ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক
১২)
বাররাজা, বাররাণী ও ঠাকুরদেব
নভেম্বরের শেষের সন্ধ্যে।
শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। পাঁচজনের একটি দল গুটি গুটি পায়ে পথ চলছে। সবার গায়ে আলোয়ান, মাথায় বাঁদুরে টুপি। গন্তব্য আহিরণ নদী পেরিয়ে একটি গ্রাম বসীবার। সেখানে আজ বার-উৎসবের শেষ দিন। দিন না বলে রাত বলাই সংগত। কারণ ধানকাটার পর এই উৎসবটি রাতেই জমে ওঠে। দিনের বেলায় লোকে হয় ঘুমোয়, নয় জুয়ো খেলে।
‘বার-উৎসব’ আসলে খেতের ফসল ঘরে উঠলে প্রকৃতিদেবীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের আনন্দউৎসব। চলে বারো দিন ধরে; অদ্যই শেষ রজনী। বারো দিন ধরে উৎসব একটি গাঁয়ে, সেখানে জুটবে বারো গাঁয়ের লোক। হবে মাদল-বাঁশির সুরে তালে বিভিন্ন দলের সমূহ নৃত্যের প্রতিযোগিতা। উৎসবের স্থান প্রতিবছর পালা করে একেকটি গাঁয়ে হয়। মাঠের এক পাশে একটি বড়ো গাছের গোড়ায় তৈরি হবে ঠাকুরের থান। সেখানে দুই দেব ও এক দেবী; বাররাজা, বাররাণী ও ঠাকুরদেব। এরা লৌকিক দেবতা, কোন পুরাণে উল্লেখ নেই। বৈগা পুরোহিত ও কিছু উপোস করে থাকা ভক্তকুল বারোদিন ধরে আরাধনায় রত। শেষ রাতে পাঁঠাবলি দিয়ে প্রসাদ বিতরণ করে সমাপন।
ও হ্যাঁ, আর একটি ব্যাপার। এই মেলায় যুবক যুবতীরা স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করে। হেথায় নয়নে নয়ন মেলে। অউর, নয়ন লড় গই হ্যাঁয় তো মনমে খটকোয়া হইবে করি। ফলে মেলা শেষে দেখা যায় অন্ততঃ বেশ ক’টি জোড়া পালিয়েছে। তারপর তারা উদয় হয় নিজগাঁয়ে, কয়েকদিন পরে। তাদের বিয়ে হয়ে যায়। এই ব্যাপারটাকে গুরুজন একটু প্রশ্রয়ের চোখে দেখেন। দেবস্থানের যোগাযোগে গান্ধর্ব-বিবাহ, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? যে বছর পলায়নের সংখ্যা কম হয়ে সে বারের মেলাকে অসফল ধরা হয়। কাজেই সবার কৌতুহল আগের বারে পাঁচটি ছিল, এবারে কয় জোড়া?
ধানকাটা প্রায় শেষ।
এক দশক আগেও এই এলাকায় ধানকাটা, তাকে আঁটি বেঁধে গোলায় তোলা আর কুলোর বাতাস দিয়ে ঝাড়াই মাড়াই করা—এই সব কাজ চলত আরও একমাস। কারণ, চাষিদের পছন্দ ছিল দেশি ধান, যেমন শ্রীকমল, চিনি-শক্কর, বিষ্ণুভোগ, দুবরাজ, জবাফুল, কালিজিরা ইত্যাদি। আর গরীবের জন্যে মোটা ধান গুরমিটিয়া।
এই আদিবাসী এলাকায় আগের দিনে কেউ কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ও পেস্টিসাইড ব্যবহার করত না। জৈষ্ঠের গোড়ায় গোবরখত্তা বা গোবরসার ক্ষেতে ছড়িয়ে দেওয়া হত। আর বর্ষায় পাহাড় থেকে ঢল নামলে এই আদিবাসী এলাকার জমি পেত জলের সঙ্গে নিয়ে আসা মিনারেলস ও হিউমাস।
ব্যস, চাষিরা মাথায় গামছা বেঁধে হাল-বলদ নিয়ে মাঠে নেমে পড়ত। নার্সারি করে চারা তুলে রোপণ করার বদলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিত বীজ, এই পদ্ধতিকে বলে ‘ছিড়কাও’। এতে জল লাগে অল্প, পোকা ধরে অল্প, কিন্তু ফলনও হয় অল্প। ছত্তিশগড়ের কিসান তাতেই খুশি। খাদ ও কীটনাশক কিনতে না হলে শ্রম কম লাগলে প্রতি একর উৎপাদন ব্যয় ও কম। ফলে পড়তা পুষিয়ে যেত।
কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ফলে সরকারের কৃষিবিভাগ নেমে পড়ল উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ এবং সুপার ফসফেট, ইউরিয়া ও পটাশের গুণগান করতে; আর মাহো মানে শ্যামাপোকা, কাটুয়া পোকা এবং পঙ্গপালের প্রকোপ থেকে ফসল বাঁচাতে ছাই আর কেরোসিনের বদলে নানান ধরণের কীটনাশকের ম্যাজিক দেখাতে।
চাষিরা প্রথমে পিছিয়ে গেল। কেন? ওরা বলল – খালি সরকারি লোকজন ভুজুং ভাজুং দিলেই হবে? স্পষ্ট দেখছি খচ্চা আছে।
কিন্তু ‘উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়?’
নাছোড়বান্দা কৃষিবিভাগ আর ওদের আমলারা, সে তৃণমূল স্তরের গ্রামসেবক থেকে শুরু করে এস ডি ও পর্য্যন্ত। আমরা ‘ফিরিতে’ দিচ্ছি বীজধান, এগ্রো-‘কিট’; মিনিকিট, প্যারাকিট, শেষে দাঁত কিট-কিট! ওদের টারগেট পুরো না হলে বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি আটকে দেওয়া হবে, প্রমোশন তো দূর অস্ত!
দেড় দশক পেরিয়ে গেল। এবার মাঠে নেমেছে নতুন প্রজন্ম, অনেকেই স্কুলে পড়েছে। অন্ততঃ সরকারি পাঠশালা ও প্রাইমারি পর্য্যন্ত। ওরা চিনেছে পয়সার মাহাত্ম্য। তাই লাগানো হচ্ছে উচ্চফলন শীল আই আর এইট ও স্বর্ণাধান। এরা শুরুতে খেতে ছড়াচ্ছে রাখড় (সুপার ফসফেট), ধানের চারা পোক্ত হলে ইউরিয়া, আর পটাশ। পুরনো ‘ছিড়কাও’ পদ্ধতিতে বীজ ছড়ানো কমে গেছে। বেড়েছে ‘রোপা’ লাগানো। কিন্তু এর জন্য নিয়মিত জল দেওয়া চাই, শুধু ইন্দ্রদেবের ভরসায় চলেনা।
ঠিক আছে; ওসব আমরা জানি। তাই সেচ বিভাগের তত্ত্বাবধানে হসদেও, বাঙ্গো নদীর ক্যানাল নির্মাণ বহু শুকনো খেতে জল পৌঁছে দিচ্ছে, তৈরি হয়েছে ব্যারাজ, চেক ড্যাম।
যেখানে যেখানে ক্যানালের জল পৌঁছয়নি, সেখানে গেছে কুয়ো ও পাম্প। বিজলি নেই ? কুছ পরোয়া নেই,আছে ডিজেল পাম্প। একটা হালকা পাম্প জিনি-লম্বার্ডিনির সঙ্গে ছবি সাঁটা—স্বামী-স্ত্রী ধরাধরি করে খেতে পাম্প নিয়ে যাচ্ছে। ব্যস, গাঁয়ের লোক ওর নাম দিল ‘ডৌকা-ডৌকী’ পাম্প, মানে বর-বঊ পাম্প।
এবার ধান বিক্রি হলে চাষি কিছু ধান সস্তায় বাজারে ছাড়বে। বীজধান তুলে রেখে পরিবারের জন্যে কিনবে লাল লুগরা বা পাঁচহাত্তি। নিজের জন্যে পটকু, জ্যাকেট আর সাফা। ওহো,গামছা, গেঞ্জি ইত্যাদিও চাই যে! তারপর আছে গৌটিয়া অর্থাৎ বড়ো ভূস্বামীর ধার শোধ করা। বঊ বাচ্চার হাত ধরে মেলায় ঘুরে আসা; পারলে আট আনার টিকিট কেটে তাঁবুর ঘেরাটোপে ‘সনেমা’ দেখিয়ে আনা। আর মহুয়ার মদ? সে তো এই আদিবাসী এলাকায় ঘরে ঘরে পেছনের উঠোনে তৈরি হয়। আছে চালের খাপরা সরে গিয়ে কোথায় কোথায় বৃষ্টির জল ঢুকছে সেখানে নতুন খাপরা কিনে সারিয়ে নেওয়া। আগামী গ্রীষ্মে বড়ো খোকা বা ছোটখুকির বিয়ে দিতে হবে, তার জন্যে এখন থেকেই চেনাপরিচিতের মধ্যে কথা চালাচালি করা। মাঠের কাজ শেষ হলে ঘরের কাজ শুরু।
আশকথা পাশকথা ঢের হলো। এবার আসুন, আমাদের পরিচয় দিই।
দলটির সবচেয়ে নিরীহ সদস্য হলাম আমি—রূপেশ বর্মা; ছত্তিশগড় গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় শাখার ম্যানেজার বা শাখা প্রবন্ধকজী। সবাই বলে ‘নানহে’ ম্যানেজার,মানে খোকা ম্যানেজার। কারণ আমার গোঁফ দাড়ি একটু কম, রোগাপটকা। একবার পথ চলতে কানে এল – এঃ গাল টিপলে দুধ বেরোবে মনে হচ্ছে!
গ্রহের ফেরে আর বাবার ভিলাইয়ে চাকরির সুবাদে ছত্রিশগড়ের ডোমিসাইল সার্টিফিকেট বাগিয়ে আদিবাসী এলাকার গ্রামে চাকরি করে খাচ্ছি।
কিন্তু সবচেয়ে ওজনদার সদস্য হলেন আমাদের এই এলাকার সরপঞ্চ কুমারসাহেব। উনি আদিবাসী রাজপরিবারের সেজভাই বা ‘সঝলা কুমার’, নাম একগজ লম্বা—উদ্যমেশ্বরশরণ মণিপাল প্রতাপ সিং। ব্যাংকের লেজারে লিখতে গিয়ে আমার ক্লার্কের কলমের নিব ভাঙার দশা। পরনে সাদা টেরিকটের শার্ট প্যান্ট, মুখভর্তি জর্দা দেওয়া মিঠেপাত্তি পান। তার পিকের কণা ওঁর কলার,বুকপকেট সর্বত্র ‘নিশানি’ রেখে যায়।
উনি দরিয়াদিল হাসিখুশি বন্ধুবৎসল মানুষ। ‘ঘর ফুঁক কর তামাশা দেখো’ গোছের মানসিকতা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতেন বটে, কিন্তু ওঁর ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করে অন্যেরা। এই যেমন আমার মকান মালিক সদনলাল গৌঁড় বা কাল্লু সদন। গাঁয়ে আরেকজন সদন হলো ‘ভুরুয়া’ সদন, মানে ধলা সদন; ডঃ চন্দ্রকান্ত কাশ্যপের কম্পাউন্ডার।
কাল্লু সদন কালো হলেও চেহারায় চেকনাই আছে। স্বভাবে গুরুঘন্টাল। সঝলাকুমারের বন্ধু সেজে পঞ্চায়েতের থেকে গাঁয়ে রাস্তা বানানোর বরাত নিয়ে নেন। টেন্ডার-ফেন্ডার গোলি মারো!
তারপর জঙ্গল এলাকায় রাস্তা ক’ফিট তৈরি হলো, তাতে কী সাইজের গিট্টি ঢালা হলো, কতটা পিচ, কে দেখতে যাচ্ছে! ‘জঙ্গল মেঁ মোর নাচা কিসীনে ন দেখা’! শেষকালে অডিটের সময় হিসেবের গরমিল—ভর্তুকি দেবে সরপঞ্চ সঝলাকুমার। প্রতিবছর একই কিসসা!
এই সদনলালের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। ছিপছিপে একহারা গড়নের আদিবাসী মানুষ। চল্লিশ পেরিয়েও এথলেটিক ফিগার। মদ খায় না,পান সিগ্রেটের অভ্যেস আছে। কিন্তু এই চতুর ধড়িবাজ লোকটির রয়েছে মেয়েমানুষ বাই। পিঙ্গলচোখ জ্বলে শ্বাপদের মত, শিকারের তালাসে; নজরে চোদ্দ থেকে চল্লিশ।
চতুর্থজন ঠাণ্ডারাম সিদার। উনি জাতে মাতাল তালে ঠিক। দশ কিলোমিটার দূরের তহশীল অফিসে ছোটবাবু। কিন্তু অসাধারণ তবলার হাত। আশপাশের ‘নওধা রামায়ণ’ আর ‘মাতা জাগরণ’ এর সময় চারপাশের দশটা গ্রাম থেকে ডাক আসে। উনি অম্লানবদনে অফিসে ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়ে ভিনগাঁয়ে তেরে- কেটে- তাক করতে চলে যান। হাজিরাখাতায় ঢ্যাঁরা পড়ে, মাইনে কাটা যায়, ওঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। মিতবাক শিল্পীমনের মানুষটিকে আমার বেশ লাগে। দোষের মধ্যে সন্ধ্যের দিকে গঞ্জিকা সেবনে আরক্তচোখে প্রায় বোবা হয়ে যাওয়া।
গত সন্ধ্যেয় ওঁর খোঁজ করছিলাম, উদ্দেশ্য আজকের এই বসীবার গাঁয়ের মেলায় যাওয়ার প্রোগ্রাম ফাইনাল করা। দেখা মিলল শিবমন্দিরের চাতালে। কেউ নেই, পূজারী কোথাও বেরিয়েছে। একটা টিমটিমে হলদেটে বাল্ব জ্বলছে। একা ঠাণ্ডারাম শিবনেত্র হয়ে বাজিয়ে চলেছেন ত্রিতালে লহরা।
পঞ্চম ব্যক্তিটির কথা না বললেই নয়। ও হলো আমাদের দলের বিদুষক—মোল্লা নাসিরুদ্দিন ও বীরবলের জাতের লোক। কিন্তু রসেলুরাম সাহু হলো গাঁয়ের অন্যতম বিদুষক, জাতে তেলি। তাই গাঁয়ের লোক আড়ালে বলে তেনালিরাম। উদ্ভট যত গাঁজাখুরি গল্প ও লোকজনের গোপন কিসসার অফুরন ভাণ্ডার; ওকে বাদ দিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না।
তখন থেকে হাঁটছি তো হাঁটছি।
নিকষকালো কালো কৃষ্ণপক্ষের রাত। আর কতদূর?
সবাই আশ্বাস দেয়। এই তো হয়ে এল, নদীটা আসুক। নদী পেরোলেই বুঝলেন কিনা!
আসলে আমি প্রথমবার এই মেলায় যাচ্ছি। বেশ কয়েক বছর বাদে আমাদের ব্রাঞ্চের থেকে পাঁচমাইল দূরে এই মেলা হচ্ছে। আর আমার নতুন চাকরি, প্রথম পোস্টিং এই ব্রাঞ্চে; এসেছি প্রায় দু’বছর হয়ে গেল। ব্যস, আর এক বছর; তার পরেই ফের তবাদলা, মানে ট্রান্সফার। তাই ভাবলাম এই মেলাটা দেখেনি।
রসেলুরামের গল্প শুরু হলো।
বুঝলেন ম্যানেজার সাহেব, বছর পনের আগেও এই পথে বাঘ বেরোত। এখনও হুড়ার দেখা যায়। হুড়ার জানেন না ? ওই বুনো কুকুর আর হায়েনার মাঝামাঝি একরকম জানোয়ার। ছোটবাচ্চা মুখে করে নিয়ে পালায়। একা পথিক দেখলে--। আরে ভয় পাবেন না। দলবেঁধে চললে কোন চিন্তা নেই। তবে বাঘের কথা আলাদা।
--আপনি বাঘ দেখেছেন?
--সেই কথাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। বছর কুড়ি আগের কথা। সেবার আমি আর আমার দেড়শালা (বড়ো ভগ্নিপতি) ভিনগাঁয়ের কুটুমবাড়ি থেকে বোগরা-ভাত ( খাসির মাংস আর ভাত) খেয়ে বাড়ি ফিরছি। তখন এদিকে পাকা রাস্তা হয় নি, মোটরবাস চলেনি।
-হবে কী করে? তখন না কুমারসাহেবের মত সরপঞ্চ ছিলেন, না সদনলালের মত ঘাঘু ঠিকেদার।
মিতবাক সিদার আজ গাঁজায় দম চড়ায় নি, তাই একটু একটু মুখ খুলছে। খোঁচাটা ঠিক জায়গায় লেগেছে।
সদনলাল বলে –আজ বোধহয় কল্কে ফাটাওনি; তাই কথার কোন কাঁড়-কাঁকুড় মাত্রা নেই।
সরপঞ্চ কুমারসাহেব আশু বিপদ বুঝে বলে ওঠেন—ভাইগে ! ভাইগে! ( হয়েছে, হয়েছে, ক্ষ্যামা দাও।) ঠাকুরের নাম নিয়ে মেলায় যাচ্ছ, ফালতু কথা কেন? বাঘের গল্প চলুক।
সদনলাল হার মানবে না। আরে ওটাও তো গাঁজায় দম দেওয়া গল্প, তেলি দেখবে বাঘ! ঘানিগাছে বাঘ থাকে, হুঁ!
সাহু রেগে কাঁই।
--কী বলছ হে ঠিকেদার! আমি মিথ্যে কথা বলছি! মোলা লবরা কহিস ঠিকেদার? ( আমাকে ও মিথ্যেবাদী বলল?)। কুমারসাহাব, তঁয় হমনকে রাজা; তঁয় ন্যায় করহ!
( কুমারসাহাব, তুমি আমাদের রাজা; তুমিই ন্যায়বিচার কর।)
সিদার আজ যেন অন্যরকম। মুচকি হেসে চিমটি কাটে।
তোলা লবরা নহী, মিঠলবরা কহিস।
(তোকে মিথ্যুক বলেনি, বলেছে মিষ্টিখচ্চর, বুঝলি?)
বড়ো মুশকিল! শেষে কি গেঁজেলদের তক্কাতক্কিতে যাত্রা পণ্ড হবে?
কুমারসাহেব ত্রাতার ভূমিকায়। উনি বললেন –তোমরা যদি এমন ছেলেমানুষি ঝগড়া কর তো আমি এখানেই মাটিতে বসে পড়ব।
আমার হাসি পেল। কিন্তু ওঁর ধর্ণা দেওয়ার হুমকিতে কাজ হলো।
আমি ধরতাই দিই—সাহুজি, সেই বাঘের গল্পটা!
সাহুজির অভিমান যায় না। কী হবে গাঁজাখুরি গল্প শুনে? আমি তো মিথ্যে মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে বলি।
উদ্যমেশ্বর মণিপাল প্রতাপ সিং এবার ধমকের সুরে বললেন—বেশি ভাও খেও না,সাহু। আমি তো তোমার ওই গল্পটি অনেকবার শুনেছি, কখনও বলেছি যে বানিয়ে বলছ!
সাহু এবার নতুন উদ্যমে শুরু করলেন।
আমাদের মধ্যে সামনা সামনি বাঘ কেউ দেখেনি, এক আমি ছাড়া। এটা তো মানবেন? যা বলছিলাম, সেবার আমি ও আমার দেড় শালা কুটুমবাড়ি থেকে খেয়ে দেয়ে ফিরছি। জব্বর খাওয়া হয়েছে, ক’পাত্তর ঘরে তৈরি মহুয়াও ছিল। টাটকা;
বোতলে আঙুল ডুবিয়ে মাচিস মারুন, আঙুল জ্বলবে মোমবাতির মত। পরানে দেদার ফুর্তি। গান আমার দেড়শালা ফাটা বাঁশের আওয়াজে গান ধরেছে—
“পীপল কে পতিয়া ডোলত নাহী ও,
মেরে মন কে রাজা বোলত নাহী ও।
“অশত্থ গাছের পাতা দেখি নড়ে না,চড়ে না ,
আমার হৃদয়রাজা তো কথাই বলে না”।
হঠাৎ সামনের পাকুড় গাছ থেকে, মানে ঠিক আপনার ডানদিকে যে গাছটা, পাখিদের চেল্লামেল্লি শুরু। আমি ওর গান থামিয়ে কান খাড়া করলাম। একটা খচমচ আওয়াজ আর বোটকা গন্ধ। ঘাড় ঘোরাতেই আমার বাক্যি হরে গেল। একটা কেঁদো বাঘ আমার দু’হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে লেজ আছড়াচ্ছে। কী রাগ! বাঘেরাও সুর বোঝে। বেসুরো গানা ওদের দিমাগ খারাপ করে দেয়।
কী করি! আমার হাতে একটা খেঁটে লাঠি। ও দিয়ে কী আর--!
মোর দেড় শালাকে তো পুঁ সরক গইস। ওকর কপড়া মেঁ হো গইস।
ওউ ডর কে মারে মোর গাঁড় কে অন্দর পোকর- পোকর পোকর-পোকর হোয়ত রইসে।
তা আমি কম যাই না ! গুরুর নাম নিতেই বন্ধ দিমাগ খুলে গেল। হাতের খেঁটো নিয়ে বাঘের চোখে চোখ রেখে তাকালাম। বাঘের দুই থাবা আমার কাঁধে, রাগী চোখ আর দাঁতের পাটি আমার মুখের কাছে। আর জানেনই তো, বাঘ নন-ভেজ খায় কিন্তু দাঁত মাজে না।
-তার পর? ওই খেঁটে লাঠি দিয়ে বাঘের মোকাবিলা করলেন?
-- কী যে বলেন! তা হয় নাকি? আমি গুরুর নাম নিয়ে খেঁটে সোজা ওর মুখের মধ্যে আড়াআড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে হাঁ-মুখ মেঁ তালা লাগা দিয়া অউর লাঠিকে দোনো প্রান্ত শের কী দো মুঠঠি মেঁ! ব্যস, বাঘ ভ্যাবাচাকা লেগে ঠুঁটো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর আমি প্রায়-মুচ্ছো যাওয়া দেড়শালাকে টানতে টানতে রাস্তায় এনে তারপর দে ছুট, দে ছুট! সোজা বাড়ি এসে দম নিলাম।
সদনলাল জনান্তিকে বললেন যে এই গল্পটা উনি সাহুর দেড়শালার মুখেও শুনেছেন, তবে তাতে কর্তা-কর্ম-করণ-ক্রিয়া ইত্যাদি একটু অন্যরকম ছিল।
সাহু শুনেও শুনলেন না।
নদী প্রায় এসে গেছে। পথ একটু নীচে নেমে যাচ্ছে, পাকদণ্ডীর মত।
পাশের ঝোপের থেকে একটা ফোঁস করে আওয়াজ। আমি কিছু বোঝার আগেই সদনলাল এক হ্যাঁচকা টানে আমাকে সরিয়ে দিয়ে ঝোপের দিকে সাত সেলের টর্চ ফোকাস করেছেন।
আমরা বাক্যিহারা।
এ দৃশ্য শুধু ‘কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়’। জোড়া সাপ, তায় শঙ্খ লেগেছে। প্রায় লেজের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে নাগ-নাগিনী। আলিঙ্গন বটে! বাৎসায়ন ঋষি এমন আসন চোখে দেখেন নি নিশ্চয়। একটু পরে তারা নেমে ঘাসে গড়িয়ে গিয়ে আবার সোজা হয়ে ফণা তুলছে। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল।
কুমারসাহেব তাড়া দিলেন। সর্পদেবতার মিলন দেখা অনেক হলো। এবার মেলার দিকে পা বাড়ান সবাই। সাহু ফুট কাটেন—যাত্রায় নাগদেবতার শঙ্খলাগা দেখতে পাওয়া খুব শুভ। আমাদের সবার সংকল্প সিদ্ধ হবে, মনোকামনা পূরণ হবে।
কার কী মনোকামনা? আহা, বলতে নেই, বলতে নেই।
আমরা নদীতে নেমে পড়ি। আহিরণ নদী প্রায় শুকনো, বালুতে ভরা। কোথাও কোথাও পায়ের পাতা ভেজানোর মত জল। কিন্তু নভেম্বরের রাতে বালি ও জল, দুটোই কী ঠাণ্ডা! পঞ্চাশ গজ চওড়া নদী পেরিয়ে অন্ধকারে ভাঙা খাড়া পাড় ধরে উপরে উঠতে উঠতে পা হড়কে নীচে নামছিলাম, মকানমালিক সদনলাল খপ করে ডানা ধরে হেঁচড়ে পাড়ে তুললেন আমি ককিয়ে উঠে হাত ছাড়াতে যাব, কিন্তু সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলাম।
কাদের মশালে আকাশের ভালে আগুন উঠেছে ফুটে!
কয়েক বিঘার ছড়ানো মাঠ, চারপাশে গাছে গাছে মশাল বাঁধা। কোথাও গাছের ডাল থেকে হ্যাজাকবাতি ঝোলানো। কে বলবে কৃষ্ণপক্ষের রাত? আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। আর মাদলের তালে তালে নাচছে গোটা চারেক দল। প্রতি দলে জনা ছয় পুরুষ; কোন মেয়ে চোখে পড়ছে না।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই নাচের দলের কাছে। প্রত্যেক দলে একজন মাদল বাজাচ্ছে, স্থানীয় ভাষায় ‘মাদর’। এতে কি দোষ? বিদ্যাপতি বাদলকে ‘বাদর’ করেন নি?
কিন্তু গানটা একঘেয়ে, ঘুরে ফিরে একই লাইন—‘তোলা দয়া লাগে না, তোলা ময়া লাগে নয়া, তোলা দয়া লাগে—এ –এ –এ!’
তোর দয়া হয় না গো, তোর মায়া নেইকো গো, তোর দয়া যেন পাই-ই-ই।
নিদয়া প্রকৃতিদেবী। ছত্তিসগড়ে প্রতি তিনবছর অন্তর সুখা বা দুকাল (আকাল) পড়ে যে! নাচ এমন পানসে দায়সারা লাগছে কেন? বারো দিন ধরে একই গান গেয়ে হাঁফ ধরে গেল নাকি?
সরপঞ্চ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন -- চিন্তা করবেন না,এখন মাত্র সাড়ে ন’টা বাজে; কলির সন্ধ্যে। বারোটা নাগাদ মেয়েদের দল নামবে। তখন দেখবেন রক্তে জোয়ার এলে নাচ কেমন হয়। ততক্ষণ আপনি আমার সঙ্গে এসে আগে দেবস্থানে প্রণাম করে যান। তারপর এদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে মেলা দেখুন গে।
*******
নদীটির ওই পারেতে, ভিনদেশি ওই গাঁয়েতে
একটা বড়োসড় প্রাচীন বটগাছে ঝুরির পাশে গোটাকয় বাঁশ পুতে চাঁদোয়া টাঙিয়ে দেবস্থান। নিত্যিপুজো শেষ, বাকি শেষরাতের উৎসব সমাপনের পুজো।
কুমারসাহেবের সঙ্গে পারিষদ দলের মত আমরা ঢুকতেই একটু হৈ চৈ পড়ে গেল। আদিবাসী পুরোহিত, মানে বৈগা এগিয়ে এসে নমস্কার করতেই কুমারসাহেব প্রতি নমস্কার করলেন। একটা পুরনো আধময়লা সতরঞ্চি পেতে আমাদের বসানো হলো। কুমারসাহেবের বিশেষ খাতির। কারণ, আশপাশের দশটা গাঁয়ের জমিদার হিসেবে উনিই এই পুজোর প্রধান যজমান। এর সমাপ্তিতে ওঁকে থাকতেই হবে।
দেবতাদের চিনে নেব বলে এদিক সেদিক তাকাতে নজরে এল এবড়ো খেবড়ো পাথরের তিন টুকরো; সিঁদূরলেপা। এরাই নাকি বাররাজা, বাররাণী এবং ঠাকুরদেব! হরি হরি! আলাদা করে কোন নাকমুখ নেই, কী করে যে চেনে কে জানে!
ছোটবেলায় আমার চোখে সব সাহেব, সব চিনেম্যান একরকম দেখাত। এমনকি, রথের মেলায় জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রাকেও আলাদা করে চিনতে কয়েক বছর লেগেছিল। একটা পাথরের বড়ো থালায় দুধ দেওয়া রয়েছে। তাতে ডিমের সাইজের একটা কিছু ভাসছে। কুমারসাহেব বললেন – এটা হলো গতরাতের কথা। বাররাণী তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে পাখির রূপ ধরে দেবস্থানের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের বৈগা মন্ত্র পরে ওদের বন্দী করে এই আকৃতির মধ্যে আটকে রাখে। শেষে রাণী ছাড়া পেয়ে পালিয়ে গেলেন। মেয়ের প্রাণ এর মধ্যে আটকে আছে। আপনি হাত দিয়ে ধরুন, ছুঁয়ে দেখুন, কেমন ধুকপুক করছে!
আমি ঠান্ডা দুধের পাত্রে হাত ডুবিয়ে দিই। একটা নরম নরম স্পর্শ, কিছু একটা নড়ছে। হাত দিয়ে দুধের থেকে বের করে ভাল করে দেখব কি, সবাই হাঁ-হাঁ করে উঠল। বাইরের হাওয়া লাগলে নাকি মেয়েটির প্রাণ বেরিয়ে যাবে!
কুমারসাহেব বললেন নিজেই পরখ করে দেখলেন তো! এখানে এমন অনেক কিছু আছে যার নাগাল সায়েন্স এখনো পায়নি।
আমার কেমন যেন গাঁয়ের কোসাফল (তসরের ককুন) মত লাগল। ওর মধ্যের লার্ভা কীট ঠাণ্ডায় মরে না।
ব্যাজার মুখে জানতে চাইলাম বাররাণী নিজের মেয়েকে বন্দী অবস্থায় রেখে পালিয়ে গেলেন কেন?
ওঁরা অবাক হয়ে বললেন বন্দী রেখে নয়, বন্ধক রেখে। আজ পুজো সমাপনের জন্যে শেষ যজ্ঞে ওঁকে আসতেই হবে। আজ মাঝরাতে এসে আমাদের আশীর্বাদ দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাবেন।
সদনলালের হাত নেড়ে নেড়ে ইশারা কুমারসাহেব দেখতে পেয়েছেন। আমাকে বললেন—যান, মেলা ঘুরে আসুন। চা-টা খেয়ে ঘুম তাড়িয়ে আসুন।
আমরা এগিয়ে যাই নাচের দলকে ছাড়িয়ে। মেলাই বটে। দোকানের সারি। প্রায় গোটা কুড়ি। বেশির ভাগই নানারকম খাবারের দোকান। সবচেয়ে বেশি বিক্রি তেলেভাজার। বেসন গুলে আলুর বড়া, ছোলার ডালের ভাজিয়া, মুগডালের মুংগোরি, বড়ো বড়ো লংকাভাজা। আর আছে কলাইডাল আর পেঁয়াজের বড়া, সঙ্গে লাল রঙের লংকা পেষা চাটনি। একটা দোকানে ফুচকা, আর একজায়গায় বুড়ির চুল। এছাড়া আছে শিশুভোলানো কটকটি, বেলুন, মাটির পুতুল। আর মেয়েদের জন্যে ছিপিয়ার দোকান, মানে প্রসাধন সামগ্রী; চুলের রঙিন ফিতে, নেলপালিশ, মাহুর মানে আলতা, চুলের কাঁটা, নকল মটরমালা, নকল বোরোলীন, হুবহু একইরকম দেখতে,কিন্তু গায়ে ছাপা ‘কোরোলীন’। রাত বাড়ছে, মেয়েদের ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা চোখে পড়ছে। সবাই এসেছে দলবেঁধে,পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে।
একজায়গায় বড্ড চেঁচামেচি; হুঙ্কার ও চড়ের শব্দ। লোকের ভিড়ে কিছু বোঝাই দায়। চোখে পড়ল একটি বেশ সাজগোজ করা হাতে দামি ঘড়ি শহুরে দেখতে যুবককে কজন ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির চুল উস্কোখুস্কো। জামার বোতাম ছেঁড়া, ঠোঁটের কষে রক্তের ছিটে আর লালচে ভীত চোখ।
অনেক কথা থেকে যা বুঝলাম ও হলো স্থানীয় মহকুমা সদর কাঠঘোরার নগরশেঠের ছেলে—মকসূদন,মানে মধুসূদন। এই মেলায় মদ খাওয়া ও বিক্কিরি মানা; কিন্তু মধুসূদন পকেটে করে এনেছিল একটি পৌয়া বা পাঁইট। আর সবচেয়ে বড়ো অন্যায় করেছে – তা হলো একটি অনিচ্ছুক মেয়ের হাত ধরে টেনেছে। ফলে মেলার বাতাবরণ খারাপ করার অপরাধে তাকে গণধোলাই দিয়ে বিদেয় করা হলো।
আমার মনের খটকা যায় না।
আজ তো সব গুণাহ মাফ, তবে ও মার খেল কেন? ভিন্নসমাজের লোক বলে? মেয়েটা রাজি নয় তো দিত ওর গালে এক চড়! এমন গণধোলাই! লঘু পাপে গুরু দণ্ড!
আপনি মশাই শহুরে লোক, কিছুই বোঝেন নি। এটা আইন-কানুনের ব্যাপার নয়। পাপ থাকে মানুষের মনে। আপনি স্ত্রীর সঙ্গে শুলেন আর নগরবধূর সঙ্গে ওর কোঠায় গেলেন, দুটো কাজ বাইরে থেকে দেখতে একইরকম, কিন্তু এক হলো কি? একটায় মনের সম্পর্ক, আর একটায় পয়সার সম্পর্ক।
এই মেলায় মিলতে হলে দু’পক্ষের সহজ সম্মতি চাই; কোন জোর জবরদস্তি বা টাকার লোভ দেখানো চলবে না। শেঠের ব্যাটা টাকার গরমে ওই ভুলটাই করেছিল।
উফ, মাথা ধরে গেছে। গলা শুকোচ্ছে। একটু চা আর ভাজিয়া খেলে হয় না ?
চলুন, চলুন। এই না হলে ব্যাংকবাবু! এজন্যেই রাষ্ট্রকবি গাহিয়াছেন—
কী গাহিয়াছেন?
ছাড়ুন তো! সাহুব্যাটার যত্ত ফালতু লফফাজি! আসুন আমার সঙ্গে, ভাল চায়ের দোকান ওইদিকে।
চায়ের দাম কিন্তু আমি দেব।
আপনিও সেই ভুল করলেন! টাকার জোর ফলাচ্ছেন। ব্যাংকের তিজোরি কি আপনার পকেটে? বললাম না এই মেলায় কোন জোর খাটানো চলে না।
কী চলে?
ভালবাসা; শুধু ভালবাসা চলে।
কারবাইডের গ্যাসবাতির আলো জ্বলছে; প্রাইমাস স্টোভে ফুটছে দুধ-চা। কালচে ন্যাকড়া দিয়ে ছেঁকে দিচ্ছে কাঁচের গ্লাসে। শীতের রাত, তাই মেয়েপুরুষের সামান্য ভীড়।
ভীড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখি রামখিলাওন। ওকে সাতদিন আগেই ‘আই আর ডি পি’ ( ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট) তে পাঁচ হাজার টাকা লোন দিয়েছি। দেড় হাজার সাবসিডি, পাঁচ বছরে শোধ দিতে হবে। ও শশব্যস্ত হয়ে আমার জন্যে একটা প্লাস্টিকের টুল বের করে। আমি বুঝিয়ে বলি এসবের দরকার নেই। ও আমাদের ফ্রেশ চা বানিয়ে দিক; কড়িমিঠি। ও অবাক হয়ে বলে চার গেলাস বলছেন,কিন্তু আপনারা তো তিনজন?
মানে? খেয়াল করে দেখি গেঁজেল তবলচি ঠাণ্ডারাম সিদার গায়েব, কখন কেটে গেল? কেন গেল? কোথায় গেল?
সদনলাল আর সাহু চোখে চোখে কথা বলে।
তারপর রামখিলাওনকে হুকুম দেয় – ঠিকই বলেছিস। তিনটে ফুল চা; চালু নয়, ফ্রেশ।
আমাকে নীচু গলায় বলে – কে? কোথায়? কেন? কখন? এসব জেনে কী হবে? বলেছি না এই মেলায় সবাই অপনা মন কে রাজা!
সাহু ফুট কাটে—কিসমৎ অপনী অপনী! হুঁ হুঁ বাবা!
কিস্যু বুঝতে পারলাম না। সে যাকগে, তাকিয়ে আছি সসপ্যানে খলবলিয়ে ফুটতে থাকা চায়ের দিকে। এমন সময় কানে এল কিছু হাসির সঙ্গে একটা খ্যানখেনে গলা— বেংকওয়ালে সাহাব লা বিনতি কর দেইহ কি হম্মো মন লা তাজা চাহা পিলায়ে।
দুজন ললিতলবংগলতা সদনলালকে বলছে যাতে উনি ব্যাংক ম্যানেজারকে চা খাওয়ানোর জন্যে অনুরোধ করেন।
সদন ও সাহুর মুখে দুষ্টু হাসি। বলে এই সাহাবটি কিপটে, আমরা বললে হবে না। তোমরা নিজে বলে দেখ, কাজ হতে পারে। ওরা দু’জন গা ঠেলাঠেলি করে। আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি যে কিছু বলেনি তার চোখে সলজ্জ মুগ্ধতা।
কে আবার বাজায় বাঁশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে! ম্যানেজার, সাবধান হও। ক্লায়েন্ট এলাকায় কোন ব্যক্তিগত ঝামেলায় ফেঁসে যেয়ো না।
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রামখিলাওনকে বলি ওদের জন্যেও চা বানাতে।
চায়ে চুমুক দিয়ে ঠান্ডার কামড় একটু কম মনে হলো। সোয়েটার থাকলেও নদীর পাড়ের মাঠে বড্ড জাড়া। আলোয়ানটা ভাল করে জড়াই। তাড়াতাড়ি চা শেষ করে এগিয়ে চলি।
আগে একটি স্টলের সামনে ভিড় দেখে দাঁড়াই। ব্যাঞ্জো আর তাসাপার্টির মত কিছু বাজছে, সঙ্গে কোমর দুলিয়ে চটুল নাচ।
‘তঁয় বিলাসপুর কী টুরি, অউ ময় হুঁ রায়গড়িয়া,
তোলা মোলা জোড়ি বনে হ্যাঁয় বরবরিয়া।‘’
তুই বিলাসপুরের ছুঁড়ি, আমি রায়গড়ের চ্যাংড়া,
আমাদের রাজযোটক, জমবে ভাল ভাঙড়া’।
আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।
আবার শুরু হয়ঃ
“ মোর সংগ রবে ননি খাবে নোন-চাটনী,
এ তো হাবয় গাঁবয় টুরি, নহে মুম্বাই-পটনী”।
আমার সঙ্গে ঘর করবি? খাবি নুন আর চাটনি।
এটা তো গ্রাম রে খুকি, নয় মুম্বাই-পাটনা।
হঠাৎ সাহুজীর ছত্তিশগড়ি বিশুদ্ধ সংস্কৃতি চেতনা একেবারে ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ হয়ে ওঠে। কী আজেবাজে জিনিস দেখে দাঁত বের করছেন ম্যানেজারবাবু? এগুলোতে আমাদের মাটির ‘সোন্ধী গন্ধ’ নেই। এসব বম্বাইয়া ফিলিমের প্রভাবে তৈরি দো-আঁশলা জিনিস। চলুন, আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি ভাল জায়গায়। মাঠের এক কোণে সতরঞ্চি পেতে হারমনিয়াম ও ডুগি-তবলা নিয়ে জনাকয়েক বসে আর দু’জন কলাকার (আর্টিস্ট) দাঁড়িয়ে পালা করে গাইছেঃ
পুরুষঃ নদিয়া কে পার মা, পরদেশি গাঁও মা
লাগে হ্যাঁয় অব্বর এক মেলা।
আজা টুরি ঝুলবে তঁয় ঝুলা।
নারীঃ শাস-শ্বশুর সংগ হ্যাঁয়, দাঈ-দদা সংগ হ্যাঁয়,
কেইসে ঝুলাবে তঁয় মোলা,
ও সঙ্গী কেইসে ঝুলাবে তঁয় মোলা?
নদীটির ওই পারেতে, ভিনদেশি ওই গাঁয়েতে,
জমেছে এক মনভোলানো মেলা।
এস কন্যে, তোমায় দেব দোলা।
সঙ্গে আছেন শ্বশুর-শাস, বাবা-মা ও আশপাশ,
কেমন করে আমায় দিবি দোলা?
ও সাথী, কেমন করে আমায় দিবি দোলা?
আহা, অল্পবয়েসে বিয়ে হয়ে ভিনগাঁয়ে ঘর করতে যাওয়া মেয়েটি মেলায় এসে খেলার সাথীর বাঁশির ডাক শুনেছে, মন উচাটন। কিন্তু সমাজের বেড়া ভাঙতে সাহস হয় না যে!
দর্শকদের দিকে তাকাই। সবার চোখ অশ্রুসজল। ভাবছি সদনলাল আর সাহুজিকে কিছু জিজ্ঞেস করব এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে মেলা কাঁপিয়ে একসঙ্গে যেন হাজার মাদল বেজে উঠল। গোটা ভিড় সেই আওয়াজে পাগল হয়ে দৌড়তে লাগল শব্দের উৎসমুখ আন্দাজ করে। ওরা দুজন আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে চলে।
কী হয়েছে?
আরে মেয়েদের দল নেমেছে, পা চালান।
হ্যাঁ, মেয়েদের দল এসেছে আটটি গাঁয়ের থেকে। গতবারের থেকে একটা বেশি। প্রতি দলে কম করে সাতজন মেয়ে। তাদের গাছকোমর করে পরা লাল লুগরা, নানা রঙের ব্লাউজ, হাতে পায়ে কোমরে রূপোর গয়না—নাগমুহুরি, করধন, তোড়া; নাকে কানে গলায় – ঢার, কর্ণফুলি, মটরমালা। বললাম এদের পয়সা আছে।
সদনলাল দাবড়ে দিলেন।– আরে বেশির ভাগ গয়না নকল রূপোর, স্থানীয় ভাষায় ‘ডালডা’ ( ডালডা ঘিয়ের নকল বলে কি?)।
এই মুহুর্তে এসব অবান্তর কথা। আমি দেখছি সত্যিই রক্তে জোয়ার লেগেছে।
আমি সাঁওতালি নাচ দেখেছি। এরাও খানিকটা ওইরকম কোমর ধরে সারি বেঁধে নাচছে। কিন্তু অমন ঢিমেতেতালা লয়ে নয়। বেশ দ্রুত লয়ে, আর চটুল ছন্দে। এদের সমবেত পা উঠছে অনেকখানি, তাই শুকনো ধুলো উড়ছে। গানটা সেই একঘেয়ে ‘তোলা দয়া লাগে না ‘। কিন্তু ওই তাল আর লয় গানের মেজাজ পালটে দিয়েছে।
এক বুড়ো মাদল বাদক আর এক জোয়ানের সঙ্গে কমপিটিশন করে বাজাচ্ছে। মণিপুরি নৃত্যে খোলবাদকের মত হাঁটু গেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠে চক্কর কেটে নানান করতব দেখাচ্ছে।
ধিতাং-ধিতাং-ধিতাং-ধিং
ধিতাং-ধিতাং-ধিতাং-ধিং।
দোলা লেগেছে সবার শরীরে মনে। আমরা দর্শকরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছি সেই দোলায়। কী হলো, ব্যাংকবাবু? নাচবেন তো লজ্জা কিসের? তৈরি হয়ে যান, আমরা আমাদের গাঁয়ের দলটিকে বলে দিচ্ছি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আর পরের দিন তুমিই স্থানীয় সংবাদদাতা সেজে ‘দৈনিক নবভারত’ পত্রিকায় বক্স করে ছাপিয়ে দেবে – ‘বারমেলা কে অন্তিম দিন পর ব্যাংক ম্যানেজার কে মনমোহক নৃত্য’। তোমায় চিনি না শ্যালক! সদনলাল খ্যা-খ্যা করে হেসে পিচ করে পানের পিক ফেলে।
তারপর সবার খেয়াল হয় যে দেবস্থানে গিয়ে দেখা দরকার পুজো কতদূর এগোল, রাত অনেক হয়েছে।
সদনলাল আমাদের একটা শর্টকাট দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকটা অন্ধকার। বেশরম আর বনইমলির ঝাড়। কোথাও কোথাও কোন মিথুন যুগলের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
তবে সবাই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে মগন, নিজের অস্তিত্বে সম্পূর্ণ। আমরা পাশ কাটিয়ে পা চালিয়ে এগোতে থাকি। প্রায় পেরিয়ে এসেছি, দূরে দেবস্থানের আলোর ছটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এই নির্জনতায় প্রকট হচ্ছে কোন নারীর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না।
“অউ কতকা দুখ দেবে তঁয়, অউ কতেক দিন ডর ডরকে জীনা পড়ি মোলা”?
পুরুষ কন্ঠ সান্ত্বনা দেয়। “চুপ হো যা, চুপ হো যা ও; মোর উপর ভরোসা কর; এদারে কুছু ব্যবস্থা করহুঁ। পক্কা বাত। তোর কসম!”
আমার শরীরে বিশহাজার ভোল্টের শক! এ আওয়াজ যে বড়ো চেনা। আর আমি তো মেয়েটিকেও চিনেছি। ‘ভালুমার’ দ্রুপতী, সেবিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ১/১০।
সাহুজি আমার ঠোঁটের উপর আঙুল ছোঁয়ায়,সদনলাল হাতে চাপ দেয়। আমরা সন্তর্পণে সরে আসি।
দেবস্থানে গিয়ে দেখি ভারি উত্তেজনা।
উপোস করে থাকা ভক্তদের মধ্যে রাত্রির দ্বিতীয় যামে দেবতার ভর হচ্ছে। চোখ বুঁজে শান্ত হয়ে বসে থাকা মানুষটি হটাৎ বিকট শব্দ করে ছটফটিয়ে গুঙিয়ে ওঠে। তারপর মৃগীরোগীর মত ছটফট করে মাটিতে গড়াগড়ি খায়, ধুলোয় মুখ ঘসটায়। বৈগা ওর মাথায় জল দিয়ে থাবড়ান, মন্ত্র পড়েন। আস্তে আস্তে ভরের প্রকোপ কমে, শান্ত হয়ে ভক্তটি মাটিয়ে এলিয়ে পড়ে থাকে।
বৈগা তখন শুধোন—তুমি কে?
দৈবী ভরগ্রস্ত বলে আমি বাররাজা।
সমবেত ভক্ত ও দর্শককুল জয়ধ্বনি করে।
এইভাবে একের পর ভক্তের শরীরে ভর করে হাজির হন বাররাজা ও ঠাকুরদেব। কিন্তু বাররাণী কই? তিনি না এলে ষোলকলা পূর্ণ হবে না। দর্শকেরা ধৈর্য্য হারাচ্ছে, রাত অনেক হলো।
ইতিমধ্যে তৃতীয় একজনের একইভাবে ভর হলো। জয়ধ্বনি। জনতা ও বৈগা নিশ্চিত যে এবার বাররাণী এসেছেন, যজ্ঞ সম্পন্ন হবে। কিন্তু বৈগার প্রশ্নের উত্তরে ভরকরা দেবতা জানালেন যে তিনি বাররাণী ন’ন, তিনি বাররাজা!
সন্নাটা! সন্নাটা!
একজন বাররাজা তো আগেই এসেছে, ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। তাহলে?
একজন বলেই ফেলল যে আমি আসল বাররাজা। আগে যে এসেছে সে নকল,ঢং করছে। ধুন্ধুমার বেধে গেল। দুই বাররাজার পক্ষে দাঁড়িয়েছে তাদের গাঁয়ের দলবল।
সবাই চেঁচাচ্ছে যে পরীক্ষা হয়ে যাক, কে আসল কে নকল। দুধ কে দুধ, পানী কী পানী! বৈগা পরীক্ষা নিক।
বৈগা দুই যুযুধান পক্ষকে শান্ত করে বিধান দিলেন যে আগে বাররাণী আসুন, তাঁর মেয়েকে আমরা মুক্ত করে দেব। তখন শেষ পুজোর আগে বাররাণী ও ঠাকুরদেবের উপস্থিতিতে আসল-নকলের পরখ হবে।
সবাই শান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রার্থনায় বসল। এসো গো বাররাণী!
শীত বাড়ছে, নদীর দিক থেকে একটা হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কুমারসাহেবের মাথা বুকের উপর ঝুলে পড়ছে। আবার উনি বড়ো বড়ো লাল চোখ করে সবাইকে দেখছেন।
আমি অগ্নিকুণ্ডের কাছাকাছি গিয়ে আলোয়ান জড়িয়ে নিয়ে কাত হই।
ঘুম ভাঙল সরপঞ্চ সায়েবের ঠেলাঠেলিতে।
--উঠুন, মেলা দেখতে এসেছেন, কি পড়ে পড়ে নাক ডাকাতে? কী ঘুম রে বাবা!
-- বাররাণী এসেছিল?
--কেন আসবে না? জেগে থাকলে তো দেখবেন?
চোখ কচলে উঠে দাঁড়াই, আড়মোড়া ভাঙি, হাই তুলি। যজ্ঞকুন্ডের আগুন নিভু নিভু। আকাশে গোলাপি রঙ লেগেছে। সমস্ত মশাল নিভে গেছে। কিন্তু গোটা মাঠ রক্তে লাল, শুনলাম পঞ্চাশটি পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছে।
আমাদের ভাগের প্রসাদী মাংস শালপাতায় মুড়ে চারভাগ করে সদনলালের কাঁধের ঝোলায় রাখা। বসীবার গাঁয়ের সরপঞ্চ অনুরোধ করেছিলেন দুপুরের খাওয়াটা ওঁর বাড়িতে সারতে, কিন্তু আমরা রাজি হইনি। কুমারসায়েব কোরবায় শ্বশুরবাড়ি যাবেন আর আমায় ব্যাংক খুলতে হবে।
আমরা নদীর পাড়ে প্রাতঃকৃত্য সারি, নিমগাছের ডাল ভেঙে মুখারি করি। তারপর গাঁয়ে তৈরি গুড়ের চা খেয়ে রওনা দিই। ফেরার সময় দলের মধ্যে একজন কমে গেছে। তবলা মাস্টার আর ফেরে নি।
পথে কেউ কোন কথা বলি না, সবাই যে যার নিজস্ব দুনিয়ায় হারিয়ে গেছি। এমন সময় রসেলুরাম সাহু ঘুম –থেকে- জেগে- ওঠা গলায় বলল, গতবারে পাঁচ জোড়া পালিয়েছিল, এবারেও সেই পাঁচ; লেইকা-টুরি মনকে কা হোইস? সব বুড়া গে কা?
ছোঁড়াছুঁড়িগুলোর হলো কী? সব অকালে বুড়িয়ে গেল?
সদনলাল শান্ত গলায় বললেন— পাঁচ নয় ছয়। আমাদের তবলামাস্টার ঠাণ্ডারাম সিদারকে ভুলে গেলে?
0 comments: