1

প্রবন্ধঃ মনোজিৎ কুমার দাস

Posted in


প্রবন্ধ



বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র: কলকাতা বেতারের প্রবাদপ্রতিম অনুষ্ঠান প্রযোজক, ভাষ্যকার ও শিল্পী
মনোজিৎ কুমার দাস





বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র(১৯০৫- ১৯৯১) ছিলেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ। তাঁর পরিচয় দু’এক কথায় তুলে ধরা অসম্ভব। ১৯৩১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেবীপক্ষের শুরু মহালয়ার ভোর ৪টায় আকাশবাণী কলকাতা বেতার থেকে বাণীকুমারের রচিত ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সুললিত কন্ঠের রেকর্ডকৃত সংস্কৃত স্ত্রোত্র পাঠ ও ভাষ্য ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে জেগে উঠেছে আলোক মঞ্জির...’ এর মাধ্যমে শারদীয়া দুর্গা পূজার আগমন বার্তা ঘোষিত হয়। 

১৯৩১ সালের মহালার ভোরে ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ নামে যে অনুষ্ঠানটি প্রথম কলকাতা বেতার থেকে প্রচার হয় তার তিন মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসে তৈরি হয় কালজয়ী ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ গীতি আলেখ্য। বাণীকুমারের রচনা,পঙ্কজ মল্লিকের সুর আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভাষ্য ও চণ্ডীপাঠে ঋদ্ধ এই ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। মহালয়ার এ অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতন শুদ্ধ উচ্চারণে সুললিত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ ও ভাষ্য দিতে পেরেছেন বলে কোন প্রমাণ মেলা ভার। 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্ম ১৯০৫ সালের ৪ আগষ্ট উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায়। পিতা: কালীকৃষ্ণ ভদ্র। মাতা: সরলা দেবী। ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ওই বছরই নব প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বেসরকারী বেতারে যোগদান করেন। ১৯২৭ সালে এর ২৬ আগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। একই সময়ে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মল্লিক ও অনুষ্ঠান প্রযোজক ও অনুষ্ঠান রচয়িতা বাণীকুমার কলকাতা বেতারে যোগদান করেন। 

১৯৩১ সালের চলচ্চিত্রে সবাক যুগের যাত্রা শুরু হয়। তার আগে সিনেমা ছিল নির্বাক, যা বায়স্কোপ নামে পরিচিত ছিল। তারপর এক সময় কলের গান বা গ্রামফোন এলেও তা ছিল মূলত ধনীদের বাড়ির বিনোদনের মাধ্যম। ১৯২৭ সালে এর ২৬ আগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর যে সব অনুষ্ঠান উদ্ভাবকরা বেতারের অনুষ্ঠানকে সুরুচিসম্পন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অন্যতম। 

কলকাতা বেতারে যোগদানের পর থেকেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতারে শ্রুতি নাটক প্রচার শুরু করেন। বেতারের শ্রুতি নাটককে জনপ্রিয় করতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সম্পাদনা ও প্রযোজনায় ‘শাহজাহান’, ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘প্রফুল্ল’, ‘ তাহার নামটি রঞ্জনা’, ‘দুই পুরুষ,’ ‘ বিরিঞ্চবাবা’, ‘রামের সুমতি’ সহ অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়। তিনি তাঁর নিজের প্রযোজিত অসংথ্য বেতার নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি মঞ্চ নাটক লিখেছেন ও নাট্যরূপ দিয়েছেন, কিন্তু মঞ্চে কখনও অভিনয় করেননি। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ প্রযোজিত বেতার নাটকগুলোতে প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, ছবি বিশ্বাস, মলিনা দেবী,সরজুবালা, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখ।

একটা সময় ছিলো যখন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিলো বেতার। প্রতি শুক্রবার রাতে প্রচারিত বেতার নাটক শোনার জন্য অসংখ্য শ্রোতা অধীর আগ্রহে রেডিওর সামনে বসে থাকতেন। শ্রুতি নাটক এত জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চিন্তা, চেতনা, মেধা, মনন, পরিকল্পনা বিশেষ ভাবে কাজ করেছিলো। বেতারে শ্রুতি নাট্যধারার প্রবর্তক ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্রে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উত্তরসূরী জগন্নাথ বসু এক স্মৃতিচারণায় বলেন, “কাজ করতে করতে বীরেনদাকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল রেডিয়ো নাটকের নিজস্ব ভাষা। কেমন করে পাতা ওল্টাতে হবে, যাতে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ না শোনা যায়। সংলাপ বলার সময় চোরা দম কেমন করে নিতে হয়। শুধু কন্ঠস্বর দিয়ে রাগ, দুঃখ, ভালোবাসা, সমস্তই প্রকাশ করতে হয় কেমন করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেমন করে মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে সংলাপ বলতে হয়, সব বীরেনদা আমাদের শিখিয়েছেন। শিক্ষা দেওয়াতে ওঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। কখনও ধমকাতেন, কখনও ভালবাসতেন, কেউ ওঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারতো না।” 

রেডিও অন্ত প্রাণ ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। তিনি কলকাতার আকাশবাণী থেকে প্রচারের জন্য নতুন নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে সেগুলোর বাস্তবায়ন করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিষ্ণুশর্মা ছদ্মনামে ‘মহিলা মজলিস’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন। বিরূপাক্ষ নামে বিরূপাক্ষের আসরে গল্প শোনাতেন কলকাতা বেতার থেকে। তাঁর এ আসর খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ধারাভাষ্যকার হিসাবে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখেন ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর শোক মিছিলের ধারাভাষ্য সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে। জোড়াসাঁকো থেকে নিমতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত পুরো শোকযাত্রার ধারাভাষ্য দেওয়া হয়, এখনও তা আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় বাণীবদ্ধ করে রাখা আছে। সেই ধারাভাষ্যেও শেষ কয়েকটি পঙক্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে, “...ওপারে দূরের ওই নীলকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিলো অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারেও এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হলো এক মহাপ্রাণের পূত পবিত্র শরীর। রবি গেলো অস্তাচলে...।” একথা বলা যায়, আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাভাষ্য দেওয়ার প্রবর্তক ছিলেন তিনি।

আকাশবাণী কলকাতা বেতারের স্টাফ আর্টিস্ট পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলেও তেমন আর্থিক সুবিধা বা সম্মাননা পাননি। ১৯৯১ সালে ৮৬ বছর বয়সে এই প্রবাদ প্রতিম মানুষটি লোকান্তরিত হন। প্রতি বছর দেবী পক্ষের মহালয়ার ভোরের ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ গীতি আলেখ্যে তাঁর কন্ঠের স্ত্রোত্রপাঠ ও ভাষ্যই তাঁকে কালজয়ী করে রাখবে।



1 comment:

  1. খুব সুন্দর এবং প্রাসঙ্গিক লেখা। কিন্তু একটি তথ্যের ভুল রয়েছে। ১০৩১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেবীপক্ষের শুরু বানীকুমারের মহালয়া দিয়ে-----এই তথ্যটিতে খুব সামান্য একটি ভুল আছে। মাঝে, ১৯৭৬ সালে জরুরী অবস্থার সময়ে বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকে না জানিয়েই আকাশবাণী উত্তমকুমারের কন্ঠে অন্য এক মহালয়ার প্রবর্তন করেছিলেন যেটি চরম ভাবে ফ্লপ হয়।

    ReplyDelete