0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in
 

১১ 

লুসিনো স্কারাবোটার সেই অভিশপ্ত বাসস্থান থেকে বেরিয়ে এসে ফ্রান্সেস্কো তাড়াতাড়ি অনেকখানি দূর নেমে গেলো ফেরবার উতরাই ঢালের রাস্তায়। ঐ মুহূর্তে সে এতটাই দূরে যেতে চাইছিল, যাতে ঐ ডেরাটা আর চোখে দেখা না যায়। একটু পরে রোদ্দুরে উষ্ণ হয়ে থাকা একটা জায়গা বেছে নিয়ে একটু জিরোতে লাগলো তরুণ যাজক। ভাবতে লাগলো কিছুক্ষণ আগের ঘটনাবলী। সে নিজেকে বোঝাতে লাগলো, যেরকম ঝঞ্ঝাটের কাজে সে এসেছিলো, তার মোটামুটি ভদ্রস্থ একটা সমাধান সে করতে পেরেছে। কিন্তু তার মন থেকে অস্বস্তির কাঁটা দূর হচ্ছিলোনা। কী যেন একটা ঠিকঠাক হলনা, এমনটা বারবার মনে হচ্ছিলো তার। মন থেকে খচখচানিটা ঝেড়ে ফেলবার তাগিদেই হয়তো বা সে নিজের ঝোলায় লেগে থাকা রাস্তার সব ধুলোবালি টোকা মেরে ঝেড়েঝুরে পরিষ্কার করতে শুরু করলো। 

কিছুক্ষণ পরে সেই কাজে যখন সে বিশেষ সাফল্যলাভ করতে পারলোনা, তখন আলখাল্লার পকেট থেকে ধর্মগ্রন্থ বের করে বেশ কিছুটা উচ্চস্বরেই সে ঈশ্বরের নামকীর্তন পাঠ করতে শুরু করলো। তা সত্ত্বেও যেন সে শান্তি পাচ্ছিলো না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল যে সে বোধহয় জরুরি কিছু ভুলে গিয়েছে, কিম্বা কোথাও একটা কিছু ভুল হয়ে গিয়েছে তার। যে কাজে সে এসেছিলো, হয়তো বা সেখানে কোথাও কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে। অস্বস্তিটা তার পিছু ছাড়ছিলো না কিছুতেই। সেই কারণেই সে পাহাড়ি উতরাই ঢালে চলবার সময় বারে বারে পিছন ফিরে চশমার মধ্য দিয়ে পিছনদিকে দেখছিল। পিছনদিকে বারবার তাকানোর জন্য সে ঠিকভাবে চলতে পারছিলোনা এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তায়। 

সে যেন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে আবিষ্ট হয়ে পথ চলছিল। দুটো অদ্ভুত ঘটনাতে তার স্বপ্নের জাল ছিন্ন হল। প্রথমত, পাহাড়ি রাস্তার এক বাঁকের মুখে এসে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় হঠাৎ তার চশমার ডানদিকের কাচ ভেঙে গেলো এবং দ্বিতীয়ত, ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গেই সে মাথার উপরে এক সাঙ্ঘাতিক আওয়াজ শুনতে পেল এবং অনুভব করল কে যেন তার ঘাড়ে প্রবল চাপ দিচ্ছে। 

ফ্রান্সেস্কো লাফ দিয়ে উঠলো এবং পরক্ষণেই হাসিতে ফেটে পড়লো তার এই আকস্মিক আতঙ্কের কারণটিকে দেখে। সে দেখলো এক বিশালাকৃতি রামছাগল তার সামনের দুটো পায়ের খুর দিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার ঘাড়ে উঠবার চেষ্টা করছে; তরুণ যাজকের আধ্যাত্মিক পদাধিকার সম্পর্কে, ধর্মাধিকরণ সম্পর্কে ছাগলটির বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি আছে বলে মনে হলনা। 

কিন্তু এই ঘটনা ছিল এক বিশেষ গোপনীয় আখ্যানের গৌরচন্দ্রিকা মাত্র! ঝাঁকড়া লোমশ ঐ রামছাগল তার কঠিন, আহত শিং নাচিয়ে আর আগুন ঝরানো চোখের দৃষ্টিতে ঐখানকার পথচারীদের প্রায়ই রাস্তা আটকাত, যদি তাদের ঝোলায় কোনো খাবারদাবার থাকে, সেইজন্য। হাস্যকর আর অপ্রতিরোধ্য, জেদি ভঙ্গিতে ছাগলটা এমন কাণ্ড করতো যে, পালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল। সে ফ্রান্সেস্কোর কাঁধে সমানে চাপ দিতে লাগলো; সে কোনোমতে আলখাল্লার পকেট থেকে আধখাওয়া রুটির একটা টুকরো বের করে দেওয়াতে, সে রুটিটা গিলে তারপরে ফ্রান্সেস্কোর আঙুলগুলো চাটতে শুরু করলো; সম্ভবত তরুণ যাজকের আঙুল, নাক, চুল সবকিছুই চেখে চেখে দেখে তারপর গিলে ফেলবার মতলব ছিল তার। 

একটু পরেই একটা মাদী ছাগল চলে এলো কোত্থেকে। তার গলায় ঘণ্টা বাঁধা, ভরন্ত দুধেল বাঁটগুলি প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই; সেও এসে ধাক্কা দিতে শুরু করলো ফ্রান্সেস্কোকে। তার আবার বিশেষ পছন্দ হলো ক্রস চিহ্ন আঁকা ধর্মগ্রন্থখানা। সেটা উদ্ধার করবার জন্য তরুণ যাজক একটা মেথি গাছের আঁকাবাঁকা ডাল নিয়ে তাকে তাড়না করবার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু বিশেষ লাভ হলনা। গাছের সবুজ পাতার মত সেই ধর্মগ্রন্থের বেশ কিছু পাতা, কালো কালিতে লেখা ধর্মীয় পবিত্র উপদেশসমেত সেই প্রাণী আক্ষরিক অর্থেই লোভীর মত গিলতে শুরু করলো। 

এইরকম বিপদের মুখে যখন আরও একটি দুটি প্রাণী এসে ফ্রান্সেস্কোকে ঘিরে ফেলছিল, তখন ত্রাণকর্ত্রী হিসেবে স্বয়ং মেষপালিকার আবির্ভাব ঘটলো। ফ্রান্সেস্কো চিনতে পারলো তাকে; সেই কন্যা, যাকে সে লুসিনোর ডেরায় দেখেছে। লম্বা, সুগঠিত শরীরের হাসিমুখ সেই মেষপালিকা, যার নাম ইভা, তার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সেস্কো প্রশংসা না করে পারলো না, ‘বাহ, খুব ভালো, ভালো মেয়ে তুমি! উফফ, আমাকে বাঁচিয়েছ!’ ইভার হাত থেকে আদ্ধেক ছাগলে খাওয়া ধর্মগ্রন্থ ফেরত নিতে নিতে ফ্রান্সেস্কো খুব একচোট হেসে নিলো, ‘সত্যি, আমার এতসব আধ্যাত্মিক জ্ঞান তোমার এই ছাগলভেড়ার পালের শক্তির সামনে একেবারে অর্থহীন!’ 

একজন যাজকের একা কোনো অল্পবয়সী মেয়ের সঙ্গে অনাবশ্যক সময় কাটানো একেবারে নিষিদ্ধ। যদি এরকম কোনো ঘটনা চার্চের বাইরে ঘটে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এটা ফ্রান্সেস্কোর মাথায় ছিল; নিজের পেশা সম্বন্ধে সে যথেষ্ট সচেতন, কাজেই সেই জায়গায় আর বেশি সময় নষ্ট না করে, স্থানত্যাগ করে জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করলো সে। তবুও, তার মনে একটা খচখচানি থেকেই গেলো। অবশেষে সে স্থির করলো যে তার এই অস্বস্তি, এই পাপবোধ, সবকিছুর জন্য তার একটা অনুতপ্ত স্বীকারোক্তির প্রয়োজন। পরবর্তী সুযোগেই সে সেটা করবে। নাহলে শান্তি পাবেনা। 

ছাগলভেড়ার দলের ঘণ্টার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। ফ্রান্সেস্কো ঈশ্বরের নাম জপ করতে করতে নেমে যাচ্ছিল দ্রুত। এর মধ্যেই সে শুনতে পেলো এক সুরেলা আওয়াজ। কে যেন গান গাইছে! সে জপধ্যান বিস্মৃত হল মুহূর্তেই। সেই কণ্ঠস্বর এতটাই মার্জিত যে একবারের জন্যেও তার মনে হয়নি যে এই গানের সুর সেই মেষপালিকারও হতে পারে, যার সঙ্গে একটু আগেই তার দেখা হয়েছিল। ফ্রান্সেস্কো নানাধরণের সঙ্গীত শুনেছে। শুধু ভ্যাটিকানের ধর্মীয় সঙ্গীত নয়, সে যখন মায়ের সঙ্গে মিলানে থাকতো, তখন নানা রকমের শাস্ত্রীয়, আধুনিক সঙ্গীত, অপেরা শুনেছে সে। প্রিমা দনাদের কণ্ঠস্বর কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা আছে তার। সঙ্গীতের ব্যাপারে তার শ্রুতি বিশেষ পরিশীলিত। সে ঐ গানের আওয়াজ শুনে আপনা থেকেই দাঁড়িয়ে পড়লো। তার মনে হল যে এই কণ্ঠস্বর নিশ্চয়ই মিলান থেকে আগত কোনো ট্যুরিস্টের হতে পারে। একটু একটু করে পায়ে পায়ে এগোচ্ছিলো সে, যদি ঐ কণ্ঠস্বরের অধিকারিণীকে একটিবার দেখা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পায়ে পায়ে এগিয়েও সেরকম কাউকে দেখা গেলোনা। তাই আর অপেক্ষা না করে ফ্রান্সেস্কো আবার গতি বাড়িয়ে উতরাই পথে দেখেশুনে নামতে শুরু করলো। 

ফ্রান্সেস্কো তার পেশাগত জীবনে এমন কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয়নি আজ অবধি, যা বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম। লুসিনোর ডেরায় যে বিরোধিতার মুখে তাকে পড়তে হয়েছিল, এমনটি এর আগে কখনো হয়নি। আজকের এই পর্বতারোহণ যেন তাকে ভেতরে ভেতরে বদলে দিয়েছে, এমনটাই মনে হল তার। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল সে; এমন নয় যে শয়তান এসে তার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাচ্ছিল কিম্বা তার মাথায় বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হয়ে আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু একটা মানসিক যুদ্ধ যেন তাকে জয় করতে হল, সেটা সে বুঝতে পারছিলো। স্বর্গের মত সুন্দর পার্বত্য প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনা থেকেই তার হাত কপালে উঠে গেলো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। সে হাতজোড় করে ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানাতে লাগলো, যাতে তার প্রচেষ্টা সফল হয়। যেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার আবেদন গ্রাহ্য হয়, এমনটাই প্রার্থনা ছিল তার। তার মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন এক ঐশ্বরিক চাঁদোয়া বিছিয়ে ধরে আছে তার মাথার উপরে, যে চাঁদোয়ার তিনদিক ধরে আছে স্বয়ং দেবদূতেরা, আর একদিক আটকানো আছে এই জেনেরাসো পর্বতের শিখরে। ঈশ্বরের ভাবনা যে মানুষেরই সৃষ্টি, প্রকৃতির অপরূপ রহস্যময় সৌন্দর্য সেই ভাবনাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে, দৃঢ় করেছে, সে কথা ফ্রান্সেস্কোর মনে না হলেও সে অভিভূত চিত্তে পর্বতের তুষারাবৃত্ত শিখরের দিকে তাকিয়ে রইলো, যেখানে বসন্ত ঋতুর আগমনের কারণে মৃদু উষ্ণতায় হিমবাহের সম্মুখভাগের ছোট ছোট ধস হাল্কা আওয়াজে গলে গলে পড়ছিল। 




(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 



0 comments: