ওবাড়ির চিঠি -শতরূপা দত্ত
Posted in ওবাড়ির চিঠি
সম্প্রীতি ও সৌহার্দে বাংলাদেশের দুর্গাপূজা
বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্লোগানটি আজকালকার হলেও, এর অসাম্প্রদায়িক ভাবটি কিন্তু বহু যুগ আগের, বাংলার জল-মাটি-হাওয়ায় মানুষে মানুষে এই মেলবন্ধন শতাব্দী-প্রাচীন। তাই বাংলাদেশের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে দুটি ঈদ, পহেলা বৈশাখ আর শারদীয় দুর্গাপূজা এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণযোগ্য।
পঞ্চাশের দশকেও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক আনন্দঘন আয়োজন। পূজামন্ডপের আঙ্গিনায় রামায়ণ কীর্তন, পালাগান, কবির লড়াই অনুষ্ঠিত হতো। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আয়োজিত হতো মেলা। মেলাপ্রাঙ্গনে থাকতো নাগরদোলা, মোরগের লড়াই থেকে শুরু করে নানা আয়োজন। এসব আয়োজনে ধর্মীয় বৈপরীত্য ভুলে গ্রামের সব মানুষ উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করতো।
পাকিস্তান আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছড়িয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বাঙালির সংস্কৃতিতে যে আঘাত করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা থাকলেও তাকে পুরোপুরি পরাস্ত করা যায়নি। ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিষবৃক্ষ থেকে কিছু অনাকাঙ্খিত ফল তাই মাঝেমধ্যেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাই এখন আর গ্রামে-গঞ্জে দুর্গাপূজার তেমন বড় আয়োজন দেখা যায় না। দুর্গাপূজা এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ বড় বড় মহানগরে ধুমধামের সাথে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে চারপাশ। যেমন নিরাপত্তা বাড়াতে হয় ঈদের নামাজে, তাজিয়া মিছিলে, পহেলা বৈশাখের প্রভাতী আয়োজনে।
এসবের মাঝেও দুর্গাপূজা যেভাবে উৎসবের আমেজে ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের মানুষকে একীভূত করে, এমনটি অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। পাড়ায়-পাড়ায়, মণ্ডপে-মণ্ডপে মানুষের যে ঢল নামে তা যে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরই ঢল নয়, সে কথা হলফ করে বলা যায়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোকে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প- মধু-কৈটভের কাহিনী, মহিষাসুরের কাহিনী ও শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনী রয়েছে। আর আছে মর্ত্যে বা পৃথিবীতে প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলনের কাহিনী। এই কাহিনী রাজা সুরথ ও সমাধি নামের এক বণিকের। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে রাজা সুরথের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তাঁর মন্ত্রী ও সভাসদেরা তাঁর ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। মনের দুঃখে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে রাজা মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা মুনি রাজাকে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। একদিন বনের মধ্যে রাজা সমাধি নামে এক বণিকের দেখা পেলেন। সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তাঁর সব টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মেধা ঋষির উপদেশে তাঁরা দুজন দুর্গাপূজা করলেন। দেবীর বরে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলো।
পুরাণে বর্ণিত এই মেধা ঋষির আশ্রমটি অবস্থিত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ে। বর্তমানে এটি মেধষ মুনির আশ্রম নামে পরিচিত। ১৯০০ সালে স্বামী বেদানন্দ নামে এক সাধক দৈবাদেশ পান কড়লডেঙ্গার বেতসা নদীর তীরে যাওয়ার জন্য। আদেশানুসারে সেখানে এসে মেধষ মুনির আশ্রমকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচান স্বামী বেদানন্দ। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন পাকিস্তানী সেনারা এই আশ্রমে লুটপাট চালায় এবং গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্দিরে পাথরের প্রতিমা প্রতিস্থাপন করে আবার পূজা শুরু হয়।
বলা হয়ে থাকে, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ। সম্রাট আকবরের শাসনামলে (ষোড়শ শতকে) বাংলার দেওয়ান হন তিনি। এতো বড় এক পদ পাওয়ার আনন্দে রাজা চাইলেন পৌরণিক যুগের মতো এক মহাযজ্ঞ করতে। রাজার পুরোহিত বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের রমেশ শাস্ত্রী জানালেন, বিশ্বজিৎ, রাজসূর্য, অশ্বমেধ ও গোমেধ- এই চার রকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে। কিন্তু রাজার জন্য এই চার যজ্ঞের কোনোটাই করা সম্ভব নয়। যজ্ঞের বদলে তাই দুর্গাপূজা করার পরামর্শ দিলেন রাজপুরোহিত। রাজা খুশি মনে দুর্গাপূজার আয়োজন করলেন। সেইসময় এই পূজার জন্য খরচ হয়েছিল আট থেকে নয় লক্ষ টাকা। বর্তমানে যে পারিবারিক কাঠামো সমেত পূজিত হন দেবী, তার সূচনা হয় তখন থেকেই।
রাজা কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃত্তিবাস পণ্ডিত। তিনি ছিলেন নদীয়ার ব্রাহ্মণ। রাজার অনুরোধে ১৪৬০ শকাব্দে বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন তিনি, যা ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে বাংলার ঘরে ঘরে নতুন এক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হলেও আপামর হিন্দুদের কাছে তখনই এটি বৃহত্তর পূজা হয়ে উঠেনি। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিভিন্নজনের আত্মজীবনীতে এ পূজার তেমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যায় না। সে হিসেবে বলা যায়, তখনও এটি হিন্দুদের প্রধান উৎসবে পরিণত হতে পারেনি।
ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর ১৮৩৯ সালে লেখা তাঁর ‘ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা’ বইতে ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে- ‘মহররম’, ‘বেরা’ এবং ‘বৈষ্ণ’ উৎসবের কথা বললেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। ঢাকার বাসিন্দা হৃদয়নাথ মজুমদার উনিশ শতকের সত্তর দশকেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছু বলেননি। বরং বলেছেন ‘হোলি’, ‘ঝুলন’, ‘মহররম’-এর মতো ধর্মীয় উৎসবের কথা।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তাঁর ‘আট দশক’ বইতে লিখেছেন, “ঢাকার মতো বৈষ্ণব প্রধান শহরে সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা নয়। আসল উৎসব ছিল ঝুলন আর জন্মাষ্টমী। শহরে অনেক মন্দির ছিল, সেগুলো ঝুলনের সময়ে উৎসবের সাজে সাজানো হতো।”
তাই বলে যে ঢাকাতে দুর্গাপূজা একদমই হতো না তা কিন্তু নয়। ভবতোষ বাবু আরও লিখেছেন, “বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন তখনও হয়নি অন্তত ঢাকাতে। পূজা দেখতে যেতাম সূত্রাপুরের ঢাকার বাবু নন্দলালের বাড়িতে যেখানে দোতালা প্রমাণ বড় প্রতিমা হতো। সবচেয়ে বেশি যেতাম টিকাটুলি ছাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজোয়। আমরা সবাই মিলে কাজ করতাম। ভিড় সামলানো থেকে দর্শনার্থীদের জুতোর খবরদারি করা পর্যন্ত। সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন: আমরাও তাতে যোগ দিতাম।”
পরবর্তীতে দেখা যায়, দুর্গাপূজা উপলক্ষে খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো। ১৯০২ সালে ঢাকার প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ থেকে জানা যায়, ‘শারদীয় পূজা উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ হইতে চার সপ্তাহের নিমিত্ত ঢাকা প্রকাশ বন্ধ থাকিবে। গ্রাহক, অনুগ্রাহক এবং পৃষ্ঠপোষকবর্গের যথাযোগ্য অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমরা অবকাশ গ্রহণ করিতেছি। মা সর্ব্বমঙ্গলী সকলের মঙ্গল বিধান করুন।’ বোঝা যায়, বিস্তৃত হচ্ছে দুর্গাপূজার আয়ো্জন। তবে, তখনও এসব পূজার অধিকাংশই ছিল পারিবারিক।
সার্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর। দেশ ভাগের পর এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্রাক্ষণ-অব্রাক্ষণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। তবে এখনো পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে পুরানো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। ‘৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় দেশের কেন্দ্রীয় দুর্গা পূজা।
বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উপমহাদেশের একমাত্র রক্তবর্ণের প্রতিমায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এই পূজা। আয়োজকরা জানান, তাদের পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সিপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার কামরূপ-কামাক্ষ্যায় পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয়রা তাকে একটি মেয়ে দেন। মহাষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা শেষে সর্বানন্দ দাস দেখেন, কুমারীর গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি কুমারীরূপী দেবীকে জিজ্ঞাসা করেন, মা আমার পূজা সুসম্পন্ন হয়েছে কি? উত্তরে ভগবতী বলেন, হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এখন থেকে ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবি। পরবর্তী বছর সর্বানন্দ দাস তার নিজ বাড়ি মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ে রক্তবর্ণের প্রতিমায় শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। আজো সেই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। ব্যতিক্রমী এই দুর্গা প্রতিমা দেখতে পূজার ক’দিন মানুষের ঢল নামে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে।
২০১০ সাল থেকে বাগেরহাট সদরের হাকিমপুর গ্রামের শিকদার বাড়িতে ব্যক্তিউদ্যোগে দেশের বৃহত্তম দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। প্রতিমার সংখ্যার দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পূজামণ্ডপ বলে দাবি করেন পূজার আয়োজক ডা. দুলাল শিকদার ও তার ছেলে লিটন শিকদার। প্রতিবছর এখানকার প্রতিমা সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ বছর (২০১৯) এই মণ্ডপে ৮০১টি প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে।
দুর্গাপূজার আনন্দ দ্বিগুণ হয় তা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা সূচনালগ্ন থেকেই সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির মিলনমেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। শারদীয় এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে মানুষের মধ্যে এক সৌহার্দ্যের বাতাবরণ সৃষ্টিতে অসামান্য অবদান রেখে আসছে। এভাবেই দুর্গাপূজা বাঙালির অন্যতম একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
0 comments: