প্রবন্ধ - পৌলোমী
Posted in প্রবন্ধ
সংঘর্ষ থেকে সংহতি
পৌলোমী
দয়া নদীর জলে স্নান সেরে উঠলেন সম্রাট অশোক। একি স্নান নাকি রক্তস্নান! জানা নেই তাঁর। স্বচ্ছ নদীর জলে এখন আর নীলিমারর নীল দেখা যাচ্ছে না। দয়া নদী আজ পরিণত হয়েছে রক্ত নদীতে। সাম্রাজ্য বিস্তার আর প্রতিহিংসায় অন্ধ হয়ে রাজা ভুলে গিয়েছিলেন বাকি সব মানুষের মত তাঁরও রক্তের রঙ লাল। দেড়লক্ষ কলিঙ্গ সেনা, দশ হাজার মগধী সেনা আর অগণিত নিরীহ শিশু, নারী হত্যার পর রাজার দুহাতের তালু ভরে গেছে রক্তে। এই পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন একমাত্র তথাগত। তাই সম্রাট শরণাগত হলেন বুদ্ধের। আঁকড়ে ধরলেন শান্তির পথ। চণ্ডাশোক হলেন ধর্মাশোক।
"ওঁ সহনাববতু সহ নৌ ভুনকতু
সহ বির্যং করবাব হই
তেজস্বী নব ধীত মস্তু মা বিদিস্বাব হই
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি হি..."
শান্তির বার্তা দিয়েই আজকের প্রবন্ধ শুরু করলাম। যদিও পৃথিবী সৃষ্টির মুহূর্তকাল থেকে সংঘাতই আমাদের জীবনের মূল ধারক। সেই সংঘাত পৃথিবী সৃষ্টির লগ্নে অনু-পরমাণুর সংঘাত থেকে শুরু করে আদিম মানবের সাথে প্রকৃতি ও জীবজন্তুর বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই, মানব শরীরে জীবনের স্পন্দন আনার জন্য শুক্রাণুর দৌড় সব ব্যাপারেই লক্ষ্য করা যায়। সংঘাত ছাড়া জীবন এক মুহূর্তও চলে না। মহামতী ডারউইন 1959 সালে তাঁর 'origin of species by means of natural selection' বইতে 'স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্স' বা অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম নামে একটি তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। আর তাতেই আমরা দেখি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতমের উদবর্তন হয়। কাজেই সংঘাত অবিশ্যম্ভাবী।
কিন্তু সেই সংঘাত যদি অস্তিত্বের প্রয়োজন ছাপিয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে আরও কিছু আগ্রাসনের জন্য যেমন সম্পদ এবং শ্রম লুন্ঠনের জন্য হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া যায় না। আজকে বিশ্ব জুড়ে লুন্ঠনের পদ্ধতি পাল্টেছে।বিশ্বায়নী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা লুন্ঠন প্রক্রিয়াকে সর্বজনীন চরিত্র দিয়েছে। গত কয়েক শতাব্দী ধরেই বহুযুদ্ধ এবং গত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধ বলা যায় চরমতম লুন্ঠন এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। এই স্বার্থান্বেষী, পুঁজিবাদী লুঠতরাজঘটিত সংঘাত কখনোই কাম্য নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ছেষট্টি ভাগ। আজকের দিনে যে কোন আঞ্চলিক যুদ্ধে আশি থেকে নব্বই ভাগ নাগরিক জনসাধারণের সম্পদ ও জীবন বিনষ্ট হয়। গত তিন দশক ধরে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক, লেবানন কবরস্তানে পরিণত হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধের আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়ছে সিরিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ কমেনি বরং ধ্বংস এবং মৃত্যু ব্যপকতা লাভ করেছে। উচ্চশ্রেণীর প্রযুক্তি, বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের পরীক্ষাগার হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলো। মহামারীর মত প্রায়শই যুদ্ধ লেগে রয়েছে। ধর্মীয় সংঘাত, গণতান্ত্রিক সংঘাত লেগেই রয়েছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে অকাতরে। অথচ এর কোনোটাই কাম্য নয়।
সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ শান্তিতে বাস করতে চায়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য জাতিপুঞ্জ, জাতিসঙ্ঘসহ বহু সংস্থা গড়ে উঠেছে। কিন্তু শান্তি কি, সংঘর্ষ বলতে আমরা কোন ধরনের সংঘাত বুঝবো এ সব ব্যাখ্যার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতিসঙ্ঘের পিস ইউনিভার্সিটি। তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো ওপরের দিকে থাকে।
যদিও আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে আজ সংহতি শব্দটা প্রহসনেরই নামান্তর। অথচ বারে বারে এই তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলিতে যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন বিভিন্ন মহাপুরুষের দল। পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শান্তির বাণী। বুদ্ধ, মহম্মদ, যীশুখ্রীষ্ট থেকে শুরু করে মহাত্মা, ম্যান্ডেলা, মালালা নিজেদের সুখ জলাঞ্জলী দিয়ে জীবনের বিনিময়ে আমাদের মধ্যে আনতে চেয়েছেন সংহতিকে। আমরা ক্ষুদ্রস্বার্থ মানুষ তা হেলায় ভুলতে বসেছি। আর তাই সংহতি ফিরিয়ে আনতে 'শান্তি ও সংঘর্ষ' অধ্যয়ন সামাজিক বিজ্ঞান পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত একটি শাখা ও গবেষণার অংশ হিসাবে স্থান পেয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ বহু আগে থেকেই সংহতি অধ্যয়ন করে আসছেন। এটি এমন একটি পাঠক্রম যেখানে অহিংস ও হিংসাত্মক উভয় ধরনের আচরণ এবং তাদের কার্যাবলী নির্ণয় ও বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া সংঘর্ষের বিভিন্ন কাঠামোগত গঠন যেগুলো মানুষের সঠিক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেগুলি নিয়েও আলোচনা করে। এটি একটি সমন্বিত অধ্যয়ন ব্যবস্থা। এর মূল উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেকোন সংঘর্ষের তীব্রতা কমিয়ে আনা, সমাধান এবং নির্মূল করা।যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন কলেজগুলিতে এই বিষয় অধ্যয়নের উৎসাহ দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ বছরে সুইডেনে একই ধরনের আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে।
সংঘর্ষ থেকে সংহতি এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানব, দানব, দেবতা এই কর্মযজ্ঞের ক্রীড়ানক মাত্র। হিন্দু শাস্ত্রে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব এই কর্মকান্ডের বাইরে নন। ধ্বংসের দেবতা বলা হয় তাঁকে। তবে এই সংঘর্ষ কেবলমাত্র নতুন ভালো কিছু সৃষ্টির জন্য। তাই প্রকারন্তরে বলা যেতে পারে সংঘর্ষ থেকে সংহতি একটি সুবিশাল প্রক্রিয়া যা-'বহে নিরন্তর'। তবে এই সংঘর্ষ ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রয়োজনে না হয়ে তা কেবলমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় হানাহানির বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, শিশু ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং জগতে আর যা কিছু খারাপ আছে তার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে হতে হবে। তাই মানুষ হিসাবে আবারও বুদ্ধ, মহম্মদ, যীশু, চৈতন্যের মতন মহামানবের অপেক্ষায় দিন কাটাই। যাঁরা মানুষের মধ্যে 'প্রেমের বাণী' প্রচার করবেন, তাঁদের মধ্যে সংহতির মানব বন্ধন রচনা করে ঐক্যবদ্ধ করবেন। কেননা, যুগে যুগে যখনই সভ্যতা বিপন্ন হয়েছে তাঁর আবির্ভাব হয়েছে জ্যোতির্ময় রূপে _______
"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
0 comments: