1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ পুরকায়স্থ

Posted in

দুর্গোৎসবের ব্যতিক্রমী প্রতিমা: অভয়া দুর্গা
অমিতাভ পুরকায়স্থ

যুগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বছর বছর দুর্গাপূজা নিয়ে উৎসাহ কমেনি। শ্রদ্ধাশীল বিশ্বাসী মানুষের কাছে এই আরাধনা হারায়নি তার প্রাসঙ্গিকতা। এই প্রসঙ্গে শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন: ‘‘তোমার শ্রদ্ধা, তোমার আন্তরিকতা, তোমার সমর্পণ যত পূর্ণতর হয়ে উঠবে, মায়ের করুণা ও অভয় ততই তোমাকে ঘিরে রাখবে।’’ 

আমরা সাধারণত যে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গার আবাহন করি, তার থেকে একেবারে ভিন্ন রূপের দেবীপ্রতিমা দেখা যায় শহর কলকাতা ও বাংলার নানা প্রান্তে। সেই সব দুর্গাপ্রতিমাকে সাধারণত ‘অভয়া দুর্গা’ বলা হয়। অস্ত্র ত্যাগ করে তিনি শান্ত দ্বিভুজা মূর্তিতে মর্তবাসীকে অভয় প্রদান করছেন। 

ছোটবেলা থেকেই আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। মা অসুরের সঙ্গে মরণপণ সংগ্রাম করছেন, অথচ তাঁর ছেলেমেয়েরা এমন নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কী করে? একটু অদ্ভুত লাগত। তাই সেই সত্তর বা আশির দশকে বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার যে সব সর্বজনীন মণ্ডপে আলোর ভেল্কিতে যুদ্ধে কার্তিক বা গণেশের অংশ নেওয়া দেখানো হত, সেগুলি মনে হত অনেক বাস্তবসম্মত। অন্য দিকে বাকি মণ্ডপগুলিতে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর সঙ্গে তাঁর পুত্র-কন্যার এই পারিবারিক প্রতিমা কল্পনার মধ্যে একটা গোঁজামিল আছে বলে ভাবতাম। 

তার পর কলকাতার পুরনো পারিবারিক পুজোগুলো দেখতে শুরু করার পর খেয়াল করলাম, আরও এক ধরনের প্রতিমায় দুর্গাপূজা হয়, যেখানে এই পারিবারিক অ্যালবামের ছবিটা ঠিকঠাক ফিট করে। কোনও গোঁজামিল নেই। অভয়া দুর্গা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে অভয়া রীতির আর এক ধরনের দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে একটু বলে নেওয়া যাক। এই ধরনের প্রতিমাকে বলে ‘শিব-দুর্গা’ মূর্তি। 

সাধারণত বেনে বাড়ির দুর্গাপূজায় এই মূর্তি দেখা যায়। ষাঁড়ের উপর শিব বসে রয়েছেন। তাঁর বাঁ কোলে দ্বিভুজা অভয়দাত্রী দুর্গা। লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিক— সব নিজেদের জায়গায় বিরাজমান। যেন এই মাত্র কোনও স্টুডিওতে পোজ দিয়ে ছবি তুললেন সপরিবার মহাদেব। 

এমন মূর্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সূত্র দিয়েছিলেন বিডন স্ট্রিটের বিখ্যাত ‘ভোলানাথ ধাম’-এর শ্রী অজয় দত্ত। তিনি বলেছিলেন, তাঁরা ধনপতি সওদাগরের বংশধর। চুলচেরা ঐতিহাসিক বিচারে না গিয়েও মঙ্গলকাব্যের গল্প থেকেই আমার জানতে পারি যে বণিক পরিবারগুলি সাধারণত ছিলেন শিবভক্ত। দেবীরা নিজেদের পূজা সমাজে প্রচলন করার জন্য তাঁদের নির্দেশ দেন। কিন্তু গোড়ায় সেই আদেশ তাঁরা পালন করতে চাননি। পরে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যখন দেবীপূজা চালু হল, তখনও এমন মূর্তি তাঁরা কল্পনা করলেন, যেখানে শিবের জন্য নির্দিষ্ট হল উঁচু স্থান। শিব-দুর্গা প্রতিমাতেও শিবের মূর্তি বড় করে গড়া হয়, যাঁর কোলে বসানো হয় দুর্গাকে। 

শিব-দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী ছাড়াও জয়া-বিজয়ার মূর্তি দেখা যায়। কোথাও জয়া-বিজয়ার আলাদা মূর্তি না গড়ে মূর্তির পেছনে যে চালা থাকে, সেখানেই সুন্দর করে এঁকে দেওয়া হয়। প্রতিমার এই রূপদানে এক সম্পূর্ণ পারিবারিক ছবি ফুটে ওঠে। ঠিক যে ভাবে বছর শেষে পরিবার আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এক জমজমাট মিলনোৎসবে গমগম করে শতাব্দীপ্রাচীন ঠাকুর দালানগুলি! 

বনেদি এই বাড়িগুলির অধিবাসীরা মূলত বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তাঁরা বজায় রেখে চলেছেন পারিবারিক দুর্গোৎসবের মাধ্যমে। দুর্গাপ্রতিমার এই ভিন্ন রূপের সঙ্গে তাঁদের বাড়ির পুজোর ব্যবহৃত উপচার ও বিভিন্ন প্রথা-পদ্ধতি বার বার সে কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সব বাড়িতে পুজোর সময় কিছু বিশেষ আচার অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়। যেমন অষ্টমী/নবমীর দিন ধুনো পোড়ানো। মহিলারা এক সঙ্গে বা এক-এক করে ঠাকুরের সামনে বসেন। তাঁদের দুই হাতে এবং মাথায় নতুন গামছা দিয়ে বিড়ে বানিয়ে তার উপর নতুন মালসা বসানো হয়। তার পর সেই মালসায় পোড়ানো হওয়ার ধুনো। সন্তান ও পরিবারের মঙ্গলকামনায় এই অনুষ্ঠান পালন করেন বাড়ির মহিলারা। আবার বিসর্জনের দিন ঠাকুর বরণ হয়ে যাওয়ার পর উঠোনে প্রতিমা নামিয়ে তার চারদিকে মহিলারা ঘুরে ঘুরে অঞ্জলি দেন। এই প্রথাকে বলা হয় ‘বেড়া অঞ্জলি’। এ ছাড়াও বণিক বাড়ির প্রথা হিসাবে পুজোর দিনগুলিতে নাকে বড় বড় নথ ও পায়ে মল পরে থাকা অবশ্য কর্তব্য মনে করেন এই সব বাড়ির মহিলারা। 

কলকাতার বেশ কয়েকটি পুরনো বাড়ির পুজোয় এই শিব-দুর্গা মূর্তি দেখা যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বাড়ি হল বড়বাজারের বৈষ্ণবদাস মল্লিকের বাড়ি, বৌবাজারে গোবিন্দলাল দত্তের বাড়ি (বেলু বাড়ি), ঠনঠনিয়া (দ্বারিকা) দত্ত বাড়ি, দুর্গাচরণ লাহার বাড়ি, বিডন স্ট্রিটের ভোলানাথ ধাম, ঝামাপুকুর চন্দ্র বাড়ি, কাশীপুরের বংশীধর দত্তের বাড়ি, বেনিয়াটোলা দত্ত বাড়ি, বড়াল বাড়ি ইত্যাদি। 


কলকাতার আরও কয়েকটি বণিক বাড়িতে আর এক ধরনের অভয়া দুর্গাপ্রতিমা পুজো হয় এই শারদোৎসবের সময়। সূর্য সেন স্ট্রিট দিয়ে পশ্চিম দিকে যাওয়ার সময় ডান দিকে বৈঠকখানা রোডে কাগজ আর প্রিন্টিং-এর দোকানগুলির মধ্যে নজর এড়াবে না গত শতকের একেবারে প্রথম দিকে তৈরি একটি সাদা রঙের বাড়ি। বাইরের বারান্দার নীচে ব্র্যাকেট আর উপরে নকশাদার গ্রিল— দুই-ই ঢালাই লোহার তৈরি। এই বাড়িতেই পুজো হয়ে এসেছে অভয়া দুর্গার। যশোরের বাসিন্দা সুবর্ণ বণিক নীলমণি সেন কলকাতায় এসে প্রথম জাকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই শুরু হয় দুর্গোৎসব। তিন খিলান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান-সহ বৈঠকখানা রোডের এই বাড়ি তৈরি করেন নীলমণির পৌত্র কানাইলাল সেন। এক সময় ঠাকুরদালানের গায়ে সুন্দর কারুকাজ ছিল, যার একটা আভাস এখনও পাওয়া যায়। ১৯১৩ সাল থেকে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে এখানে দুর্গা ‘অভয়া’ রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। এই মূর্তিতে অসুর নেই, রক্তপাত নেই। দ্বিভুজা দেবীর এক হাতে অভয় মুদ্রা, অন্য হাতে বরদা মুদ্রা। পায়ের কাছে বসে আছে সিংহ, ঠিক যেন পোষা বেড়াল। দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ নিজেদের প্রথাগত স্থানে প্রতিষ্ঠিত। ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়ে পুজো শুরু হয়। পুজোর ক’দিন প্রতিমা দর্শনের জন্য বাইরের দর্শনার্থীদের ঢুকতে দেওয়া হয় বাড়িতে। 

আরও খানিকটা পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে পটলডাঙায় ধর বাড়িতে আর এক ধরনের অভয়া দুর্গাপ্রতিমা দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত এই বাড়িটিকে মদনমোহন ধরের ঠাকুরবাড়ি বলা হয়। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায় যে ১৮৪৪ সালে কানাই ধর লেনের বাড়িতে শুরু হয় সুবর্ণবণিক গোষ্ঠীভুক্ত এই পরিবারের পুজো। ১৮৮৪ সালে পরিবারের সদস্য মদনমোহন ধর পটুয়াটোলা লেনের এই বাড়িতে পুজো শুরু করেন। ঠাকুরদালানটি একটু অদ্ভুত দেখতে। পুজো হয় তিনটি দরজা যুক্ত একটি ঘরে, যার সামনে চওড়া বারান্দার তিনটি কারুকার্যখচিত ঢালাই লোহার থাম, সাবেক খিলানবিশিষ্ট দালানরীতির স্থাপত্যের একটা আভাস দেয়। এখানেও দেবী অভয়া মূর্তিতে পূজিতা হন। অসুর ও রক্তপাতবর্জিত শান্ত অভয়দাত্রী প্রতিমা। দেবীর পায়ের কাছে দুটি ছোট ছোট সিংহ থাকে। লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ ছাড়াও সঙ্গে জয়া-বিজয়ার উপস্থিতিও নজরে পড়ে। 

একই ধরনের অভয়া মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় আর একটি বাড়িতে। সেই পরিবারেরও কৌলিক পরিচয় সুবর্ণবণিক এবং পদবি ‘ধর’। হ্যাঁ, কলুটোলার বিখ্যাত ধর বাড়ি। এখানেও লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ আর জয়া-বিজয়ার সঙ্গে দেবীর পায়ের কাছে দুটি ছোট ছোট সিংহ থাকে। চন্দননগরের সর্ষেপাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র ধর নিজের বাড়িতে অভয়া দুর্গাপুজো শুরু করেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র পূর্ণচন্দ্র ধর ছিলেন জার্ডিন অ্যান্ড স্কিনার কোম্পানির ক্যাশিয়ার। তিনি কলুটোলার দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে নতুন ঠাকুরদালান সমেত বাড়ি করে পুজোটি নিয়ে আসেন। এই বাড়িতে ‘হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা’র কলুটোলা অঞ্চলের কার্যালয় স্থাপিত হয় এবং সেই সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৮৮২ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ এই বাড়িতে আসেন। ঠাকুরদালানের যে জায়গাটিতে তিনি বসেছিলেন, সেখানে এখন যজ্ঞকুণ্ড তৈরি করা হয়েছে। 

১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় বাড়ির সমস্ত দামি আসবাব লুঠ হয়ে যায়। প্রাণ নিয়ে পরিবারের লোকেরা পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন স্থানীয় এক মুসলমান পুলিশ অফিসারের সহযোগিতায়। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার সময়েই সেই লুঠের দৃশ্য দেখে মানসিক ভারসাম্য হারান বাড়ির এক বয়স্ক সদস্যা। তার পর প্রায় চার বছর বাড়িছাড়া ছিল পরিবারটি। অনেক কষ্ট করে তাঁরা শেষে ফিরে পান তাঁদের ভদ্রাসন। কয়েক বছর ঘটে নিয়মরক্ষার পর আবার ঠাকুদালান উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আনন্দময়ীর আগমনে। বর্তমানে কলুটোলার এই বাড়ি দুই শরিকের মধ্যে ভাগ হয়েছে। বাড়িতে দুটি তিন খিলানের ঠাকুর দালান। প্রতি বছর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দুই পক্ষ আয়োজন করেন অভয়া মূর্তিতে দুর্গাপূজার।

শহরের সব অভয়া দুর্গাপূজার গল্পে কিন্তু এমন ‘হ্যাপি এন্ডিং’ নেই। বরং আছে বিষাদমাখা ঘটনার ছোঁয়া। যেমন দাঁ বাড়ির গল্প। আনুমানিক ১৭৩৪ সালে বাঁকুড়ার কোতুলপুর থেকে দয়ারাম দাঁ কলকাতার দর্জিপাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। গন্ধবণিক কৌলিক পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যে বড়বাজারে শুরু করেন মশলার কারবার। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়তে থাকে। পুত্র রামনারায়ণের সময় সেই বিত্ত-সম্পত্তি আরও বিস্তার লাভ করে। খুব কম বয়সে আদরের মেয়ে দুর্গারাণীর বিয়ে দিয়েছিলেন রামনারায়ণ দাঁ। খুব জাঁকজমক করে। বিয়ের পর ধুলোপায়ের দিন বাপের বাড়ি ফিরল দুর্গা। সেখানেই আক্রান্ত হল কলেরায়, আর রাত না পোহাতেই দাঁ বাড়ির সব উৎসবের আলো যেন নিভে গেল। 

মেয়ের কথা ভুলতে পারেন না রামনারায়ণ। সব সময় তাঁর মনে হত, দুই বেণীতে লাল ফিতে লাগিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট মেয়েটি। এই স্মৃতিকে স্থায়ী করতে ১৭৬০ সালে বাড়িতে অভয়া দুর্গার পুজো প্রচলন করেন রামনারায়ণ দাঁ। কমলাসনে বসে যেন সেই বারো বছরের মেয়েটি। মাথায় দুই বেণী আর তাতে লাল ফিতে। পুজোয় শোকার্ত রামনারায়ণ হয়তো প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাশুভম্। হর রোগং হর ক্ষোভং হর দেবি হরপ্রিয়ে।’ আর এ ভাবেই প্রতি বছর বাপের বাড়িতে ফিরে আসার প্রথা চালু করে কি দুর্গারাণী সেই প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছিলেন? আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি যে সেই প্রথা আজও চলে আসছে। 

১৯৩০-এর দশকে সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরি হওয়ার সময় ভাঙা পড়ে দর্জিপাড়ায় মূল দাঁ বাড়িটি। বর্তমান জয় মিত্র স্ট্রিটের বাঁ দিকের প্রথম কয়েকটা বাড়িতে থাকেন ওই পরিবারের কয়েক শরিক। বাকিরা ছড়িয়ে পড়েন শহরের বিভিন্ন দিকে। জানতাম যে দর্জিপাড়ায় পুজো হয় এই অভিনব প্রতিমার। শুনে খুঁজতে গেলাম, কিন্তু কেউ বলতে পারলেন না। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আলোচনা করছি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে, এমন সময় উপযাচক হয়ে এক প্রৌঢ় এগিয়ে এলেন। সমস্যা শুনলেন, আর সটান আমাদের নিয়ে গেলেন দাঁ বাড়িতে। কথা বলিয়ে দিলেন তাঁদের সঙ্গে। সেখান থেকেই জানলাম যে এ বারের পালা পড়েছে ঠনঠনিয়ার এক শরিকের। 

পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে করে উপস্থিত হলাম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে। কিন্তু সেই বাড়ি আর কিছুতেই খুঁজে পাই না। শেষে পাড়ার দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলেই খোঁজ করলাম। এক ভদ্রলোক নিজে সঙ্গে করে পৌঁছে দিলেন। নিজেরা কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারতাম না এই বাড়ি। খুব বেশি হলে আড়াই ফুট চওড়া গলিতে, দুটি বাড়ির পর এই বাড়ির দরজা। দরজার সামনে দ্বারঘট আর কলাগাছ বলে দিচ্ছে যে বাড়িতে শুভ অনুষ্ঠান হচ্ছে। 

চক মেলানো সাবেক বাড়ির মতো ঠাকুরদালানের বিলাসিতাও আজ সামর্থ্যের বাইরে এই পরিবারটির। কিন্তু ঐতিহ্য আর শ্রদ্ধা দিয়ে সেই অভাব পূরণ করার চেষ্টায় তাঁরা সফল। একটা ঘর খালি করে পুজোর আয়োজন। পরিচয় হল গৃহকর্তার সঙ্গে। বললেন, এই ছোট জায়গায় সকলের সহায়তায় পুজো ভাল ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। অন্য শরিকদের মধ্যে কেউ কেউ শহরের বাইরে, আবার কেউ নানা সমস্যায় এই আয়োজন করে উঠতে পারেন না। তাই সেই দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন সঞ্জীব দাঁ ও তার পরিবার। পর পর কয়েক বছর ধরে এই পরিবারটিই আয়োজন করছেন তাঁদের পারিবারিক অভয়া দুর্গা পুজোর। 

কলকাতার বাইরেও অভয়া মূর্তির খোঁজ পেয়েছি বর্ধমান আর হুগলি জেলার সীমান্তে বৈঁচি গ্রামে। আদি সপ্তগ্রাম তখন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। বৈঁচির বিনোদবিহারী দাঁ ছিলেন গন্ধবণিক। আদি সপ্তগ্রাম থেকে পণ্য কিনে এনে মেমারির গঞ্জে বিক্রি করতেন তিনি। ব্যবসায় কিছু সুনাম হওয়ার পর মেমারিতে দোকানের পাশেই অস্থায়ী ঘর বানিয়ে থাকতেন। এক রাতে বিনোদবিহারী স্বপ্ন দেখলেন, তিনি শ্রীমন্ত সওদাগরের মতো সপ্তডিঙা ভাসিয়ে চলেছেন বাণিজ্যে। নৌকা সমুদ্রে পড়ার পর দেখলেন, সাগরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিশাল দেবীমূর্তি। এ মূর্তি দুর্গার, তবু যেন ঠিক দুর্গা নয়। পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ রয়েছেন। কিন্তু দেবীর পদতলে অসুর নেই, নেই সিংহ, কোনও অস্ত্রও। বাঁ হাতে একটি শিশুকে ধরে যেন তাকে অভয় দান করছেন দেবী। ডান হাতে বরদা মুদ্রা। দেবী আদেশ দিলেন, ‘‘তুই আমাকে এই রূপেই পুজো কর।’’ নিজের সঙ্গতির অভাবের কথা মাকে জানাতেই আবার আদেশ এল, ‘‘অধিক উপচারের দরকার নেই। কলাগাছের থোড় দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করলেই আমি সন্তুষ্ট হব। এর থেকে বেশি কিছু দরকার নেই।’’ সেই স্বপ্নাদেশ মেনেই বিনোদবিহারী আরম্ভ করলেন দেবীর অভয়ামূর্তির পুজো। ক্রমে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন তিনি। পুজোর আড়ম্বরও বাড়ে। কিন্তু সেই থোড়ের নৈবেদ্য বরাবর বজায় রইল ঐতিহ্য ও পরম্পরার নিদর্শন হিসাবে। 

ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘মহারাজা’ খেতাব পাওয়া দুর্গাচরণ লাহার মতো দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এই সব বাড়ির পূর্বপুরুষেরা সকলেই ছিলেন সাধারণ মানুষ, যারা নিজেদের কৌলিক বৃত্তি পালন করে শহরের বুকে স্থাপন করেছিলেন নিজেদের ভদ্রাসন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়েও তাঁদের উত্তরসূরিরা এখনও বজায় রেখেছেন নিজেদের ঐতিহ্যশালী পুজো। ঠনঠনিয়া দত্তবাড়ির মতো কিছু বাড়িতে এখনও পুজোর জাঁকজমক যথেষ্ট। আবার দাঁ বাড়ির মতো কোথাও কোথাও সেই জৌলুস এখন অতীত। কিন্তু নিজেদের ব্যতিক্রমী দুর্গাপ্রতিমার পুজো প্রতি বারের মতো এ বারও তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। 

দনুজদলনী দুর্গা যে বাঙালির ঘরের মেয়ে হয়ে উঠলেন, সেই রূপান্তরটা বোঝার একটা সূত্র হয়তো এই সব পুরনো পারিবারিক পুজোর ইতিহাস ও প্রতিমার বিশ্লেষণ করে পাওয়া যেতে পারে। সেই দায়িত্ব তো সনিষ্ঠ গবেষকের। আমরা সাধারণ মানুষ শুধু এটুকুই বুঝি যে উত্তর ভারতীয় বিভিন্ন সঙ্গীত-পরম্পরার মতো দুর্গাপ্রতিমার কল্পনাও বাংলার শস্যশ্যামল কাদামাটিজলে পড়ে তার পাথুরে কাঠিন্য হারিয়ে হয়ে উঠেছিল বাড়ির শান্ত স্নিগ্ধ মেয়েটি, বছরের মধ্যে চারটি দিন যাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি।
বৈঠকখানা নীলমণি সেন বাড়ি

বড় বাজার বৈষ্ণবদাস মল্লিক বাড়ি

বেনিয়াটোলা দত্ত বাড়ি

ভোলানাথ ধাম শিবদুর্গা

বৌবাজার গোবিন্দলাল দত্ত বাড়ি

কলুটোলা ধর বাড়ি - ১

কলুটোলা ধর বাড়ি - ২

দাঁ বাড়ি 

ঝামাপুকুর চন্দ্র বাড়ি

পটুয়াটোলা ধর বাড়ি

1 comment:

  1. Kuntal Datta, Adi Chowmatha Datta Paribar, Chinsurah20 October 2025 at 09:43

    আমাদের চুঁচুড়ার বাড়িতেও মা দুর্গার অভয়া মূর্তি। তবে উনি বাঁ হাতে অভয় দান করছেন আর ডান হাতে বরদা মুদ্রা। বারোমাস পুজো হয় অষ্টধাতুর মূর্তি আর তার আদলেই তৈরি করা হয় মাটির মূর্তি।
    সরকারি দলিল অনুযায়ী পুজোর শুরু ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে।
    কুন্তল দত্ত, আদি চৌমাথা দত্ত পরিবার, চুঁচুড়া। মোঃ: 9830980845

    ReplyDelete