0

গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

বিসর্জন
দীপারুণ ভট্টাচার্য



তাতাই বন্ধু সঙ্ঘের পুজা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে এক মনে আরতি দেখছে। এই পুজোটার বয়েস মাত্র ক’বছর। এবারের পুজোতে সে ছুটি নিয়ে এসেছে মা-বাবার কাছে। সম্প্রতি সে চাকরি পেয়েছে মুম্বাইতে। তার বাবা এই নতুন পুজোর মেম্বার। কাজেই তাকেও এখানেই থাকতে হচ্ছে। যদিও তার ছোটবেলার বন্ধুরা কেউই এই পুজোতে নেই। আগে এই অঞ্চলে একটি মাত্র পুজো ছিল। ক্লাবটার নাম ছিল অশোক সঙ্ঘ। সম্রাট অশোকের নামে এই ক্লাব কে গড়ে ছিল, তাতাই জানে না। বছর কয়েক আগে ক্লাবের লোকরা নিজেদের মধ্যে অশান্তি করে ক্লাব ভেঙেছে। ভাঙার পরে নতুন ক্লাব দুটোর নাম হয়েছে যথাক্রমে সবুজ সঙ্ঘ ও বন্ধু সঙ্ঘ। তাতাইয়ের বাবা এই বন্ধু সঙ্ঘের মেম্বার। আর তার অন্য বন্ধুদের বাবারা চলে গেছে সবুজ সঙ্ঘতে। 

বাবা কাকারা ঝগড়া বিবাদ করে ক্লাব ভাঙ্গা গড়া যাই ক্রুক না কেন ছেলে মেয়েরা কেউই এটা মেনে নেয়নি। তাতাই তো তার বাবাকে সরাসরি প্রশ্নই করেছিল। বাবা বলেছিলেন, ওই ক্লাবে একটা দল আছে; তারা মানুষকে সম্মান করতে জানে না। সুযোগ পেলেই লোককে অপমান করে আনন্দ পায়”। কথাটা শুনে তাতাই বলেছিল, “এরা তো কেউ নতুন নয় বাবা, আগেও ছিল। এমনকি তুমি যে বার প্রেসিডেন্ট ছিলে তখনও এরা সবাই ক্লাবে ছিল!” কথাটা শুনে বাবা বললেন, “সে সময় বিভিন্ন ভাবে এই অশুভ শক্তিকে দমিয়ে রেখেছিলাম। এখন তো ওরাই সর্বেসর্বা”। বাবার কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস হয়নি তাতাইয়ের। তার মনে হয়েছে এই ক্লাব ভেঙ্গে দেওয়াটা একটা ফেলিয়োর। আর বাবা কিছুতেই এর দায় এড়াতে পারে না। বাঙালি মাত্রই যে বিচ্ছেদ প্রিয় এই সত্যটা তাতাই এই ঘটনার থেকেই অনুভব করেছে। 

আরতি শেষ হতেই আলোচনাটা আবার তাতাইয়ের কানে আসতে শুরু করলো। কর্মকর্তারা বিসর্জন নিয়ে চিন্তিত। গতকাল সবুজ সঙ্ঘের মণ্ডপেও এক আলোচনা শুনেছে তাতাই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবার যমুনায় বিসর্জন বন্ধ। নির্দেশেটা এসেছে মাত্র কিছুদিন আগে। দিল্লি সরকার কিছু একটা ব্যবস্থা করছেন বটে তবে সেটা শুধুমাত্র দিল্লির পুজো গুলোর জন্য। এই অঞ্চলটা দিল্লির বাইরে। তাই বিষয়টা নিয়ে সবাই চিন্তিত। দীপু কাকা বলল, “আমাদেরও বিদেশের পুজোর মতো হয়ে যেতে হবে। ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা বানানো হোক যেটা বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না”। কথাটা শুনে শিশির কাকা বললেন, “সে তো পরের বারের বিষয়। এবারে কি হবে তাই ভাবো”। সলিল কাকা বললেন, “আমি বিজয়বাবুর সঙ্গে কথা বলছি। ওরা যৌথ ভাবে কিছু একটা করছেন। চলো, বিকালে গিয়ে কথা বলে আসি”। এই প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়ে যেতেই আলোচনা থেমে গেল।

বিজয়বাবু নিজেও একটা পুজোর সঙ্গে যুক্ত। তাদের পরিকল্পনা হল, একটা কৃত্রিম পুকুর তৈরি করে সেখানে প্রতিমা নিরঞ্জন করা। একটা প্রতিমার মাটি গলে গেলে কাঠামো তুলে আরেকটা প্রতিমা নিরঞ্জন হবে। পরিকল্পনা খুবই ভালো তবে পুলিশ, দমকল এবং প্রশাসনের ছাড়পত্র এখনো আসেনি। সেসব নিয়েই চলছে ছোটাছুটি। প্রশাসনের পক্ষেও অঞ্চলের সব পুজোকে এক জায়গায় নিরঞ্জনের ছাড়পত্র দেওয়ার কঠিন। একটা কিছু বিপদ আপদ হলে মিডিয়া মাথায় চেপে বসে। তাছাড়া ঢাক আর মাইক বাজিয়ে বিসর্জন করতে আসা দলগুলোকে সামাল দেওয়া চারটিখানি কথা নয়। প্রতিবার যমুনায় পুলিশ আর ক্রেনের ডালাও ব্যবস্থা থাকে। তবুও বিপদ হয়। একবছর তাতাই অশোক সঙ্ঘের বিসর্জন যাত্রায় গিয়েছিল। সেবার একজন মূর্তির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। বহু চেষ্টাতেও দিল্লি পুলিশ তাকে বাঁচাতে পারেনি। এসব চিন্তা করতে করতে তাতাইয়ের মনটা ভারী হয়ে ওঠে। মা দুর্গার কাছে সে প্রার্থণা করে, “মা, সঙ্গে থেকো, পথ দেখাও, কোন ভুল করতে দিও না”। প্রার্থণা শেষ হতেই তার মাথায় জলের ছিটে লাগে। ঠাকুর মশাই শান্তির জল দিচ্ছেন। মা কি তবে তার প্রার্থণা শুনেছেন! মনটা একটা গভীর আবেশে ভরে ওঠে। এমন সময় কাঁধে হাত রাখেন দিবাকর কাকা। এই মানুষটিকে তার বড় ভালো লাগে। শান্ত সৌম্য দর্শন মানুষটার মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, জগতে কোথাও কোন তাড়াহুড়ো নেই, কোলাহল নেই, দুশ্চিন্তার ছায়া পর্যন্ত নেই। মানুষটার সঙ্গে গল্প করেও সুখ। তাতাই নিজে এমনটা হতে চায়। “কিরে কবে এলি?” প্রশ্ন করে দিবাকর কাকা। এতক্ষণ প্রতিমার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন একটু কান্না কান্না ভাব হয়েছিল তাতাইয়ের। সে বলল, “এই তো, কালই এলাম। তুমি কেমন আছো?” প্রশ্নের উত্তর দিলেন না কাকা। তিনি একটু কাছে এসে নিচু গলায় বললেন, “মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে যদি চোখে জল আসে, তবে বুঝবি কিছু একটা ভালো হবেই”। মানুষটা এমন ভাবেই বার বার চমকে দেন। তিনি কি মন পড়তে পারেন! তাতাইয়ের অবাক লাগে। ঠিক এই সময় ছোট্ট মেয়ে টুপুর এসে বলল, “এমা তোমরা প্রসাদ পাওনি? দাঁড়াও আমি তোমাদের প্রসাদ এনে দিচ্ছি।“

নবমী সকালে সলিল কাকা খবরটা আনলেন, “বিজয়বাবুর সঙ্গে সব ফাইনাল হয়ে গেছে। আমাদের বিসর্জনের সময় দুপুর দুটোতে”। কথাটা শুনে তাতাই আনন্দ পেল। মনে হয় মা কথা রেখেছেন। শিশির কাকা বললেন, “একটা বিষয় কিন্তু আমাদের ভেবে দেখা দরকার। সবুজ সঙ্ঘকে সময় দেওয়া হয়েছে একটার সময়। একটা থেকে দুটো ওরা বিসর্জন করবে; তারপর আমরা। কাজেই ওদের সঙ্গে দেখা হবেই। ভাবছি আবার কোন গোলমাল যেন না হয়”। তাতাই দেখল দিবাকর কাকা চুপচাপ বসে আছেন। নিলয় কাকা বললেন, “গোলমাল করার লোক আমাদের দলে কেউ নেই। যদি কিছু করে তো ওরাই করবে”। প্রবীর জেঠু এই দলে সবচেয়ে বয়েস্ক মানুষ। তাঁর কথা সবাই শোনে। তিনি বললেন, “আমরা ঠাকুর নিয়ে একটু দেরি করেই যাবো। ওরা বিসর্জন করে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা পৌঁছবো। তাহলে আর কোন গোলমাল হবে না”। কথাটা বলেই তিনি দিবাকরের দিকে ফিরলেন, “তুমি তো কিছুই বলছ না! তোমার মতটাও তো শোনা দরকার”। দিবাকর কাকা বললেন, “আমাদের একটার আগেই পৌঁছে যাওয়া উচিৎ। সবুজ সঙ্ঘের মেম্বার সংখ্যা অনেক বেশি; তারা কখনই ওই সময়ের মধ্যে যেতে পারবে না। আমরা নিরঞ্জন করে ফিরে আসার পর ওরা গিয়ে যা পারে করুক”। কথাটা শুনেই সবাই “হ্যাঁ, হ্যাঁ” বলে উঠলো। প্রবীর জেঠু প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু যদি গিয়ে দেখি ওরা এসে পড়েছে, তখন কি হবে?” দিবাকর বললেন, “তাহলে আমরা গাড়ি নিয়ে মাঠের বাইরেই অপেক্ষা করবো। কিন্তু সে সম্ভাবনা খুবই কম”। কেউ আর প্রতিবাদ করলো না।

দশমীর সকালে প্রতিমা চলে যাওয়াটাই এখানকার রেওয়াজ। কোলকাতার মতো প্রতিমা রাখার অনুমতি এখানে পাওয়া যায় না। দর্পণ বিসর্জন, দেবী বরণ ও সিঁদুর খেলা শেষ করেই প্রতিমা ট্রাকে তুলে দেওয়া হয়। তারপর সবাই দুটো ডাল ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে নিরঞ্জনের জন্য। অনন্য বার যমুনাতে পৌঁছাতে বেলা দুপুর গড়িয়ে যায়। মেয়েদের সিঁদুর খেলা আর ছেলেদের ধুনুচি নাচ শেষ হতেই সময় নেয় অনেক। এবার কর্মকর্তাদের তাড়াহুড়োতে সময়টা খানিক কমে গেল। বন্ধু সঙ্ঘের মেম্বার সংখ্যাও কম। তাই এতবড় প্রতিমা বয়ে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজের জন্য তাতাইয়ের বাবার কারখানা থেকে জনা দশেক শ্রমিক এসেছেন। এরা প্রতি বছরই আসেন। লোকগুলো খুব ভদ্র ও বাধ্য ধরনের। তাতাই আর সলিল কাকা দিবাকর কাকার গাড়িতে গিয়ে উঠলো। অনেকেই ট্রাকের সামনে চলল নাচতে নাচতে।

নিরঞ্জনের মাঠে পৌঁছানোর আগেই বিজয় বাবু সলিল কাকাকে ফোন করলেন। সময় তখন একটা পনেরো। 

-“আপনারা কোথায়?” 

-“এই তো দাদা রাস্তায় আছি। আর মিনিট দশেকে সময় লাগবে।“

-“তাড়াতাড়ি আসুন। এখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। আপনারা আসলে আপনাদের প্রতিমাই আগে নিরঞ্জন হবে।“ 

কথাটা শুনে মনে মনে হাসল তাতাই। দিবাকর কাকাও কি হাসছেন নাকি! 

বিসর্জনের মাঠটা বেশ বড়। একটা মঞ্চ বেঁধে তাতে খাবার জলের ব্যবস্থা, ডাক্তার ও পুলিশের বসার জায়গা করা হয়েছে। একটা এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। রয়েছে পুলিশের গাড়ি ও ক্রেন। মাইকে বাংলা গান চলছে। খানিকটা দূরে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল বিশাল এক গর্ত করে তাতে অর্ধেকটা জল ভরা হয়েছে। একটা ট্যাংকার ক্রমাগত গর্তে জল ঢেলে চলেছে বাকিটা ভরার জন্য। গর্তের চারপাশে বাঁশ বেঁধে তারে লাল কাপড় জড়িয়ে বিপদ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে। বিজয় বাবুদের আয়োজন যে বেশ সুন্দর হয়েছে এটা মানতেই হবে। বিসর্জন যমুনায় হলে মহিলারা বিশেষ যান না। এ জায়গাটা বাড়ির কাছাকাছি তাই পুরুষ, মহিলা ও বাচ্ছা সবাই এসেছে। বিজয় বাবু ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। অনেকেই তাকে আয়জনের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে বেশ উৎসবময় পরিবেশ। 

বন্ধু সঙ্ঘের প্রতিমার তিনটি অংশ। মাঝখানের দুর্গার অংশটাই বড় ও ভারী। ট্রাক থেকে প্রতিমা সরাসরি ক্রেনের বেল্টে ঝুলিয়ে জলে ফেলা হবে। এতে বিপদের সম্ভাবনা খুব কম। বিজয় বাবু বেশ চাপেই ছিলেন। দুর্গা মূর্তিটা জলে পড়তেই তাকে খানিকটা চাপ মুক্ত মনে হল। কিন্তু প্রতিমা জলে দেওয়ার পরপরই বোঝা গেল, এক ঘণ্টার মধ্যে প্রতিমার তিনটি অংশের মাটি জলে ধুয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সময় আরও লাগবে। এতে অবশ্য বন্ধু সঙ্ঘের নারী পুরুষদের মধ্যে বিশেষ কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। ঢাকের বাজনার তালে তালে ক্রেনের মাথায় মূর্তির নড়াচড়া অনেকেই এক মনে দেখছেন। কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছেন। মূর্তিতে জল লেগে সেটা গলতে শুরু করেছে দেখে আদু নামে একটা ছোট হঠাৎ কেঁদে উঠলো। সে তাতাইয়ের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাতাই তাকে আরও কাছে টেনে নিলো। তার মনে হল এই কান্না বড়ই শুভ, বড়ই সুন্দর।

ততক্ষণে বেশ খানিকটা সময় চলে গেছে। প্রতিমা বাহকেরা একে একে লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্ত্তিক-সরস্বতীর মূর্তি দুটোকে ট্রাক থেকে নামিয়ে এনে গর্তের কাছে রেখেছে। বিজয় বাবুর এক সাথী এসে বললেন, “আপনারা হাতে করে কিছুই করবেন না। আমরা ক্রেন এনেছি কি জন্য। আমাদের উপর ভরসা রাখুন”। এই কথা যখন হচ্ছে তখন ঘড়িতে প্রায় দুটো বাজে। ঢাক বাজাতে বাজাতে তখনই সবুজ সঙ্ঘের লোকেরা প্রতিমা নিয়ে মাঠে ঢুকল। এদের লোক ও গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। ছেলেরা সবাই মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরে আছে। মহিলারা পড়েছে লাল পাড় সাদা শাড়ী। বেশ ভালো লাগছে। বিসর্জনের সময় সবাই একই রকম পোশাক পরার একটা রীতি আছে। বন্ধু সঙ্ঘের লোকেরাও সবাই সাদা রঙের টি-সার্ট পরে আছে। বুকের উপর বড় করে মা দুর্গার মুখ ছাপানো। 

দুই দলের অনেকেই একে অপরকে শুভ বিজয়া বলে আলিঙ্গন করছে। তাতাইও তার ওপাড়ার কজন বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে পোশাক ছাড়া দুই দলের মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই। ততক্ষণে লক্ষ্মী-গণেশ কে জলে ফেলা হয়েছে। সবুজ সঙ্ঘের মোড়ল গোছের কয়েকজন গর্তের কাছে গিয়ে বিপদজনকভাবে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে নিরঞ্জনে যে এতটা সময় লাগবে সেটা তাদের ধারণাতেই নেই। কিংশুক নামের কালো বেঁটে লোকটার মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল। হয়তো কিছুদিন আগেই কামানো হয়েছে। তার মুখেও খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মুখের ভাবে বিরক্তি ভাব স্পষ্ট। পার্থ নামের গোঁফওয়ালা লোকটা বেশ লম্বা ও সাস্থবান। সে এক পাশে দাঁড়িয়ে বিজয় বাবু ও তার লোকদের গালাগাল দিতে শুরু করেছে। তার রাগ এই জন্য যে, সবুজ সঙ্ঘের নাম আগে থাকা সত্ত্বেও বন্ধু সঙ্ঘকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। একটু পরে দেখা গেল সবুজ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট, ছোট্ট হাতের ইশারায় কিংশুকে ডেকে কি যেন বলছেন। কিংশুক ছেলেটা ওই দলের অ্যাকশান মাষ্টার। যে কোন গোলমাল তাকে সামনে রেখেই সঙ্ঘবদ্ধ করা হয়। তাতাই জানে বাজারে পণ্ডিতের সিগারেট গুমটির পিছনে কিংশুক, পার্থ, প্রাণেশ সহ আরও কয়েক জনের গাঁজা খাওয়ার একটা ঠেক আছে। বুবুন এই ঠেকের নাম দিয়েছিল, “শুখনো নেশা সঙ্ঘ”।

লক্ষ্মী-গণেশকে জলে ধুয়ে ক্রেন খালি হতেই কিংশুক তার বেল্টটা চেপে ধরল। এবং ঘোষণা করলো, “আগে আমাদের প্রতিমা যাবে তারপর অন্যরা”। বিষয়টা যে এমন হবে সেটা বুঝি কেউই ধারণা করতে পারেনি। বিজয় বাবু এবং বন্ধু সঙ্ঘের দুইতিন জন এগিয়ে গেল। কিন্তু কিংশুক কিছুতেই বেল্ট ছাড়বে না। ক্রমেই মনে হতে লাগল বিষয়টা একটা হাতাহাতির রূপ নেবে। বন্ধু সঙ্ঘের কার্ত্তিক-সরস্বতী প্রতিমা পড়ে রয়েছে গর্তের কাছে। 

একটু আগেই যারা একে অন্যের গলা জড়িয়ে শুভ বিজয়া বলছিল, তাদের চোখে মুখে একটা দ্বিধাগ্রস্থভাব এখন সুস্পষ্ট। পার্থ অঙ্গুল তুলে বিজয় বাবুকে বলল, “আপনারা টাকা খেয়ে এই সব কাজ করেছেন”। তারপর চিৎকার করে গালাগাল করতে লাগলো। মায়েরা তাদের বাচ্চা্দের ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। ভালো মানুষ বিজয় বাবু বন্ধু সঙ্ঘের লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি বলছেন, তাহলে কি এদের একটা প্রতিমা করে দিয়ে তবে আপনাদের শেষটা হবে?” প্রস্তাব শুনে বন্ধু সঙ্ঘের দাশ বাবু ক্রেনের বেল্ট ধরে হ্যচকা টান মেরে বললেন, “এতো ভারী অন্যায়”! কে যেন একজন বলল, “বিসর্জনে এসে একটা গণ্ডগোল না পাকালে বাঙ্গালির ভাত হজম হয় না। আমি দুই ভাইকে দুই ক্লাবের হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখেছি আসানসোলে। কিন্তু প্রবাসে এসেও একই ছবি দেখতে হবে, কে জানতো!” বিজয় বাবুর একজন ছুটে গেল পুলিসের দিকে। মনে হচ্ছে গণ্ডগোল হওয়ার বিষয়ে তারা একেবারে নিশ্চিত। দুই ক্লাবের সাধারণ জনগণ ঠিক বুঝতে পারছেন না গণ্ডগোল শুরু হলে তারা ঠিক কি করবেন!

ঠিক এই সময়, যখন কিংশুক আর দাশ বাবু বেল্ট ধরে টানছে, পার্থ খিস্তি পাঠ করছে, সবুজ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট দূর থেকে হাত নেড়ে লড়াইয়ে উৎসাহ দিচ্ছে আর বিজয় বাবু সমঝোতার চেষ্টা করছেন; তখন তাতাই দেখল দিবাকর কাকা জলের কাছে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তাতাই এই হাসির কারণ বুঝেতে পারলো না। কয়েক মুহূর্ত পরে একটা ঘটনা ঘটতেই সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। সকলের ঝগড়া মারামারি চিন্তার মধ্যে হঠাৎ জলে ঝাপাং করে কিছু পড়ার শব্দ হল। কি হয়েছে বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিল জনতা। আর বুঝতে পেরে, সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। বন্ধু সঙ্ঘের প্রতিমা বাহকরা ক্রেনের অপেক্ষায় না ঠেকে হাতে করেই নিরঞ্জন কাজ করে ফেলেছেন। সব আওয়াজ ফুঁৎকারে মিলিয়ে গিয়ে হঠাৎ যেন এক শান্তি নেমে এলো সবদিকে। বন্ধু সঙ্ঘের লোকেরা ততক্ষণে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছে। 

আজ বিসর্জনের মাঠের এই ঘটনাটা দেখার পর তাতাইয়ের মনে হচ্ছে তার বাবার ক্লাব ভেঙে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটাকে সে কিছুটা হলেও সমর্থন করতে পারছে। ফেরার সময় সে ও সলিল কাকা আবার উঠলো দিবাকার কাকার গাড়িতে। গাড়ি রাস্তায় পড়তেই একটা উটকো চিন্তা মাথায় এলো, বিসর্জন শব্দটার মধ্যে “বিষ অর্জন” কথাটা লুলিয়ে আছে। শব্দটা বদলে “বিষ বর্জন” করে দিলে কেমন হয়! কথাটা ভেবেই সে ফিক করে হেসে ফেললো। দিবাকর কাকাকে প্রশ্ন করলো, “বিসর্জনে এমন গোলমাল কেন হয় কাকা?” মৃদু হেসে কাকা বললেন, “মা দুর্গা চলে গেলেই অসুর ভাব জেগে ওঠে”।

0 comments: