথম যৌবনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলি,
আমাদের শয়নকক্ষে তুমি ঘুমন্ত দেখবে দুজনকে
রোজ ভোরে, তোমার আলো নিভবে না কখনো
এবং চাঁদের আলোয় সেই লাইব্রেরি আর
তার গ্রন্থগুলির মাধুর্য ছড়ানো চারদিকে আর
ঘুম ভেঙে দূরের পাহাড় গান গায় স্বাগত জানিয়ে।
[তিনি চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে ছবি এঁকেছেন সারাজীবন। ১৯ বছর বয়েসে কবিতা লেখার শুরু। স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রগতিশীলদের পক্ষে। যুদ্ধের শেষে অভিবাসী হন আর্হেন্তিনায়। ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পরে ফিরে আসেন স্পেনে। কবিতাটি ১৯৫২ সালে প্রকাশিত “রেতরনোস দে লো ভিভো লেহানো” কাব্যগ্রন্থ থেকে। স্প্যানিশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ পেরি হিগম্যান।]
রনে শার: (ফ্রান্স, ১৯০৭-১৯৮৮)
মৃগয়ার আবহ অথবা কবিতার জন্ম
আমার বিশুদ্ধ কান্নার থেকে চুঁইয়ে এলো বিষ: ভালোবাসার মস্তিষ্কের সঙ্গে প্রেম করতে আসে ভাঙা শিশিবোতল।
আঃ, গ্রহণের আলয় কর্তা স্বয়ং সরে গিয়ে, অন্ধকার বয়ে আনুক। অন্ততঃ খানিকটা দেরি হবে সন্ধেয় অগ্রসরমান তুমুল ঝড়ের।
প্রেমের ভিতরে, রয়েছে জড়পদার্থ, এই বিরাট বিশাল যৌনাঙ্গ।
শেষ রাত্তিরে আমরা দল বেঁধে বেরোই মৃত্যুস্বপ্ন দেখার জন্যে ফল পাড়তে: কয়েকটি পাটলরঙা ডুমুর।
বাথটবের মতন দেখতে মৃত পৌরাণিক অশ্বেরা হেঁটে আসে এবং মিলিয়ে যায়। তাদের গোবর সান্ত্বনা দেয় আমাদের মৃদু স্বরে।
আমি যখন দীর্ঘকালের জন্যে আসি ব্যক্তিত্বহীন ধরায়, মহান কমলালেবু গাছের শয্যার পাশে জলীয় বাষ্পের প্রশান্তি।
স্বর্গীয় চরমানন্দের মুহূর্তে এসে হাজির লঘুনিতম্বিনী এক তরুণী, সে গলা কাটে মোরগের, আচ্ছন্ন হয় গভীর ঘুমে, তার বিছানার অল্প দূরে বয়ে যায় নদী ও বিপন্নতা। ফেরত পাঠাও প্রেরককে।
প্রেমে হিংসার স্থান নেই
অকস্মাৎ শ্বাসরোধী হিরে
স্থবিরতা চলমান মাধুর্য
[বিংশ শতাব্দীর প্রধান ফরাসি কবি এবং আলব্যের কামুর ঘনিষ্ঠ বান্ধব। জানুয়ারী ৪, ১৯৬০ কামুর অন্তিম যাত্রায় তাঁরও সহযাত্রী থাকার কথা ছিল; কিন্তু গালিমারের টু-সিটার গাড়িতে তাঁর স্থান সংকুলান হয়নি। এর ফলে বিশ্বের সাহিত্য তাঁর সাহচর্য পায় আরও সতেরো বছর। কবিতাটির ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মেরি অ্যান ক’স।]
মিকলোস রাডনোটি: (হাঙ্গেরি, ১৯০৯-১৯৪৪)
ঝড়বৃষ্টি
সময়মতো বেরিয়ে পড়েছো তুমি। নদীর জল বিষাদভারে দুর্বহ।
এলোমেলো বাতাস। ছেঁড়াছেঁড়া মেঘ।
জলের ওপরে অঝোরধারে বৃষ্টির আঘাত।
চূর্ণ হয় ফোঁটাগুলি। তোমার পানে ধায় আঁখি আমার।
চূর্ণ হয় ফোঁটাগুলি। আমার শরীর হাত বাড়ায়
তোমার দিকে। আমার প্রতিটি মাংসপেশি, হে প্রেম,
মাকড়সার জালের মতন তোমাকে জড়ায় বন্য আলিঙ্গনে!
মনে রাখি তোমাকে আর জর্জর হই বিষাদে।
আমার তনু থরোথরো কাঁপে তোমায় হারানোর দু:খে,
তোমাকে দেখতে চায় আমার সত্তা, উড়ে যায় তোমার দিকে।
কোনো কিছুই, কোনো কিছুই, এমনকি এই অবিশ্রান্ত ঝড়বৃষ্টিও
ধুয়ে দিতে পারে না তোমার জন্যে আমার কামনাকে।
তোমাকে গোপন রাখি
তোমাকে গোপন রাখি দীর্ঘকাল
গাছের ডাল যেমন তার পত্রালীর আড়ালে
অনায়াসে লুকিয়ে রাখে পেকে ওঠা ফল,
এবং শীতের জানালার কাচে
জমে ওঠা তুষারফুলের মতন
আমার অন্তরে নিজেকে মেলে ধরো তুমি।
এখন আমি জানি সেই দৃশ্যটির মানে
যখন ক্ষিপ্র দুহাতে চুল খুলে দাও তুমি।
আমার হৃদয়ে রেখে দিই
তোমার পায়ের গোড়ালির মৃদু নড়াচড়া
আর তোমার বুকের পেলব বক্র অরাল দেখে
শিহরিত হই, যেন শীতল চোখের সামনে
ঘটছে অলৌকিক ঘটনা, তবু
জলজ্যান্ত বেঁচে রয়েছি।
তা সত্ত্বেও কখনো স্বপ্নে
শতভুজ পুরুষ হয় আমি
আর স্বপ্নে দেখা ঈশ্বরের মতন
প্রতিটি বাহুতে জড়িয়ে ধরি তোমায়।
[হাঙ্গেরির কবি ও শিক্ষক; জাতিতে ইহুদি, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাহিত্য আন্দোলনে। নাৎসিরা তাঁকে জোর করে পাঠায় শ্রমশিবিরে তামার খনিতে কাজ করার জন্যে। ১৯৪৪ সালের হেমন্তে হিটলারের পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন ক্যাম্প খালি করে ৩৬০০ বন্দিকে পাঠানো হয় দীর্ঘ পদযাত্রায়। দুমাস পথে পথে কাটানোর পর তাঁর অনাহারে, ক্লান্তিতে শোচনীয় মৃত্যু। কবিতাদুটি ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত “ফেনায়িত আকাশ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। হাঙ্গেরিয় ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন স্টিভেন পোলবার্গ, স্টিফেন বার্গ এবং এস. জে. মার্কস।]
এলিজাবেথ বিশপ: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯১১-১৯৭৯)
অনিদ্রা
দেরাজের আয়নায় চাঁদ
লক্ষ মাইল দূর থেকে তাকায়
(হয়তো বা অহমিকার সঙ্গেই, নিজের দিকে,
কিন্তু হাসে না সে ভুলে কখনো)
দূরে অনেক দূরত্বে ঘুমের দেশ পেরিয়ে, অথবা,
হয়তো সে ঘুমিয়ে নেয় দুপুর বেলায়।
জনহীন চরাচরের পাশে দাঁড়িয়ে
সে বলতে পারে -- গোল্লায় যাও,
আর খুঁজে নিতে পারে জলাশয়,
অথবা মুকুরের আশ্রয়।
অতএব মাকড়সার জালে জড়িয়ে নাও সুখদু:খ
আর ধীরে ধীরে নামাও কুয়োর জলে।
উল্টে যাওয়া পৃথিবীতে
যেখানে বাম মানে সবসময় ডান,
আর ছায়াই হয়ে ওঠে আসল শরীর,
আর আমরা জেগে থাকি সারা রাত্তির,
আর স্বর্গ, সে সমুদ্রের মতন অগভীর
থেকে গভীরতা পায়, আর তুমি আমার প্রেম।
[মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক; ব্যক্তিগত জীবনে সমকামী হলেও “নারীবাদী কবি” অথবা “লেসবিয়ান কবি” বিশেষণে ছিল তাঁর প্রবল আপত্তি। জীবনের পনেরো বছর কাটিয়েছেন তাঁর সঙ্গিনীর সঙ্গে ব্রাজিলে। তাঁর রচনা ধ্বনিময়, বিচারক্ষম এবং যুক্তিবাদী। ১৯৫৬ সালে পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়েছিলেন “কবিতা উত্তর-দক্ষিণ” এবং “এক শীতল বসন্ত” -- যুগ্ম কাব্যগ্রন্থের জন্যে। কবিতাটি ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” গ্রন্থ থেকে নেওয়া।]
সৈয়দ আকল: (লেবানন, ১৯১১-২০১৪)
তোমার আঁখির থেকে সুন্দরতর
তোমার আঁখির থেকে সুন্দরতর
তোমার আঁখির জন্যে আমার প্রেম।
তুমি গেয়ে উঠলে গান গায় পৃথিবী।
তুমি কি রয়েছে আকাশে, আমার
কামনার নক্ষত্র, নাকি তুমি
কেবলই এক অলীক স্বপ্ন?
তোমার চিন্তায় সুরভিত হয়
আমার হৃদয় -- গোলাপের
দল দিয়ে গড়া কি তোমার তনু?
হয়তো রূপের আকাঙ্খা থেকেই
তোমার সৃষ্টি, অনুপ্রাণিত দুহাত
আশায় বুক বেঁধে গড়েছে তোমায়।
যে বীণায় কামনার সুর বাজে
তার তন্ত্রীগুলি কল্পনা করতে পারে কি
সেই সুরের পিপাসী অন্তরকে?
আমাদের মিলনকালে থেমে থাকে সময়,
লুপ্ত হয় সীমারেখা,
ভেসে যায় বাধার প্রাচীর।
পৃথিবী আমাদের বিদায় জানিয়ে
রওনা করে দেয় অন্তহীন উড়ানে
স্বর্গের বিলাসী উদ্যানের দিকে।
আমাদের এই বাসভূমির কথা ভাবলে
পৃথিবীর সুন্দরতম মনে হয়;
কারণ তোমার পা পড়েছে এখানে।
[লেবাননের প্রথম আধুনিক কবি, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার। তিনি ভাষাবিদ, ভাষা গবেষক এবং ৩৬টি লাতিন বর্ণের সমাহারে লেবাননি ভাষার স্রষ্টা; আরবি ও লেবাননি উভয় ভাষাতেই তিনি নিয়মিত কবিতা ও গদ্য লিখেছেন; তিনি নাটক ও নাট্যসংগীতের জন্যেও জনপ্রিয়; তাঁর রচিত সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে খুবই অল্প। কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদক অথবা কাব্যগ্রন্থের নাম জানা যায়নি।]
মিউরিয়েল রুকাইজার: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯১৩-১৯৮০)
পরস্পরের মুখে তাকিয়ে
হ্যাঁ, আমরা পরস্পরের মুখে তাকিয়ে
হ্যাঁ, আমরা পরস্পরকে অন্তরঙ্গভাবে চিনি
হ্যাঁ, আমরা পরস্পরকে সঙ্গম করেছি বারবার
হ্যাঁ, আমরা সংগীত শুনেছি একসঙ্গে
হ্যাঁ, আমরা সমুদ্রে গিয়েছি পরস্পর
হ্যাঁ, আমরা রেঁধেছি আর খেয়েছি একসঙ্গে
হ্যাঁ, আমরা হেসেছি ঘন ঘন দিনে আর রাতে
হ্যাঁ, আমরা দেখেছি হিংসাকে এবং লড়েছি তার বিরুদ্ধে
হ্যাঁ, আমরা ঘৃণা করেছি অন্তরের ও বাইরের অত্যাচারকে
হ্যাঁ, সেদিন আমরা পরস্পরকে দেখেছি একান্তে
হ্যাঁ, সূর্যের আলো এসে ঝরেছিল অঝোরধারায়
হ্যাঁ, টেবিলের এক কোণে দুধারে আমরা দুজন
হ্যাঁ, টেবিলে রয়েছে রুটি আর ফুলের স্তবক
হ্যাঁ, আমাদের চোখেরা দেখলো পরস্পরকে
হ্যাঁ, আমাদের মুখেরা চাখলো পরস্পরকে
হ্যাঁ, আমাদের বুকেরা ধাক্কালো পরস্পরকে
হ্যাঁ, আমাদের শরীরের মাখলো পরস্পরকে পুরোপুরি
হ্যাঁ, তারপর থেকেই শুরু হলো পরস্পরকে ভালোবাসা
হ্যাঁ, তারপর থেকেই ঢেউ এসে ভাসালো আমাদের
হ্যাঁ, তারপর থেকেই দ্রুত হল হৃদস্পন্দন
হ্যাঁ, তারপর থেকেই সূক্ষ্ম হল নাড়ির গতি
হ্যাঁ, যে অবস্থান যে পূর্বরাগ
হ্যাঁ, যে প্রবেশ যে নির্গমন
হ্যাঁ, দুজনের জন্যে প্রথম থেকে শেষ
হ্যাঁ, আমরা পরস্পরের মুখে তাকিয়ে
[মার্কিন কবি ও রাজনৈতিক কর্মী। নারীবাদী কবিতা আন্দোলনের নেত্রী। ধর্মে তিনি ইহুদি এবং উদারপন্থী ইহুদি ধর্মতত্ত্বের প্রভাব রয়েছে তাঁর কবিতায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদী। কবিতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; গণতন্ত্রে ও মানবজীবনে কবিতার গভীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন ও বক্তৃতা দিয়েছেন। কবিতাটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া হয়েছে।]
ফাজিল হুসনু দাগলার্কা: (তুরস্ক, ১৯১৪-২০০৮)
আঁখিপল্লব
তোমার আঁখির দৃষ্টি জেগে থাকে তারার তিমিরে,
উন্মাদ জনতা থেকে পরিত্যক্ত, অদৃশ্য কিনারে।
হৃদয়ে বিষাদ জন্মে, মনোকষ্টে ব্যাথা পেয়ে কাঁদে
গাঢ় লাল অন্ধকারে বেড়ে যায়, বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তোমার আঁখির দৃষ্টি: রজনীর একান্ত উষ্ণতা।
তারপর শীতলতা নেমে আসে শূন্য, খাঁখাঁ পথে,
গতিহীন হাওয়া
স্তব্ধ হয়ে থাকে মৃত সারমেয় শবটাকে ঘিরে।
তোমার আঁখির দৃষ্টি অন্ধকারে পথ ভুলে যায়।
স্বর্গ থেকে আলো ঝরে ঝিরি ঝিরি জলের শরীরে
সে জল অনেক দূরে-- মৃদু, মৃদু, আরও ক্ষীয়মান
অন্ধকার প্রেমের ভুবনে।
পেরিয়ে
যখন নারীকে ভালোবাসি
উপলব্ধি হৃদয় গহনে
আমাকে পেরিয়ে আরো আগে
ঈশ্বর বেসেছে ভালো তাকে।
হ’ল
ভালোবাসা
মানে হ’ল
পৃথিবীকে
দ্বিগুণ বাড়ানো
ছায়া
প্রেমের মানুষটি হ’ল
আমাদের
মুখচ্ছবি
ভবিষ্যতের দিকে
[তুরস্কের প্রথম “বিশুদ্ধ” আধুনিক কবি; ষাটটির বেশি তাঁর কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতা মানবতার গান গায় এবং প্রবলভাবে যুদ্ধবিরোধী। তুর্কি জাতীয়তাবাদ এবং তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর কবিতার এক প্রিয় বিষয়। কবিতাটি ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত “ভূমধ্যসাগরের কবিতা“ গ্রন্থ থেকে নেওয়া; তুর্কি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তালাত সাইত হালমান।]
জুডিথ রাইট: (অস্ট্রেলিয়া, ১৯১৫-২০০০)
বড়দিনের সনেট
কৃষ্ণঝড়ে চেয়ে দেখি আমাদের সোনালি সময়,
উড়ন্ত ধুলোয় ভাঙে সনির্বন্ধ প্রেমের প্রহর।
কালো স্বপ্ন হাঁকে, “ওহে, বন্দি হলে শীতের প্রকোপে,
তোমরা পরাস্ত হবে, এসে গেছে ঘোর দু:সময়।”
-- তীব্র ভয়ে ঘুম ভাঙে, সান্ত্বনার মতো পাশে তুমি
উদ্দাম আঁধারে শুয়ে ক্ষুদ্র দুই অসহায় বীজ।
তুচ্ছ বীজ অসহায়, হাওয়া বয়ে যায় দ্রুত বেগে
হৃদয়ে সাহস ভরে দিবসের জন্যে বুক বাঁধি।
অবিরত ভালোবাসা গড়ে তোলে লতার শিকড়
একান্তে প্রোথিত হয় ভূমির জরায়ুগর্ভে, ডাকে,
“মৃত্যু, তুমি থেমে থাকো, আমি আছি দোর আগলে দৃঢ়
হত্যা, ঘৃণা, প্রেম: সব আমার হৃদয়ে একাকার।”
ভয়ের কারন নেই, তীব্র শীতে অবিশ্রান্ত ঝড়ে
গ্রন্থির আশ্রয়ে ধরা তোমার শিকড় উষ্ণ রাখে।
[অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় কবি, রাজধানী ক্যানবেরার একটি মহল্লার নাম দেওয়া হয়েছে “রাইট”, তাঁর নামে। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনে এবং ভূমিজ মানুষদের জমির অধিকার রক্ষায়। নানান পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত তিনি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” গ্রন্থ থেকে কবিতাটি নেওয়া হয়েছে।]
অক্টোবর ২০১৯ [ক্রমশঃ]
0 comments: