বিশেষ ক্রোড়পত্র - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in বিশেষ ক্রোড়পত্রআদ্যন্ত ফ্যান ফিকশন ও মূল স্রষ্টাকে প্রণাম জানাই -
প্রফেসর শঙ্কু ও ড্রিমোভিশন
উৎসর্গ: স্বয়ং ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু মহাশয় সমীপে,
(৬ই জুলাই, রাত ন'টা পাঁচ)
এযাবৎকালে আজ পর্যন্ত যে সব আবিষ্কার আমাকে ভারতীয় আবিষ্কারক হিসাবে সারা পৃথিবীতে আগামী একশো বছরের বেশী সময় ধরে মানুষের মনে বিস্ময়ের সাথে একটা স্থান দিয়ে রাখবে বলে আমি মনে করি তার একটা নামের তালিকা নিয়ে বহুবার পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞান সম্মেলনে গত তিরিশ বছর ধরে নানা প্রদর্শনীতে ডিসপ্লে ও সেসব নিয়ে এত আলোচিত হয়েছে যে প্রচারবিমুখ হওয়াসত্ত্বেও আমি যে এই কৃতিত্বের জন্য যে আজীবন সম্মানিত ও তারজন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকব সেটা এখন শেষবয়সে এসে আমি নিজেও বেশ বুঝতে পারছি।
তবে আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত খ্যাতি বা আত্মপ্রচারের বাইরেও যে জিনিষটি নিয়ে গত পনেরদিনে আমার গিরিডির ল্যাবে বসে কাজ করতে করতে বুঝতে পেরেছি যে আক্ষরিকভাবে ওতে সফল হয়েও যে আমি শেষমেশ এই আবিষ্কারটিকে আমার মনে বা খাতায় কোথাও রাখতে চাইনি বলে বিশেষ মানসিক শান্তি পেয়েছি সেটাও ঠিক। তবে এটার আবিষ্কারের কিছুটা সম্মান আমার বন্ধু হ্যারির প্রাপ্য বলে এর সবটা না বললেও বিজ্ঞানের স্বার্থে কিছুটা আজ একটু বলে যেতে চাইছি, তার একটাই কারণ তা হল ভবিষ্যৎে এই জাতীয় কাজে সাফল্যের সম্ভাবনা আসলেও যাতে আগামীদিনের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই আবিষ্কার ও তার ফলাফলের ব্যাপারে সংযত হতে পারে।
...
(৭ই জুলাই, সকাল ন'টা পঁচিশ )
আজ ডায়েরী লিখতে বসে আমার মনে হল যে ইতিপূর্বে আমার আবিষ্কৃত সেরিব্রিলান্ট ও নার্ভিগার যা নার্ভ চাঙ্গা রাখার দুটি মোক্ষম ওষুধ হিসেবে সমাদৃত ও আর একটি নতুন অডিও - ভিস্যুয়াল যন্ত্র যার নাম হল "এভিলিউটন " যা আজকের মানুষকে আগামীদিনের ক্রমবিবর্তনের রাস্তায় চলবার ক্ষেত্রে একটা পথনির্দেশ করতে সাহায্য করলেও এগুলো কখনোই ঠিকমত কোন কারখানায় বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বানানো যাবেনা বলেই তাই এগুলোর ভরসাতেই বিবর্তনের আগামী পৃথিবীর চেহারা সংক্রান্ত এক যন্ত্রের পূর্বাভাস নিয়ে আজ আবার একটা নতুন কাজে নামতে চলেছি ।
....
আমার বন্ধু সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনের জীব রাসায়নিক হ্যারি কেপমার্সন মাসছয়েক আগে একবার একটি চিঠিতে এই নবতর আবিষ্কারটির সম্ভাবনার কথা জানিয়ে আমাকে একটা লম্বা চিঠি লিখেছিল। তার সাথে ওর অনুরোধ যে এই কাজটা নিয়ে এরপর থেকে আমাকেই ভাবতে ও শেষমেশ কাজে সফল হতে একান্ত অনুরোধ জানিয়েছে। এর একটাই কারণ যে এখন হ্যারি তার ব্লাড ক্যানসারের ফাইনাল স্টেজে পৌঁছে গেছে। তাই যেহেতু তাকে কেউ আর বেশীদিন এই পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারবেনা আর সেটা জানতে পেরেই ও এখন ওর জীবনের শেষের কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবেই থাকবে তাই একজন যোগ্য লোকের হাতে ওর অসমাপ্ত কাজটির ভার দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়।
....
সেজন্যই ওর হয়ে আমাকে ওর অসমাপ্ত চিন্তাগুলির নোটস্ গুলো সব পাঠিয়ে এই কাজটা নিয়ে ভাবতে হ্যারি এই অদ্ভূত অনুরোধটি জানিয়েছে। আর এজন্যই হ্যারি'র পাঠানো এই বিশাল চিঠিটি ও তার সাথে সব জরুরী নোটস্ গুলো আজ সকালের ডাকে এখানে এসেছে।
....
এবার ওগুলো হাতে পেয়ে এক আগ্রহী ছাত্রের কৌতূহলে সবটা নেড়েচেড়ে দেখে ও বিশদে পড়বার পর আমারও যে বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ জন্মাল সেটা আর নাও বললে হবে।
এই যৌথ আবিষ্কারটি আদৌ ঠিক কি বস্তু ফাইন্যালি হবে সেটা না জেনেও আমি ঠিক করলাম যে আমার এই মরন্মুখ বিজ্ঞানী বন্ধুটির অনুরোধে এই " সিউডো- ভিশনারি এটিটিউড " যন্ত্র বা ড্রাগ সংক্রান্ত যা হোক অর্ধসমাপ্ত আবিষ্কারটির কাজে আমিও এবারে সোৎসাহে নেমে পড়ব।
....
যদিও কালকের "হেডিংটন ডেইলি" কাগজটির ভারতীয় সংস্করণে ছাপে আসা কাগজটির পাঁচের পাতার গোড়ায় এই বিশ্বখ্যাত জীব রাসায়নিক হ্যারি'র মৃত্যুসংবাদটিও পড়ার পর আমার মনটা আরো বিষণ্ণ হয়ে আছে। তাও ঠিক করেছি যে আমার বন্ধুর শেষ অনুরোধটি রাখার প্রাণপণ চেষ্টা আমি করব।
.............
(১৩ই জুলাই, সকাল দশটা বেজে দশ)
গত সাত দিনে একটা আশ্চর্য জিনিষ লক্ষ্য করেছি। আমার বেড়াল নিউটন যে বার্ধক্যজনিত কারণে আজকাল সারাদিনের বেশীটাই ঝিম্ মেরে বসে থাকে তাকে দেখলাম ভোরবেলা ওর নির্দিষ্ট দুধটা চেটে খেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার আগের মত সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে চেষ্টা করছে।
তাই এটা দেখে ভাবলাম যে আমাদের মতো একটা বেড়ালের আয়ূষ্কালেও কি তাহলে অন্তত আর একবারের জন্য অনন্তকালের জীবনীশক্তিলাভের একটা সুপ্ত বাসনা থেকে যায় কি?
তবে এখানে একটাই খটকা।যদিও আমার আগে তৈরী এক্স এবং অ্যান্টি এক্স ওষুধদুটো যেটা দিয়ে সুস্থ মানুষকে কয়েক মিনিটের মধ্যে হিংস্র দানবে পরিণত করা যায় ও অ্যান্টি এক্স দিয়ে ফের তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজটায় সফল হলেও এখন হ্যারি'র কথা অনুযায়ী এই নতুন "ড্রিমোভিশন " বা " স্বপ্নদর্শী " বস্তুটি যদি আমি ঠিক বানিয়েও ফেলি তাও কি ওটা পারবে আমাদের স্বপ্নকে একেবারে বাস্তবে পরিণত করতে? বা তার অদম্য ইচ্ছাটির ব্যর্থতার পরেও তাকে আমাদের আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে?
..........
(২৪শে জুলাই, বিকেল পাঁচটা সতের)
আমার কাজটা আজ অনেকটা এগিয়ে এনেছি। এখনো অবধি একটা টিউবে করে খানিকটা ব্রাহ্মী শাকের রস নিয়ে আর তাতে একটু কর্পূর আর মধু'র সহযোগে একটা মিশ্রণ তৈরী করে তারপর সেটা আমার তৈরী রিমাইন্ডার পিলের সাথে হ্যারি ও আমার যৌথ পরিকল্পনায় তৈরী "ড্রিমোভিশন " ট্যাবলেটটিকেও গুঁড়ো করে মিশিয়ে এক মগ কফির সাথে পান করেছি।
এখানে বলে রাখি ওটা একটা খাওয়ার বা ইঞ্জেক্ট করার মত উপযোগী ওষুধ হিসেবেই আমি বানিয়েছি। এছাড়া মানব শরীরে ওষুধটি প্রয়োগ করার পর তারপর আমার এই পর্যায়ে যে নতুন সংযোজনটি এরসাথে করেছি সেটা হল একধরণের বিশেষ শয্যাযান বা "স্লিপকার্ট "।
....
সেখানে নিজে শুয়ে একঘন্টা ধরে পরীক্ষা করে দেখেছি যে আগে থেকে ভেবে নেওয়া কোন স্বপ্নদৃশ্যের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে ওতে চড়ে ঘুমাতে গেলেও একটা সিনেমার মত সেগুলোকে দেখছি, অথচ অন্য আর সবকিছু যেমন আমার চিন্তাশক্তি বা কর্মক্ষমতার কোন বিকৃতি ঘটছে না।
যদিও আমার দেহটা এই স্লিপকার্টে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকছে তাও একটা এনার্জি রে যন্ত্রটি থেকে বেরিয়ে এসে আমার ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে একটা বাস্তবমুখী স্বপ্নের দৃশ্যকে দেখাচ্ছে যেটা আমিই শুতে যাবার সময় মনে মনে চেয়েছিলাম। এমনকি দেড়-দু ঘন্টা ধরে ঘুমের পরেও সেটা মনে থেকে যাচ্ছে। আর এটাই হল হ্যারির ফরমূলায় তৈরী ওষুধটি আর আমার এই স্বপ্নযান যন্ত্রের কারসাজিটিতেই।
.....
এখন দেখতে হবে যে জেগে উঠে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার পর ওই স্বপ্নের দৃশ্যটিকে অনুসরণ করলে আমার ওই স্বপ্নে দেখা ইচ্ছেটা আদৌ সত্যিই বাস্তবে আক্ষরিকভাবে ফলবান হচ্ছে কি না ?
.............
আমার বেড়াল নিউটনকে এই "ড্রিমোভিশন" ক্যাপসুলটিকে একটু পাউডারে পরিণত করে আমার মতই আর প্রয়োজনীয় সব উপাদানের সাথে একবাটি দুধের সাথে খাইয়ে দিলাম। এরপর ও ঘুমিয়ে পড়লে ওকে আলতো করে " স্লিপকার্টে" পনের-কুড়ি মিনিট শুইয়ে রাখলাম।
এটা করতে গিয়ে অবিশ্যি ভাবছিলাম যে বেড়ালেরও কি মানুষের মত মস্তিষ্কের ভিতরে কোনও সুপ্ত আকাঙ্খা রাখে? আর সেটা যদি থেকেও থাকে সেটা অবিশ্যি নিউটনের জেগে ওঠার পর ও আচরণেই বোঝা যাবে।
............
(২৫এ জুলাই, সকাল এগারোটা বেজে পাঁচ)
আজ একটা অদ্ভূত ব্যাপার ঘটল। এইরকম একটা কিছু যে হতে চলেছে সেটা আন্দাজ করতে পারলেও যে তার অগ্রগতির প্রভাবটিকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে একটু হলেও হিমশিম খাব তখন সেটা বুঝিনি।
তবে সেটা হল বলেই আর একবার নিজেই নিজেকে আবার ধন্যবাদ জানাতে খুব ইচ্ছে করছে। এটা না হলেই বরং নিজেকে বড্ড বেশী অপরাধী লাগত।
....
দেখলাম ঘুম ভেঙে ওঠার পর নিউটনকে মেঝেতে কিছুটা ঝিম্ মেরে পরে থাকতে দেখলাম।
তখন আমার একটু সন্দেহ হতেই তখন একটু ওকে কোলে তুলে নিয়ে ওর লোমশ গায়ে হাত বোলাতে গেলাম। এমনিতে নিউটন এই ধরণের প্রশ্রয়ে অন্যদিনে বেশ আহ্লাদে গলে যায় আর সেটাই হল ওর এতদিনকার অভ্যেস। কিন্তু এবারে দেখলাম ওর গায়ের রোঁয়া ফুলে উঠেছে আর চোখটায় একটা বিশ্রী রকমের জ্বলজ্বলে চাহনি।
এরপরে যেটা ও করে বসলো সেটাও গত দশবছরে একদিনের জন্যেও কখনো করেনি।
এমনিতে আমার ঘরে জানলা খোলা থাকে বলে দু একটা কাক, চড়ুই, শালিখ এসব বাইরে থেকে ঢুকে খানিকক্ষণ ওড়াউড়ি করে আবার পরে চলেও যায়। নিউটনকে এসবে কোনও দিন চাঞ্চল্য প্রকাশ করতে দেখিনি। এমনকি কর্ভাস নামের যে কাকটি আমায় পক্ষীবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজে অনেক হেল্প করেছে তাকেও দেখেছি নিউটনের অলস বিশ্রামের সময় বা পাওয়ার ন্যাপের টাইমে সে ওর পিঠে বেশ ভারিক্কী চালে বসে নিজে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে।
.......
এহেন নিউটন'কে দেখলাম যে তড়াক করে আমার কোল থেকে লাফিয়ে নেমে গিয়েই ঘরের মধ্যে উড়ে আসা একটা চড়াইকে ওর এক থাবায় নিকেশ করে তারপর সে পাখিটার টুঁটি চেপে ধরে যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দৃষ্টি আমার চেনা নয়। একটা জান্তব জিঘাংসা আর ক্ষুধিতদৃষ্টির সাথে যেটা আজ নিউটনের আচরণে ফুটে উঠছিল ওর থেকে আদৌ কাঙ্খিত নয়।
তাই বাধ্য হয়ে ওকে " অ্যান্টি এক্স " ইঞ্জেকশান দিতে হল আর তারপরেই ও জবুথবু হয়ে কিছুক্ষণ ঘোলাটে মুখে আমার দিকে চেয়ে রইল।
........
নিউটনের জন্য আমার নিজের একটু কষ্ট হলেও বুঝলাম যে এমন কিছু প্রবৃত্তিগত পরিবর্তনেই আসলে "ড্রিমোভিশন" ড্রাগ ওকে চালিত করেছে। তাই এটা হয়েছে খুব স্বাভাবিকভাবেই।
.....
পরক্ষণেই ল্যাবে ফিরে আমি ভাবতে বসলাম যে এটা আর একবার নিজের ওপর দুপুরে পরীক্ষা করে দেখতেই হচ্ছে। কারণ এর আগে তো আমি আমার কোন আচরণ পরিবর্তন তো সরাসরি বুঝতে পারিনি বা চোখের সামনে ঘটতে দেখিনি।
.......
(২৬এ জুলাই, বিকেল পাঁচটা )
আমার গত একটা দিন পুরোটা যেভাবে কাটল তার ফলেই ডায়েরী লেখা বন্ধ করে আমিও সেই পরীক্ষার পরে খানিক থম্ মেরে বসেছিলাম। এমনকি আজ প্রহ্লাদকেও রাতের খাবার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি।
এখন খালি ভাবছি আগামী দিনে এই যদি আধুনিক বিজ্ঞানের পরিণতি হয় তাহলে এখনি আমায় সবরকম গবেষণা করা ছেড়ে গিরিডিতে আমার বাগান পরিচর্যা করাই বোধহয় ঠিক কাজ হবে।
......
তাহলে এবার ঘটনাটার গোড়া থেকে বলছি। কাল "ড্রিমোভিশন " সহ কফি খেতেই বেশ ঘুম পেল। তারপর " স্লিপকার্টে" উঠে আমি দিব্যি ঘুমোতে গেলাম। তবে এসবের আগে আগামী একশো বছর পর পৃথিবীর চেহারাটা কেমন হবে সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল।
তারপর কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। হঠাৎ দেখি এক আজব দুনিয়ায় এসে পড়েছি। এটা পৃথিবীর কোনও একটা শহর হয়ত হবে তাও বুঝলাম এ শহর আমার অজানা বা অদেখা । সেখানে দেখলাম সবাই এখন খুব ব্যস্ত। স্রেফ হুসহুস শব্দ করে অত্যাধুনিক ধোঁয়াবিহীন গাড়ি ছুটে চলেছে আর রাস্তার দুপাশে অজস্র বর্ণময় মনোহারী জিনিসের দোকানপত্র, আর সময়টা হল দুপুর আর সন্ধের মাঝামাঝি।
......
তবে দেখলাম এখানকার নারী-শিশু-পুরুষ-বৃদ্ধ সব আমার দেখা সময়েরই মত সবাই রক্তমাংসের। অর্থাৎ স্বপ্নে যা দেখছি তা কিন্তু কোন রোবোটিক্সেরর এ্যানিম্যাটিক খেয়াল বা যন্ত্রের অবয়ব নয়।
তবে এও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এদের সময়টা খুব দ্রুত বদলিয়ে গেছে আর সবাই যেন নিজের কাজে ভীষণ ভীষণ ব্যস্ত!
....
এবারে একটু পরে দেখলাম একটা হাড় জিরেজিরে মহিলা শতচ্ছিন্ন পোশাকে কোত্থেকে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাবলাম এরকম মানুষ কি ততোদিনেও থাকবে?
এখন দেখলাম ওই মেয়েটার কোলে আবার ততোধিক কঙ্কালসার একটা শিশু। বোঝাই যাচ্ছে যে ওটা মেয়েটির সন্তান।
আমি দেখে বেশ বুঝতেই পারছি যে ওদের দুজনেরই ক'দিন ধরে পেটে খাদ্যদ্রব্য কিছুই হয়তো আর জোটেনি। এই অবস্থায় ওদের দেখে আমার খুব মায়া হল। তক্ষুণি কোটের পকেট থাবড়িয়ে যেই কিছু পয়সা বের করে ওদের দিতে যাব এমন সময় শুনতে পেলাম সামনের রাস্তায় একদল সেনা আর পুলিশ মিলে এসে খুব গোলমাল করছে আর লাঠি উঁচিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলছে।
......
এসবের কারণ হল এই যে এটা নাকি এখন একটা স্মার্টসিটি তাই সেনাবাহিনীর পোষাক পড়া ওই লোকগুলো তাই বলছিল আর মাইকিং করছিল! এবারে ওদের কথা শুনে বুঝলাম যে এখানে এখন আর এই বিশ্রী পোশাকের আদবকায়দাহীন ও জঞ্জালসদৃশ ক্ষুধিত মানুষগুলোর নাকি থাকবার কোন অধিকার নেই। একটু পরে এখানের উৎসবের কোন একজন নামী ভি.আই.পি. নাকি এই পথ দিয়ে কনভয় নিয়ে যাবেন আর তাঁর সাথে থাকবেন একজন মানী অতিথি আর তিনিও নাকি অন্য কোন দেশের শিল্পমন্ত্রী।
এখানে যে বিশেষ একটি শিল্পোন্নতির প্রজেক্ট পাশ হবে এই দুটি দেশের যৌথ আগ্রহে, তাই অবাঞ্ছিত সবাইকেই এখন রাস্তা থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
.....
আমাকেও তখন কে যেন ধাক্কা মেরে একটা ঘুপচি ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। যদিও এমনিতেই এসব ঝামেলা টামেলা আমার কোনওদিনই আদৌ পছন্দ নয়। তাই বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয়ের মতন ঘরটিতে রাখা জলের বেসিনের দিকে এগিয়ে কার্যতঃ গেলাম। মনে হচ্ছিল এখন চোখে মুখে এখন জলের ঝাপটা দিলে বোধহয় একটু ঠিক লাগলেও লাগতে পারে।
....
(২৭শে জুলাই, বেলা তিনটে পনের)
চোখে জলের ঝাপটা দিতেই দেখলাম আমার সামনের তিনটে জানলায় তিনটে তিনরকমের দৃশ্য। ফুটে উঠেছে আর একটু আগের রাস্তাঘাট সব উধাও। এখন দেখলাম সামনে ধূ ধূ করছে একটা মরুভূমি যেখানে ইতস্ততঃ পড়ে আছে জীবজন্তু এমনকি মানুষেরও অজস্র কঙ্কাল। জায়গাটা আর একটু ভাল করে দেখতে গিয়ে দেখলাম আমার সামনে একটাও সবুজ পাতা বা কোন গাছ বা ফুল, পাখি কিছুই নেই। রাতারাতি ম্যাজিক করে কেউ যেন একটা মৃতের নগরীকে এনে আমার চোখের সামনে তুলে ধরেছে।
....
এইবার একটু এগিয়ে আমি দ্বিতীয় জানলাটার সামনে এসে দেখি এখন মরুভূমি ছেড়ে সবটা আবার সমুদ্রের জলে থইথই করছে। আর এদিক ওদিক ভাসছে বরফের চাঙর। দেখে একবার মনে হল এসব গ্লোবাল ওয়ার্মিং নাকি!তারপর দেখলাম ওই নীল ফেনাওয়ালা একটা আলগা ঢেউ কোত্থেকে এসে জানি অজস্র পেঙ্গুইন আর ওয়্যালরাসের মৃতদেহ এনে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কি আশ্চর্য!
এ দৃশ্যতেও সব কেমন যেন আগের ওই মরুভূমির দৃশ্যটির মত নির্বাক ও প্রাণহীন।
.....
এইবার তিন নম্বর জানলায় যে দৃশ্যটা দেখলাম আর সেটা দেখে মনে হচ্ছে যে সেটা যেন না দেখলেই বোধহয় ভাল হত। দেখলাম যে কতগুলো রোবটের হাবভাবের অল্পবয়সী ছেলে মেয়ের দল সব বসে বসে কি একটা ঢাউস স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কি সব অপারেট করছে আর যন্ত্রমানবের মত ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তা দেখে নিজেদের মধ্যে কেবল আলোচনা করছে। তবে এদের সবটাই যেন যন্ত্রের মত। ওদের কথাবার্তায় কোন আবেগের বহিঃপ্রকাশ কারও মধ্যে নেই।
...
এবারে বুঝলাম যে তাই ওদের এই অতি আধুনিক সভ্যতায় এখন সৃষ্টির প্রকাশ হিসেবে ফুল, পাখি অথবা এক কলি গান বা চারুশিল্প এমনকি নিছক স্পোর্টসেরও আজ আর কোন স্থান নেই।
এরা এখন সব যন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে এদের জীবনে বংশবৃদ্ধি ছাড়া আজ আর কোন বিনোদন বা অন্য কাজের আর স্থান নেই।
এটাই বোধহয় আগামীকালের পৃথিবী!
তবে প্রশ্ন হল এরকম হলে সেটারই বা আয়ূ আর কতদিন?
তারপর কি ওই মরুভূমি বা সমুদ্রে ভাসমান মৃতদেহগুলিই কি নিষ্প্রাণ পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চলেছে? এগুলো তারই সূচক কি?
............
(২৯শে জুলাই, সকাল এগারোটা)
আর পারছি না। অনেকক্ষণ এসব দৃশ্য দেখে মাথা ঝিমঝিম করতে বাধ্য হলাম আমার " অ্যান্টি এক্স " মুখে দিয়ে নিউটনের মত এই " ড্রিমোভিশন"এর কবল থেকে একেবারে নিস্তার পেতে।
......
(৩০ শে জুলাই, সকাল নটা)
আমাদের দুই বিজ্ঞানীর দেখা যৌথ আবিষ্কারের এই স্বপ্নদৃশ্য যে এরকম একটা নিষ্প্রাণ দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে সেটা আর ভাবতে পারছিলাম না।
আচ্ছা! হ্যারিও কি বুঝতে পারেনি যে আগামীকালের পৃথিবী কি সত্যিই এতটাই ভয়াবহ ও নিষ্প্রাণ হতে চলেছে?
.....
এ্যান্টি এক্স ইঞ্জেকশানের পর দেখছি কিছুটা সুস্থ বোধ করছে বলেই হয়ত ঠিক আগের মত আদুরে ভঙ্গিতে নিউটন এক লাফে আমার কোলে এসে মাথা ঘষতে ঘষতে বলল "মিঁয়াও"!
একটু হেসে ওকে আদর করতে করতে দেখলাম যে এমনকি প্রহ্লাদের মুখেও একটা আগেকার আনন্দের নির্মল হাসি যা কেবল আমাদের এখনকার পৃথিবীতেই এখনো দেখা যায় ও আশাকরি তা আগামীদিনেও যাবে।
এবারে দেখলাম ওর চোখে টলটল করছে জল আর সেটা সে ধুতির খুঁট দিয়ে মুছছে। এসবে কারণটা এতক্ষণে বুঝলাম যে আমার "স্লিপকার্টে" শুয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাই দেখে ও এতক্ষণ আমাকে মৃত ভেবেছিল ও তাইজন্য দুশ্চিন্তা করছিল।
...
অবশেষে ঠিক করলাম আমাদের এই নতুন আবিষ্কার "ড্রিমোভিশন"টির জন্য আর কখনোই কোন সময় ও এনার্জি কোনওটাই আর ব্যয় করবনা। আশা করব বিদেহী হ্যারিও আমার সাথে একমত হবে। আসলে এই অদ্ভূত যন্ত্র যা এমন কোনও সম্ভাবনার পরিণতি বা আশংকা দেখাক যা আমরা আর কখনোই দেখতে বা ভাবতে চাইব না।
সব ভালোমন্দ'য় মিশে থাকা এই বিচিত্র পৃথিবী নামক গ্রহটি সৌরজগতে সবার চেয়ে একেবারে আলাদা হয়েই বেঁচে থাকুক।
সবাই জানুক এখনো এখানে ফুল,পাখি, চাঁদ এসব নিয়ে প্রাণ টিকে আছে আর তার সাথে টিকে আছে মানুষে মানুষে সংযোগ ও অকৃত্রিম ভালবাসা।
এসবের সত্যি আজ বেশী বড় প্রয়োজন। তাই
এটাই এখন নতুন করে আগামী প্রজন্মকে বুঝতে হবে যে এগুলোর কোনটাই বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরিপন্থী নয় , আর সেটা কখনো হতেও পারবেনা।
সভ্যতার প্রয়োজনে সবাইকেই হাতে হাত মিলিয়ে থাকতে হবে সেটা যেমন ঠিক, তেমন আবার সবাইকে নিয়ে একসাথে চলতেও হবে।
.....
এই প্রথম কোন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রথমে আমি তাতে সাফল্য ও সবশেষে তার সম্পূর্ণরূপে বিস্মরণটিতেও যে অনেক বেশী আনন্দ ও স্বস্তি পেয়েছি সেটা অন্তত আজ স্বীকার করে যাওয়া উচিত বলে আমার ডায়রিতে এটুকুই আজ স্রেফ লিখে রাখলাম।
0 comments: