0

প্রবন্ধ - মনোজ কর

Posted in

ছাত্র রাজনীতি – প্রেক্ষাপট এবং প্রাসঙ্গিকতা
মনোজ কর


বিগত কয়েকবছর ধরে যে প্রশ্নটি শিক্ষিত সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবিদের বারবার বিড়ম্বিত করে চলেছে সেটা হলো - ‘ছাত্রদের কি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত?’ আক্ষরিক অর্থে এই প্রশ্নটি অবশ্যই বিতর্কিত। যেহেতু সমাজের সবকিছুই এবং আমাদের প্রতিদিনের জীবন রাজনীতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত সুতরাং ছাত্ররা যারা এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং অদূর ভবিষ্যতে বুদ্ধিজীবি হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার অধিকাপ্রাপ্ত হবে তারা কি করে রাজনীতির বাইরে অধিষ্ঠান করতে পারে ? তর্কের খাতিরে যদি মেনে নিই অভিভাবকদের নির্দেশে ছাত্ররা রাজনীতির বাইরে থাকতে চায় তবুও বাস্তবে রাজনীতির আঁচ কি বাঁচিয়ে চলা সম্ভব? 

আমার মনে হয় এই প্রশ্নটিকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক হবে না। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি আসল প্রশ্নটি হলো – ‘যে রাজনীতির অনুশীলন বা রাজনীতির নামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধারা শিক্ষাঙ্গনে গত কয়েকদশক ধরে বয়ে চলছে সেই স্রোতে গা ভাসানো ছাত্রদের পক্ষে সমীচিন কি না?’ তথাকথিত ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতারা যারা কেবলমাত্র আখের গোছানোর জন্য বা সমাজের সর্বস্তরে নিজেদের কর্তৃত্ব জারি করার জন্য রাজনীতির নামে ছাত্রদের বিপথে চালনা করছেন তারা সর্বক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থগন্ধী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নানাবিধ ক্রিয়াকলাপকে সুস্থ রাজনীতির অনুশীলনের সাথে গুলিয়ে দিচ্ছেন। ফলতঃ অরাজকতা এবং রাজনীতি আজকের দিনে সমার্থক হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ, অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। মদ, গাঁজা, ড্রাগের নেশা ছাড়ানোর মতো বাবা মায়েরা ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে রাজনীতি করার নেশার থেকে বাঁচাতে চাইছেন। প্রয়োজনে ছেলে মেয়েদের অন্য শহরে এমনকি বিদেশেও পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। ছেলেধরার খপ্পরের মতো স্কুল কলেজে রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পর থেকে ছেলে মেয়েদের বাঁচানো ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠেছে। 

সুতরাং প্রশ্নটি যে প্রাসঙ্গিক তা সন্দেহাতীত। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর বা এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে বলা যেতে পারে এই সমস্যার কোনো সমাধান এই সময়ের প্রেক্ষিতে আছে কিনা তা দেখবার জন্য ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। একটা কথা মনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে ছাত্র আন্দোলন বা রাজনীতি কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন বা রাজনীতি নয়, সমাজের বৃহত্তর রাজনীতি এবং আন্দোলনেরই অংশ। শুধুমাত্র চরিত্রগত এবং গতিপ্রকৃতির দিক থেকে এটি ভিন্ন। ছাত্র রাজনীতিতে যুক্তির চেয়ে আবেগের আধিক্য বেশী। ছাত্র রাজনীতি বা আন্দোলন স্বচ্ছ, স্বার্থহীন, সৎ, নির্ভীক এবং অপরিণামদর্শী। ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র রাজনীতি বহুক্ষেত্রেই বৃহত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সমস্যার মূল সেখানেই নিহিত। 

ভারতবর্ষে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস প্রায় ১৫০ বছরের বেশী পুরোনো। 

১৮৪৮ সালে দাদাভাই নৌরজী ‘স্টুডেন্টস লিটারারি অ্যান্ড সাইন্টিফিক সোসাইটি’ বলে একটি সংগঠনের পত্তন করেন। এটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মধ্যে সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার অভ্যাস এবং প্ল্যাটফর্ম তৈরী করা। এই প্ল্যাটফর্মেই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যাথার্থ্য নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবং সেই আলোচনা ছাত্র আন্দোলনের রূপ পায় লাহোরের কিং এডওয়ার্ড কলেজে ব্রিটিশ এবং ভারতীয় ছাত্রদের ভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতির প্রতিবাদে ছাত্র ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। এই ধর্মঘট সাফল্য পায় এবং এই আন্দোলনকেই অনেকে ভারতের প্রথম ছাত্র আন্দোলন বলে অভিহিত করেন। 

১৯০৫ সালে যখন লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করে তখন তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মূল আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। 

১৯০৭ সালে সুরাট অধিবেশনে যখন কংগ্রেস বিভক্ত হলো তখন বাল গঙ্গাধর তিলকের সমর্থনে ছাত্ররা বিপুল সংখ্যায় এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী কালে ১৯১৯ সালে রাঊলাট অ্যাক্ট এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতায় হাজার হাজার ছাত্র অংশগ্রহণ করেন। 

১৯২০ সালে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে নাগপুরে অনুষ্ঠিত হয় সারা ভারত ছাত্র অধিবেশন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় এই সমাবেশ থেকেই। মূলস্রোত রাজনীতিতে ছাত্রদের যুক্ত করার সচেষ্ট প্রয়াস এই সময় থেকেই শুরু হয়। এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। ১৯২২ সালে নো ট্যাক্স আন্দোলনে এবং ১৯৩০ এ আইন অমান্য এবং ডান্ডি অভিযানে ছাত্ররা সংগঠিত ভাবে অংগশগ্রহণ করেন। এরপর থেকে অস্পৃশ্যতা, জাতপাত, বয়স্কশিক্ষা, স্বচ্ছতা অভিযান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার এবং গণসচেতনতায় দলে দলে ছাত্ররা যোগদান করেন। 

১৯৩৬ সালের ১২ই আগস্ট সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে। মহম্মদ আলি জিন্না এবং জহরলাল নেহেরু ছাত্রদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় এবং ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান ১৯শে আগস্ট । তারপরই স্কুল কলেজ ছেড়ে শত শত ছাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে জাতীয় কংগ্রেস এবং সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের অধিবেশন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় চেন্নাইতে। এইসময় থেকেই রাশিয়ায় প্রবর্তিত স্টালিন কন্সটিটিঊশন সমর্থন করার প্রসঙ্গে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে দ্বিমত সৃষ্টি হয় এবং অবশেষে ১৯৪৫ সালে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে কম্যুনিস্ট সমর্থকদের হাতে চলে যায় । 

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রদের একটা বড় অংশ হিংসাত্মক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং অনেকেই জেলে যান বা ফাঁসিতে অথবা পুলিশের গুলিতে মারা যান। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ছাত্র আন্দোলনগুলির চরিত্র লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে এগুলি মূলতঃ স্বাধীনতা আন্দোলনের তথা মূলস্রোত রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সুতরাং এই আন্দোলনগুলি মূলতঃ জাতীয় স্তরে এবং সর্বভারতীয় নেতৃত্বের দ্বারাই পরিচালিত হত। 

স্বাধীনতোত্তর কালে ছাত্র আন্দোলনগুলির চরিত্র পরিবর্তিত হয়। স্থানীয় এবং রাজ্যভিত্তিক স্তরে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনগুলি সংগঠিত হতে থাকে । স্বল্পমেয়াদী ইস্যুভিত্তিক এই আন্দোলনগুলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িক সাফল্য পেলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্যের মুখ দেখেনি। 

স্বাধীনতার পর জাতীয় কংগ্রেস দল ক্ষমতায় আসে৷ তারপর এক সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু হয়৷ ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে দলগুলি অংশ নেয়, তাদের প্রায় সকলেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখা৷ এনএসইউআই, এবিভিপি, এমএসএফ,এআইএসএফ, এসএফআই, সিপি, টিএমসিপি ইত্যাদি —ছাত্রশাখাগুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুগামী৷ ফলে ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলি দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলির মতই কেবলমাত্র ক্ষমতাদখলের লক্ষেই চালিত হতে থাকে। ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও হিংসার আবহাওয়া তৈরী হতে থাকে। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে ছাত্র আন্দোলনগুলির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যাতে পারে তার মধ্যে ১৯৬৯ -৭১ এ নকশাল আন্দোলন একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল কিন্তু ভ্রান্ত রণকৌশল এবং অপরিণত নেতৃত্বের কারণে এই আন্দোলন কেবল ব্যর্থ হয়নি বিগত পঞ্চাশ বছরে এই আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সে প্রসঙ্গে আসছি এই প্রবন্ধের শেষের দিকে। 

এছাড়া যে আন্দোলনগুলিতে ছাত্রদের বিশেষ ভূমিকা ছিল সেগুলি হলো,

১৯৭০ এ চিপকো আন্দোলন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা এবং জঙ্গল কেটে ফেলার বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালে উত্তরাখণ্ডের গোপেশ্বরে চণ্ডীপ্রসাদ ভাটের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সংগঠনটির নাম ছিল দাশৌলি গ্রাম স্বরাজ সঙ্ঘ। এই আন্দোলন শুরু হয় যখন বনদপ্তর সাইমন কোং কে গাছ কাটার ইজারা দেয় এবং স্থানীয় বাসিন্দারা তার প্রতিবাদ জানালে বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হয়। সঙ্ঘের সদস্যরা গাছ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক মহিলা এবং ছাত্র এই আন্দোলনে অংশ নেন। পরে এই আন্দোলন বৃহত্তর বনসম্পদ রক্ষা আন্দোলনের চেহারা নেয়। এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ৪৪ দিন (২৫।৫।৭৪ থেকে ৮।৭।৭৪) ব্যাপী এক দীর্ঘ ৭০০ কিমি পদযাত্রায় হাজার হাজার ছাত্র সামিল হন।

১৯৭৪ সালে নবনির্মাণ আন্দোলন। ১৯৭৩এর ডিসেম্বরে আমেদাবাদের এক কারিগরি কলেজে এই আন্দোলন শুরু হয় ২০% হোস্টেল ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে। এই আন্দোলন অচিরেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের চেহারা নেয়। ৩।১।৭৪এ এক ধর্মঘটে ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী চমনভাই প্যাটেলের পদত্যাগের দাবিতে ২৫শে জানুয়ারি রাজ্যব্যাপী বন্ধের ডাক দেয় ছাত্ররা। ৪০টি শহরে কার্ফু জারি হয়। অবশেষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চমনভাই প্যাটেলকে পদত্যাগ করতে বলেন।

১৯৭৯ থেকে ৮৫ সালে আসামে অনুপ্রবেশকারী হঠানোর দাবিতে তুমুল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামে একটি ছাত্র সংগঠন এই আন্দোলনের শুরু করে। ব্যাপক জনসমর্থনের ভিত্তিতে এই আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে পরবর্তী নির্বাচনে এই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্ব এবং প্রাপ্তবয়স্ক সক্রিয় সমর্থকেরা ক্ষমতা দখল করে ‘ আসাম গণ পরিষদ’ সরকার প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং ওবিসিদের জন্য মন্ডল কমিশন প্রস্তাবিত ২৭% সংরক্ষণ চালু করতে চাইলে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ এবং দিল্লি স্কুল অব ইকোনোমিক্স এর ছাত্রদের নেতৃত্বে হাজার হাজার ছাত্র সংগঠিত হন এবং দেশজুড়ে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ তখনকার মত স্থগিত রাখা হয়। 

২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কাতে তামিলদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে এবং ইউনাইটেড নেশান্সের ‘রেসলিউশন ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন অফ ওয়ার ক্রাইমকে’ সমর্থন না করার দাবিতে ‘স্টুডেন্ট ফেডারেশন ফর তামিল ইলম’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১১।৩।২০১৩ তে লয়লা কলেজে অনশনরত ছাত্রদের এবং রাজভবনের সামনে জমায়েত হওয়া ৫০০র বেশী ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে । 

২০১৪ সালে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী নিগ্রহের বিচারের দাবিতে ছাত্র অবস্থানে পুলিশি নিগ্রহের প্রতিবাদে এবং উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রছাত্রী এবং প্রাক্তনীরা এক বিশাল আন্দোলনে সামিল হোন। ‘হোক কলরব’ নামে এই ছাত্র আন্দোলন আংশিক সাফল্য পায়। উপাচার্য অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই আন্দোলনে সোসাল মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এই আন্দোলন এক বিশেষ চেহারা পেয়েছিল। 

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দলিত পিএইচ ডি গবেষক রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান এবং বিচারের দাবিতে এক বিশাল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক এবিভিপি নেতাকে আক্রমণের শাস্তি হিসেবে পাঁচজন দলিত ছাত্রকে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং ক্যাম্পাসে প্রবেশের ব্যাপারে তাদের ওপর নানা বিধিনিষেধ চালু করা হয়। এই পাঁচজনের একজন রোহিত ভেমুলাকে ১৭ই জানুয়ারি হোস্টেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং বিচারের দাবিতে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। শেষ অবধি কেউ শাস্তি পায়নি। 

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তামিলনাড়ু এবং পণ্ডিচেরিতে প্রায় কুড়ি লক্ষ ছাত্র ‘জাল্লিকাট্টু’ বন্ধ করার প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশ নেন। অবশেষে সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

লক্ষণীয় যে এই সমস্ত ছাত্র আন্দোলনগুলি ছিল মূলতঃ ইস্যুভিত্তিক। এগুলির মধ্যে কোনোটিই কোনো বৃহত্তর সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেনি। সুতরাং এগুলি তাদের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই সাময়িকভাবে সফল, অর্ধসফল বা অসফল হয়েই শেষ হয়ে যায়। কোনো আন্দোলনই সামগ্রিকভাবে জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর আন্দোলনে উন্নীত হতে পারেনি। 

এবারে আসি নকশাল আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনায়। ১৯৬৯ সালে নকশালবাড়িতে এবং শ্রীকাকুলামে কম্যুনিস্ট নেতৃত্বে কৃষক অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই তদানীন্তন সি পি আই এম দ্বিধাভিবক্ত হয়ে যায়। সংসদীয় রাজনীতির পথ থেকে সরে এসে চীনের কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আদলে গ্রামকেন্দ্রিক সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সি পি আই এম এল নামে একটি পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। নকশালবাড়ির আন্দোলন সাময়িক সাফল্য লাভ করার ফলে দেশের অনেক জায়গা জুড়ে এই আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এর ফলে সি পি আই এম এল নতুন করে ভারতের শ্রেণীচরিত্র নির্ধারণ করে এবং শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে এগিয়ে চলে। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া এবং সামন্তবাদ শ্রেণীশত্রু এবং আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্ণিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে কলকাতার ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে সামিল হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই আন্দোলন শহুরে আন্দোলনে পরিণত হয় এবং নেতৃত্বের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনায় শ্রেণীশত্রু খতমের নামে শহরাঞ্চলে সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, পুলিশকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা শুরু হয়। শিক্ষা এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, থানায় আগুন লাগানো, বোমাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। জনজীবন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের রুটি রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তার ওপরে এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সমাজবিরোধীরা নকশাল নাম ভাঙ্গিয়ে শুরু করে চুরি ডাকাতি এবং লুঠপাট। পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ যৌথভাবে এই আন্দোলনের নামে প্রহসনকে বন্ধ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে বহু স্বল্পবয়সী অপরিণতমনস্ক ছাত্রের অকালমৃত্যু ঘটে । অনেক ছাত্র শহরছাড়া হয়ে কোনোক্রমে প্রাণে বাঁচে। গ্রামকেন্দ্রিক সশস্ত্র আন্দোলনকে শক্তি জোগানো তো দূরের কথা সম্পূর্ণ দিশাহীন এই আন্দোলন অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব কৃষক শ্রমিকের দেওয়ার কথা সেই আন্দোলনকে কিছু শহুরে মধ্যবিত্ত যে চালনা করতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। নকশাল আন্দোলনের তৎকালীন অনেক নেতাই পরে মধ্যবিত্ত জীবনে ফিরে আসেন এবং কেউ কেউ সংসদীয় রাজনীতিতেও যোগদান করেন । 

এবার আসি বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি কি চেহারা নিয়েছে সেই প্রসঙ্গে। রাজনৈতিক দলগুলি শুধুমাত্র ছাত্রদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়ন দখলের পাশাপাশি প্রশাসনের উচ্চস্তরে নিজেদের লোক নিয়োগ করে এই নিয়ন্ত্রণকে আরো জোরদার করে। সব আমলেই এর ভূরি ভূরি নিদর্শন আমরা দেখেছি। অল্পবয়েসি ছাত্ররা পড়াশোনা ব্যাহত করে’এই কর্মকান্ডে জড়িয়ে যায় মূলত তিনটি কারণে, নেতৃত্বের লোভ, অ্যাডভেঞ্চারের নেশা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা। শতকরা ৯৮ ভাগ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক জীবনের শুরু এবং শেষ ছাত্রজীবনেই সীমাবদ্ধ। সাংসারিক এবং পেশাদারী জগতেই জীবনের বেশীরভাগ সময় কেটে যায়, আজও নিজের গতিতে।

আমার মতে যে সব ছাত্রের রাজনীতিতে উৎসাহ আছে তারা সচেতনভাবেই এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে অংশগ্রহণ করতে পারে তবে কোনওভাবেই নিয়মিত পড়াশোনার বিনিময়ে নয়। এই পরিস্থিতে রাজনীতির জন্যে পড়াশোনার সঙ্গে সমঝোতা আত্মহননের সামিল। কোনো ব্যক্তির বা দলের রাজনৈতিক উচ্চাশার শিকার হওয়ার থেকে সাবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। ছাত্রাবস্থায় অন্তরের তাগিদকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করেই কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নয়তো পদস্খলনের সম্ভাবনাই সমধিক।

যদি এ কথা মানতেই হয় যে ভারতবর্ষকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য কম্যুনিস্ট আন্দোলন একান্তই প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে ভারতবর্ষে প্রকৃত অর্থে এই মুহূর্তে কোনো কম্যুনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব নেই। যারা নিজেদের কম্যুনিস্ট বলেন তারা সংসদীয় বা অসংসদীয় দু ক্ষেত্রেই নানাবিধ কারণে চূড়ান্ত অসফল। একথা বলা বাহুল্য যে অন্তর্দন্দ্বে দীর্ণ এই কম্যুনিস্টরা এই মুহূর্তে একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি।

যে কম্যুনিস্টরা ভোটের রাজনীতির প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করে সংসদীয় কম্যুনিস্টদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নতুন দল গঠন করে’ বিপ্লবের নতুন পথে হাঁটতে শুরু করলো তাঁরা নকশালবাড়ী আন্দোলনের সাময়িক জয়ের অব্যবহিত পরেই সাংগঠনিক ব্যর্থতার শিকার হয়ে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেলো। শুনেছি বহুভাগে বিভক্ত এই পার্টির মধ্যে অনৈক্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং ঐক্য আর পুনর্স্থাপিত হয়নি। 

বিগত ৫০ বছরে ভারতবর্ষের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পাতা জুড়ে একটা বিশাল শূন্য। বিপ্লবোত্তর চীন এবং রাশিয়ার শ্রেনীভিত্তিক অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যদিও দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্ত্তুবাদের উপরে আধারিত মার্ক্সীয় দর্শন যথার্থই যুক্তিভিত্তিক এবং সর্বাঙ্গীন বিপ্লবের অবিসংবাদিত চালিকাশক্তি তবুও দুই প্রধান কম্যুনিস্ট দেশের বর্তমান অবস্থার নিরিখে বিশ্ব জুড়ে কম্যুনিস্ট আন্দোলন এক বিশাল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে শাসকশ্রেনীর প্রতিনিধিরা যদিও কয়েকটি দলে বিভক্ত তবুও নীতিহীন ভাবে ক্ষমতা ভাগ করে একত্রে ভোগ করার ব্যাপারে প্রকৃতই সংহত। অন্যদিকে শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এমন কোনো শক্তি সংগঠিত হয়নি যারা এই ব্যবস্থাকে বদল করার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ। সুতরাং প্রকৃত অর্থে ছাত্র আন্দোলনকে মূল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার উপযুক্ত নেতৃত্ব এইমুহুর্তে অনুপস্থিত। এই কারণেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেনতেনপ্রকরেণ ক্ষমতাদখলের রাজনীতিতে ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ না করাই শ্রেয়।

0 comments: