জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে
Posted in জংলা ডায়েরি
৭
"সুন্দরের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে
সুন্দর, সময় হলে, বৃক্ষের নিকট চলে আসে
শিকড়ে পাতে না কান, শোনায় না শান্ত গান
করতপ্ত ভিক্ষা দিতে বৃক্ষের নিকট চলে আসে..."
(শক্তি)
কমলদা একবার লিখেছিলেন, সিংভূম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভূমি শেষ। বড়ো সত্যি কথা। দক্ষিণ পশ্চিম সিংভূমের সীমান্তের ঐ সাতশো নীল পাহাড় চূড়া আর নিচের দিকে তাকালে সবুজ বনজঙ্গলের মাঝে কেওঁঝরের বোলানি, মহিষানি, বড়বিলের লাল হিমাটাইটের খাদান। সাহেবরা তাকে ব্লাড ওরও বলে থাকে। প্রায় আবিরের মতই রাঙিয়ে দেয় সারা শরীর। মনও রাঙায়। নাহ, এ রাঢ় পৃথিবীর লাল ধুলো নয়। অন্য লাল। সব রক্তই কি একই রকম লাল? বৃক্ষের নিকটে কোন শান্তি, স্বস্তি পেতে যাওয়া? শ্যামলছায়া না বোধির শিকড়?
চিরিয়া মাইন্সের কাছে নদীতে এখন ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, এবার সারান্ডা পেরোবো লাল মাটির পথ দিয়ে। আগে মাইন্সের মালগাড়ির গার্ডের সঙ্গে গপ্পো করতে করতে ঝিক ঝিক যেতুম সারান্ডার পার। এবার অন্য পথে।
চক্রধরপুর পেরোলেই একটু একটু করে জঙ্গল কাছে আসতে থাকে। প্রথমে ছাড়া ছাড়া, চাবি ঘুরিয়ে তানপুরো বাঁধার সময় সুর-বেসুর যেমন তার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন স্লো মোশনে সবুজ বনস্পতিরা এগিয়ে আসে। লালমাটি, ধূসর ঘাসজমি, মোরমফেলা রাস্তা, খাপরাছাওয়া কুঁড়ে, ইতস্তত মোরগ, ছাগলছানা, শ্যামলা মানুষদের জটলার গুয়াশ পটচিত্র। শালবীথির ছায়া মেলা পথের পাশে অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়ি সাজিয়ে বসে থাকা শাদা শাড়ি, উজ্জ্বল কৃষ্ণা ধরিত্রীকন্যারা। তারা হাঁড়িয়ার পসারিনী। সব কথাতেই হেসে আকুল, কিন্তু সহজাত সম্ভ্রমের কাচের দেওয়াল ভাঙেনা সচরাচর। সোনুয়া, টুনিয়া, গইলকেরা, পোসাইটা.... ছবির মতো ইস্টিশন সব, লালসবুজ পথে জলরঙে আঁকা লেভেল ক্রসিং, লাইনের দুধারে সাজানো গিট্টিপাথর-চুনাপাথরের বেড পেরিয়ে, সার সার কৃষ্ণচূড়ার আগুনলাগা বীথিকাদের দুলিয়ে দিয়ে, টানেলের পর টানেল আরপার, ছুটে যায় বি এন আর লাইনের ট্রেন। পোসাইটার পরেই এসে থামে আমাদের জঙ্গল রাজধানী, মনোহরপুর।
মনোহরপুর স্টেশনের বাইরেই একটা তেমাথা। উত্তরের রাস্তাটা নন্দপুর হয়ে চলে গেছে পোসাইটা আর অন্য রাস্তাটা সোজা পূবদিকে একটু গিয়ে ঘুরে গেছে দক্ষিণে। কোলেবিরা- হাটগামারিয়া শীর্ণ সড়ক। এই রাস্তাটা সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে কোয়না নদীটিকে। মনোহরপুরেই কোয়্না এসে মিলিয়ে গেছে কোয়েল নদীতে। এই কোয়েল দক্ষিণের কোয়েল। উত্তরে ডাল্টনগঞ্জে যে রয়েছে সে উত্তর কোয়েল। এই দুই কোয়েলের মতো মায়াময় স্রোতস্বিনী আমি তো আর দেখিনি কোথাও। খুব ক্লিশে উপমা বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নদী আর নারী। হে শব্দফতুর কবি, নদীকে দেখো, নারীকে ছোঁও, ডুব দিও নিভৃতে, একা। তার পর ভেবে দেখো। কারো,কোয়েল, কোয়না, খড়কাই, সুবর্ণরেখা,.... অতো সহজে ধরা দেয় না।
সালাই পর্যন্ত গিয়ে হাটগামারিয়ার রাস্তা ছেড়ে ধরতে হলো ছোটা নাগরার ভাঙাপথের রাঙা ধুলোর সড়ক। কোয়না চলেছে পাশে পাশে। ছোটা নাগরা পেরিয়ে সোজা দখিনে উঠে গেছে পাহাড়ের পথ। কোয়নার উপর ব্রিজ পেরিয়ে বরাইবুরুর ঘাটি। এখান থেকে আবার সঙ্গী হবে কোয়নার সখি কারো।
এইখান থেকে শুরু হলো সারান্ডাসুন্দরীর চেহলসুতুন। অন্দরমহলের দেউড়ি। ঢুকতে গেলে পাসওয়র্ড লাগে। খুব ছোট্টো। লিখে রাখার দরকার নেই। বুকের ভিতর খুঁজলেই পাওয়া যাবে। 'ভালোবাসা'।
"দূরত্ব নিকটে আসে , আমি তার শরীরের বিচ্ছুরিত আলো
পান করি প্রাণপনে মদিরার মতো করে ক্রমশ নেশায়
ধবল হবার পর টের পাই সে আমার ঊরুর উপরে
হাত রেখে বলে 'নদী যখন সংকীর্ণ থাকে, তখনি তো তাকে
লোভনীয় মনে হয়....." (দূরত্ব- বিনয়)
ভূগোল বইয়ের বাইরে প্রথম গল্প শুনি তার। লীলা মজুমদারের 'আর কোনোখানে'। পতাকার তিরঙ্গার মতো পাশাপাশি তিনটে পাহাড়ের রেঞ্জ। গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া। পশ্চিম থেকে পূবের দিকে টানা। সম্ভবত দেশের সব চেয়ে ঘন জঙ্গলহৃদয় রাজ্য। নাম মেঘালয়। কজনই বা জানে? সারা অবিভক্ত উত্তরপূর্বাঞ্চলের সদর ছিলো চেরাপুঞ্জি। এখন যার নাম সোহরা। সিলেটের সমভূমি ছাড়িয়ে সাহেবরা দখল করেছিলো শেষ খাসি সিয়েমের (রাজা) রাজপাট। নাম দিয়েছিলো চেরাপুঞ্জি, কমলার বাগান। তার পর ভিজতে ভিজতে অস্থির হয়ে সেখান থেকে সদর তুলে নিয়ে এলো শিলঙে। শিলং অনেকদিন ছিলো সারা উত্তরপূর্বের মহারানি। জঙ্গল যাদের টানে, সোহরা, মওসমাই আর মাওমলুহ, অরণ্যসাম্রাজ্যের টান তাদের ডুবিয়ে দেবে। মধ্য মেঘালয়, অর্থাৎ খাসিপাহাড়ের এলাকা পৌঁছোনো সহজ। কিন্তু মওসিনরাম রিজার্ভ ফরেস্ট মাশা'আল্লাহ। হায়, পূবদিকে গারোপাহাড়ের রাজ্যে বহিরাগত 'দিকু'দের জন্য দরজা খোলা থাকে না। গেটক্র্যাশ করে যাওয়া যায় বটে। কিন্তু দুঃসাহস করা খতরনাক হতে পারে। না হয় মাওসমাই, মাওলং, মওসিনরাম, মাওলিনলঙের জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেই খুশি থাকি । সারাজীবনেও ফুরোনো যাবে না ঐ সবুজের টেবলস্প্রেড।
গুয়াহাটি শহরটা আমার ভালো লাগে। নানা কারণেই। তা নিয়ে কথা পরে। এই শহরটার মেরুদণ্ড হলো জি এস রোড। গুয়াহাটি শিলং রোড। উত্তরে পল্টন বাজার থেকে দক্ষিণ পূর্বে গড়াতে গড়াতে জোড়াবট মেঘালয় বর্ডার। এবার সোজা দক্ষিণ। উমলিং পেরোলেই রাস্তার ডানদিকে নংখাইলেম অভয়ারণ্য শুরু হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো পাহাড়ের চড়াই। ফার্ন, কনিফার আর অর্কিডের রাজত্ব। মাওলিংখং এসে গেলো মানেই উমিয়াম লেক। 'স্বর্গ যদি কোথাও থাকে'র এলাকা। তার পরেই ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে শিলং। লীলা মজুমদার বা অমিত রে'র শিলং তো আর নেই। তবু যা আছে, তাকে মাত দেয় কে? চারদিকেই পাহাড় আর কত রকম সবুজ। যেদিকেই যাই নানা মুডের জঙ্গল বিছিয়ে রেখেছে তাদের সংসার। কিন্তু যাবো তো নিশ্চিন্দিপুর। আরো দক্ষিণে।
শিলং থেকে মাইলিয়েম হয়ে উমলিমপং। সেখান থেকে রাস্তা দুভাগ। ডানদিকে সোহরা-শেলা রোড আর বাঁদিকে ২০৬ জাতীয় সড়ক চলে যাবে সোজা ডাউকি বর্ডার। যেখান থেকে হাত বাড়ালেই জিলা সিলেট। জাফলং জিরো পয়েন্ট। ছবির মতো সুন্দর ডাউকি নদীর দেশ বদলে নামও পাল্টে যায়। গোয়াই। খাসি পাহাড়ের পূর্বদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে যাওয়া এই রাস্তার ডানদিকে রঙ্গেন, লাইটিং, পংটুং নানা নামের জঙ্গলমহল। জঙ্গলের কী আর নাম হয়? নদীর মতো'ই। সির্ফ এহসাস হ্যাঁয় জো রূহ সে মহসুস করো। মানুষ নাম দেয় তার। জাত'ও দেয় নিজেদের মতন করে।
বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলেই উমটিংগর নদীর তন্বী ধারার উপর একটি মারাত্মক বাঁক। আড়াআড়ি পাহাড়ি নদীর ব্রিজ। শাদা রেল। নীচে খ্যাপা স্রোত ছোটোবড়ো পাথরের গোল গোল নুড়ি কাঁপিয়ে ছুটে যাচ্ছে মাওফলং বাঁধের দিকে। পশ্চিমে। এই রাস্তাটিই চলে যাবে সোহরারিম পাহাড়জঙ্গল। দুয়ান সিং সিয়েম ডিম্পেপ উপত্যকাটি এলেই টের পাওয়া যায় এদেশি পাহাড় আর জঙ্গলের আসল চেহারা। খুবলেই অরণ্যের দেশ। ঢেউয়ের মতো সবুজ পাহাড়ের স্রোত। তারা মাথায় উঁচু নয়। কিন্তু তাতার সৈন্যদের মতো ঘনপিনদ্ধ আর নানা শেডের সবুজ ইউনিফর্মে স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে সমঝদারদের জন্য। উত্তর দিক থেকে রাশি রাশি চণ্ড পর্যটক সুমো আর কোয়ালিস সওয়ার, চোখের সামনে স্মার্টফোনে ভিডিও ধরতে বেশি ব্যস্ত। ঘড়ি মেপে ড্রাইভারকে তাড়া, আলো কমার আগে শিলং ফিরতে হবে। তার উপর গাড়ির জাম লাগলেই চিত্তির। কখনও কখনও তো রাত ভোর হয়ে যায়। তার উপর কখন যে ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, তারও ঠিক নেই। হে অস্থির পথিকবর, একটু থামো। গাড়ি থেকে নামো। বাঁদিকের ঢাল রাস্তায় যতোদূর নেমে যাওয়া যায়, নেমে যাও। পা'য়ে জড়িয়ে যাবে সিলভার ফার্ণ, পিচার প্ল্যান্ট আর লেমন ঘাস। উপরি পাওনা তার সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকা জলবিন্দুর স্বগত আশ্লেষ।
জঙ্গল আসলে উমিয়াম থেকেই পুরোদস্তুর চার্জ নিয়ে নেয়। ঘরদোর, গাড়িবাড়ি, মানুষফানুস সব গৌণ লসাগু। থাকলেও হয়। না থাকলেই বোধ হয় ভালো। ঐ হ্রদটা একটা মায়াবী আয়োজন। শিলং ঢোকার আগেই প্রেমিকদের হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়। সেখান থেকে শিলং হয়ে সোহরা-শেলা রাস্তার সব দিকই চোখ মজিয়ে রাখে। দক্ষিণের পথে অরেঞ্জ রুট নামের একটা সরাইখানার কাছে একটা হেয়ার পিন বেন্ড। পৌঁছে গেলো চেরাপুঞ্জি।
গাড়ির ড্রাইভার আঙুলের কর গুণে গুণে বলে দেবে কোথায় কোথায় যেতে হবে। সে সব জায়গায় যাওয়াই যায়। যেতেও হয়। এতোদিন পরেও কিন্তু সোহরা পুরোনো হয়না। তার কৌমার্যের জাদু মানুষের পাপস্পর্শকে ধুয়ে দেয় অবিরল বৃষ্টিধারায়। এখানের অরণ্যচরাচর দেশের অন্য সব প্রান্ত থেকে এভাবেই আলাদা, অনন্য। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ভরে থাকা সবুজের ঢেউ হয়তো ধরাছোঁয়ার থেকে একটু দূর। সারান্ডার মতো, সাতপুরার মতো, পঞ্চগনির মতো বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরা যায়না এখানে। কিন্তু তাদের সত্ত্বাকে অনুভব করা যায়। তাদের প্রাণস্পন্দনকেও। পরজীবী, এপিফাইটস, অর্কিড আর ফার্নবনের উপর ঝরে পড়ে কনিফারের পাতা গড়ানো টুপটাপ ফোঁটা। আনাচে কানাচে প্রপাত থেকে মুক্তধারায় উৎফুল্ল জলের ঝাঁপ। জামা ভিজে যাওয়া, সপসপে জুতো আর কুয়াশার ওপারে চশমার কাঁচে শুধুই ক্লোরোফিলের রামধনু। সাতটা রং'ই তো সবুজ। তবু তারা আলাদা। হরি কা ভেদ না পায়ো, কুদরত রঙ্গীবেরঙ্গী ।
".... করবো না অরণ্যে রোদন, না কী দরকার,
অরণ্য নিজেই আজন্ম রোদনে বাঁধা, তাই নিয়ে তার
পাখিদের সাথে গেরস্থালী, গাছপালাদের ভরণপোষণ,
তাই নিয়ে তার রোদে পোড়া, জলে ভেজা, ঝড়ে ওপড়ানো......"
( অনাদি অরণ্য যেন-হাসান হাফিজুর রহমান)
(ক্রমশ)
0 comments: