1

গল্প - পিউ মহাপাত্র

Posted in

বড়ির সুতো
পিউ মহাপাত্র

গরমটা যখন আশেপাশের পাথর ফাটিয়ে মাটির গভীরে চুইয়ে গিয়ে লুকানো জলের তলটুকুতে প্রায় ছুঁতে যায় যায়, ঠিক সেই সময়টাতে বড়ি দেখেছে, ওদের ছাদের টবে সার দিয়ে রাখা অ্যাডেনিয়াম গাছগুলোর মোটা মোটা, পুরুষ্টু, বিজভরা শুটিগুলো কেমন নড়েচড়ে ওঠে যেন। নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করে ওরা। ওদের আখরোঠি গায়ে কচি আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে দেখে নেয় বড়ি, বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে, তেতে ওঠা রোদের ওমে শুটিগুলো ঝনঝনে হল কিনা। 

‘ডিম ভরা ট্যাংরা দেখনি যে কখনও বড়ি দিদিমণি, তা নইলে বুঝতে ভরা ভাদরে কী মন্থর গতি ওদের। জলের তলে সুতোর মত ডিম ছেড়ে যায় মা আর ভাসতে ভাসতে সে ডিম কখনও রুই কখনও মৃগেল এর প্যাটে। টবের মাটি ঝুরো করতে করতে আলগা করে কথাগুলো বলে হারান জেঠ্যা। কবেকার লোক কিন্তু গল্পগলো কেমন ঝকঝকে নতুন। ট্র্যেপ ফ্রকটা হাঁটুর ফাকে গুঁজে ঘাড় গোঁজ করে বসে বড়ি। দুখি গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তাতে বুঝি ট্যাংরা মায়ের দুঃখ হয় না কোনও?!’ হারান জেঠ্যা তাতে হাসে না কাশে তা বোঝা বড়ই মুশকিল। মুশকিল তো বড়ির ও। দিদুনের চরম হাঁকডাকে ঘরের ভেতর ঢুকে আসতে হয় বইকি। এই ভীষণ রোদে বাইরে থাকলে নাকি বড়ির মাথা আর পেট - দুটোই বিগড়বে। পথ্য হিসেবে ঘন ঘন বেলের পানা খাওয়ার চেয়ে মৃগেলের ‘প্যাটে’ যাওয়া ঢের ভাল, সে বড়ি ছাড়া আর কে ভাল জানে! আগত্যা, বিকেলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অঙ্ক খাতা টেনে নেয় বড়ি ডিমভরা ট্যাংরার মন্থর গতিতে। 

ভর দুপুরে যখন ডেঁয়ো পিঁপড়েগুলো পর্যন্ত গাছেদের ছায়ায় খানিক খানিক জিরোয়, তখন বড়ি পা টিপে টিপে ওপরের ছাদে শিকলি খোলে। অ্যাডেনিয়াম গাছের মোটা মোটা বেঁটে গুঁড়িগুলো দেখলেই বড়ির কেমন পুরীর মঠে দেখা সেই বুড়িটার কথা মনে পড়ে। তার পা দুটোও এমন মোটা আর জল টুসটুস। ড্যাবড্যাব করে তাকানোর জন্যে বিনুনিতে হ্যাঁচকা দিয়ে পিকুদা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘গোদ! বেশি দেখলে তোরও হবে!’ মনে পড়তেই শিউরে উঠে চোখ সরিয়ে নিল বড়ি গাছের গুঁড়ি থেকে সটান নিজের লিকলিকে কচি ঠ্যাং-এ। নিচু হয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে কান পাতল ডালে ডালে ঝুলে থাকা বীজভরা শুটিতে। পুরুষ্টু, আটানো খোলের ভেতর ছনছনে বীজের দানা খলবলিয়ে উঠল যেন। 

সারাটাক্ষণ কান পেতেই রেখেছে বড়ি। ফুটফাট শব্দ শুনছে কি অমনি তরতরিয়ে ছাদের পানে ছুট। অমন শক্ত মোটা বীজের খোল ফাটলে কি একটুকুও শব্দ হবে না? জ্যাঠা বলেছে নৌকোর মত শক্ত খোল দুপাশে মেলে উড়ে যাবে কচি কচি বীজেরা। ওদের বাদামি রঙের বুকের ভেতর একটা করে গোলাপি উল্কি আঁকা। গরম হাওয়াতে দমকে দমকে গোত্তা খেয়ে উড়ে যাবে ওরা, ছোটুদের বারান্দা পেরিয়ে, জগবন্ধু ঈস্কুলের মাঠ পেরিয়ে, গোল পার্কের জল ছুঁয়ে ওই দূরে কালো পরীটার দিকে। বড়িকে যে সে ওড়ার সাক্ষী হতেই হবে। বর্ষা নামার আগে, ডানা ভেজার আগেই ওদের উড়ে যাওয়া যে বড়োই জরুরী। ওর দুচোখ দিয়ে যতদূর দেখা যায়, আর তারও পর অবধি, বড়িকে দেখে নিতে হবে যে। ফিরে এসে ওকেই তো বলতে হবে গাছ-পোঁতা মাকে, যে ওর দানারা হাওয়ায় পাল তুলেছে। এক টুকরো মাটি আর এক আঁজলা জল ঠিক পেয়ে যাবে ওরাও, ঠিক যেমন বড়িও পেয়ে গ্যাছে একটা নিজস্ব ডাকনাম আর সেই অচেনা আশ্রম থেকে এই দোতলা বাড়ির মজবুত খোলের পরম নিশিন্ত আশ্রয়। ওরাও পাবে বইকি!! নিশ্চয়ই পাবে!

1 comment: