0

গল্প - দোলা সেন

Posted in

নিষেধ মানতে হয়
দোলা সেন


[১]

কমল খুবই ভালো ছেলে। পড়াশোনায়, খেলাধূলায়, গানে – সবেতে চৌকস। এমন ছেলে নিয়ে বাবা মায়ের দুশ্চিন্তার কোনওই কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু আছে। বেশ গুরুতর রকমেরই আছে। অন্ততঃ বিকাশবাবু সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। ছেলে নিয়ে তাঁর অশান্তির শেষ নেই।

ঘটনাটা খুলেই বলি তাহলে। কমলের মাথায় একটা পোকা আছে। এমনিতে সেটা দিব্বি পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুম দেয়; কিন্তু একবার কেউ ‘এটা করো না’ জাতীয় কথা বলে দেখুক দেখি! ওমনি সেই পোকা চিড়বিড়িয়ে জেগে উঠে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করে দেয়। সেই নিষেধ অমান্য না করা পর্যন্ত তার নাচন কিছুতেই থামে না। বাস্তবিক, যে কোনোরকম নিষেধের গণ্ডী পেরোতেই হবে – এ কমলের এক অদ্ভুত জেদ। এর জন্য সে কম বিপদে পড়েনি, কম মারধোর খায়নি। কিন্তু এ রোগ তার সারেনি। বরং বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে এই বিচিত্র জেদটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বলেই বিকাশবাবুর ধারণা। তিনি এও ভাবেন – মা মরা ছেলে, হয়তো তাঁর অতিরিক্ত আদরেই এমন হয়ে উঠেছে কমল। মাঝে মাঝে উত্যক্ত হয়ে মারধোরও করেন না, এমন নয়। কিন্তু তারপরে বাবা ছেলের যৌথ কান্নার বানভাসির একটা দৃশ্য সবার চোখের আড়ালে সংঘটিত হয়।

এই রায়বাবুদের বাড়ির বাগানের কথাটাই ধরা যাক। বেশ বড় ফলের বাগান আছে রায়দের। বেশির ভাগই আমগাছ। সবকটাই ভালো জাতের। প্রতিবছর পাড়ার সব ছেলেমেয়েকে ডেকে পেটভরে আম খাওয়ান রায়গিন্নী। আমের আচার বানিয়ে সবাইকে ভাগ করে দেন। কিন্তু চুরি করে খেলে, মালীর হাতে ধরা পড়তেই হবে। সে লোকটি ভারি সেয়ানা। তাকে এড়াবার উপায় নেই। রায়দিদার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। শুধু বলেন, তোদের জন্যই তো। তবু লুকিয়ে খেতে হলো!

তারপর মালীকে গেট খুলে দিতে বলে একবারও পিছনে না তাকিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যান। কিন্তু সেই ছেলের দল স্পষ্ট দেখতে পায়, যেতে যেতে দিদা আঁচল দিয়ে চোখ মুচছেন। সেই দৃশ্য তাদের তাড়া করে বেড়ায়। ফলে, দাদু বা দিদা না ডাকলে ছেলেরা কেউ বাগানে ঢুকে উৎপাত করে না। কিন্তু সেবার হলো কি, রায়দাদুর ছেলে পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে একটা গ্রে হাউন্ডের বাচ্চা দিয়ে গেল। চারপাশে আজকাল নাকি চুরিচামারি বেড়েছে। তার ফলে, কদিন বাদে সে একটু বড়ো হতেই গেটের দরজায় নোটিশ টাঙানো হলো – কুকুর হইতে সাবধান। বিনা অনুমতিতে কেহ প্রবেশ করিবেন না।

ব্যস, হয়ে গেল! এত বছর ধরে রায়বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ইস্কুল যায় কমল, দাদু বা দিদা না ডাকলে ওবাড়ি ঢোকার কথা মনেও হয়নি তার। কিন্তু এই নোটিশটা দেখেই তার মাথার পোকাটা নড়ে উঠল। যদিও সে বোঝে না, নোটিশ সবসময় কেন সাধুভাষাতেই লেখা হয়, তবু বারণ যখন, তখন তো ব্যাপারটা দেখতেই হচ্ছে। অতএব, ইস্কুল থেকে ফেরার পথে হারুর হাতে বইয়ের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে সে পাঁচিলের ওপর উঠে বসল। তারপর লাফ দিয়ে ওদিকে নামতেই – সে কি বাস্ করলো তাড়া!

বেচারা কমল জানতো না যে গ্রে হাউন্ড আসলে রেসিং ডগ। তার সঙ্গে দৌড়ে এঁটে ওঠা সাধারণ মানুষের কম্মো নয়। তবে নেহাৎ বাচ্চা এবং ট্রেন্ড, তাই। নাহলে আজ আর আমায় এই গল্প লিখতে হতো না। যাই হোক, সেবারের ঘটনাটা ছেঁড়া প্যান্ট আর কিছু কাটাকাটির ওপর দিয়ে গেল। আর বাড়িতে ফিরে বাবার ছড়ি – সে তো উপরি পাওনা।

অবশ্য সবসময়েই যে ধরা পড়ত, এমনটাও নয়। টিফিন টাইমে স্কুল থেকে পালিয়ে আবার ফিরে এসে পরের ক্লাসটা করার কৃতিত্ব এই স্কুলে একমাত্র কমলেরই। এটা পড়ে যারা হাসবে তারা একবার হেডমাস্টার অবনীস্যারের ক্লাসে ধরা না পড়ে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখাক দিকি! ওরম মনে হয়! আবার সফল হলেই যে তার ফল ভালো হয় এমনটাও নয়। সেবার ঘোষলদের পুকুরে স্নান নিষেধের বোর্ড দেখে, সবার চোখ এড়িয়ে সেখানে স্নান করেছিল কমল। তারপর সাতদিন প্রবল জ্বরে কোঁ কোঁ করতে করতে বুঝেছিল, পুকুরের জল কোনো কারণে খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্যই ঐ নোটিশটা টাঙানো হয়েছিল।

এভাবেই চলছিল। কিন্তু কমল টেন পাশ করার পরে বিকাশবাবু দৃঢ় স্বরে ঘোষণা করলেন, কমল আর যাই পড়ুক, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া তার চলবে না। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেরা ভারি বদ হয়। কমল এমনিতেই বাঁদর, তার উপর ওইসব কলেজে গেলে সাপের পাঁচ পা দেখবে। তখন কমলের মাথার পোকাটা দুবছর ধরে সমানে নাচ করে গেল। একেবারে খড়গপুর আই আই টিতে চান্স পাওয়ার পর তার লাফানি থামল। বাড়ির আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবদের চাপে বিকাশবাবু নিমরাজি হয়ে ছেলেকে পড়তে যাবার অনুমতি দিলেন। তবে, কুলোকে বলে, সামনে হম্বিতম্বি করলেও তিনি নাকি ঘরের বন্ধ দরজার ওপারে নাচ করেছিলেন। ঐ নিষেধ বাক্যটি নাকি তাঁর একটি বুদ্ধিদীপ্ত চাল ছিল। কে জানে? হতেও পারে। বাবারা আসলে যে কী চান, তা বোঝা ভারি শক্ত।

[২]

তা বাবা যাই চেয়ে থাকুন, কমল বি টেক পাশ করলে। তারপর জি আর ই, টয়েফেল ইত্যাদি পরীক্ষা দিয়ে বাইরে পড়তে যাবার ছাড়পত্র আদায় করে নিল। বিকাশবাবু সামনে আশীর্বাদ ও আড়ালে চোখ মুছলেন। বিদেশে গিয়ে কমল একদম নতুন পরিবেশে গিয়ে পড়ল। আমেরিকার এই অঞ্চলে কেউ কাউকে চট করে কিছুতে মানা করে না। অথচ মোটামুটিভাবে সকলেই একটা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করে। এটাই এদেশের বৈশিষ্ট্য কিনা তা কমল জানে না। তবে, এখানকার লোকজনের প্রাত্যহিক জীবন যাপন কমলের বেশ পছন্দ হলো। অনেক বন্ধু বান্ধব হলো। তাদের সঙ্গে হৈ হৈ, গল্প, পড়া সব নিয়ে তার দিন ভালোই কাটতে লাগল। বাবাকে সে উৎসাহের সঙ্গে সব খবর জানায়। বাড়ির জন্য মাঝে মাঝে মন কেমনও করে বৈকি।

এখানে এসে কমল একটা নতুন শব্দ শিখল। লং উইকএন্ড। অর্থাৎ শনি রবির সঙ্গে শুক্রবার বা সোমবার ছুটি। যদিও পড়ার চাপে হাবুডুবু খায় অধিকাংশ সময়, তবু ফাঁক পেলে সে জন, ডিক বা চার্লির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। কখনো একটা হাইক, কখনো সমুদ্রের জলে হুটোপাটি, তাকে কিছুটা অক্সিজেনের যোগান দেয়। তবে বিদেশে পয়সার যোগান কম, তাই খুব বেশি কোথাও যেতে পারে না বেচারি। তা এইরকমই এক লং উইকএন্ড। কপালক্রমে এবার টানা চারদিনের ছুটি। ডিক প্রস্তাবটা দিল –

- এই কমল, ছুটিতে আমার বাড়ি চল। মা তোর গল্প শুনে তোর সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে। মা ইন্ডিয়ার গল্প পড়েছে। কিন্তু কোনও ইন্ডিয়ানকে চেনে না।

- ধ্যেৎ, আমি কি মিউজিয়ামের শো-পিস?

- সরি, আমি সেভাবে বলিনি রে।

কথার হাল ধরল জন –

- কমল, তুই মিথ্যেই অফেন্ডেড হচ্ছিস। মিসেস লংফোর্ড খুব ভালোমানুষ। আমি এর আগে একবার ডিকের সঙ্গে গিয়েছি। ডিক আমায় ডাকলে আমি যেতে রাজি আছি। ওদের বাড়িটা খুব সুন্দর জায়গায়। অনেকগুলো হাইকের রুট আছে।

- সরি জন। আমার বলায় ভুল হয়েছে। আমি তোদের তিনজনকেই আমার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

হৈ হৈ করে উঠলো সকলেই। এরপর প্রবল উৎসাহে সবাই মিলে রওনা দিল। বাসে ঘণ্টা তিনেকের জার্নি। গাড়ির চেয়ে সেটাই সস্তা। চার্লিরা জানে অন্য ব্যবস্থায় কমলের ওপর চাপ পড়বে। তাই ওরা ভান করে যে, সবারই ভাঁড়ে মা ভবানী। কমল যে একেবারেই বোঝে না, তা নয়, তবে ওদের এই মানসিকতাকে শ্রদ্ধাও করে। ডিকের বাড়ি যে শহরে, তা বেশ ফাঁকা জায়গায়। একটু মফস্বল মফস্বল চেহারা। অবশ্যই এদেশের নিরিখে। ঝকঝকে উঁচু নীচু পথ। দুধারে গাছের সারি। ডিকদের বাড়িটা একতলা। একটা ছোটমতো বাগানও আছে। বাড়িতে ডিকের বাবা, মা আর ডিকের বোন। সে এখানকার এক কলেজে পড়ে। ডিকের ঘরটায় ওরা চারজন মিলে থাকবে। ডিকের বাবা মায়ের আন্তরিক ব্যবহারে কমলদের অস্বস্তি তাড়াতাড়িই দূর হয়ে গেল।

দুদিন বেশ ভালোভাবেই পার হয়ে গেল। সকালে ওরা ব্রেকফাস্ট খেয়ে টিফিন প্যাক করে বেরিয়ে যেত। বিকেল বা সন্ধ্যায় ফিরে আসত। এই এলাকায় অনেকগুলো হাইক পয়েন্ট আছে। তৃতীয় দিনে ডিকের বাবা বললেন, আজ আমার গাড়িটা নিয়ে যাও। একটু দূরে মেলডি ফল হাইক আছে। ঘুরে এসো। খুব সুন্দর জায়গা, তোমাদের ভালো লাগবে।

হৈ হৈ করে উঠলো চারমূর্তি। মেলডি ফলসের একটা বাঁধানো ছবি আছে ডিকদের ড্রইংরুমের দেওয়ালে। অপূর্ব সেই ছবি। ডিক অবশ্য আগেও গেছে। এবারের যাত্রাপথে সেই গাইড। পরদিন ওরা বেশ সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ল। ইচ্ছে, হাইক তাড়তাড়ি শেষ হলে আসেপাশের জায়গাগুলোও দেখে নেবে।

তা হাইকটা করে মন ভরে গেল সবার। ছোট্ট নদীর পাশ দিয়ে বনপথ ধরে চলা, তারপর কিছুটা চড়াই পার হয়ে মেলডি ফলস্। ঝর্ণা যেন সত্যিই গান গেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পাথরের গা বেয়ে। লুকিয়ে থাকা পাখির ডাক, জলের কলস্বর, পাতার সরসরানি সব মিলিয়ে সুন্দর ঐকতান। এসব জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। ফেরার পথে একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করাল ডিক। পথের একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গ্রীন ক্রীক। সত্যি সত্যি পান্না সবুজ তার জল। তার ধরে দুইপাশে অজস্র বুনোফুল ফুটে আছে। সাদা, হলুদ, নীল, কমলা রঙের হোলিখেলা চলছে যেন। চারবন্ধুতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে গেল জলের কাছে। কিছুটা সময় কাটিয়ে, ছবি টবি তুলে উঠে গাড়িতে চড়তে যাবে, কমলের চোখ পড়ল রাস্তার অপর দিকে একটা কংক্রীটের পথের দিকে। সুন্দর আঁকাবাঁকা পথ, পাক খেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। অথচ সেই রাস্তার ওপর আড়াআড়ি করে একটা পাইপ লাগানো। তার গায়ে নোটিশ – ‘নো ওয়ান শুড এন্টার”!

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কমল। ওই পথটা তাকে টানছে। ভীষণভাবে টানছে। নিষেধের জন্য? নাহ্, তার চেয়েও অনেক বেশি এক আকর্ষণ। বলল –

- ওটার ওপাশে গিয়ে একটু দেখে আসি চল।

- আরে নিষেধ দেখছিস না?

- ধ্যুৎ, দিব্বি পরিষ্কার পথ। কোনও মানে হয়?

- এখানে এমনি এমনি মানা কেউ করে না রে। হয়তো পথ ভেঙে গেছে, কিম্বা অন্য অসুবিধা।

- একটুখানি যাবো তো। চল যাই।

- তুই বুঝছিস না, কোনও ঝামেলা হলে পুলিশ উৎপাত করবে।

- তাহলে তোরা একটু অপেক্ষা কর, আমি খানিকটা গিয়েই ফিরে আসব।

- তুই যাস না। ভুলিস না, তুই বিদেশী। আইন ভাঙলে তোর শাস্তি আরো অনেক বেশি।

- আরে, কিচ্ছু হবে না। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবো।

- সন্ধ্যে হয়ে আসছে কিন্তু, তাড়তাড়ি ফিরিস।

কমল আর অপেক্ষা করে না বন্ধুদের মতামতের জন্য। একলাফে পাইপের বেড়া ডিঙিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় রাস্তা ধরে। তিনজনে কিছুটা হকচকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। খানিকটা এগোতেই কমলের ভারি ভালো লাগতে থাকে চারপাশটা। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তাই বুনো পথ ধরে দ্রুত এগিয়ে যায়। অল্প সময়ে যতটা পারা যায় দেখে নিতে হবে। সুন্দর ঝকঝকে পরিষ্কার সোজা রাস্তা। দুপাশে ঘন বন। গাছের তলায় পুরু হয়ে জমে আছে ঝরাপাতার দল। ভারি নিস্তব্ধ চারপাশ। পাকা রাস্তা শেষ। এবার মেঠো পথ শুরু। ঘড়ির দিকে একঝলক তাকায় কমল। পনেরো মিনিট পার হয়ে গেছে। আর পাঁচ মিনিট এগোবে ও। তারপর ফিরে যাবে। সামনের রাস্তা ক্রমশঃ সরু হচ্ছে। এবার সেটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেলো। কমল খেয়াল করে দেখল, একটা গাছের গায়ে তীর চিহ্ন দিয়ে ট্রেলের দিক আর ফিরবার দিক নির্দেশ আঁকা। সেদিকেই এগোল। আর অবাক হয়ে ভাবলো এতো সুন্দর রাস্তায় বন্ধের নোটিশ কেন? এবার ফুল শুরু হয়েছে। দূর থেকে একটা ঝর্ণার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর এগোলো না কমল। বিদেশের মাটিতে বেশি হঠকারিতা ঠিক নয়। এবার দ্রুত ফিরবে। ওই তেমাথাটা পার হলেই তো সোজা রাস্তা। একদৌড়ে নীচে নেবে যাবে।

কমল জানে না। ওর সুদূরতম কল্পনাতেও নেই, ওই তীর চিহ্ন দেখে, সে এগিয়ে বাঁক নেবার পরেই, সচল হয়ে উঠেছিল এক গাছ। একটা ডাল নুয়ে পড়েছিল আর তীর চিহ্নের দিকটা পথের অন্যদিকটার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ফলে কমল পুরোনো পথে না ফিরে, অন্য বনপথ ধরে এগিয়ে গেল। খানিকটা যাবার পরেও যখন পাকা রাস্তার খোঁজ মিলল না, তখন ভারি অবাক হয়ে গেলো। আবার পথ ধরে ফিরতে চাইল ওই তেমাথায়। কিন্তু এগোবার সময় তো খেয়াল করেনি এই রাস্তাটা থেকে আরো এদিক ওদিকে রাস্তা বেরিয়েছে! কোন পথ দিয়ে এসেছিল ও? খুব মন দিয়ে মনে করে করে এগোবার চেষ্টা করল। আর ঢুকে গেলো জঙ্গলের আরও ভিতরে। এতক্ষণে ওর খেয়াল হলো, সন্ধ্যা নেমে আসছে। অথচ বনে একটাও পাখি ডাকছে না। অদ্ভুত নিশ্ছিদ্র এক নীরবতা বিরাজ করছে সর্বত্র। পকেট থেকে ফোনটা বের করল। গুগল নিশ্চয় বলে দেবে ট্রেলের হাল হকিকত। আর ফোনটা খুলে স্তব্ধ হয়ে রইল কমল। ফোনে কোনো টাওয়ার নেই। অনেক হাইকিং রুটেই থাকে না। আর এটা তো পরিত্যক্ত। এইবার কমলের চিন্তা হলো। কি করবে এখন? বনের মধ্যে দ্রুত অন্ধকার নেমে এসেছে। পথ আর দেখা যাচ্ছে না। আজকে নামার আশা বৃথা। সকাল অবধি অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু রাতটা কাটাবে কোথায়? মরিয়া হয়ে কমল সামনের দিকেই এগিয়ে গেল। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর ছোট্ট কটেজটা চোখে পড়ল। হয়তো পরিত্যক্ত। কিন্তু তবু মাথা তো গোঁজা যাবে। কমল ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল।

[৩]

ডিক, চার্লি আর জন বারবার ঘড়ি দেখছিল। আধঘন্টা ছেড়ে দেড় ঘণ্টা কেটে গেছে। কমল ফিরে আসেনি। প্রথম দিকের বিরক্তি এখন উৎকণ্ঠায় পরিণত। কি করবে বুঝতে পারছিল না ছেলেগুলো। চার্লি বলল – পুলিশে খবর দিবি?

জন আঁতকে উঠল – কি বলছিস? কমল বিদেশী। ওর কি দশা হবে তাহলে?

ডিকের চিন্তা সবচেয়ে বেশি। হাজার হোক, কমল তারই অতিথি। বলল – দেখ অন্ধকার হয়ে গেছে। কমল এই অন্ধকারে পথ চিনবে কি করে? কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। বাবাকে ফোন করি বরং।

মিস্টার লংফোর্ড কথাটা শুনেই তাড়াতাড়ি আর একটা গাড়ি নিয়ে এসে পৌঁছালেন। তিনি একেই নার্ভাস প্রকৃতির লোক। এই উটকো ঝামেলা কিভাবে সামলাবেন, কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। তবু অনেক ভেবে তিনি আজ রাতেই পুলিশের কাছে যাওয়াটা নাকচ করলেন। বললেন, যদি পথ হারিয়ে থাকে, তাহলে এই রাতে ওর পক্ষে নেমে আসা সম্ভব নয়। কাল সকালে খানিকষণ অপেক্ষা করার পরেও কমল যদি না ফেরে, তাহলে অবশ্য পুলিশে খবর দিতেই হবে।

এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। অগত্যা তারা কাছের একটা মোটেলে রাতের মতো আশ্রয় নিল। সকাল হতেই আবার অপেক্ষা। ইতিমধ্যে জন আর ডিক গিয়ে কিছুটা পথ দেখেও এসেছে। কিন্তু কমল কোনদিকে গিয়েছে, কিছুই বুঝতে না পেরে ফিরেও এসেছে আবার। এতদিকে পথ ভাগ হয়েছে যে পুরো ব্যাপারটাই বোধগম্যতার বাইরে। নটার মধ্যেও যখন কমল ফিরে এলো না, তখন বাধ্য হয়েই তাঁরা ৯১১ ডায়াল করলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা পুলিশ ও একটা দমকালের গাড়ি এসে হাজির হলো। সব শুনে পুলিশটির মুখে আঁধার ঘনালো। সে খোঁজাখুঁজির কোনো চেষ্টা না করে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওরা একটু অবাক হলো। লংফোর্ড দেখলেন, খানিক পরে গাড়িতে একটা বড়ো দল এলো। দড়িদড়া আরো কি সব নিয়ে তারা দলবেঁধে ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। শেরিফ নিজেই এসেছেন। তিনি ওদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। জানালেন – কোনও খবর পেলেই জানিয়ে দেবেন। এখানে অপেক্ষা করার দরকার নেই। তারপর বোধহয় লংফোর্ড আর ছেলেগুলোর মুখের চেহারা দেখে একটু দয়ার উদ্রেক হলো। বললেন – এই পথটা তাঁরা বাধ্য হয়েই বন্ধ করেছেন। মাঝে মাঝেই হাইকারদের কেউ কেউ রহস্যজনকভাবে এই জঙ্গলে হারিয়ে যায়। কখনো তাদের আর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কখনও বা পথের পাশেই তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পথের এত পাশে, অথচ আগে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের আগে দেখতে না পাওয়াটা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা যায়নি। সেজন্যই পরে এই নো এন্ট্রির নোটিশ। আতঙ্ক ছড়াতে পারে ভেবে খবরটা বাইরে ছড়ানো হয়নি। একটাই আশার কথা এই খবরটা তাড়াতাড়ি পাওয়া গেছে।

[৪]

ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি বড়ো দ্বিধার সঙ্গে এগোচ্ছেন। তিনি এর আগেও এই ট্রেলের রেসকিউ মিশনে এসেছেন। বিরক্তিতে তাঁর মুখে অনেকগুলো ভাঁজ পড়েছে। লোকে যে কেন নিষেধ মানে না, কে জানে? দলের লোকেদের তিনি হুকুম দিলেন পাঁচজনের একটা টিমকে রোপ আপ করে একটা দিকে এগোতে। দড়ির শেষ প্রান্তটা তাঁর কাছে থাকবে। তাঁর দলের কেউ গায়েব হোক, এ তিনি চান না। কোনো অবস্থাতেই যেন কেউ দড়ি ছেড়ে এগিয়ে না যায়, সে বিষয়ে বারবার সতর্ক করে দিলেন। টিমের মধ্যে জেমস সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তার অভিজ্ঞতার কদর সবাই করলেও, তার নানান কুসংস্কার নিয়ে সবাই মজা করে। সে হাত নেড়ে অফিসারকে আশ্বস্ত করলো।

পথ বলতে বিশেষ কিছু নেই। ভাঙা গাছের ডালে, গজিয়ে ওঠা চারাগাছে, পথ প্রায় অদৃশ্য। খুব স্বাভাবিক, ভাবলেন অফিসার। চার বছর ধরে পরিত্যক্ত বনপথের এমনই তো দশা হবার কথা। এর ভিতর দিয়ে ওই কমল না কামাল বিকেলবেলায় যাবার মতো ঝুঁকিটা নিলো কেন, সেটাই রহস্য।

প্রথম দিনের খোঁজ ব্যর্থ হলো। কোনও চিহ্ন বা সূত্র মিলল না। সন্ধ্যে নামার আগেই তিনি সবাইকে নিয়ে ফিরে এলেন নাগরিক সভ্যতার নিরাপদ আশ্রয়ে। পর দিন আবার। তারপরের দিনও। তৃতীয় দিনে জেমস একটা প্রস্তাব দিলো। এখানে একটা ঝরনা আছে। সেটা পার হবার ব্রিজটা যদিও অনেকদিন ভেঙে গেছে, তবুও সেদিকে একবার শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে। মোটামুটি গম্য রাস্তাগুলো, তার আসেপাশের বন মোটামুটি ভাবে তো দেখা হয়েইছে। যদিও ঝরনার দিকের রাস্তা পুরোটাই ভেঙেচুরে গিয়েছে, তবু অফিসারটি জেমসের কথায় রাজি হলেন। তিনি পরিষ্কার দেখেতে পাচ্ছেন, আগামী দিনে পরিত্যক্ত উদ্ধার অভিযানের সংখ্যা আরও একটি বাড়ল।

যাই হোক পাঁচজনের ছোট দলটি ঝরনার দিকে এগিয়ে গেল। আজ অফিসারটিও সঙ্গ ধরেছেন। দড়ির প্রান্ত রয়েছে বুড়ো সাইমনের হাতে। তাকে বলা আছে কোনও কারণেই, পুরো দল না ফেরা পর্যন্ত, যেন নিজের পোস্ট ছেড়ে এক পাও কোথাও না যায়। ঝরনা পেরোবার কোন সহজ পথ নেই। ওপারে একটা অসমাপ্ত বসবার চালা রয়েছে। সেও আগাছাতে প্রায় ঢেকে গিয়েছে। কিন্তু মাটিতে ওটা কি? হ্যারি নীচু হয়ে একটা রুমাল তুলে ধরে। রুমাল এলো কোথা থেকে? জেমস উৎসাহিত হয়ে দূরবীন লাগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। অনুসন্ধানকারী দলটার মধ্যে হঠাৎ একটা চাঞ্চল্য দেখা যায়। এদিকে অস্থির হয়ে ওঠে বন। হঠাৎই বেড়ে যায় পাতার সরসরানি। হাওয়াটা কি একটু বেশি? বুড়ো জেমস আকাশের দিকে তাকায়। ভরদুপুরের রোদ তাকে আশ্বস্ত করে। হেঁকে বলে, সন্ধ্যে হতে এখনো দেরি আছে। ভয় পেয়ো না। তবে দূরেও যেও না কেউ। দড়ি সামলে।

হ্যারির নজর আছে বলতে হবে। সেই প্রথম হেঁকে ওঠে – লোকটার গায়ে লাল জ্যাকেট ছিল বলেছিলে না? ওই চালাটার কোণায় দেখো তো?

দু-তিনটে দূরবীন ঘুরে যায় সেইদিকে। সত্যিই মনে হচ্ছে লাল মতো একটা কিছু ওখানে পড়ে আছে। অফিসারটির গলায় তবুও সন্দেহ – ভিক্টিম ওখানে পৌঁছাবে কি করে?

জেমস মাথা নাড়ে – রাতের বেলায় এ জঙ্গল তার চেহারা পালটায়। দুবছর আগে একটা লোক বেঁচে ফিরেছিল। আমাদের পাড়ার ছেলে। তার মুখে শুনেছি। কিন্তু সেসব কথা পরে হবে। আগে তো ওপারে চল। এপাশে একজন দাঁড়িয়ে থাকো হলুদ ঝলমলে নিশান নিয়ে। এই বনের পথ ভুলিয়ে দেবার বদনামটা খুব বেশি।

বাকিরা ঝরনা পেরিয়ে চালাটার কাছে পৌঁছে যায়। চালার নীচে পড়ে আছে একটা মানুষ। জেমস প্রাথমিক চিকিৎসার শিক্ষাপ্রাপ্ত। দেখেশুনে জানায়, লোকটা বেঁচে আছে এখনও।

কমলকে দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। হাজার ডাকেও সে সাড়া দেয় না। অগত্য তাকে বয়ে নিয়েই ফিরে আসে পুরো দল। জেমস শুধু তাড়া দেয়, তাড়তাড়ি চল। রোদ ঢলবার আগেই বেরোতে হবে এখান থেকে।

আজ আর জেমসের কথায় কেউ হাসে না। সকলেরই মনে হতে থাকে বন বুঝি ফাঁক পেলেই ওদের ঘাড়ে চেপে বসবে। পাতায় পাতায়, ঘাসে ঘাসে তার হিংস্রতার আভাস যেন ভারি স্পষ্ট।

[৫]

শেষ অবধি তারা সবাই নিরাপদে বাইরে এলো। কমলকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। তিনদিন খাদ্য-পানীয় কিছুই তার পেটে পড়েনি। শরীরে রক্তাল্পতাও দেখা দিয়েছে। কিছুদিন পর তার জ্ঞান ফিরলে উদভ্রান্তের মতো সে থমাসের খোঁজ করতে থাকে।

থমাস? থমাস বলে একজনের নাম শোনা আছে বৈকি নার্স স্টেলার। সে তার বাবার কাছে শুনেছে, ওই গ্রীন ক্রীকের উল্টোদিকের ট্রেলের রাস্তা বানানোর কাজ করতো থমাস নামের এক সর্দার মিস্ত্রি। ঝরনার ওপারে একটা বসার জায়গা তৈরি করার সময় কি করে যেন পাথর ধসে গিয়ে ওদের পুরো দলটাই মারা পড়ে। সে আজ থেকে অনেক দিন আগেকার কথা। এরপর বহুদিন সেখানে কোন রাস্তা বানানো হয়নি। মাঝে কাজ শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে বারবার সে কাজে বাধা পড়েছে। তারপরে কয়েকজন হারিয়ে যাওয়ায় পুরো কাজটা পরিত্যক্ত করা হয়।

কমলের পুরো জ্ঞান ফেরে আরও সাত আটদিন পরে। তার গল্পটা অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। সেদিন সন্ধ্যার আঁধারে সে ঝরনার ওপারে একটা কটেজ দেখতে পায়। প্রথমে ভেবে ছিল পোড়ো ঘর হয়ত। কিন্তু ব্রিজ পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে দেখে সেখানে বেশ কয়েকজন আছে। কমলকে তারা আদর করেই বসায়। খাবার খেতে দেয়। ঝরনার জলটা কি মিষ্টি! খেলেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তারা এই ঝরনার ধারে কয়েকটা কটেজ তৈরি করছে। কমল ইঞ্জিনিয়ার শুনে তাকে প্ল্যানটাও দেখায়। ওকে জোর করে ধরে রাখতে যাবে কেন? কমলের নিজেরই তো মনে হয়েছিল এত সুন্দর কাজে তারও অংশ থাকা উচিত। সেই তো বলেছিল, একদিন থেকে সে ফিরে আসবে। ওরা হেসেছিল। কমল পরদিন ওদের সঙ্গে কাজ করে, প্ল্যানের খুঁটিনাটি আলোচনা করে থমাস নামের একজনের সঙ্গে। থমাস ওকে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। কমলের বারবার মনে হচ্ছিল, বাকি জীবন সে ওখানেই থেকে যায়। কিন্তু বাবার কথা মনে পড়ায় মনটা চঞ্চল হয়েছিল।। সেটা থমাসকে বলাতে সে কেন জানিনা ভীষণ রেগে গিয়ে অন্য দিকে চলে গিয়েছিল। আর কমলের ভারি মন খারাপ হয়েছিল। কমল তারপর অনেক খুঁজেও থমাসকে আর দেখতে পায়নি। কমল আর কি করে। সে রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর নিজেকে এখানে দেখেছে।

তিনদিন? না, তিনদিনের হিসেব তো সে জানে না। সে তো অনেক কিছু খেয়েছিল। ডাক্তার কেন বলছে যে সে কিছু খায়নি? আর পথ তো ছিল ঝকঝকে সুন্দর। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে পুলিশ মিথ্যে বলছে কেন কে জানে! সে পুরো ব্যাপারটার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।

সে কমল বুঝুক বা নাই বুঝুক, সব খবর জেনে, আইনের ব্যাপর মিটলে, কমলের বাবা ছেলেকে ফিরে আসতে বললেন। ওই বনের মায়ার কাছে ছেলেকে আর যেতে দিতে তিনি রাজি নন। কমল ফিরে গেল। পুলিশ অবশ্য বলেছিল হ্যালুসিনেশন। কিন্তু যেদিন সে দেশে ফিরে আসছিল, সেদিন সিকিউরিটি চেক হবার পরে সে পিছন ফিরে তাকায়। কমল পরিষ্কার দেখেছে ডিক, জন আর চার্লির পিছনে দাঁড়িয়ে থমাস তাকে হাত নাড়ছিল। ওর চোখে জল ছিল।

এর পরে কমলের স্বভাবে অবশ্য একটা বদল দেখা দেয়। সে এখন নিষেধবাণী দেখলে প্রথমেই সেটা অমান্য করার জন্য ঝাঁপায় না। সে এখন জানে নিষেধ মানতে হয়।

0 comments: