ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
৭
পেরো
দুপুর গড়িয়ে সন্ধে। এখানে বিকেল হয়না। চারদিকে উঁচু পাহাড়। পশ্চিম দিকের লম্বা উঁচু পাহাড়গুলো হেলে রয়েছে।সূর্য অস্ত যাবার আগেই জোনাকি পিট পিট করে জ্বলতে থাকে। এই জায়গাটিকে বস্তি গ্রাম বনাঞ্চল কিছুই বলা যায় না। একটি উন্মুক্ত বিশাল সংশোধনাগার বলা যায়। গোরাচাঁদকে জানলেন এখানের নাম কুনিহা। এখানের যারা বাসিন্দা তাদের লেখাপড়ার ভাষা অলচিকি। এই ভাষাতেই এরা প্রত্যেকে অংক ভূগোল ইতিহাস বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত। গোরাচাঁদের অবাক লাগে। এই অলচিকি ভাষার স্রষ্টা পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু। যাঁর বাংলা ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি শহুরে মানুষ ছিলেন।তাঁর সাথে এদের কিভাবে যোগাযোগ হল? বাইরের জগতের শিক্ষা এখানে কি করে এলো? এই রহস্যময় অজানা গুপ্ত স্থানে পন্ডিত রঘুনাথ কি গোরাচাঁদের মত কোনোভাবে এসে পড়েছিলেন? আর এদের সুশিক্ষিত করে আবার লোকালয়ে ফিরে গেছিলেন? সেও তো অনেকদিন আগের কথা?
গোরাচাঁদের চার পাঁচ মাস হল এখানে আসা। ওদের ভাষাতেই প্রতিটি বাখুলের তিনি নামকরণ করেছেন। চোখের সামনে দেখতে দেখতে বহিরাগত জনজাতিদের চেহারা আচার আচরণ স্বভাব চলন বলনের আমূল পরিবর্তন দেখলেন। ওদের কুটিরগুলো প্রায় ছয়মাস হয়ে গেছে। এখনো মনে হয় যেন সদ্য তৈরি। ওদের আচার ব্যবহার এতো রুক্ষ ও আদিম ছিল যে স্বামী স্ত্রীর যৌন সম্পর্কও গোপন রাখতে জানতো না। ঘর পরিষ্কার নির্মল করে রাখা,আবর্জনা এক নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা এইসব এখন দৈনন্দিন জীবনযাপনের অঙ্গ।ওরা ধীরে ধীরে সহবত শিখে নিয়েছে। পাহাড়ের কোলে জঙ্গল কেটে পাথর কেটে একটি বিশাল এসেম্বলি হল বানানো হয়েছে যেখানে সবাই সকালে যখন প্রার্থনা করে ও শরীর চর্চা করে। রোজ দুপুরের পর সাধারণ জ্ঞান গণিত ও ভাষা চর্চা হয়। গোরাচাঁদ জেরেকা ও জোহা ও আরো কয়েকজন জনে জনে মন দিয়ে শেখায়। খুব অল্প সময়ে প্রায় সবাই শিক্ষিত হয়ে গেছে। প্রতি পাঁচটা পরিবারের জন্য পদ্ম দিঘীর পাশে এক একটা পাঁচ বিঘের মতো করে চাষের জমি তৈরি করা হয়েছে। আগে চাষবাসের নিয়ম জানতোনা তাই তেমন ফসল হতো না,কিন্তু এখন এই ক মাসেই চার রকমের ফসল তোলা হয়ে গেছে। বেশকিছু অমূল্য দুর্লভ ভেষজ ও ব্রাহ্মীপাতার রস সেবন করতে ওদের চারিত্রিক আদিম রুক্ষতা কমে এসেছে। ওরা অনেকরকম জ্ঞান ও ধ্যান ধারনা মাথায় নিতে পারছে ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইছে। চেহারা ও গায়ের রঙের পরিবর্তন এসেছে। গোরাচাঁদ এখানে আসার পর প্রতিটি বাখুলের মোড়লের কাছ থেকে পেরো লোকসংখ্যার গুনতি করে জেনেছিল বহিরাগতদের মোট পাঁচজন মানুষ পালিয়ে গেছিল। তাদেরমধ্যে দুজন মৃত,একজন এখন ধীরে ধীরে আরোগ্যের মুখে, আর দুজন এখনো পলাতক। বিস্তর খুঁজেও পাওয়া যায়নি। পেরো জানে,এখানথেকে বাইরের জগতে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। যে পথ দিয়ে জোহা ওদের এখানে নিয়ে এসেছিল সেটা অত্যন্ত জটিল ধাঁধা। গুহার মাঝপথে জলাশয়ের ধারে পাহাড়ের গায়ে প্রায় একই রকমের অনেকগুলো গুহাপথ আছে যেগুলোর মধ্যে একটিই নিস্ক্রমন পথ। কিন্তু সেটাকে চিনে নেওয়া বিভ্রান্তকর। জোহা তিনচার বার সেখানে গিয়ে ফিরে এসেছে। কাউকে দেখতে পায়নি। অন্যপথগুলোও অনেকে দেখে এসেছে কিন্তু ওইদুজনকে পাওয়া যায়নি। এখানথেকে বাইরের জগতে কেবল দুচারজনই যাওয়া আসা করেন। জোহা বাদ দিয়ে তাঁরা কারা ও কিভাবে কখন যান পেরো এখনো জানেনা। তাঁরা নিশ্চয়ই বইপত্র খবরাখবর নিয়ে আসেন ও এখানের সবাইকে জানান। এইতো, গতকাল গোরাচাঁদের কাছে জোহার সাথে পেরো আর জেরেকা গেছিল। তখন বেশ রাত, কিন্তু জ্যোত্স্নার আলো ফুটফুট করছিলো। রেড়ির মতো একধরনের গাছের রস থেকে তেল বের করে সেই তেলের বাতির আলোয় গোরাচাঁদ বই পড়ছিলেন। জোহা তাঁকে ডেকে নিয়ে সরোবরের পাড়ে বসে খুব আস্তে আস্তে কথাটি বললো।
-গুরুজি,আমাদের লোকেরা খবর এনেছে লেফ্টন্যাণ্ট জেনারেল সৌমজিতের বেল হয়েছে কিন্তু রাশিয়ান আর্মি ওনার ওপর আন্তর্জাতিক মানহানির মামলা করাতে উনি নজরবন্দী হয়ে আছেন। খুব কড়া পাহারা,কোনোরকমের যোগাযোগ ওনার সাথে হওয়া সম্ভব নয়,কিন্তু তবু একদল মিলিটারি এখনো শিমুলিয়া ও আসেপাশে ঘিরে রয়েছে। আমাদের লোক কোনোমতে এমন গুপ্তপথ দিয়ে পালিয়ে এসেছে যেটা কখনো আমরা ব্যবহার করিনা। কার আদেশে ওই সামরিক বাহিনী এখনো রয়েছে? ওদের তো প্রশিক্ষনের সময় সীমা শেষ আর রাশিয়ান ট্রুপও চলে গেছে?
-সৌমজিতের কার্যভার নিশ্চয় অন্য কাউকে দেওয়া হয়েছে। এটাই তো স্বাভাবিক।
–কিন্তু গুরুজি,সেখানে ওরা জানলো, যে খনি মালিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সৌমজিত বেআইনি খনি নিষ্কাশন শুরু করেছিল, সেইকাজ এখন পুরোদমে চলছে। পেরো উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো। প্রায় অন্ধকারেও তার চোখ জ্বলছে।-গুরুজি,আগে আমাদের বনাঞ্চলের ভাইদের নিয়ে আমরা বিরোধীতা করেছি,কিন্তু এখন তো অবাধে চলছে বাইরে থেকে লেবার আনিয়ে। যে সব এলাকা সরকার সিল করে দিয়েছে,সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য জায়গায়,আমাদের এই জায়গার ওই দক্ষিণ পাহাড়ের ওপারে মাইন ফাটাচ্ছে। আর রাত্রে কাজ হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করুন,প্রমাণ পাবেন। পেরোর কথা শেষ হতে না হতে দূরের দক্ষিণ প্রান্তের পাহাড়ের পিছনে আকাশ হঠাত্ জ্বলে উঠলো। আর একটা অস্পষ্ট বুম শব্দ। ওরা তিনজনই উঠে দাঁড়াল।
-হুঁ। মিলিটারি একটা আই ওয়াশ। ওদের শিখণ্ডি রেখে এই বিস্ফোরণ। এর পিছনে নিশ্চয় কোনো সরকারী আমলা রয়েছে। বা কোনো পলিটিক্যাল পার্টি। আমরা শিমুলিয়াতে নেই তাই বাধা দেবার কেউ নেই। উন্মুক্ত অরাজকতা। আমি একটা কথা জানি, শিমুলিয়ার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে এক বিস্তীর্ণ গভীর খাদ আছে। সেখানের মাটি ছাই রঙা সবুজ। ওই এলাকা জুড়ে যে কপার পাইরাইট খনিজ আছে তার সাথে সমান ভাগে এন্টিমনি ধাতু যা এখনকার যুগে অত্যন্ত দুর্লভ ও দামী। এখন কম্প্যুটারের কাজে অনেক ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু ধাতুটি অত্যন্ত বিষাক্ত। আর ওই ধাতুটি মাটির তলায় থাকা মানে সেখানে বিষাক্ত আর্সেনিক ধাতু থাকা। এমন তো নয় যে সেখানে ওরা কার্টিজ ব্লাস্ট করে বেআইনি সুড়ঙ্গ বানাচ্ছে ও খননের কাজ শুরু করেছে?
গোরাচাঁদ আরো কিছু বলতে যাবেন এমন সময় পেরো উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। -ওই ওই দেখুন গুরুজি ! এবার দক্ষিণের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। এবার কি ব্লাস্ট পাহাড়ের ওপরে? গোরাচাঁদ দাঁড়িয়ে পড়লেন। -এখান থেকে ওই পাহাড় কতোদূরে,আন্দাজ? জোহা উত্তর দেয়,-ওদিকে আমি কখনো যাইনি গুরুজি,কিন্তু মনে হয় খুব দূরে নয়। -এই জ্যোত্স্না রাতে আকাশটা লাল হয়ে যাওয়া মানেই পুরো এরিয়া জুড়ে ধুলোয় ভরে গেছে। এই ধুলো যদি আর্সেনিক এন্টিমনি গুঁড়ো হয় তবে সর্বনাশ হতে বাকি নেই। এই কথা বলতেই তিনজন একেবারে চুপচাপ হয়ে অনেকখন বসে রইল। চাঁদের আলো ঠান্ডা বাতাস শান্ত পরিবেশ বড় বেশি বিষন্ন। সর্বনাশ কথাটিতে কি মৃত্যুর স্পর্শ লেগে আছে। গোরাচাঁদ ভাবলেন।
0 comments: