0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















২০

স্মৃতির শহর – ৬ : তুরিন

২০১৩ সালের গোড়ার কথা। লিঙ্কড ইন এর সূত্রে আকস্মিকভাবে আলাপ হয়ে গেল এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে। তার নাম ওরাৎসিও ডি রাইমোন্ডো। অসংখ্যবার ইউরোপ যাতায়াত করলেও ‘বুট’ আকৃতির এই দেশটিতে যাওয়া হয়নি কখনো। অথচ বিশ্বের হেঁশেল সংস্কৃতির ইতিহাসে ইতালীয় ঐতিহ্যের গুরুত্ব বিশাল। একদিন সকালে মেইল ঘাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল একজন চিজ রাখার জন্য একটা বিশেষ আকৃতির বাক্স খুঁজছেন। দেখামাত্র আমার ভিতরের প্যাকেজিং অনুসন্ধিৎসু মনটা নেচে উঠল। যোগাযোগ হল এবং তা ক্রমশই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে লাগলো। সেই চিজ বক্স কখনো তৈরি হলনা বটে কিন্ত সূত্রপাত ঘটল নতুন এক বন্ধুত্বের, অন্যতর এক দিগন্ত খুলে গেল সম্পর্কের যখন আমরা দুজনেই আবিষ্কার করলাম রান্নবান্না আমাদের অস্তিত্বের সংবেদনশীল একটি অংশ। আরেকটা বাড়তি বিষয় জানা গেল, তা হচ্ছে, ইতালি জুড়ে ওরাৎসিওর প্যাকেজিং ক্লায়েন্টদের মধ্যে প্রায় সবাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রির। এ এক কথায় সোনায় সোহাগা! আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের দুজনেরই মনে হল ইতালির বিপুল খাদ্যসম্ভারের কিছু কি সরাসরি ভারতে আনা যায়? এমন নয় যে সেসময় এদেশে ইতালীয় রান্নাবান্না নিয়ে খাদ্যরসিকদের মধ্যে উৎসাহ কিছু কম ছিল! আমাদের মনে হয়েছিল পাস্তা এবং পিৎজার বাইরে সে হেঁশেলের যা বিস্তার, তার অনেকটাই ছিল অধরা আর অনেক কিছুই ইতালিয়ান বলে চালানো হলেও সেগুলি কি সত্যিই ইতালিয়ান? এই চিন্তা-ভাবনা থেকে জন্ম নিল ‘ইতালিয়ান ফুড অ্যান্ড ড্রিঙ্কস’। কিন্তু কী করবে এই ‘ইতালিয়ান ফুড অ্যান্ড ড্রিঙ্কস’? ঠিক হল প্রাথমিকভাবে আমরা দুদেশের বাজারটা একটু ঘুরে দেখব। দেখব মানুষ কী চায়? দেখব ইতালিয়ান খাদ্য সংস্কৃতি সত্যিই আসলে কী? আর শেষমেশ দুদেশের মধ্যে আমরা রচনা করব একটি ছোট্ট সেতু, যা খাঁটি ইতালীয় খাদ্য উপকরণ পৌঁছে দেবে এদেশে।

এই সময়টা থেকে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েক বছর। দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসেছে আমাদের বন্ধু এরিকা বারবিয়ানি। সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এরিকা ভালোবাসতো রান্না করতে। রেস্তোরাঁয় কাজও করেছিল বেশ কিছুদিন। যেদিনের কথা বলছি, কলকাতায় তখন ঘোর বর্ষা। তারই মধ্যে এরিকা হাজির আমাদের বাড়িতে। নৈশাহার নিয়ে কথা উঠতেই এরিকা বলল ও রান্না করবে। জিগ্যেস করল, ‘বাজারে যাবে?’ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা হাজির হলাম গড়িয়াহাট বাজারে। প্রথমে মাছ। এরিকার পছন্দ হল পাবদা আর ভাঙন! তারপর একরকম আমাদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেই পৌঁছে গেল শাক-সবজির বাজারে। বেছে নিল টাটকা পালং শাক, বেসিল, পার্সলি আর থাইম। তখনও জানিনা ওর মাথায় কী ঘুরছে। বাড়ি আসার পর বলল, ‘চল, আজ আমরা রাভিওলি খাই’। এর আগেও রাভিওলি খেয়েছি বটে, বার্লিনে, বারবারার বাড়িতে। আর ওদেশে তো সুপার মার্কেটে এসব সহজেই কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এরিকা সেদিন বলল, ‘আজ আমরা বাড়িতেই রাভিওলি তৈরি করব। সেইমতো শুরু হয়ে গেল কাজ। প্রথমে ময়দা মাখা এবং বেলার কাজ তারপর চৌকো আকারে সেগুলো কেটে নিয়ে তাতে পুর ভরার পর্ব। শেষে ফুটন্ত, ঈষৎ লবণাক্ত জলে সেগুলো ফেলে দিতে হবে। ভেসে উঠলেই বুঝতে হবে রাভিওলি তৈরি। সাধারণত রিকোত্তা চিজ, মাংসের কিমা বা শাক জাতীয় উপকরণ রাভিওলির পুর হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সেদিন পালং শাক ছিল কিন্তু ছিলনা রিকোত্তা চিজ। এরিকা সেই সন্ধ্যায় বিকল্প পুর হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল ভাঙন মাছের ফিলে! আর সস তৈরির সময় ভার্জিন অলিভ অয়েলের বদলে সরষের তেল। ফলাফল হয়েছিল অভাবনীয়। রান্নাবান্নার বিষয়টি এমন এক সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া, যেখানে কল্পনাশক্তির প্রয়োগে প্রস্তুতিপর্বে নিজস্ব কিছু সংযোজন পদটির এক আলাদা উত্তরণ ঘটাতে পারে। ঐতিহ্যকে তখন বাধ্য হয়ে জায়গা করে দিতে হয় নতুন এই অবতারটিকে। এরিকার সৌজন্যে বর্ষণসিক্ত সেই রাতে এই উপলব্ধি মনের ওপর এক জোরালো অভিঘাত তৈরি করেছিল। আরেকটি বিষয়, যা আমি এর আগেও একাধিকবার লিখেছি, পরেও লিখব আমি জানি। রান্নার বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এক মানুষ, যার এক্ষেত্রে প্রথাগত কোনও শিক্ষা নেই, শুধু তীব্র আবেগ আর ভালোবাসা সম্বল করে এক হেঁশেল থেকে আরেক হেঁশেলে ঘুরে বেরিয়ে বারবার একটি কথাই মনে হয়েছে। খাদ্যসংস্কৃতি আমাদের সামগ্রিক যাপনের এক অচ্ছেদ্য অংশ, যার মূল ভিত্তি সারল্য, সারল্য এবং সারল্য।

ইতালিয়ান খাবারের কথা উঠলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাস্তা আর পিৎজা। কিন্তু এই ছবিটি চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর। কারণ এ দুটিই দুই বৃহৎ পরিবারের নাম। এর শত-সহস্র শাখা, উপশাখা আছে। ইতালির আলাদা আলাদা অঞ্চল, গ্রাম, প্রদেশে আলাদা হয়ে যেতে পারে এদের ধরন-ধারণ। একই সস অথচ আলাদা আকৃতি বা ধরনের পাস্তা কিংবা একই পাস্তার সঙ্গে বিভিন্ন ঘরানার সস, এর ফলাফল যে কত রকমারি ও অনন্য হতে পারে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই একমাত্র তা বলে দিতে পারে। সেদিনের সেই হঠাৎ এবং পরিকল্পনাহীন আহারের প্রস্তুতি ও উপস্থাপনার পিছনে ছিল এরিকার তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনীশক্তি। যেকোনো সার্থক শিল্পের ক্ষেত্রে যা এক অবশ্য-প্রয়োজনীয় উপাদান। পেস্ত সসের একটি প্রধান উপকরণ পারমেজান চিজ সেদিন আমাদের বাড়িতে ছিল না কিন্ত সেই অভাব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল দেশজ উপকরণের ব্যবহারে। পারমেজান চিজ ছাড়াই পেস্ত সস তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সেদিন এরিকা।

আবার সেই ধান ভানতে শিবের গীত। শুরু করেছিলাম ওরাৎসিওকে দিয়ে। ন’বছর আগে ঐ দেশটিতে প্রথম পদার্পণের আগে আকস্মিকভাবে আমাদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব। আর এই বন্ধুত্ব না ঘটলে হয়ত কোনোদিনই আবিষ্কার করতে পারতাম না ইতালীয় খাদ্য ও পানীয় সংস্কৃতিকে ঘিরে আমার অবদমিত ব্যাক্তিগত আবেগের কথা। এ যেন খানিকটা শ্যাম্পেনের বোতল খোলার মতো ব্যাপার। কর্কটি না খোলা পর্যন্ত আন্দাজ পাওয়া যায় না পরের মুহূর্তটি কেমন হতে চলেছে। সে বছর আমার ইতালি যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল নতুন প্যাকেজিং ব্যবসার সন্ধান। রোম, মিলান হয়ে তুরিন যখন পৌঁছলাম তখনও বুঝতে পারিনি মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সেই সুপ্ত প্রবণতার কথা। সময়টা অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ। উত্তর ইতালির এই শহরটি আল্পস পর্বতমালার কাছাকাছি হওয়ায় জন্য সেখানে শৈত্যপ্রবাহ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের ট্রেনটা তুরিন স্টেশনে পৌঁছল যখন, বাইরে দেখলাম একটা রোদ ঝলমলে দিন। প্ল্যাটফর্মে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে হাওয়ার ঝাপটা মুখের ওপর আছড়ে পড়ল এবং জ্যাকেটের ফাঁক দিয়ে ঢুকে কাঁপিয়ে দিল অন্তস্থল, তার উৎপত্তিস্থল কোথায়, তা বুঝতে বেশি দেরি হল না। মোবাইল ফোনের বেড়াজাল টপকে যখন শেষ পর্যন্ত ওরাৎসিওর সঙ্গে দেখা হল ততক্ষণে খিদের চোটে আমরা কাহিল। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আমরা পৌঁছলাম একটি সুপার মার্কেটের ফুড কোর্টে। থরে থরে সাজানো খাবারের মধ্যে চোখ চলে টমেটো সসের মধ্যে গায়ে গায়ে লেগে থাকা গোলাকৃতি একটি পদের দিকে। দেখলাম মোৎজারেলা চিজ আর বেসিল ছড়ানো এলোমেলোভাবে। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে ওরাৎসিও এগিয়ে এল। বলল, ‘এও একধরণের পাস্তা’। পাস্তা? ‘হ্যাঁ তাইই, খেয়ে দ্যাখো’। লেখা দেখলাম ‘Gnocchi alla Sorrento’ অর্থাৎ সোরেন্তোর ন্যক্কি। তা এই বিষম বস্তুটি কী? আলু, ময়দা আর ডিমের মিলমিশে গড়ে ওঠা তাল থেকে কেটে নেওয়া ছোট ছোট টুকরো রাভিওলির মতো একই কায়দায় প্রথমে সিদ্ধ করে নেওয়া হয়। তারপর সস তৈরি করে নেড়েচেড়ে নেওয়ার কাজ। শেষে একটি বেকিং ট্রেতে মিশ্রণটি ঢেলে দিয়ে ওপর থেকে ছড়িয়ে দিতে হবে মোৎজারেলা চিজের টুকরো আর বেসিল। এরপর শুধু মিনিট কুড়ি বেক করে নিলেই খাবার টেবিলে ম্যাজিক। এক্ষেত্রে বলার কথা এই যে সোরেন্তোর নামটি এই রান্নার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটি বিশেষ কারণ আছে। তা হচ্ছে মোৎজারেলা চিজের ব্যবহার। যার জন্ম ইতালির নেপলস অঞ্চলে আর নেপলস এর কাছেই নয়নাভিরাম আমালফি উপকূলবর্তী শহর সোরেন্তো। এই নেপলস এর সঙ্গে আবার জড়িয়ে রয়েছে পিৎজা মারগারিটা আর দিয়েগো মারাদোনা নামক এক ফুটবলশিল্পীর ঈশ্বর হয়ে ওঠার লোকগাথা।

বোতলের কর্কটা যে খুলে গিয়েছে, বুঝতে পেরেছিলাম পরদিন ওরাৎসিও যখন অনেক যানজটের দুর্ভোগ পুইয়ে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমাদের নিয়ে গেল একটি পিৎজেরিয়ায় আর আনতে বলল পিৎজা মারগারিটা। অতিকায় সেই পিৎজা সেদিন শেষ করে উঠতে পারিনি। তবে এটি নিয়ে নেপলস এর বিশেষ গর্বের কারণ বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও কয়েক বছর। যখন নেপলস রেলস্টেশনের কাছে একটি ছোট রেস্তরাঁর মেনু কার্ড দেখে অর্ডার করেছিলাম মারগারিটা। সন্ধের মুখে সেই পিৎজা টেবিলে পৌঁছনর পর প্রথম টুকরোটি মুখের ভিতর প্রবেশ করার পর যে অনুভূতি হয়েছিল, তা এক কথায় অবিস্মরণীয়। খেয়াল করিনি শেফ নিজেই কখন হেঁশেল থেকে এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করার জন্য।

0 comments: