0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




প্রাণি বিবর্তনের শেষে এসে মানুষের মস্তিষ্ক হল মগজাস্ত্র। গুরুমস্তিষ্ক যাবতীয় কল্পনাপ্রসূত চিন্তা, ভাষা, ভাব-আবেগ, স্মৃতি, পরিকল্পনা, বিচার, দোষ, গুণ এবং যত জটিল কর্মক্ষমতার আঁতুড়ঘর। এর জন্যেই অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা মানুষ। প্রতিটি জীবকোষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর নির্দেশ, প্রেরণা ও ঐক্যতত্ত্ব যা অগোচরে কাজ করে যায়। প্রেরণা সমস্ত দেহের প্রতি, ঐক্য সমস্ত দেহে ব্যপ্ত। যেমন মস্তিষ্কের পেছনের অংশ সঙ্কেত গ্রহণ করে সামনের অংশকে নির্দেশ দেয় মোটর সঞ্চালনে। এই ঐক্যবদ্ধতার নির্দেশ বিনম্র এবং বাধ্য। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ বৈশিষ্ট বজায় রেখে যুথবদ্ধ হয়ে একটা দেহ চালাচ্ছে। মানুষের মধ্যেও এরকম যুথবদ্ধভাবে একটা সমাজকে চালনা করার নামই সভ্যতা। এখানেও প্রত্যেকটা মানুষ স্বতন্ত্র কিন্তু কোন এক অজানা কিছুর নির্দেশে সে সঙ্ঘবদ্ধ, ঐক্য। কী সেই নির্দেশ? একসঙ্গে থাক। কেন? আত্মরক্ষা ও শিশুসহ পরিজনদের রক্ষার্থে। কে দিল এই নির্দেশ? মস্তিষ্ক। মাথার খুলির যে অংশটা ভ্রূ-কে ঢেকে রয়েছে সেই অংশে মানুষের ন্যায়-নীতি বোধ, দূরদৃষ্টি, আধ্যাত্মিকতা, সৃষ্টিমূলক চিন্তার রান্নাঘর। এখানেই আবেগ জন্মায়।

আবেগের প্রকাশ নানাভাবে হয় যার মধ্যে একটা হল ভাষা। সাহিত্য, নৃত্য, ছবি আঁকা, ছবি তোলা বা ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যম। একই জিনিস কিন্তু প্রতিটা মানুষের আবেগ ভিন্ন হওয়ায় তার চিন্তা এবং প্রকাশ নিজস্ব হয়ে যায়। আমাদের চারিদিকে কত কি ঘটে যায় অহরহ, কিছু মনে দাগ কাটে কিছু মিলিয়ে যায়। কত কি শুনি, দেখি; ইন্দ্রিয়েরা সদাজাগ্রত, আমাদের জানিয়ে দেয় সব কিন্তু সব কি দেখি বা শুনি? মস্তিষ্ক কিন্তু সব সঙ্কেত গ্রহণ করছে ও পাঠাচ্ছে। মানুষের আবেগ তার চরিত্র অনুযায়ী বেছে নিচ্ছে স্মৃতিতে রাখার জন্যে। এই আবেগের সাথে কল্পনা মিলেমিশে শিল্পের সৃষ্টি।

আমাদের এই বাংলায় এমন দুজন শিল্পী দুই পিঠোপিঠি শতকে জন্মেছেন যাঁরা তাঁদের আপন আপন শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। একজন উনিশ ও বিশ শতকের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দ্বিতীয়জন বিশ শতকের সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে সর্বোৎকৃষ্ট সম্মান নোবেল দ্বারা পুরস্কৃত আর সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে সর্বোত্তম অস্কার বিজয়ী। রবীন্দ্রনাথের শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্র বিশাল। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠি, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নাটক, প্রহসন, বক্তৃতাসম্ভার, ছবি আঁকা আর সর্বোপরি গান যা তিনি নিজে লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও আরও নানা বিষয়ে আগ্রহ ও প্রকাশ। সত্যজিতের প্রধান শিল্পক্ষেত্র চলচ্চিত্রের বাইরে ছবি আঁকা, ক্যালিগ্রাফি, বিভিন্ন স্বাদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, বক্তৃতামালা, ফটোগ্রাফার এবং আরও অনেক কিছু। সত্যজিতের ক্ষেত্রে শুধু চলচ্চিত্র বললে সবটা বলা হয় না বরং বলা ভাল ফিল্ম ইন টোটালিটি। তিনি শুধু পরিচালকই নন, একাধারে চিত্রনাট্য, সঙ্গীতস্রষ্টা। এ দুটো তো টাইটেল কার্ডে থাকতই এছাড়া তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের সব বিভাগেই তিনি ছিলেন শেষ কথা। দুজনেই আবেগপ্রবণ এবং চিন্তাশীল কিন্তু আপন আপন গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ। তবু যখন রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ ছবি তৈরি করেন তখন এই দুই মহান শিল্পীর আবেগের মিশ্রণ নিজ সত্তায় আমাদের কাছে ধরা দেয়। সেই ধরা দেওয়াটাও আবার দর্শকদের মধ্যে স্বতন্ত্র যেমন সেই গল্প পাঠে হয়। তবু গল্পের সাথে পাঠকের আবেগের অনেক মিল থাকতেও পারে, থাকেও কিন্তু সেই গল্প নিয়ে সত্যজিৎ যেভাবে তাঁর শিল্প মাধ্যমে গল্প বলেন তার সাথে মিল থাকাটা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ নয়।

দার্শনিকদের মতে মানুষের সত্তা তিনটে লোকে বিচরণ করে। প্রথমটা আমাদের এই শস্য-শ্যামলা, সমুদ্র-নদী, পাহাড়-মরু ভরা পৃথিবী যার কোনো অংশ মানুষের কাছে আর দুর্গম নয়। দ্বিতীয় আশ্রয় মানুষের স্মৃতিলোক। একমাত্র মানুষের স্মৃতিই দীর্ঘস্থায়ী এবং সুখে-দুঃখে মানুষ স্মৃতির কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে। মানুষ শুধু নিজের স্মৃতি রোমন্থন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি, নির্বাক পৃথিবীর স্মৃতিও উন্মোচন করে তাকে সবাক করে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। পূর্বপুরুষদের কাহিনী তার প্রজন্মের স্মৃতি উদ্রেক করে বিশ্বমানবের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেছে। আর এর থেকেই উদ্রেক হয়েছে চিত্তলোক যেখানে সকল মানুষের অন্তরের আশ্রয়স্থল। একের সাথে অন্যের অন্তরের মিলন ঘটায়। আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে বেরিয়ে তাই তো মানুষ আগুনের মধ্যে ঢুকে দগ্ধ মানুষকে উদ্ধার করে। কোনো অন্যায় কাজের জন্যে অনুশোচনা করে। এই যে সর্বমানবসত্তা এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব। এর জন্যেই সে শ্রেষ্ঠ। এই মনুষ্যত্ব মানুষের আবেগ পরিচালনা করে। ফুলকে সুন্দর বলে মনে করে, চাঁদকে মায়াময় মনে হয়, হিংস্রতায় কষ্ট পায়, বিচ্ছেদে বিরহ আসে। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে বলেছেন, “আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি মানবিক ভূমা। তার বাইরে কিছু থাকা বা না-থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন।”


সত্যজিতের ফিল্ম জীবন

মানুষই প্রধান চরিত্র সত্যজিতের ছবিতে। সেখানে ফুটে ওঠে সেই চিরাচরিত দ্বন্দ্ব – জীবনের সঙ্গে শিল্পের, কর্তব্যের সাথে আবেগ, এবং মুক্ত ইচ্ছের বিপরীতে ভবিতব্য। এটাই নানা ভাবে নানা গল্পে জীবনে জীবনে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। স্বাধীনতার পর দেশের আধুনিকীকরণ গ্রামীণ সমাজে যে ধাক্কা দিয়েছিল তার একটা প্রতীকী দৃশ্য অপু তার মায়ের স্নেহকে উপেক্ষা করে, গ্রামের ওই পরিবেশে অসুস্থ মাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে তার নতুন জীবনের সন্ধানে চলে গেল। জমিদারপ্রথা বিলোপের প্রতিক্রিয়া দেখাতে চমৎকার সৃষ্টি জলসাঘর। আবার নারীর মধ্যে দেবীর রূপ আরোপিত করার প্রবণতা যখন চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছায় সেই মানসিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ দেখিয়েছেন দেবী চলচ্চিত্রে। বিজ্ঞানবিরোধী মতাদর্শে শিক্ষিত আজকের হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাষ্ট্রের অশ্লীল আস্ফালন সম্পর্কে অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন তিনি। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে অনবরত বয়ে চলেছে নানাবিধ দ্বন্দ্ব। সত্তার ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র রূপ।

প্রতিটা শিল্পেই শিল্পীর সারাজীবনের কলাকৌশলে একাধিক মোড় থাকে। থাকতেই হয়, নইলে শিল্প এগোয় না। সত্যজিতের একাধিক শিল্পসৃষ্টির অন্যতম এবং প্রধান চলচ্চিত্র শিল্পেও অন্তত তিনটে মোড় খুব স্পষ্ট। প্রথম ধাপে তিনি সমাজের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাচ্ছেন- এর শুরু ১৯৫৫-য় ‘পথের পাঁচালি’ দিয়ে এবং শেষ ১৯৬৭তে ‘চিড়িয়াখানা’-য়। এরপরেই দেখা যাচ্ছে তিনি সমাজের অন্দরে ঢুকে বিশ্লেষণে তাঁর শিল্পমাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছেন, প্রথম হাতেখড়ি ‘গুগাবাবা’ এবং তারপরে একের পর এক ছবিতে নিজের জিনকেই কাটাছেঁড়া করলেন, তৈরি হল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘অশনি সঙ্কেত’। ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে তিনি সরাসরি ঘুমন্ত দর্শককে চাবুক মেরে জাগিয়ে তোলেন। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। টাকার লোভে মধ্যবিত্ত ঘরের মা-বোনকে বৃহৎ পুঁজিপতির অঙ্কশায়িনী করে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না এই ভয়াবহ সত্য উচ্চারিত হল। নারী ও মাতৃজাতির প্রতি মধ্যবিত্তের ভক্তির পেছনে খেলা করে নারীমাংস-ব্যবসাকে আড়াল করার একটা আত্মপ্রতারণা। সিনেমা হল থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন সত্যজিৎ এবার আমাদের দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি। এই দেখা ‘নায়ক’ ছবিতেও আছে, এবং চলেছে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ এবং ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এও। ‘গুগাবাবা’র মত আপাত নিরীহ গল্পের দ্বিতীয় ভাগে ‘হীরক রাজার দেশে’-য় এসে গেল খুল্লমখুল্লা রাজনীতি, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এরপর আর লুকোছাপা নয়, বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের মুখোশ খুলতে আশ্রয় নিতে হল রবীন্দ্রনাথের, সৃষ্টি হল ‘ঘরে বাইরে’। তার আগেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। বুঝে গেছেন, সময় অল্প, বলতে হবে এবার নিজের গল্প। না, আত্মজৈবনিক গল্প নয়, সমাজ সম্পর্কে এতদিনের যত অভিজ্ঞতা তা প্রকাশ করার সময় এসেছে। দর্শক এখন সিনেমা দেখায় শিক্ষিত। এইখানেই তাঁর শেষ মোড়। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-রাজনীতিজীবী-মানবসেবী-ভদ্রসমাজের চোখের সামনে রাখলেন আয়না। একসময় ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া লোক যিনি অরণ্যে ঘুরে ঘুরে দিনরাতের গল্প বলেছেন, তিনি এখন ঘরে বসে বাইরের সমাজের গল্প বলতে শুরু করলেন। এবার আর বিশ্লেষণ নয়, সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কোথায় আমরা আছি, কী ভাবছি আর কী ভাবা উচিৎ, কী করছি আর কী করা কর্তব্য। মনমোহন মিত্রকে মনে আছে? সেই-ই যেন শেষ তিনটে ছবিতে ঘোরাফেরা করছে। মনের মধ্যে জমা বিদ্রোহ যেন ক্রোধকম্পিত হয়ে উঠছে। তার প্রথম প্রকাশ ‘গণশত্রু’। হেনরিক ইবসেনের অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল-এর ছায়া অবলম্বনে তৈরি এই ছবি, প্রবল জনপ্রিয় তারকেশ্বরের শিবের মন্দিরে দূষিত পুকুরের জলকে চরণামৃত বানিয়ে অন্ধভক্তদের চিটিং করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ডাক্তারের সাথে বিবাদে জড়ালেন জনপ্রতিনিধি। কী করুণ অবস্থা এই ধর্মীয়সংস্কারে ডুবে যাওয়া লোকজন যাদের বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে আর তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে এই জনপ্রতিনিধিরা। এর পরের দুটো ছবি সত্যজিতেরই লেখা। সুবিধেবাদী, অসৎ মধ্যবিত্তের অর্থলোভের ভয়ঙ্কর ছবি ‘শাখা-প্রশাখা’ যেখানে শিশুও জেনে যাচ্ছে দু-নম্বরি কথাটা। অসদাচরণ অহঙ্কার এবং ধর্মের চেয়ে বড় উচ্চবিত্ত হওয়ার বাসনা, কথার চাবুকে নীতিহীন সমাজকে জর্জরিত করেছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান যখন মমতামাখানো আবেগে ‘বাবা’ বলে ডাকে সেখানেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় মানবিকবোধ। প্রশ্ন জাগে, তাহলে আসলে কারা মস্তিষ্কবিকৃত?

আগন্তুক

শেষ দুটো ছবিতে সত্যজিৎ মেঘনাদের মত মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করেছেন। এবার মনমোহন মিত্র সেজে সরাসরি নেমে এসেছেন মাঠে এক ‘আগন্তুক’। ‘অতিথি’ নামে নিজেরই এক গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ। সত্যজিৎ রায়ের চেহারা উৎপল দত্তের মেকআপে। ডান চিবুকের তিলটা শুধু গালে উঠে বসেছে। দুজনের জীবনও অনেকটা একরকম। উৎপলের অভিনয়ে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের দুকলি গান সত্যজিতের গলায়। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা, বিস্ময়বোধ, নানা জায়গা ও প্রাচীন সভ্যতার মত নানা অজানাকে জানার আগ্রহ মনমোহনের এসব তো আমরা সত্যজিতের জীবনেই দেখি। আড্ডার মধ্যেই গল্পচ্ছলে চিনিয়ে দেন মানুষের প্রতি প্রতিষ্ঠিত অবিশ্বাস মানুষের পরম শত্রু। আর এই অবিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখাই রাজনীতির মূলধন। স্যাটায়ারিক ভঙ্গিতে বলেন, দুর্নীতির আশ্রয় যে নেয় না, মুদ্রাদোষ যার নেই, সে কি এই গ্রহের জীব? মেকি সভ্যতার চেয়ে আদিম সভ্যতাই শ্রেয়- এটাই সত্যজিতের শেষ কথা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শিল্পের দ্বারা নানাভাবে বৈচিত্রময় গল্পের মধ্যে দিয়ে মানবিকবোধ প্রচারের এই ভঙ্গি মানুষের মন জয় করে।

আগন্তুক মনমোহন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় বাড়িছাড়া এবং পশ্চিম গোলার্ধ ভ্রমণের শেষে পূর্বে যাওয়ার আগে ভারতে এসেছেন। সেই অবসরে কলকাতায় ভাগ্নীর বাড়ি তাঁর আগমন। ভাগ্নীর দু বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন ফলে দুজনেই পরস্পরের কাছে দৃশ্যত অপরিচিত হলেও সম্পর্ক হারায়নি। ছোটমামা আসল না নকল এই ধাঁধায় ভাগ্নী ও তার স্বামীর কথোপকথন থেকে তাদের ছেলে বলে ওঠে “জাল দাদু”। এই ধন্ধ থেকে বেরোতে সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্যের মুনশিয়ানায় সমাজ ও সভ্যতার মেকি মুখোশ পরতে পরতে খুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ প্রদত্ত ভাষণে সভ্যতার যে সংকটের কথা উল্লেখ করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন আগামী প্রজন্মের ভয়াবহতা তার পঞ্চাশ বছর পর সত্যজিৎ সেখান থেকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেই সংকট নিম্নচাপ থেকে কিভাবে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। আজকের দিনে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতিকে যেভাবে কাজে মানবতা ধ্বংসে কাজে লাগানো হচ্ছে সেটা তিনি অসুস্থ অবস্থায় তাঁর শহর কলকাতায় বসে উপলব্ধি করে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। বিশ্বখ্যাত পরিচালক ফেডেরিক ফেলিনি, যাঁর শতবর্ষ সত্যজিতের সাথেই ইটালিতে পালিত হচ্ছে, তাঁর দেশের এবং সংলগ্ন ভূমধ্যসাগর পরিবেশের উপযুক্ত চিত্রনাট্যের ওপর সিনেমা বানিয়েছিলেন যদিও তখন দেশটা নাজিদের দখলে ছিল। কিন্তু সত্যজিৎ কলকাতায় বসে উপলব্ধি করেছিলেন পৃথিবীব্যাপী সমাজের অবক্ষয়, যুদ্ধ, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক তিক্ততা, শুধু রাষ্ট্র নয় মানুষের সম্পর্কে পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের আবহ এবং আক্রমণ। সেটাই ভয়ঙ্কর ভাবে উঠে এসেছে তাঁর আগন্তুক ছবিতে। আমরাও ছবি দেখতে দেখতে ভাবি আগামী ভবিষ্যতে মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সত্যজিতের এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আকিরা কুরোসাওয়ার শেষ দুট ছবির ভাবনার মধ্যে মিল দেখা যায়। দার্শনিকদের ভাবনায় এভাবেই মিল দেখা যায়। প্রশ্ন উঠে আসে ‘সভ্য কারা?’ ব্যতিক্রমী এই চিন্তাই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় নয়তো আমরা অনেকেই সামাজিক এই ধসের সাক্ষী কিন্তু শিল্পী তার মাধ্যমে সেটাকে ‘জুম’ করেন বলেই আমাদের চিন্তার জগতকে ধাক্কা দেয়।

সভ্য, সভ্যতা ও সিভিলাইজেশনের আধুনিক রূপ দেখে তিনি রীতিমত আতঙ্কিত। তবু জনমোহিনী বিশ্বায়নের প্রকৃত রূপ ও উদ্দেশ্য দেখার সুযোগ পান নি। মানুষের নিজস্ব চিন্তাশক্তিকে কীভাবে মগজধোলাই করে একটা রাজনৈতিক বিশ্বাসের বশে এনে অকেজো করে দেওয়া যায় তা বিগত শতকে ত্রিশের দশক থেকে রাজনীতির আবহাওয়ায় প্রকট ছিল। ঠিক অনেকটা প্রাচীনকালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মত। সে সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন যার প্রতিফলন তাঁর ছবিতে আছে। বর্তমানে ডিজিটাল সমাজ এবং তার আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিন সামগ্রীর মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারিত অর্ধসত্য ও মিথ্যা আপাত-সত্যের মোড়কে যেভাবে মগজধোলাই করা হচ্ছে সেটা সমাজের প্রায় সব শ্রেণিকেই আক্রান্ত করেছে। বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরীয় পরিচয়ের আড়ালে মানুষ তার নিজের পরিচয় হারাচ্ছে। এপিডেমিক আকারে সমাজের বড় ক্ষতি করে যাচ্ছে। আমরা হতবাক হয়ে দেখে যাচ্ছি এই পতনের কিন্তু আজ রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিতের মত শিল্পী নেই যে ‘জুম’ করে দেখাবে।

সভ্যতা কাকে বলে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে মনোমোহন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কিছু উদাহরণ দিয়েছেন যার প্রকাশ মানুষের শিকার-সংগ্রহের যুগ থেকে। আমি চলে যাব তারও আগের যুগে যখন মানুষ ছিল না, মানব গণের প্রাথমিক প্রজাতি ছিল পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। এই লেখা শুরু হয়েছে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন নিয়ে। সেই সূত্র ধরে বিজ্ঞানের আবিষ্কার সেদিন আলোর মুখ দেখল যেদিন সেই প্রজাতির মানব বুঝতে পারল শিকারের জন্যে মাটি বা বালির থেকে পাথর অনেক দূর অবধি ছোঁড়া যায় এবং নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে পাথর ছুঁড়ে আক্রমণকারীকে তাড়ানো যায়। ভর বা ওজনের তারতম্য বোঝাটাই বিজ্ঞান আর তার প্রয়োগ ছুঁড়ে মারা। এবার যখন আঘাতের মাত্রা তীব্র করার জন্যে সে পাথর ঘষে ছুঁচলো করলো শুরু হয়ে গেল প্রযুক্তির যুগ। যুথবদ্ধ থাকা সভ্যতার আজও শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আর আগুনের ব্যবহার সংস্কৃতির ভিত। সেইসব ‘অশিক্ষিত’ লোকেদের এইসব ‘মৌলিক’ আবিষ্কার আজকে আমাদের পৃথিবীকে যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে সেখানে বসে আমরা ক’জন তাদের কথা স্মরণ করি। জানিই না কারণ জানানো হয় না, সেটাই আধুনিক শিক্ষা। যা করেছে সব আজকের মানুষ বড়জোর দু-তিন হাজার বছরে অথবা দু-তিনশো বছরে বা আরও সংক্ষিপ্ত করে প্রচার হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সভ্যতার সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মনমোহনকে ‘জাল’ প্রমাণ করতে আসা এক দুঁদে উকিল। আমেরিকায় বসবাসকারী উপজাতিদের সভ্যতার উচ্ছসিত প্রশংসার মুখে ছাই দিয়ে তাদের ফ্রি-সেক্স বা মুক্ত যৌনতা নিয়ে কটাক্ষ করে উকিলবাবু বলেন সেটাও কি সভ্যতা? এই সময় থমকে যান মনমোহন; সম্ভবত সত্যজিতও, চিত্রনাট্য লেখার সময়। যে কারণে ভদ্রতাবশত এই সাধারণ প্রশ্ন করার আগে উকিলবাবু তার বন্ধুজায়ার ক্ষমা প্রার্থনা করেন ঠিক সেই কারণেই মনমোহনকে থমকে দেয় এবং পরে মাথা নেড়ে ঋণাত্মক জবাব দেন। এখানেই খটকা জাগে। সামাজিক সংস্কার মেনেই হয়তো এই চিত্রনাট্য কিন্তু সত্যজিৎ নিশ্চয়ই জানতেন প্রাণিজগতে বহুগামিতা স্বাভাবিক ধর্ম, উভয়লিঙ্গেরই। অস্বীকার করার উপায় নেই যবে থেকে যৌনাঙ্গ আড়ালের ব্যবস্থা হল তখন থেকেই যৌন অত্যাচারের শুরু। শরীরাচ্ছাদনের প্রয়োজন হয়েছিল হিমবাহের কঠিন ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে, পশুর চামড়া ব্যবহার করে। তখন কিন্তু মানুষের এবং তার ঠিক আগের প্রজাতি নিয়েনডারথালের জনসংখ্যা মাত্র কয়েকহাজার করে। পরে মানুষ যখন একা, আর তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রজাতি নেই তখন জনসংখ্যা কিছুটা বাড়ে, দশ-বারো হাজারের মত। আজও উপজাতিদের মধ্যে ঊর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত দেখা যায়, তথাকথিত ‘সভ্য’ জগতের যৌন অত্যাচার সেখানে নেই, যৌন সংযম তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। এরা নাকি ‘অসভ্য’! সভ্য জগতে যৌন অত্যাচার আজও হয়ে চলেছে; পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ অনাহারে থাকে, পানীয় জল পায় না, পরিচ্ছদ নেই শিশুদের, চিকিৎসাব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনো ধারনাই নেই। অন্যদিকে মানুষ মহাকাশচারী। এই কি সভ্যতা? এই মানুষকেই বলা হয় সভ্য?

প্রকৃতির মধ্যে মানুষ জন্মেছে। প্রকৃতি থেকেই মানুষের শিক্ষা। প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে চলার বদলে তাকে ধর্ষণ করে, অসম্মান করে, লুণ্ঠিত করে এগিয়ে যাওয়াকে বলা হয় সভ্যতা। এর বিরুদ্ধে শিল্পীরা তাদের নিজ নিজ মাধ্যমে আওয়াজ তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মাধ্যমে কঠোর আঘাত হেনেছেন আর সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে। মনমোহনের লিপে সত্যজিৎ তাঁর কণ্ঠে গেয়েছেন “অন্ধজনে দেহ আলো / মৃতজনে দেহ প্রাণ”; প্রশ্ন তুলেছেন, “কে দেবে এই প্রাণ?” এর উত্তর জানা নেই আজকের সবজান্তা পাবলিকের অথবা গুগল জ্যাঠার।

মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে পশ্চিম থেকে আগত ‘আগন্তুক’এর পূর্বাচলের পথে প্রস্থানের পরের বছরেই স্রষ্টা তেইশ এপ্রিল ১৯৯২ মহাপ্রস্থানের পথে পাড়ি দেন।

0 comments: