undefined
undefined
undefined
প্রবন্ধ - পৃথা কুণ্ডু
Posted in প্রবন্ধ
‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’
পৃথা কুণ্ডু
গঙ্গাযাত্রা করতে চাইছেন এক বৃদ্ধা। দীর্ঘদিন রোগভোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ‘চান্দ্রায়ণ’-এর বিধান রয়েছে। কিন্তু পরিবার-পরিজন সবাই দ্বিধায় – চান্দ্রায়ণের পরও যদি দেহে প্রাণ থাকে, তাহলে ত আর বাড়ি ফিরে যাবার উপায় নেই। গঙ্গার ধারেই আটচালা বেঁধে কাটাতে হবে আমৃত্যু। কিন্তু বৃদ্ধা নিজেই যে অস্থির হয়ে উঠছেন সংসার থেকে ছুটি পেতে। অগত্যা আত্মীয় স্বজন, গ্রামের লোকজন সবাই মিলে যাত্রা করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল গঙ্গার ঘাটে। দিনভর চলল পুজোপাঠ। তারপর বেলা গড়াতে বৃদ্ধা নিজেই সজ্ঞানে বললেন, আর দেরি নয় – এবার তোরা আমায় অন্তর্জলি কর। সবাই কাঁদল, শেষবারের মত পায়ের ধুলো নিল তাঁর। তারপর, গঙ্গার জলে তাঁর শরীর স্পর্শ করা মাত্রই সব শেষ।
অবাক বিস্ময়ে ঠাকুমার জীবনের এই ‘মহাসুন্দর শেষ’-এর সাক্ষী হয়ে ছিল বছর পাঁচেকের ছেলেটি। বড় হয়ে সে লিখল, “ঠাকুমার মৃত্যু আমাদের সংসারে একটা বিরাট ছন্দপতন। কিন্তু ঠাকুমা তো সেটা বুঝতে দিলেন না কাউকে। কত সুন্দরভাবে, সুর লয় ঠিক রেখে শেষ করলেন তাঁর জীবনের পর্ব। জীবনকেও তাহলে সুরে বাঁধা যায়।... সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, হতাশা - এর কোনটাই সুরের আওতার বাইরে নয়। প্রচণ্ড আনন্দ, প্রকাশটা ঠিক সুরে না হলে সেটা মিষ্টি না লেগে তেতো লাগবে। তেমনি দুঃখের কান্নাটাও বীভৎস ঠেকবে যদি না বিলাপটা সুরে সুরে বেরিয়ে আসে।... সেই সুরের সন্ধানেই আজও এগিয়ে চলেছি”।
এই উপলব্ধির কথা লিখেছেন যিনি, তাঁর সুরের যাদুতে মেতেছে পাঁচ প্রজন্ম। তিনি নামে হেমন্ত, কণ্ঠে চিরবসন্ত। রবীন্দ্রসংগীত থেকে গণসংগীত, বাংলা আধুনিক থেকে হিন্দি গীত-গজল, ছায়াছবির রোমান্টিক গান থেকে পুজোর গান, মেঠো সুরের আদলে লোকগান থেকে উদাত্ত-গভীর স্তোত্রগীতি – কি নেই তাঁর সুরের ভাণ্ডারে? শ্রোতাদের আনন্দ দিতে নানা ধরনের গান তিনি গেয়েছেন জীবনভর। শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতির খোঁজ অনেকসময়ই পাওয়া যায় না বৃহত্তর জনসমাজের জন্য নিবেদিত তাঁর সৃষ্টিতে - একথা ঠিক, তবু মনে হয় – শেষের গানে, চলে যাবার গানে কি আলাদা মাত্রা পেত তাঁর মরমি পরিবেশন, গভীরতর কোন বোধের আবেদনে সাড়া দিত তাঁর দেবকণ্ঠ? তাঁর সারা জীবনের সুরসর্বস্ব অনুভবের পেছনে যে ঘটনার কথা তিনি নিজে স্বীকার করে গেছেন – তার অবচেতন বা পরোক্ষ প্রভাব কি পড়েনি এই ধরনের গানে?
ভিন্ন ভিন্ন শ্রোতার বোধ ও রসগ্রাহিতা হয়তো আলাদা কথা বলবে। ‘আমিও পথের মত হারিয়ে যাব’ হয়তো কারও কাছে শুধুই একটি ভাললাগার, মন-উদাস করা গান, আবার কারও কাছে ‘চোখের আলো নিভল যখন মনের আলো জ্বেলে/ একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে’ – কথাগুলোর সুর আর উচ্চারণ জীবনের চরমতম সত্য। ‘গাঁয়ের বধূ’র শেষে যখন ‘ভাঙা কুটিরের সারি’ আর ‘আশা স্বপনের সমাধি’ শব্দগুলো আসে, কেমন যেন বুকছেঁড়া, স্বজন হারানোর ব্যথা ঘনিয়ে ওঠে হেমন্তকণ্ঠে। যারা শোনে, তাদেরও হয়ত – কে জানে কোন ফেলে আসা, চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলা পুরনো বেদনার স্মৃতিতে ভারি হয়ে ওঠে মন।
ছায়াছবিতে ‘সিচুয়েশন’ অনুযায়ী গান পরিবেশন যে কোন পেশাদার শিল্পীর দায়বদ্ধতা। এ নিয়ে হয়ত আলাদা করে বলার কিছু নেই। ‘লালন ফকির’ ছবিতে ‘সব লোকে কয়’ বা ‘আমি আছি কোথায়’-এর মত বহুল প্রচারিত না হলেও, ‘চিরদিন কাঁচা বাঁশের খাঁচা থাকবে না’ গানটি আলাদা মাত্রা পেয়েছিল হেমন্তর গলায়। লালনের গুরু ফকিরসাহেব এই গানটি শুনতে শুনতে পাড়ি দেন দুনিয়াদারি ছেড়ে। তেমনই ‘নাগিন’-এ ‘ও জিন্দেগি কে দেনেওয়ালে/ জিন্দেগি কে লেনেওয়ালে’, ‘প্রতিমা’ ছবিতে ‘কবর দাও বা চিতায় পোড়াও’ বা ‘কাল তুমি আলেয়া’র ‘যাই চলে যাই’ তো বিশেষ ভাবে মৃত্যুর অনুষঙ্গেই লেখা গান – সচেতন শিল্পী এই ধরনের গানের প্রতি সুবিচার করবেন, এটাই স্বাভাবিক – হয়ত বলবেন অনেকে । তাহলে একটু অন্যরকম গানের কথা মনে করে দেখি – যেমন ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটি। অতি-পরিচিত এই রবীন্দ্রসংগীত পাড়ার জলসায়, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে পুনর্মিলন জাতীয় উৎসবে সকলে মিলে, সুরে-বেসুরে এতবার গাওয়া হয় যে গানের ভাব বা বাণী নিয়ে অন্যরকম কিছু ভাবার কথা মনেই আসে না। ‘অগ্নীশ্বর’-এ হেমন্তর গলায় গানটি যখন পর্দায় এল, বয়স্ক নায়ককে দেখতে আসা পুরনো বন্ধুদের মত দর্শকও নতুন করে ভাবতে বসল – বাইরে থেকে কড়া মেজাজি, বেপরোয়া, বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ডাক্তারবাবুর মধ্যে যে অসহায় বিপত্নীকের প্রাণ এমন করে লুকিয়ে ছিল, কে জানত? এ ছবির শেষ দৃশ্যেও আর এক অভিনব সংগীতায়ন। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ তো দেশাত্মবোধক গান হিসেবেই জেনেছি এতদিন। অগ্নীশ্বরের হাত কেঁপে ফুলগুলো পড়ে যাওয়া, উঠোনে লোকের ভিড়, তারপর পর্দা জুড়ে চিতা জ্বলে ওঠার অপেক্ষা – সব কিছুর সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মানিয়ে যায় সম্পূর্ণ অন্য মেজাজের একটি গানের শেষ স্তবক – ‘ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি / আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’। সৌজন্যে সেই অনুপম কণ্ঠ – যার আবেদনে মৃত্যু হয়ে ওঠে অমৃত।
একজনের কথা মনে পড়ে, সাউণ্ড এফেক্ট-এর কারিকুরি নিয়ে গবেষণা করত। গান শুনত কান খাড়া করে, কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণের মানসিকতা নিয়ে। একদিন ‘পলাতক’-এর শেষ অংশের অডিও চালিয়েছে ল্যাপটপে, নোট করে রাখছে শব্দপ্রয়োগের খুঁটিনাটি। ‘বসন্ত-ও ও’ বলে বৌদির আকুল চিৎকারের পর সন্ধ্যার মত ঘনিয়ে এল ধীর লয়ে, টানা সুরে সেই গান – কোন আবহ বা যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই খালি গলায় - ‘তোমার ঘরে সুখের বাতি যেন নেভে না কো/ আনন্দ পাখিটা বন্ধু বন্দী করে রাখো/ সুখে থাকো তুমি বন্ধু আমি চলে যাই/ আমি চলে যা—ই’… গবেষকের আঙুল আলগা হয়ে পেনটা খসে পড়ল টেবিলে, সমর্পণের ভঙ্গিতে শুধু শুনতে লাগল - এ গান কি বিশ্লেষণ করা যায়!
মানুষের জন্য নানা ধরনের গান গেয়ে যাওয়া তাঁর ‘কাজ’, তবু হেমন্তর নিজের কথায়, তিনি সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেতেন রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে। বিভিন্ন স্মরণসভায় তাঁর গলায় বাছাই করা কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত অন্যরকম গভীরতা এনে দিত সামগ্রিক পরিবেশে। সমরেশ বসুর স্মৃতিসভায় নিজের অসুস্থতা, ক্লান্তিকে হার মানিয়ে গেয়েছিলেন ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে…’ দর্শকের আসনে বসা তাঁর কবি-বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায় – ‘সারা হল স্তব্ধ। কারও মুখে কথা নেই’। মাতৃবিয়োগের পর ভেঙ্গে পড়া আর এক বন্ধুকে একান্তে সান্ত্বনা দিতে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিরিবিলি গঙ্গার ঘাটে; বন্ধুকে বুকে চেপে ধরে শুনিয়েছিলেন একের পর এক মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রসংগীত। পরে সেই বন্ধুর স্বীকারোক্তি – ওই দিনটা তিনি কোনদিন ভুলতে পারবেন না।
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘তুমি কি কেবলই ছবি’, ‘আমার যাবার বেলা পিছু ডাকে’, ‘যখন ভাঙল মিলনমেলা’, ‘মরণের মুখে রেখে দূরে যাও চলে’, বা ‘কে বলে যাও যাও আমার যাওয়া ত নয় যাওয়া’-র মত গান অন্য শিল্পীরাও গেয়েছেন, কিন্তু কিভাবে যেন এক অননুকরণীয় হৈমন্তী বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়ে গেছে এই সব অশেষ-করা গানে – যেমন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ বা ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ অনেকের কাছেই ‘দেবব্রত বিশ্বাসের গান’। একজনের দাদুর মৃত্যুদিন ১৬ জুন – প্রতিবছর সে ওইদিন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি চালিয়ে, হেমন্তর সঙ্গে নিজে গলা মেলায়। এসবই মূলত বক্তিগত অনুভূতি, তা বলার অপেক্ষা নেই – কিন্তু তার বেশি কিছুই কি নয়!
হেমন্ত-অনুরাগীদের বিচারে জনপ্রিয়তার তালিকায় বরাবর উপরের দিকে থাকা ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ গানটি নাকি প্রথমে অন্য একজন শিল্পীর গাওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে ওঠেনি। হেমন্তর রেকর্ড বেরোবার পর গান শুনে সেই শিল্পীর নিজেরই মনে হয়েছিল, ‘আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’র কথা ও সুর তিনি এমনভাবে লাগাতে পারতেন না। আরও এক আশ্চর্য সমাপতন – হেমন্তর শেষ রেকর্ড করা গান ‘একটাই শুধু প্রশ্ন আমার… শ্মশানেতে কত লোক হবে’। গানটি গাওয়ার পর মজার ছলে নাকি কথা আদায় করে নিয়েছিলেন অনুজ সুরকারের কাছ থেকে – ‘কি সব গান গাওয়াচ্ছিস আমায় দিয়ে! তাহলে আমি চলে গেলে এই গানটা বাজাবি তো’? তিনি নিজে কি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু? তার কয়েকদিন আগে, জীবনে শেষবার বাংলাদেশ সফরে গিয়ে খোঁজ করেছিলেন এক পূর্বপরিচিত অনুরাগীর। জানতে পারলেন, ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে একা চলে গিয়েছিলেন তাঁর কবরের পাশে। ভক্তের সমাধির পাশে বসে কোন গান শুনিয়েছিলেন কিনা, সেকথা জানা নেই।
শেষের গান নিয়ে বলতে শুরু করে, শেষ করা সত্যি বড় কঠিন মনে হচ্ছে। আরও একটা গল্প দিয়েই না হয় শেষ করা যাক। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। পাতানো ভাইবোন। ছেলেটি লতাজির গানে পাগল, মেয়েটি হেমন্ত-ভক্ত। গলায় সুর থাক বা না থাক, ছেলেটি গাইত ‘সারাদিন রিমঝিম কত বৃষ্টি/ কত বৃষ্টি হয়েছে মন জুড়ে’ – মেয়েটি পাশ থেকে ধরত পরের লাইন। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি ছিনিয়ে নিল দাদাকে; বোন পাথর হয়ে গেল যেন। গান শুনতেও ভাল লাগত না অনেক বছর; কাউকে বলে বোঝাতে পারত না কিছু। কেবল যন্ত্রের মত কাজ আর দিনগুলো কাটিয়ে যাওয়া। রাতের পর রাত ঘুম হত না। কয়েক বছর পর ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ আটকে গেল একটি সিডিতে। লন্ডনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লাইভ রেকর্ডিং-এর সংকলন। মেয়েটি কিসের টানে যেন আর থাকতে পারল না – মাসের শেষ, তবু কিনে ফেলল। সন্ধ্যেবেলা সিডিটা চালাল সে একলা ঘরে। প্রথম গানটি আগেও শোনা, দ্বিতীয়টি ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’। হেমন্তর গলায় এ গান তার শোনা ছিল না। ‘বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে …দু বাহু বাড়ায়ে’ শুনতে শুনতে সে কাঁপল, কাঁদল – দুঃখে নয়, আনন্দে – কে বলে সবকিছু শেষ, কে বলে তার আপনজন ছেড়ে গেছে তাকে? সে তো রয়েছে সমস্ত অস্তিত্বে মিশে। জীবনদেবতা সেদিন বোধহয় গানের রাজার অশরীরী কণ্ঠে ভর করে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন জীবনে, তুলে এনেছিলেন চরম মানসিক যন্ত্রণার গভীরে তলিয়ে যাওয়া থেকে।
তিরিশ বছর হয়ে গেল – হাজার হাজার অনুরাগীর প্রিয়জন হারানোর বিষাদে ঘেরা ২৬ সেপ্টেম্বর ফিরে আসবে আবার। কিন্তু এবছর যে তাঁর শতবার্ষিকীও। ক্ষয়, লয়, বেদনা, শোক, স্মৃতি-বিস্মৃতি সবকিছু ছাপিয়ে তাই সত্য হযে থাকবে তাঁর কণ্ঠে –
কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি।
0 comments: