পথে প্রান্তরেঃ মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
Posted in পথে প্রান্তরে
আমাদের ছুটি ছুটি
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
১
ক'দিন ধরেই মনটা
কোথাও যাই যাই করছিলো। প্ল্যান করেও যেন সফল হচ্ছিলাম না। তিনদিনের ছুটি... থুড়ি,
ছুটিটা একদিনেরই। শুধু সোমবারে পড়ায় লঙ উইকএন্ড হিসাবে গণ্য
হয়েছে। সামারের শেষ লঙ উইকএন্ড, সবাইই বেড়িয়ে পড়েন এদিক
ওদিক। কারণ, এরপর একে তো ক্রমে ক্রমে ঠান্ডা পড়বে, তায় স্কুল খুলে গেছে অতএব ছুটি পেলেও বাচ্চাদের পড়ার কারণে বিশেষ কেউ
তিনদিনের ছুটির তিনদিনই ঘুরতে বের হন না। অনেকের মতো আমরাও এই ছুটিটা ঘরে বসে
আলসেমি করে নষ্ট হতে দিতে চাইলাম না।
কোথায় যাওয়া যায় খুঁজতে খুঁজতে, নিউজার্সির উত্তর-পশ্চিমে প্রায় তিনশো সাতাশ মাইল দূরত্বে,
লেচওয়ার্থ স্টেটপার্ক নামের একটা জায়গার কথা হঠাৎই চোখে পড়ে। কি
আছে সেখানে? অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। পাহাড় আর তার
গিরিখাত, তাতে নদী এবং ঝর্ণা। এই স্টেটপার্ক কে বলা হয়
"grand canyon of the east"। জায়গাটা সম্পর্কে বিশদে পড়ে বেশ আকর্ষণ অনুভব করলাম, বাড়িতে আর্জি পেশ করলাম, মোটামুটি হ্যাঁ না করে পাশও হয়ে গেল। শুধু চিন্তা এটাই যে, অন্তত ঘন্টা পাঁচেক একটানা ড্রাইভ করলে পৌঁছনো যাবে, যেহেতু একটানা ড্রাইভ করা যায় না কাজেই সময়টা বেড়ে ছ' ঘন্টা কি তারও বেশি দাঁড়াবে। এবারে, এতখানি রাস্তা
ড্রাইভ করে গিয়ে যদি দেখা যায় তেমন কিছুই নয়, এমন দৃশ্য
দু'হাত দূরেও পাওয়া যেতো, তখন?
সব আনন্দ মাটি। কারণ এদেশে বহু সময়েই এমন করে ছবি দিয়ে কোনো
জায়গা সম্পর্কে লেখে যাতে পড়লেই মনে হবে 'এটা না দেখতে
পেলে জীবনবৃথা' অথচ সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আবিষ্কৃত হয় ফটো
তোলার কারসাজি, আসলে তেমন স্পেশ্যাল কিছুই নয়। কাজেই কিছুটা
দোলাচলের মধ্যে পড়লাম। এখন উপায়? খুঁজেটুজে বের করলাম,
ওই স্টেটপার্ক থেকে ঘন্টাখানেকের ড্রাইভিং দূরত্বে কর্ণিং
গ্লাসমিউজিয়াম। এই গ্লাসমিউজিয়ামটি একদম অন্য ধরনের। কাঁচ দিয়ে বানানো বিখ্যাত
মানুষদের তৈরী বিভিন্ন স্কাল্পচার ইত্যাদি তো আছেই, সাথে
কীভাবে কাঁচের জিনিস তৈরী হয় চোখের সামনে প্রদর্শন করা হয়। এমনকি কিছু নির্দিষ্ট
কাঁচের জিনিস নিজের হাতে তৈরী করেও নেওয়া যায়, অবশ্যই সে
বিষয়ে অভিজ্ঞ একজনের তত্ত্বাবধানে। আগে কোনো এক সময়ে দেখেছিলাম বলে জানা আছে
মিউজিয়ামটা কতটা আকর্ষণীয়। ব্যস, সমস্যার সমাধান। তাহলে
বরং গ্লাসমিউজিয়াম দেখতেই যাবো, রাতে সেখানে কোনো হোটেলে
রাতটুকু কাটিয়ে, পরদিন টুক করে স্টেটপার্ক। যদি ভালো হয় তো
হলো, না হলে চটপট ফিরতি পথ ধরা যাবে।
আমার এগারো বছুরে কন্যা একটু অন্যরকম, সে আবার বেশ লোকজন নিয়ে বেড়াতে ভালোবাসে। মানে, আমরা গেলে আমাদের সাথেও কেউ চলুক এটা সব ক্ষেত্রেই চায়। কাজেই আমাদের অতি
ঘনিষ্ঠ, বলতে গেলে আমাদের এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, এমন এক পরিবারের সাথে প্ল্যান হলো যাওয়ার। যাওয়ার জায়গা ঠিক হয়ে গেছে,
এই বারে, কোনদিন রওনা দেব সে নিয়ে আলোচনা
চললো। শনি, রবি, সোম তিনদিনের মধ্যে
ঘোরা শেষ করতেই হবে, সাথে সাপ্তাহিক বাজারহাট সেগুলোও সারতে
হবে, অতএব যেকোনো দু'দিন ঘোরা।
প্রাথমিক ভাবে ঠিক হলো শনিবার গিয়ে রবিবার ফেরা হবে। বেশ ক'দিন
উত্তেজনা, কবে যাওয়া কখন যাওয়া তাই নিয়ে আলোচনা, ওঁদের একটু কাজ এসে পড়ায় শনিবারের বদলে রবিবার যাওয়া ঠিক হলো। ভাবলাম
ঠিকই আছে, শনিবার বাজারহাট সেরে রেখে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত।
কারণ সোমবার যেহেতু ছুটি, কাজেই বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ অথবা
কম সময়ের জন্য খোলা। তার মানে, ঘোরা শেষে রবিবারে ফিরতে রাত
হয়ে গেলে সোমবার হাঁকাদমকা লাগবে বাজার করতে। প্রায় যাবার দিন দু'য়েক আগে জানা গেল, অপরিহার্য কারণবশতঃ ওঁরা এ
যাত্রায় যেতে পারছেন না। টানাপোড়েন লেগে গেল, এতটা মানসিক
প্রস্তুতির পর যেতে না পারলে যেমন মন খারাপ করবে, আবার ওঁদের
ছাড়া ঘুরে আসতেও মন চাইছে না। যাই হোক, শেষ অবধি ঠিক হলো
আমরা ঘুরেই আসবো এ বারের মতো, পরে কোনো সময়ে আবার ওঁদের
সাথে প্ল্যান করা যাবে। কিন্তু বাধ সাধল, সেই তাহলে একা আমরা
যাবো? নাঃ, সমস্যার সমাধান হলো আমার
স্বামীর ভ্রাতৃপ্রতিম এক কলিগ সৌমিতকে দিয়ে। ওঁদের ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান বলতেই এক
কথায় রাজি। আবার নতুন করে আলোচনা শুরু, এবারে ঠিক হলো যে,
নিজেদের দুটো আলাদা গাড়ি না নিয়ে একটা বড় গাড়ি ভাড়া করে সবাই
একই গাড়িতে যাওয়া হবে। তবে কিনা, লেবার ডে'র ছুটি তো, কতো মানুষ একই ভাবে গাড়ি ভাড়া করবেন,
আমরা তো শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, কাজেই
আদৌ ভাড়া পাবো কি না, সেটাই কথা। গাড়ি পেলেও যদি অনেক
ভাড়া চায় বা অনেকটা দূরত্বের কোথাও থেকে নিয়ে আসার কথা বলে সেগুলোও গাড়ি না
পাওয়ারই সমান।
যাই হোক, জয়মা জয়মা করে, শনিবার সক্কাল সক্কাল টয়োটা কার
ডিলারের কাছে গাড়ি পাওয়া তো গেল, এবার সমস্যা দেখা দিল
অন্য। যেহেতু রবিবার ডিলারের দোকান বন্ধ থাকে অতএব গাড়ি ভাড়া নিলে শনিবারেই নিতে
হবে, আবার যতটা তাড়াতাড়ি নিতে পারবো, তত পছন্দসই গাড়ি পাবো। তখন, আমরা সবে মাত্র
ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা নিচ্ছি আর সৌমিতদের পরিবার ঘুম থেকেও ওঠেনি। কোনোরকমে তাদের
ফোন করে জাগিয়ে সব জানানো হলো, জিজ্ঞাস্য, কী করনীয়? ওদের সাথে আলোচনায় এটাই সাব্যস্ত হলো,
যে ব্রেকফাস্ট করেই চানটান সেরে নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়ব। গাড়ি
রেন্ট করে খামোখা একদিন ফেলে রেখে পরদিন বের হবার কোনো মানেই হয় না। আর যেহেতু
একদিন আগে গাড়ি নেওয়া হচ্ছে তা'হলে আরোও কিছু জায়গা ঘুরে
নেওয়া যাবে। বাজারহাট, সেতো সব উইকএন্ডেই করি, এবারটা না'হয় ঘুরতেই গেলাম। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের প্রয়োজনীয় কিছু কাজ দ্রুত সেরে নিলাম। সপ্তাহের জমা ছাড়া
কাপড় কেচে শুকিয়ে রাখলাম, সকালের জলখাবার খাওয়া বাসন গুলো
ধুয়ে ফেললাম, কাপড়জামা যা গুছিয়ে নিয়েছিলাম তার ওপর আরোও
কিছু নিয়ে নিলাম। রাস্তায় খাবার মতো মুখরোচক শুকনো খাবার, জল,
বাচ্চাদের জন্য বিস্কুট, টেট্রা প্যাকের দুধ,
জুস, সবই পরিমানে আরেকটু করে বাড়িয়ে নিলাম।
অ্যাকোরিয়ামের মাছগুলোর অসুবিধে যাতে না হয়, তাই ফিশ
ফিডারে খাবার ভরে ফিশ ট্যাঙ্কের পাশে লাগিয়ে দিলাম, ঘরের সব
দরজা, জানলা, এসি ঠিকঠাক বন্ধ টন্ধ করে
রেখে তৈরী হয়ে অপেক্ষা সৌমিতদের আসবার। একটু পরেই ওঁরা আসলে মহিলারা, মানে আমি,আমাদের মেয়ে সুকন্যা, সৌমিতের স্ত্রী জয়া ও ওদের চার বছুরে মেয়ে সৃজনী, আমরা
ঘরেই অপেক্ষা করলাম আর পুরুষরা গিয়ে নিয়মমাফিক কাগজপত্রের কাজ সেরে গাড়ি ভাড়া
করে নিয়ে এলো।
ইতোমধ্যে আমি নতুন সংযোজিত জায়গাগুলির ঠিকানা, ডাইরেকশন সব গুগল থেকে খুঁজে কপি করে
রাখলাম। শনিবার বের হবার প্ল্যান হতেই স্বাভাবিক ভাবেই আরোও দুটো জায়গার নাম প্ল্যানে
ঢুকে গেছে। এবং সর্বসম্মতিক্রমে পাশও হয়ে গেছে। একটি হলো নিউজার্সি থেকে প্রায়
সাড়ে চারশো মাইল কি তারও একটু বেশি দক্ষিণ-পশ্চিমে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যে
পাহাড়ের কোলে ইস্কনের একটি সোনার মন্দির আছে 'প্যালেস অফ
গোল্ড' নামে। মন্দিরের লাগোয়া বিশাল এলাকা জুড়ে মনোরম নিউ
বৃন্দাবন। যেখানে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়, পদ্মপুকুরে পদ্ম ফুটে
থাকে, গোলাপ বাগানে গোলাপ ফুটে থাকে। গাড়িতে সেখানে পৌঁছতে
প্রায় ছ'সাত ঘন্টা লাগে। আর দ্বিতীয় জায়গাটি
পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের পিটসবার্গ এলাকায়, নিউজার্সি থেকে
প্রায় চারশো মাইল পশ্চিমে, সেখানেও পাহাড়ের ওপর শ্রী
ভেঙ্কটেশ্বরা টেম্পল আছে। পিটসবার্গ এবং নিউ বৃন্দাবনের মধ্যে ড্রাইভিং ডিসট্যান্স
মোটামুটি ঘন্টা খানেকের বেশি নয়। কাজেই, ওই দুটো মন্দির একই
সঙ্গে দর্শন করেন সকলে। কারণ, বারে বারে ছ'সাত ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া ও রাতে থাকা খরচ এবং পরিশ্রম সাপেক্ষ।
গাড়িতে উঠে আমায় জিজ্ঞেস করে 'প্রথম কোথায়', সেই অনুযায়ী জিপিএস সেট
করা হবে। যেহেতু আমি প্ল্যানিং ম্যানেজার, জানালাম, আমার স্বামী রাজর্ষির মতে প্রথমে যাবো নিউ বৃন্দাবন, সেখান থেকে পিটসবার্গ তারপর লেচওয়ার্থ পার্ক একেবারে শেষে কর্ণিং
গ্লাসমিউজিয়াম। সব জায়গার ঠিকানা ইত্যাদি ন্যাভিগেটর সৌমিতের হাতে দিয়ে আমি আর
জয়া লাস্ট সীটে। মাঝের সীট দুটোতে দুই মেয়ে, আর ড্রাইভার
রাজর্ষি। তবে নিউ বৃন্দাবন-প্যালেস অফ গোল্ডের ওয়েবসাইটে পাওয়া ডাইরেকশনের
সতর্কীকরণ আমি হুবহু বললাম ওদের। সেখানে বলা আছে জিপিএসের পথ অনুসরণ না করতে। সে
পথ নাকি বন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অসমতল রাস্তা এমনকি নদীর ভিতর দিয়েও নিয়ে যায়।
বহু দশর্নার্থী খুব ঝামেলায় পড়েছেন ওই পথে মন্দির পৌঁছতে। তার বদলে ওয়েস্ট
ভার্জিনিয়ার বেথলেহেম জায়গার নাম দিয়ে জিপিএস কে সেট করে সেখানে পৌঁছে তারপর
ডান বাঁ করে কিভাবে মন্দিরে যাওয়া যাবে সেটা গুছিয়ে লেখা আছে। ছ'সাত ঘন্টা বাদে গিয়ে কী হতে পারে সেসব তখন চিন্তা না করে জিপিএস কে 'প্যালেস অফ গোল্ডের রাস্তা দেখাও' বলে সেট করা হ'ল।
চলতে থাকলাম। মাঝে দাঁড়িয়ে চা কফি মাফিন কিনে একটু সময় হাত পা মেলে আবার
চলা। গাড়িতে বসে ঝাল চিঁড়েভাজা সহযোগে চা কফির সদ্ব্যবহার হ'ল। বাইরের প্রকৃতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে,
আশেপাশে পাহাড় দেখা যাচ্ছে, কোথাও হয়ত
মাইলের পর মাইল আখের ক্ষেত, কোথাও হলুদ হয়ে রয়েছে মাঠ হলদে
রঙা গোল্ডেনরডস্ ফুলে। পাহাড়ী রাস্তা শুরু হ'ল এরপর।
উপত্যকার ভিতর দিয়ে অসাধারণ সুদৃশ্য রাস্তায় চলেছি। দু'ধারে
যতো দূর চোখ যায় পাহাড়ের সারি। বেশিরভাগই জঙ্গলে ঢাকা, কোনো
কোনোটায় বাড়ি আছে, তার পাশে আছে হয়ত সমান করে কাটা বিশাল
ঘাস জমি। কোথাও টলটলে জলের ছোট্ট মতো পুকুর, বাড়ির লাগোয়া
বা এমনিই জঙ্গল ঘেরা পুকুর, নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ছায়া
বুকে নিয়ে। আবার বড় বড় উইন্ডমিলও রয়েছে কোনো পাহাড়ের গায়ে। পরপর গোটা চার
পাঁচেক টানেল পার হলাম, পাহাড়ের নিচ দিয়ে গর্ত করে বানানো
টানেল। টানেল পেরোনোর সময় মনে পড়ছিলো ক'দিন আগে একটি ছবি
দেখেছিলাম অনেকটা ওপর থেকে তোলা এমনই পরপর টানেলের ফটো, যেটা
দেখে মনে হচ্ছিল একই টানেল পাহাড়ে ঢুকছে আবার বের হচ্ছে। হয়তো হেলিকপ্টার থেকে
ছবি তুললে এই টানেলগুলোকেও অমনই লাগবে! এই সব দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে আসছে,
সূর্যাস্তের লাল সূর্য অবাক করছে আমাদের। যদিও নিউজার্সিতে আমাদের বাসার
কাছে অনেক ক্ষেত খামার থাকায় সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত কিছু নতুন নয় আমাদের চোখে,
তবু এক এক দিনের সূর্যাস্ত যেন একটু আলাদা লাগে। আর এত সময় ধরে
ক্রমশঃ রঙ পাল্টে অস্ত যাওয়া দেখার সৌভাগ্য কম দিনই জোটে।
অন্ধকার নামলো, তখনও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ঢুকতে পারিনি আমরা, মন্দির তো দূর। হয়ত যতক্ষণে সেখানে পৌঁছাবো, মন্দির
বন্ধই হয়ে যাবে। আর যেহেতু মন্দির কর্তৃপক্ষকে জানানো নেই যে আমরা রাত কাটাতে চাই,
তাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হওয়াটা বুদ্ধির কাজ হবে না।
কারণ কর্তৃপক্ষ যদি থাকার বন্দোবস্ত না করতে পারেন? আগের দিন
জন্মাষ্টমী গেছে, ভিড় থাকাটাই স্বাভাবিক। কাজেই তখনি ঠিক
করা হলো আমরা মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছেছি এমন বুঝতে পারলে, সেখানেই
কোনো হোটেল খুঁজে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হবে। সেই মতো, মন্দিরের
বেশ কাছেই একটা হোটেল কমফর্ট ইন-এ গিয়ে সুইট ভাড়া নিয়ে সবাই একত্রে থাকা হলো।
মজার ব্যাপার, দেশি দেখেই ইনের রিশেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করলেন ‘‘মন্দির দেখতে এসেছ?’’হ্যাঁ বলায় জানলাম মন্দির
দর্শনার্থীদের জন্য হোটেল ভাড়ায় বিশেষ ছাড় দেন ওরা। রাতের খাবার হিসাবে বাইরের
দোকান থেকে বার্গার, স্যালাড কেনা হ'ল
আর আমার তৈরী কিছু মেথি পরোটা সঙ্গে ছিলো। রুমের মাইক্রোওয়েভে গরম করে এসবের
সদ্গতি হলো। লাঞ্চ তো সেই অর্থে হয়নি। পরদিন সক্কাল সক্কাল সবাই স্নান সেরে,
হোটেল থেকে দেওয়া কম্প্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্টে সসেজ, ওমলেট, চুড়ির মতো ব্রেড, যাকে
বলে ব্যাগেল, ইয়োগার্ট, কফি ইত্যাদি
খেয়ে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
মন্দির এই হোটেল থেকে খুব দূর নয়। মোটমুটি আধাঘন্টা টাকের মধ্যে পৌঁছে
যাওয়ার কথা। যদিও আমি মন্দিরের ওয়েবসাইটে বলা সাবধান বার্তা আবারও মনে করিয়ে
দিলাম। কিন্তু গুগল ম্যাপের ওপর ভরসা রেখে, সে যে পথে যেতে বলছে রাজর্ষি সেই পথেই চালানো শুরু করল।
একপাশে খাদ, লম্বা লম্বা গাছের জঙ্গল, আরেক
পাশে পাহাড় নয়ত টুকটাক কোথাও বাড়ি, চার্চ রয়েছে ঢেউ
খেলানো পাহাড়ী সেই রাস্তায়। যথেষ্ট নির্জন, কিন্তু চকচকে
পিচ বাঁধানো রাস্তাই। বেশ আনন্দ করে পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি, কোথাও হয়ত পথের বাঁক এমনই যে মনে হচ্ছে রাস্তা ওখানেই শেষ, যতই দেখি শুধুই 'আহা আহা' করি
মুগ্ধ আমরা। একটু পরেই টের পেলাম, আমরা সেই বাজে রাস্তা
দিয়েই যাচ্ছি, বাঁধানো রাস্তা বদলে গিয়ে ভাঙ্গাচোরা
উঁচুনিচু নুড়ি কাঁকরে ভরা রাস্তা শুরু হয়েছে একটা বাঁকের থেকে, এ যেন পায়ে হাঁটা পথে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া। দু'পাশে
জঙ্গল আর সামনে পেছনে কোত্থাও কেউ নেই। মাঝে মাঝেই পাহাড়ী বাঁক, এখন গুগল জিপিএসের কথা না শুনে কোনো উপায় নেই। চুপচাপ সামনের দিকে
চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। কি ভাগ্য ভালো যে শনিবার রাতে আমরা মন্দির অভিমুখে
রওনা দিইনি। দিনের আলোতেই গা ছমছম করে, রাতে যে কী হতো!
ডানদিকে একটা বাঁক ঘুরতেই সত্যিই নদীর ওপর দিয়ে যেতে হ'ল
আমাদের। নদীতে সামান্য জল ছিলো বলে রক্ষে, নদী পার হবার পর
অবশ্য আর খুব বেশি সময় লাগল না নিউ বৃন্দাবনে পৌঁছতে।
সেখানে দেখি বিশাল বড় গোশালা রয়েছে। দোকান তো আছেই, বিশাল পুকুর তাতে রাজহাঁস ঘুরে
বেড়ায়। পুকুর পাড়ে মস্ত মস্ত দুটো গরুর মূর্তি, তার
উল্টোদিকে পা মুড়ে বসা হাতির মূর্তি, পুকুরের অন্যপারে
গৌরনিতাই-এর প্রকান্ড মূর্তি বাগান আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর পুকুর পাড়ের
রাস্তা দিয়েই ময়ূরের বাগানে পৌঁছে যাওয়া যায়, যেখানে
রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় ময়ূর। প্রচুর গেস্টহাউস গোছের রয়েছে, যেখানে আগে থাকতে বুক করে এলে থাকা যায়। এসব দেখে আরেকটু চড়াই-এ গিয়ে
প্যালেস অফ গোল্ড। সত্যিকারের ২২ক্যারেট সোনার পাতে মোড়ানো মন্দির। মূলতঃ
মন্দিরের গায়ের কারুকাজ সোনায় মোড়া, কি ভেতরে কি বাইরে।
শ্রীল প্রভুপাদ, যিনি ইস্কনের জন্মদাতা, আমেরিকায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় তাঁর থাকার বাড়ি হিসাবেই এই বাড়ির কাজ
শুরু হয়। তবে কাজ শেষ হবার আগেই তিনি দেহ রাখেন। তখন ভক্তরা ঠিক করেন যে, এই বাড়িটিকেই মন্দিরে রূপান্তরিত করা হবে। তাঁরা অত্যন্ত মনোরম করে,
নিজেদের শ্রম দিয়ে, হরেক রকম মার্বেল,
রঙিন কাঁচ, অস্ট্রিয়ান ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি,
সূক্ষ্ম কারুকাজ খচিত টীক কাঠের দরজা জানলা আলমারি আর সোনার পাতে
সাজিয়ে দেন বাড়িটিকে। ভিতরে চমকে যাবার মতো শ্রীল প্রভুপাদ'র জীবন্ত মূর্তি, ওঁর ব্যবহার করা কিছু জিনিষের
সংগ্রহ, পায়ের ছাপ, সুন্দর করে
সংরক্ষিত। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে যখন দেখি আমরা যে বারান্দায় দাঁড়ানো শ্রীল
প্রভুপাদ সেই বারান্দায় হাঁটছেন তারই ফটো। দুপুরে আরতি এবং মহাভোজের আয়োজনের কথা
জানালেন এক ভক্ত, যিনি গাইড হিসাবে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে
দেখিয়েছেন। কিন্তু যেহেতু আমাদের পরের আরও প্ল্যান রয়েছে, ওই
অবধি অপেক্ষা না করার সিদ্ধান্তই নিলাম আমরা। মন্দির সংলগ্ন দোকান থেকে পছন্দসই
কিছু জিনিস কিনে আবার রওনা দিলাম এবারের গন্তব্য পিটসবার্গের শ্রী ভেঙ্কটেশ্বরা
টেম্পল।
এই দুই মন্দিরের দূরত্ব তেমন নয় আগেও বলেছি। কাজেই পৌঁছতে সত্যিই তেমন সময় লাগল
না। পাহাড়ের ওপরে মন্দির, তবে ইস্কন মন্দিরের চারপাশের পরিবেশ আমাদের কাছে অনেক
আকর্ষণীয় লেগেছে। চটি নির্দিষ্ট তাকে রেখে পা ধুয়ে মন্দিরের ভেতরে গেলাম। কিন্তু
মূল মন্দিরে প্রবেশের জন্য যে পরিমান লম্বা লাইন, তাতে
কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কেউ জানে না। কাঁচের দরজা দিয়ে মূল মন্দিরের ভিতরে দেখতে
পাচ্ছি তিল ধারণের জায়গাও নেই। ভক্তরা ঠাসাঠাসি করে বসে আছেন। প্রথমতঃ আমি আমার
স্বামী তেমন বড় ভক্ত নই। আমাদের ভক্তি, বিশ্বাস একটু
অন্যরকম। দ্বিতীয়তঃ বাচ্চা দু'জনের ক্ষিধে পাচ্ছে, গরম লাগছে। তাদের বোঝানোও মুস্কিল হচ্ছে যে কেন লাইন দিয়ে দাঁড়াবো।
একবার আমি আর সৌমিত চেষ্টা করলাম মূল মন্দিরের গেট আটকানো ভলান্টিয়ার ভদ্রলোককে
তুতিয়ে পাতিয়ে যদি ভিতরে গিয়ে প্রণাম করে আসতে পারি। কিন্তু ওঁরও কিছু করবার
ছিলো না। ভদ্রলোক আমাদের অবাক করে পরিষ্কার বাঙলায় অনুরোধ করলেন আরেকটু পরে ভেতরে
যেতে। কি আর করা! ঠিক করলাম, তাহলে বরং খাওয়ার কাজটা সেরে
নিই। এরই মধ্যে কিছু দেব দেবীর মূর্তিকে মন্দিরের চাতালে, যেখানে
তাঁবু খাটানো রয়েছে সেইখানে পাল্কি করে বাজনা বাজিয়ে নিয়ে আসা হলো।সেখানে রূপার
দোলনায় বসিয়ে তাঁদের পূজার্চনা শুরু হলো। সেখানেও ভক্তরা মাটিতে ভিড় করে বসে
সেই পূজা দেখতে থাকলেন। কিছু সময় এসব দেখে আমরা গেলাম খাবার ঘরে। মন্দিরের খাবার
ঘরে বেশ কয়েক রকম দক্ষিণ ভারতীয় ভাতের পদ খুব কম দামে বিক্রি হচ্ছে, টেবিল পাতা আছে ঘরের ভেতর বা বাইরেও পিকনিকের ধাঁচে, যেখানে খুশি বসে খাওয়া যায়। অত্যন্ত সুস্বাদু এবং গরম গরম বানানো খাবার
কিনে খেয়ে সবারই মুড ভালো হয়ে গেলো। তবে মন্দিরে এসে দর্শন করবো না এটাও ঠিক
ভালো লাগছিলো না। তাই সৌমিতের স্ত্রী জয়াকে নিয়ে আরোও একবার ঢুঁ মারলাম। উহুঁ!
এবারেও সেই লম্বা লাইন, তবে বের হবার দরজাটা খোলা আর ভেতরের লোকজন
একটু নড়াচড়ার জায়গা পাচ্ছেন মনে হলো। বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হবার পর আমরা বাইরে
বের হয়ে এলে সৌমিতরা আবার গেলো দর্শনের ইচ্ছায়। এবারে কিছুটা সফল হলো। ওরা এসে
জানাল যে লাইন আর নেই বাইরে। তবে মূল মন্দিরের ভিতরে লাইন সত্ত্বেও ওরা ভিতরে
গিয়ে লাইনের পিছন থেকে উঁচু হয়ে দর্শন করে এসেছে, প্রসাদও
নিয়ে এসেছে। শুনে আমি উৎসাহিত হয়ে জয়াকে নিয়ে আবার দৌড়লাম, এবারে গিয়ে আবিষ্কার করলাম মূল মন্দিরের ভিতরে শ্রী ভেঙ্কটেশ্বরা ছাড়াও
আরও দেব দেবী আছেন। এবং শ্রী ভেঙ্কটেশ্বরাকে প্রণাম করার তিনটে ছোটো ছোটো লাইন।এক
এক বারে এক একটি লাইন থেকে কিছু পরিমান ভক্তকে গর্ভগৃহে ঢুকে প্রণাম করার সুযোগ
দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে একেবারে ডানদিকের লাইনটা সব থেকে কম
লম্বা। বাকি দেবীদের এবং গরুড়দেব কে প্রণাম করে ওই ছোট্ট লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে
পড়লাম। একটু পরেই সৌভাগ্য হলো গর্ভগৃহে ঢুকে দুইহাতেরও কম দূরত্ব থেকে
শ্রীভেঙ্কটেশ্বরাকে দর্শন ও প্রণাম করার। 'কপালে থাকলে হবেই'
আমাদের এই বিশ্বাস আবারও মিলে গেল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য
লেচওয়ার্থ পার্ক, পিটসবার্গ থেকে প্রায় ঘন্টা চারেকের
ড্রাইভ।
২
চলতে শুরু করে, কিছু সময়ে বাচ্চারা ঘুমায়, কিছু সময়
পিছনে বসা আমরা; ঘুমোয় না ড্রাইভিং সিটে রাজর্ষি আর
ন্যাভিগেটর সৌমিত। রাস্তার ধারে মাইলের পর মাইল আঙুর ক্ষেত, মাঠ
ভরা হলদে ফুল দেখতে দেখতে, কতো কথা, আলোচনা,
মতের মিল-অমিল এসব হতে হতে সৌমিত রাতের থাকার জায়গা খুঁজছিলো
বিভিন্ন হোটেলে ফোন করে। লেচওয়ার্থ পার্কের কাছাকাছি হোটেলই খোঁজা হচ্ছিলো,
তাহলে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়া যাবে। কোন পথে যাচ্ছি সেই ম্যাপ
দেখতে দেখতে হঠাৎই সৌমিতের মাথায় খেলে গেলো যে নিউইয়র্ক স্টেটের বাফেলো নামের
জায়গার ওপর দিয়ে আমাদের যেতে হবে।হোটেলে গেলে তো আজ রাতে আর কিছুই করার নেই। তার
চেয়ে নায়াগ্রাফলস চলে গেলে কেমন হয়? কারণ, বাফেলো থেকে নায়াগ্রাফলস খুবই কাছে আর নায়াগ্রা থেকে লেচওয়ার্থ পার্কের
দূরত্ব ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভ-এর। রাতেরবেলা নায়াগ্রা যাবার উদ্দেশ্য হলো,
সেখানে প্রতি রবিবার রাত্রে বাজি পোড়ানো হয়, তাহলে গিয়ে রাতের বেলা সেটা দেখে তারপর হোটেলে যাবো রাত কাটাতে।যেমন ভাবা
তেমনি কাজ। একটা রেস্ট এরিয়ায় দাঁড়িয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে কিছু গরম গরম কফি,
চিকেন নাগেটস্ কিনে গাড়িতে বসে খেতে খেতে গাড়ি আরও পশ্চিম মুখে
ঘুরিয়ে চলে গেলাম নায়াগ্রা ফলস। সূর্যাস্তের রং মাখা ইরি লেককে বাঁ পাশে রেখে
যখন নায়াগ্রা পৌঁছলাম, অন্ধকার নেমেছে। কানাডা ও
অ্যামেরিকার বর্ডারে অবস্থিত ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই জলপ্রপাতের ওপর কানাডার দিক থেকে
আলো ফেলে রাতের বেলা, ফলে আলোকোজ্জ্বল জলরাশির আরেক রকম রূপ।
আমি আর আমার স্বামী এতবার নায়াগ্রা দেখেছি, যে আকর্ষণ
কিছুটা হলেও কমে গেছে। তাও হঠাৎ করে অল্প সময়ের জন্য গিয়ে ভারি মজা পেলাম।
কাছাকাছির দোকান থেকে চিকেন স্যালাড, wrap ইত্যাদি কিনে
ডিনার করতে করতে ফায়ারওয়ার্কস শো দেখলাম, ফটো তুললাম গুচ্ছ
ভরে। বাজি পোড়ানো শেষ হতেই চললাম হোটেল অভিমুখে, যদিও
ক্লান্ত সবাই তবু এমন আনন্দ মনে যে, ক্লান্তি দূর হয়ে
যাচ্ছে। রাত কাটালাম কোয়ালিটি ইন-এ, এবার অবশ্য দুটো আলাদা
ঘরে থাকতে হলো।
পরদিন সকালে আবারও চান-টান সেরে, হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বের হলাম। এদেশে সব হোটেলেরই
ব্রেকফাস্ট প্রায় একই, উনিশ বিশ তফাৎ থাকে পদের আর কোয়ালিটির।
এই হোটেল থেকে লেচওয়ার্থ পার্কের দূরত্ব আধাঘন্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের
ড্রাইভিং এর। যতো এগোচ্ছি ততো পাহাড় কাছে আসছে, লম্বা লম্বা
ঢেউ খেলানো পাহাড়ী রাস্তা, কোথাও হয়ত উপত্যকা দিয়েই
যাচ্ছি, অবশেষে আসল ছুটির দিনে, পৌঁছলাম
আমাদের আসল গন্তব্যে। আসল বললাম কারণ প্রাথমিক ভাবে কিন্তু লেচওয়ার্থ পার্ক যাবার
কথাই হয়েছিলো। তারপর তো একে একে কত জায়গা ঢুকেছে প্ল্যানে। আর শনি-রবি তো সব
সময়ই ছুটি থাকে সোমবারের ছুটিটাই তো সেই অর্থে আসল ছুটি, দিনটাও
অসম্ভব সুন্দর রোদ ঝলমলে।
পার্কে ঢোকার মুখে টিকিট কাটার সময় দেখলাম দর্শকদের ধন্যবাদ দিয়েছেন পার্ক
কর্তৃপক্ষ। লেচওয়ার্থ পার্ক দর্শকদের বিচারে অ্যামেরিকার এক নম্বর ন্যাশনাল পার্ক
হয়েছে। একটু এগোতেই একটা 'ওভার ভিউ',মানে যেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়,
ক্যানিয়ন ইত্যাদি দেখা যাবে। গাড়ি পার্কিং-এ রেখে নেমে দেখি কী
আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য! এইখানে রয়েছে মাউন্ট মরিস ড্যাম। অত ওপর থেকে দেখতে একটু
যে ভয় ভয় করছিলো না তা নয়। ড্যামের একদিক খটখটে শুকনো, অন্যদিকে
জল, আর সাথে পরতে পরতে পাহাড়। কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে
অবশ্যই ছবি তুলে আরও আগের দিকে রওনা দিলাম। কিছুদূর অন্তর অন্তরই এমন ওভার ভিউ করা,
প্রতিটাতে তো আর দাঁড়ানো সম্ভব নয়, কারণ,
এখন বুঝতে পারছি শুধু এই পার্ক দেখতে ওই তিনদিনের পুরো ছুটিটাই
লাগালে ভালো হতো। এই পার্ক দেখার পর যাবো কর্ণিং গ্লাসমিউজিয়াম আর তারও পরে ঘরে
ফিরতে হবে সময় মতো মঙ্গলবার সক্কাল সক্কাল স্কুল অফিস যাওয়ার ব্যাপার আছে। সাথে
প্ল্যান যদি সম্ভব হয় কিছুটা হলেও বাজার করে ঘরে ফেরা। কাজেই সময় বুঝে খরচ করতে
হবে। মাঝে মাঝে অপরূপ পাহাড় আর উপত্যকা দেখতে পেয়ে দাঁড়ালাম, ফটো নিলাম, আবার পথনির্দেশ দেখে এগোলাম। এবার
দাঁড়ালাম এক ক্যানিয়ন বা গিরিখাতের ধারে। দু'চোখ ভরে
দেখলাম প্রকৃতির সৃষ্টি, সাথে ফটো নিলাম স্মৃতি চিহ্ন
হিসাবে। এরপর পথের নির্দেশ পড়েই জানলাম সামনে আসছে ঝর্ণা। তিনটে ঝর্ণা আছে এখানে।
লোয়ার, মিড্ল আর আপার ফলস নামেই যাদেরকে উল্লেখ করা। লোয়ার
ফলস তেমন আকর্ষনীয় হবে না বলেই মনে হলো আমাদের। অতএব না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলাম
মিড্ল ও আপার ফলস অভিমুখে।
এখানে গ্লেন আইরিস ইন বলে একটি হোটেল রয়েছে, যার পাশে দাঁড়ালে মিড্ল ফলস সুন্দর
করে বেশ উপর থেকে দেখা যায়। এই হোটেলটি আদতে উইলিয়াম প্রায়র লেচওয়ার্থের বাড়ি
ছিলো, সংস্কারের পর বর্তমানে হোটেলে রূপান্তরিত। মিঃ লেচওয়ার্থ
একজন শিল্পপতি, তিনি এই এলাকায় হাজার একর জমি কিনে গ্লেন
আইরিস এস্টেট তৈরী করেন, পরবর্তী কালে নিউইয়র্ককে পুরো
এস্টেট দান করেন ও সেটিকে ন্যাশনাল পার্কে পরিণত করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ফলকে
লেখা রয়েছে ওই জায়গার সম্পর্কে, সে সব পড়ে পড়ে জেনে
নিচ্ছি কত কিছু। নিউইয়র্ক স্টেটের হাইয়েস্ট ওয়াটার ফলও দেখা যায় ইন্সপিরেশন
ওভার ভিউ থেকে। মিডল ফলসের কাছে ট্রেইল রোড আছে যেটা দিয়ে ট্রেক করে ফলসের কাছে
পৌঁছন যায়। আরেকটু এগিয়ে আপার ফলস, জেনেসি নদীর ওপর দিয়ে
ইরি রেলরোডের ব্রিজ রয়েছে এই আপার ফলসের ঠিক ওপর। প্রথম কাঠের ব্রিজ থাকলেও
বিধ্বংসী আগুনে সেটা পুড়ে নষ্ট হবার পর লোহার ব্রিজ বানানো হয়েছে। মিড্ল ফলস ও
আপার ফলসের মধ্যবর্তী এলাকায় পিকনিকের বন্দোবস্ত আছে, ছোট্ট
মতো খাবারের দোকান আছে, রেস্টরুমও আছে। হ্যাঁ, এদেশে রেস্টরুম বা ওয়াশরুম থাকে সর্বত্র এবং যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন, এই পাহাড় জঙ্গল তাতেও ব্যতিক্রম নেই; আর চোখে পড়লো
জঙ্গলে হ্যান্ডিক্যাপডদের আলাদা রাস্তা করা আছে, সাধারণের
জন্য পাথরের সিঁড়ি আর হুইলচেয়ার নিয়ে নামা ওঠার ঢালু পথ হ্যান্ডিক্যাপড ছাপা
দেওয়া। এইখানেই দুপুরের খাবার হিসেবে সদ্য তৈরী গ্রিলড চিকেন বার্গার খাওয়া হলো।
আপার ফলসের দিকে যাবার রাস্তাটা এতো খাড়াই, যে মনে হচ্ছিলো
যেন গাড়ি মুখ থুবড়ে পড়বে, কিন্তু দক্ষ ড্রাইভার রাজর্ষি
স্মুদলি সেই রাস্তাতেও চালিয়ে নিলো। আরোও অনেক কিছু দেখার বাকিই রইলো, পুরো দিন কেন, একটা গোটা রাতও বুঝি কম পড়ে যাবে,
অতএব যতটুকু পেলাম দেখতে তার রেশ নিয়েই রওনা দিলাম। অবশ্যই পরে
আবার কখনও এসে এক দু'দিন থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম সকলেই।
পরবর্তী ও শেষ গন্তব্য কর্ণিং গ্লাসমিউজিয়াম।
লেচওয়ার্থ পার্ক থেকে যেন চট করেই পৌঁছে গেলাম কর্ণিং গ্লাসমিউজিয়াম। এই
রাস্তাও খুবই সুন্দর। হলুদফুলে ঢাকা মাঠ, পাহাড় কখনও দূরে যায়, কখনও একেবারে
ধারে আসে। কোথাও হয়ত পরতে পরতে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। মিউজিয়ামটিও পাহাড় ঘেরা।
কাঁচ দিয়ে বানানো স্কাল্পচার, আরোও অনেক রকম মজার, শিক্ষনীয় সব প্রদর্শন দেখতে দেখতে, সময় হয়ে গেলো
কাঁচ দিয়ে কিভাবে ফুলদানি বা ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিস তৈরী হয়, তার নমুনা হাতে কলমে দেখবার। চোখের সামনে এক ভদ্রলোক তাঁর দু'জন সহকর্মীকে নিয়ে তৈরী করলেন ফুলদানি। সহকর্মীদের মধ্যে একজন আমাদের
বুঝিয়ে দিলেন কোনটা কিভাবে হয়, কেমন করে স্টিলের রডের
আগায় কিছু পরিমান গলানো কাঁচ নিয়ে সেটা গরম করে জিনিস বানানো হয়, সমানে কেন ওই রডকে ঘুরিয়ে যেতে থাকেন। চিটে গুড়ের মতো ওই কাঁচ দিয়ে
কেমন করে হ্যান্ডেল বানিয়ে ফুলদানির গায়ে লাগানো হয়, কেমন
করে রডের থেকে জিনিসটাকে সাবধানে বের করে ফ্রিজে ঠান্ডা করতে দেওয়া হয়। আর মহিলা
সহকর্মী বাকি সব কাজে সাহায্য করলেন, রড গরম করে দেওয়া,
ফার্নেসের দরজা খুলে ধরা, হাতল বানানোর কাঁচ
গলিয়ে দেওয়া, যে উপাচারগুলি লাগবে না সেগুলিকে যথাস্থানে
ফিরিয়ে রাখা, ইত্যাদি।
দৌড়ে দৌড়ে আরও এগজ়িবিট দেখে দোকানে গেলাম মেমেন্টো কিনতে। এদেশে সব কিছুর
সাথেই গিফ্ট শপ থাকে। এমনকি ওই জঙ্গলের ভিতরেও ছিলো। সেখান থেকে ওই জায়গার নাম
লেখা কিছু কিনলে তো কথাই নেই, এমনকি ওখানকার স্পেশ্যালিটি কোনো জিনিস কিনলেও স্মৃতিচিহ্ন
হিসাবে থেকে যাবে।
এরপরের অংশ শুধুই ড্রাইভ করা, রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় অ্যাক্সিডেন্ট থাকায় জিপিএস অন্য
অন্য রাস্তা দিয়ে আনতে থাকল আমাদের। চলতে শুরু করে বুঝতে পেরেছিলাম যে বাজার করা
হবে না। সে যাক... এতো মজাদার ট্রিপের পর আর কোনো অসুবিধাই গায়ে লাগবে না। তখন
ঠিক ছিলো আমাদের বাসায় এসে সবাই মিলে সেদ্ধ ভাত খেয়ে তবে সৌমিতরা ফিরবে। কিন্তু
যতো সময় গেল বোঝা গেল সেটা সম্ভব হবে না। কাজেই নিউজার্সি ঢুকে নিউজার্সির
ওয়েলকাম সেন্টার থেকে গরম গরম পিৎজা কিনে খেতে খেতে বাড়ি।
কিছু নতুন অভিজ্ঞতা, কতো পুরোনো অভিজ্ঞতাকে নতুন করে পেলাম এবারের ট্রিপে। যেমন,
জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, যে যন্ত্র
কিনা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে কোনো জায়গায় যাবার পথ বাতলায়, তার ওপর ভরসা করে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। সাধারণত জিপিএস থাকলে তার ওপর পূর্ণ
আস্থা রেখেই চালানো হয়, কোথাও রাস্তা ভুল করলে, এগজ়িট মিস করলে কোনো সমস্যা হয় না। নিউ বৃন্দাবন পৌঁছে পরে শুনলাম,
অনেকের নাকি নদীর জলে নাকানি চোবানি হয়েছে। গাড়ির চাকা ডুবে যায়
এমন জল ছিলো তাঁদের বেলায়, স্রোতের মধ্যে ফুট দু'য়েক চওড়া দূরত্ব হলেও চালানো কঠিন হয়েছে, আর তাই
মন্দির কর্তৃপক্ষ মানা করে দিয়েছেন ওই পথ ধরতে। তবে, অঘটন
না ঘটায় সারাজীবন মনে রাখার মতো অ্যাডভেঞ্চারাস অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হলো বৈকি! আবার
ফেরার পথে বিভিন্ন রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো ফলে ট্রাফিক জ্যাম হচ্ছিল, জিপিএস সেটা বুঝে আগে থাকতেই আমাদের অন্য রাস্তা দিয়ে নিরাপদে কম সময়ে
নিয়ে এসেছে। এই সিস্টেম এখন লংড্রাইভে অপরিহার্য, যা কিনা
কয়েক বছর আগেও আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না।
এবারের ট্রিপে দুটো বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও আমরা তেমন কোনো সমস্যায় পড়িনি, বাচ্চারা অসম্ভব সহযোগীতা করেছে।
বিশেষ করে সৃজনী, সে তো বড্ডই ছোটো, তাও
তেমন বায়নাক্কা ওদের কারোরই ছিলো না। বড়দের সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরেছে ওরা। অনেক
বছর পর আমরা এমন ইচ্ছে মতো, প্রায় বিনা প্ল্যানে বেড়াতে
বের হলাম, যেমন যেতাম বিয়ের পরে পরেই। আমাদের সে সময়ের
সঙ্গী দেবাশিষ ভৌমিকদাকে খুব মিস করছিলাম, তিনি আর ইহজগতে
নেই, তাঁর গল্প পরে কখনও বলব।
প্রচুর বাঙালি পরিবার দেখলাম মন্দিরে, নায়াগ্রায় তো বটেই এমনকি হোটেলে, লেচওয়ার্থ
পার্কে বা কর্ণিং গ্লাসমিউজিয়ামেও; বেশ মজা লাগছিলো যেখানে
সেখানে বাংলা কথা শুনতে। একটু খারাপও লাগছিলো বাঙালিদের স্বভাবসিদ্ধ চেঁচিয়ে কথা
বলা ইত্যাদি আচরণে।
লাস্ট সীটে বসার দরুন ইচ্ছে থাকলেও বহু সময়েই আমার ক্যামেরার সদব্যবহার করতে
পারিনি, পুরো ট্রিপে
এটুকুই আমার দুঃখ রইল।
ভীষণ উপভোগ করলাম সুলিখিত এই ভ্রমণ কাহিনীটা !!
ReplyDelete