1

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

ষষ্ঠ পর্ব



অন্তহীন কাল ধরে কালচক্র ঘুরে চলেছে তার নির্দিষ্ট নিয়মে। জন্ম-মৃত্যু, হর্ষ-বিষাদ, সৃষ্টি-লয়, মিলন-বিরহ কোন কিছুতেই তার অবিরাম গতির এতটুকু ছন্দপতন হয় না। মুহূর্তকাল পরে কি ঘটবে তা সর্বদাই অবিদিত। অনাদি-অনন্ত মহাকাল নির্মোহ হয়েও চির-বহমান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। 

স্থান্বীশ্বরের রাজপুরীর নহবতে বাজেনি প্রহরজ্ঞাপক শানাই-মৃদঙ্গের ঐকতান ধ্বনি, রাজপুরীর প্রতিটি দাসদাসীর শঙ্কিত পদসঞ্চারে অস্বাভাবিক নীরবতা। বহুগুণীসমৃদ্ধ ঐশ্বর্যমণ্ডিত রাজসভাগৃহের প্রতিটি দ্বারে নিশ্ছিদ্র প্রহরা। কোন অমাত্য বা সভাসদের আজ সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। 

সভাকক্ষসংলগ্ন অস্তিকাগারের রাজাসনে যুবরাজকুমার রাজ্যবর্ধন দুই করতলে ললাট স্থাপন করে বিমর্ষচিত্তে বিষাদ-স্খলিত অবস্থায় অধ্যাসীন। কোথায় তাঁর সেই যৌবনতেজোদৃপ্ত ভঙ্গী! সেই হূণত্রাস পরাক্রমী কন্ঠস্বর! অবিশ্রান্ত অশ্রুপাতে তাঁর আকর্ণবিস্তৃত লোচনদ্বয় রক্তজবারাগ, সুগভীর বিষাদে ক্ষণে ক্ষণেই কুমারের কন্ঠ থেকে নির্গত হচ্ছে হতাশার ধ্বনি। রাজভ্রাতা কুমার হর্ষবর্ধন আনায়-মাঝে পতিত হর্ষক্ষের মতই ক্রোধে, ক্ষোভে কক্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অস্থিরভাবে পাদচারণা করছেন। স্থৈর্যের প্রতিমূর্তি মহামন্ত্রী ভণ্ডির প্রশস্ত ললাটে চিন্তার বলিরেখা, প্রবীণ সেনানায়ক সিংহনাদের বিশাল মুখমণ্ডল ও চক্ষুদ্বয় প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ন্যায়।

আজ প্রত্যুষেই কনৌজ থেকে ভগ্নী রাজ্যশ্রীর প্রিয় ভৃত্য সংবাদক কোনওক্রমে গোপনে রাজধানী পরিত্যাগ করে অবিরাম দৌড়ে স্থান্বীশ্বরে এসে পৌঁছেছে সাহায্যের আশায়। সেই ভগ্নদূত এক নিদারুণ দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। সংবাদক রাজসমীপে আনীত হলে সে অবনত মস্তকে দ্বারের একপাশে দঁড়িয়ে অবিরত অশ্রুপাত করতে করতে মালবরাজ কর্তৃক কনৌজ আক্রমণ ও অধিগ্রহণের যে ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়েছে, তা উপস্থিত সকলকেই মর্মাহত ও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।

সপ্তাহকাল আগে মালবরাজ দেবগুপ্ত হঠাৎই নিশীথ-শ্বাপদের মতন রাত্রির অন্ধকারে কনৌজ আক্রমণ করে কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে নিরস্ত্র অবস্থায় নির্মম ভাবে হত্যা করে রাজ্য দখল করেছেন, আর মহারাণী রাজ্যশ্রীকে কোনও গোপন কারাগারে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।

ভণ্ডিদেব কেবল রাজ্যের মহামন্ত্রীই নন, তিনি পুষ্পভূতি বংশের দুই রাজকুমারের মাতুল-পুত্র এবং প্রিয় বয়স্যও বটে। রাজ্যশ্রী তাঁরও অত্যন্ত স্নেহের ভগ্নী। তিনি রাজ্যবর্ধনকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন এই বেদনার কোন সান্ত্বনা নেই। ভণ্ডিই প্রথম নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘‘এখন আর বিলাপে কালহরণ করার সময় নেই, রাজন। আমাদের অতি প্রিয় ভগ্নীস্বামী কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে ওই রাজকুলকলঙ্ক রণনীতি অগ্রাহ্য করে অপ্রস্তুত অবস্থায় হত্যা করেছে, আর দেবীপ্রতিমা ভগ্নীকে কোন এক গোপন কারাগারে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। সম্ভবত দুর্মতি মালবরাজের পরের লক্ষ্য স্থান্বীশ্বর গ্রাস করা। এখন আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রিয়স্বসাকে উদ্ধার ও সেই সঙ্গে ওই পররাজ্যলোভী দুরাচারীর অন্যায়ের প্রতিবিধান করাই আমাদের আশুকর্তব্য। মহান মণ্ডলেশ্বর প্রভুর স্বর্গলোকে প্রয়াণের পর আপনিই এখন আমাদের ধারক ও পালক, আপনি আমাদের আজ্ঞা দিন রাজন।’’

রাজ্য-হর্ষর পিতার মিত্র সেনাপতি সিংহনাদ উঠে দাঁড়ালেন। কুরু সেনাপতি অজেয় মহাবীর ভীষ্মের মতই বীরত্বব্যঞ্জক প্রাচীন অবয়বে শুভ্র শ্মশ্রু-গুম্ফের চামর, বিশাল কবাট-বক্ষে শতেক যুদ্ধের অস্ত্রাঘাতের ব্রণাঙ্ক। সিংহনাদ সিংহনিনাদে বললেন, ‘‘হে পুষ্পভূতিকুমার, আমার এই জীবন পুষ্পভূতি বংশের শৌর্য-সম্মান রক্ষার জন্য উৎসর্গীকৃত, আর তোমরা দুই ভাই আমার এই দুই বাহুর সমান প্রিয়। তুমি তারুণ্যের তেজস্বীতার প্রতীক, বিপুল তোমার প্রজ্ঞা, তুমি নিশ্চয়ই জানো ---

উদ্যমং সাহসং ধৈর্যম্ বুদ্ধিঃ শক্তিঃ পরাক্রমঃ
ষড়তে যত্র বর্তন্তে তত্র দেবঃ সহায়কৃৎ।।

(উদ্যম, সাহস, ধৈর্য, বুদ্ধি, শক্তি এবং পরাক্রম --- এই ছয়টি যেখানে থাকে সেখানে দেবতা সহায়তা করেন।)

যে পথ তোমার পিতা-পিতামহ অনুসরণ করে খ্যাতকীর্তি হয়েছেন, তুমিও সেই স্পৃহণীয় পথ অবলম্বন করে যশঃলক্ষ্মীকে বরণ করো। ধীমান ও শক্তিমান পুরুষ কখনো শোক করে না, যৌবনদৃপ্ত কেশরীর মতন সেই ধূর্ত, ভীরু শৃগাল-সদৃশ শত্রুর উপর সদম্ভে উল্লম্ফন করো; দেবেন্দ্রর কুলিশের মতন তোমার অমোঘ শস্ত্রে পতন হোক তাদের রণদম্ভ। হে রাজন, বিলম্বে ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং শত্রুও শক্তিবৃদ্ধির অবকাশ পায়। সুতরাং উত্তিষ্ঠ, আপন ভূজবলে নিঃশত্রু করো এই আর্যাবর্ত।’’

অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের প্রবল শোকাবেগ সংহত হয়ে এক ভীষণ ক্রোধে সংহত হল। তাঁর জীবনে পরাজয়ের কালিমা লাগেনি আজও, অন্তরাত্মা বীর্যদীপ্ত নবযৌবনের অহংকারে বিদ্রোহ করে উঠল। দেবকুলোদ্ভব ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ পিতার ঔরসে ও বীরপ্রসবিনী জননীর গর্ভে যে তাঁর জন্ম! তার উপর পরম স্নেহের পুত্তলী ভগ্নী এখন চরম বিপদে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যেন শার্দূলের নিদ্রাভঙ্গ হল। অর্ধশয়ান থেকে উঠে বসলেন রাজ্য, বাম উরুর উপর লাফিয়ে উঠল তাঁর দক্ষিণ চরণ; সদ্য হূণ-সমরে আহত ক্ষতস্থানগুলি থেকে রুধিরধারা নির্গত হয়ে শোনিত-সিক্ত করল তার কুন্দশুভ্র অন্তরীয়ক; সমস্ত শরীর জুড়ে এক মহা ক্রোধ আর অলঙ্ঘ্য শপথের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর সুকুমার ব্রজকিশোর রূপ যেন মহাপ্রলয়ের ভয়ংকর-সুন্দর নটরাজ রূপে প্রতিভাত হল।

রাজ্যবর্ধন গাত্রোত্থান করে জীমূতমন্দ্রে বললেন, ‘‘হে তাত, আপনি যথার্থই জ্ঞানী ও বিচক্ষণ; আপনার ভাষণে আমার শোকাচ্ছন্ন মতি জাগ্রত হয়েছে। পরমপূজ্য পিতৃ-মাতৃদেবের আকস্মিক স্বর্গারোহণে আমি ভাই হর্ষের হাতে রাজ্যভার দিয়ে চীর-বল্কল ধারণ করে তপশ্চরণ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু সেই চিন্তা থেকে আমি সম্পূর্ণ নির্গত হয়ে এখনই যুদ্ধযাত্রা করতে চাই, প্রলয় আনবো আমি মালবরাজকুলে। মহামন্ত্রী ভণ্ডি, তুমি যত শীঘ্র সম্ভব আমার শত্রুজয়ী অযুত অশ্বসৈন্যের বাহিনীকে আসন্ন মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করো। এই যুদ্ধে তুমি আমার সঙ্গী হবে। আর আয়ুষ্মন হর্ষ, এই রাজ্য, রাজধানী, রাজকুল, বান্ধব-পরিজন, ও আমাদের ভূজপরিঘে যারা লালিত-পালিত --- এই সব কিছুই আমি তোমার হাতে সমর্পণ করে যাচ্ছি। সৈন্যাধ্যক্ষ তাত সিংহনাদ থাকবেন তোমার ও রাজধানী রক্ষার গুরুদায়িত্বে। মালবের কৃপাণ আমার প্রিয়জনের রক্তে নিবারণ করেছে রাজ্যতৃষ্ণা, পুষ্পভূতি বংশের মর্যাদাকে আঘাত করেছে, --- বাস্তবিকই এ এক নির্মম আঘাত; প্রতিবিধিৎসার এক ভীষণ ক্রোধ আজ আমাকে চালিত করবে। ধ্বনিত হোক প্রয়াণ-পটহ।’’

রাজ্যবর্ধনের ঘোষণা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কুমার হর্ষদেব। একেই তো ভগ্নীপতির নিষ্ঠুর হত্যা ও প্রাণপ্রতিমা ভগ্নীর দুর্দশার সংবাদে ক্রোধে, বেদনায় মন অশান্ত; তার উপর জ্যেষ্ঠভ্রাতার এমন আদেশে হর্ষদেব ম্রিয়মান হয়ে পড়লেন। দাদার পাশে এসে করজোড়ে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলতে লাগলেন, ‘‘আর্য, কি এমন দোষ করেছি আমি যে কুলসম্মান রক্ষার এই যুদ্ধে আপনার সঙ্গলাভ থেকে বঞ্চিত হবো? যদি আপনি এখনও আমাকে বালক এবং রক্ষণীয় ভাবেন, তাহলে আপনার অপরিমেয় শক্তিসম্পন্ন ভূজপঞ্জরই তো রয়েছে রক্ষা করার জন্য। যদি মনে করেন আমি শত্রুর সমকক্ষ হতে সক্ষম নই, তাহলে বলবো, পরীক্ষিত হলাম কোথায়? যদি ভাবেন, পথশ্রম ও যুদ্ধের ক্লেশ আমি সহ্য করতে অপারগ, তাহলে বুঝব, আমি আপনার মতন পুরুষসিংহের ভাই হবার অনুপযুক্ত। আমি তো কখনও আপনার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হইনি! প্রসন্ন হোন দেব, আমাকেও আপনার সঙ্গে যাবার অধিকার দিয়ে কৃতার্থ করুন...’’ বলতে বলতে অগ্রজের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়লেন হর্ষ।

অনুজকে ক্ষিতিতল থেকে সস্নেহে উত্থাপিত করে পাশে বসিয়ে রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘‘ভাই, মালবরাজের মতন হীনচেতা, তুচ্ছ একজন শত্রুর বিরুদ্ধে যদি বিরাট এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে অভিযান করা হয়, তাতে শত্রুর গর্ব-গরিমাই বৃদ্ধি পায় না কি! একটা শশককে ধরার জন্য যদি একপাল সিংহ পশ্চাদ্ধাবন করে, সেটা কি লজ্জাকর ব্যাপার নয়! তা ছাড়া অদূর ভবিষ্যতে তোমার বিক্রম প্রকাশের জন্য তো এই অষ্টাদশ-দ্বীপ-কঙ্কণমালিনী বসুধাই পড়ে রইল। যুগপুরুষ মান্ধাতার মতন দ্বিগ্বিজয়ের জন্য তুমি শত্রুজয়ী অজেয় কার্মুক গ্রহণ করবে; আমার বিশ্বাস একদিন তা পৃথ্বীপতিদের মাঝে দুর্নিবার ধূমকেতুর মতই প্রতীয়মান হবে। আমার অন্তরাত্মা আজ ক্ষোভে, ক্রোধে এক ভীষণ শত্রুঘ্নী ক্ষুধায় দুর্নিবার হয়ে উঠেছে, তার ক্রুদ্ধ গ্রাসটি একান্তই আমার, আমাকে সেটি নিতে দাও ভাই; অগণিত ভ্রাতৃসম প্রজাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে রাজধর্ম পালন করো তুমি।’’

মহামন্ত্রী ভণ্ডির পরিচালনায় অনতিবিলম্বে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অযুত দ্রুতগামী অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনী প্রস্তুত হল, স্কন্ধাবার নির্মানকারীরা উট ও খচ্চরের পৃষ্ঠে ইতিমধ্যেই যাত্রা করেছে; অধিরাজ রাজ্যবর্ধন স্বয়ং সৈন্যাধক্ষের ভূমিকায়।

একদা আর্যাবর্ত তথা উত্তরাপথের অন্যতম ঐশ্বর্যময় ও সমৃদ্ধশালী রাজ্য কান্যকুব্জ এখন যেন এক শ্মশান-নগরী। রাজপথে মানুষ নেই, বানিজ্য-চবুতরের বিপণিগুলির বেশিরভাগই ঝাঁপ খোলা, সেগুলি মালবের সৈন্যদের হাতে যথেচ্ছভাবে লুন্ঠিত হয়েছে। স্থানে স্থানে দগ্ধ জনবস্তি থেকে এখনও কুণ্ডলি আকারে ধুম্রের উদ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যত্রতত্র যুবা-বৃদ্ধ-শিশু-নারী নির্বিশেষে মৃতদেহ পড়ে আছে; হয়তো গৃহস্থে্রা নিজেদের সম্পদ ও সম্মান রক্ষার তাগিদে শত্রু-সৈন্যের কাছে সহজে আত্মসমর্পণ করতে চায়নি, তাদের প্রতিহত করতে গিয়েই দলে দলে মৃত্যুবরণ করেছে। যারা প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে, তারা নগরীর মধ্যেই কোথাও আত্মগোপন করে আছে সুদিনের প্রতীক্ষায়, অথবা চরম দুঃখ নিয়ে পরিত্যাগ করে গিয়েছে আপন জন্মভূমি। কনৌজের পথে ঘাট এখন শুধু মৃতজীবি গৃধ্র, শৃগাল, কুক্কুরের অবাধ বিচরণভূমি। তাদের তীক্ষ্ণ কর্কশধ্বনি একদা জনাকীর্ন নগরীর নিস্তব্ধতা আরও ভয়াবহ করে তুলছে।

প্রায় বিনা আয়াসে কনৌজ দখল করার পর মালবের সৈন্যবাহিনী রাজধানী-নগরীর সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের হত্যা বা বিতাড়িত করে তাদের সম্পদপূর্ণ গৃহগুলি করায়ত্ত করে নিজেদের বাসস্থানে পরিণত করেছে। যে সব নাগরিক বেঁচে আছে, তারা দাস-দাসীর মতন সৈনিকদের সেবা–পরিচর্যা করতে বাধ্য হচ্ছে; রূপবতী কিশোরী ও যুবতীদের নিজেদের ভোগ-লালসা চরিতার্থ করতে হত্যা না করে বন্দিনী করে রেখেছে। মাঝে মাঝে গৃহগুলির উন্মুক্ত গবাক্ষপথে সৈনিকদের নেশাতুর উল্লাসধ্বনির সঙ্গে সেই হতভাগিনীদের আর্তস্বর মিশে যাচ্ছে শত্রু-কবলিত কান্যকুব্জের বিস্তীর্ণ জনপদে।

স্থান্বীশ্বরের দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে কান্যকুব্জ থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে একটি অটবী-অধ্যুষিত নাতিউচ্চ পর্বত-সানুদেশে এসে থামল। শীতকালের অপরাহ্ণ দ্রুত শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে, সামনে দীর্ঘ হিমেল রাত্রি। পথশ্রমে ও উত্তরাপথের তীব্র শীতে সৈনিক ও তাদের বাহন উভয়েই যথেষ্ট অবসন্ন, তাদের কিঞ্চিৎ বিশ্রামের প্রয়োজন। তাছাড়া যুদ্ধের আগে শত্রুর বলাবল ও অবস্থান জানা অত্যন্ত আবশ্যক বিবেচনা করে কুমার রাজ্যবর্ধন মিত্র-অমাত্য ভণ্ডির সঙ্গে পরামর্শ করে সেখানেই শিবির সংস্থাপনের নির্দেশ দিলেন।

ছোট ছোট কয়েকটি টিলা ও সেগুলির মাঝে মাঝে বেশ কিছুটা করে মালভূমি অঞ্চল, নীচে ছোট-বড় গাছের অগভীর অরণ্যানী। ভণ্ডির নির্দেশে অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের জন্য টিলার বেশ কিছুটা উপরে একটি প্রশস্ত মালভূমিতে স্কন্ধাবার নির্মিত হয়েছে, তার শীর্ষদেশে পুষ্পভূতি বংশের ভগবান ভাস্কর-লাঞ্ছিত গৌরবময় নিশান উড্ডীন। সেখানে মাত্র দুই সহস্র সেনা রেখে বাকি বাহিনীকে তুরঙ্গ-নায়েক কুন্তলের দায়িত্বে পর্বতের নীচে ছোট ছোট টিলা ও বনান্তরালে গুপ্ত সেনানিবাসে রাখা হয়েছে।

মহামন্ত্রী ভণ্ডি ও কুমারের চির-রণসঙ্গী বৃহদশ্ববার কুন্তলের সঙ্গে সব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অধিরাজ রাজ্যবর্ধন সন্তুষ্ট চিত্তে স্কন্ধাবারের রাজ-পটাবাসে যুদ্ধকালীন অধিবেশনে বসলেন। সকলে আসন গ্রহণ করলে ভণ্ডি বললেন, ‘‘হে রাজন, কান্যকুব্জ থেকে মালবের রাজধানী অবন্তিকা বহুদূরে। এত দূর থেকে কনৌজ আক্রমণ করতে মালবরাজ দেবগুপ্ত নিশ্চয়ই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেননি, কনৌজ অধিকারের পরিকল্পনাও নিশ্চয়ই দীর্ঘদিন ধরে করা হয়েছিলো।’’ 

‘‘তোমার এমন অনুমানের কারণ?’’

‘‘দেব, সংবাদকের মুখে শুনে বুঝেছি, কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির অন্ধকারে যে ভাবে মালবরাজ দেবগুপ্ত কনৌজ অধিকার করেছেন, তা কূটঘাত ছাড়া কিছু নয়, আর এই যুদ্ধে রাজপুরীর রক্ষকদেরও অবশ্যই উৎকোচে বশীভূত করা হয়েছিলো। ঘরশত্রুর সহায়তা ছাড়া কূটঘাত কখনওই সম্ভব নয়। আপনি তো জানেন, যে কোনও রাজ্যজয়ের জন্য উপযুক্ত চতুরঙ্গ বাহিনী নিয়ে অভিযান করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি, মনে হচ্ছে ছদ্মবেশী পদাতিক সৈন্য দিয়েই ওরা কার্যোদ্ধার করেছে। সংবাদকও কনৌজ নগরীতে বিরাট কোন অশ্ব-গজবাহিনী দেখেছে বলেনি। সম্ভবত তারা প্রথমে রাজপুরী ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি এবং অমাত্য, সেনানায়কদের বাসভবন করায়ত্ত করে, তারপরে সম্পূর্ণ নগরী।’’

‘‘তোমার অনুমান যথার্থ বলেই মনে হচ্ছে।’’ রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘‘এখন তোমার পরিকল্পনা কি খুলে বলো মিত্র, আমি তো এখনি শত্রুর উপর ক্ষুধার্ত শার্দূলের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাই, আমার আর বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না।’’

‘‘ধীরে বন্ধু, ধীরে।’’ মহামাত্য শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘‘পূর্ব নিশ্চিত্য পশ্চাৎ কার্যমারভেৎ। কার্য পুরুষকারেণ লক্ষয়ং সম্পদ্যতে। কালবিৎ কার্যং সাধয়েৎ।(আগে নিশ্চিত হয়ে তারপর কাজ করা উচিত, এবং নিশ্চিত করে নিলে কার্য পূর্ণ হয়ে ওঠে আর সময়ের গুরুত্ব বোঝা ব্যক্তি নিশ্চিত রূপে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে পারেন।) এখন আপনি আমার পরিকল্পনা শুনুন।’’

এরপর মহামাত্য ভণ্ডি তাঁর স্বভাবসুলব ধীর, গম্ভীর স্বরে সুনির্দিষ্ট রণকৌশল ব্যক্ত করলেন। ‘‘আজ রাত্রেই আমাদের গুপ্তচর সংবাদক কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কনৌজে প্রবেশ করে কৌশলে মালব-সেনানীদের জানাবে যে, স্থান্বীশ্বর-রাজ রাজ্যবর্ধন ভগ্নীপতির রাজ্য আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ শুনে হূণ-যুদ্ধ অসম্পূর্ণ রেখে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ছুটে এসেছেন। তিনি ও তাঁর পরিশ্রান্ত সৈন্যরা কনৌজের বাইরে বিশ্রামরত। সম্ভবত আগামী কাল দ্বিপ্রহরে স্থান্বীশ্বরের সৈন্যবাহিনী কনৌজ আক্রমণ করে মালব-বাহিনীকে উৎখাত করে মৌখরী-রাজ্য পুনর্দখল করার চেষ্টা করবে। ভগ্নী রাজ্যশ্রীর প্রিয় ভৃত্য সংবাদক এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে। এই বুদ্ধিমান যুবকটি দ্রুতগামী, অক্লান্ত ও বিশ্বস্ত, সে কনৌজবাসী হওয়ায় নগরী এবং রাজপুরীর সমস্ত অন্ধিসন্ধির বিষয়ে বিশেষভাবে অভিজ্ঞাত। সে সহজেই মালব-সৈনিকদের বিশ্বাসভাজন হতে পারবে।’’

‘‘সে কি! যুদ্ধের আগেই আমরা আমাদের অবস্থান ও সামর্থ শত্রুপক্ষকে জানিয়ে দেবো?’’ কুন্তল বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘‘এতো আত্মহননেরই নামান্তর!’’

রাজ্যবর্ধনেরও মনে একই প্রশ্ন উত্থিত হলো।

‘‘ঠিক তাই, কুন্তল।’’ ভণ্ডির বুদ্ধিদীপ্ত চোখে কৌতুকের আভা, ‘‘আমি এই মালভূমির উপরে অবস্থিত মাত্র দুই সহস্র সৈন্যের কথা বলেছি, পর্বত-অন্তরালের তোমার অধীনস্থ অষ্ট সহস্র অশ্বারোহী সৈনিকদের কথা কিন্তু বলিনি। ওরা এই সংবাদ পেয়ে নিশ্চিত ভাবে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমস্ত বাহিনী নিয়ে নগরীর বাইরে বেরিয়ে আসবে, আর আমি ঠিক সেটাই চাই। কারণ, নগরীর ভিতরে যুদ্ধ হলে ওরা অসহায় নাগরিকদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে আত্মরক্ষার প্রয়াস পাবে, আর অকারণে বহু নিরাপরাধ মানুষের প্রাণক্ষয় হবে; তা ছাড়া, নগর-প্রান্তের উন্মুক্ত পরিবেশে আমরা সহজেই ওদের শক্তির পরিমাপ করতে পারবো।’’

প্রিয় অমাত্যের চাতুর্য ও যুক্তিপূর্ণ কথায় রাজ্যবর্ধন চমৎকৃত হলেন। ভণ্ডি বলে চললেন, ‘‘হে দেব, আমি অনেক ভেবে-চিন্তেই এই মালভূমির উপরে মূল শিবির সংস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছি। ভেবে দেখুন, কয়েক ক্রোশ দূর থেকে এই মালভুমির উপরে আমদের স্কন্ধাবার, বিশেষ করে সুউচ্চ দণ্ডের শীর্ষে উড্ডীয়মান সূর্য-প্রতীক ধ্বজা সহজেই ওদের দৃষ্টিগোচর হবে, আর তা দেখে ওরা আমাদের এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে জয় করতে পূর্ণ উদ্যমে ছুটে আসবে। এবং, এই টিলার কাছে পৌঁছানোর আগেই কুন্তলের অশ্বারোহী বাহিনী টিলার নীচের বনান্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে তিন দিক থেকে ওদের ঘিরে ফেলবে। ইত্যাবসরে কুমার ও আমি এই দুই সহস্র অশ্বারোহী নিয়ে মালভূমি পরিত্যাগ করে গঙ্গা-যমুনার দোয়াবের পথ দিয়ে ঘুরে কনৌজে প্রবেশ করে অধিকার করে নেবো। কুন্তলের তুরঙ্গসেনা এই প্রান্তরে সহজেই মালব বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস; তারপর অর্ধেক সৈন্য নগরীর তোরণদ্বার গুলি রক্ষার জন্য রেখে বাকিদের নিয়ে যোগ দেবে আমাদের সঙ্গে।’’

‘‘অত্যন্ত বিচক্ষণ পরিকল্পনা তোমার ভণ্ডি!’’ রাজ্যবর্ধন সোৎসাহে বললেন, ‘‘তুমি এখনই সংবাদককে উপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে কনৌজে প্রেরণ করো, আর কুন্তল,তুমি তুরঙ্গ-নায়কদের আমাদের রণকৌশল বুঝিয়ে দাও।’’

পরদিন মহামাত্য ভণ্ডির পরিকল্পনা অনুসারে পরবর্তী ঘটনাগুলি পরপর পটচিত্রের মতন সংঘটিত হতে লাগলো। আগের রাত্রেই সংবাদক ও তার সঙ্গীরা যথাযথ ভাবেই তাদের কার্য সমাধা করেছে। দিনের প্রথম প্রহরে কিঞ্চিদধিক তিন সহস্র মালব-অনীকিনী কান্যকুব্জ নগরী থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের বেশিরভাগই পদাতিক সৈন্য, সঙ্গে অল্প সংখ্যক কনৌজের গজ ও অশ্বারোহী সেনা। পর্বত সানুদেশে পৌঁছানোর আগেই কুন্তলের পরিচালনায় তুরগারোহী সৈন্যদল তাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললো। মাত্র দুই দণ্ডের মধ্যেই স্থান্বীশ্বরের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে তারা সম্পূর্ণ পরাস্ত হলো।

যুদ্ধ চলাকালীনই রাজ্যবর্ধন ভণ্ডির সমভিব্যাহারে কালবৈশাখীর ঝটিকার ন্যায় দুই সহস্র রণদুর্মদ তুরঙ্গসৈন্য নিয়ে কান্যকুব্জের পশ্চিমে গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চল ধরে রাজধানী-নগরীতে প্রবেশ করলেন।

কনৌজ নগরী জুড়ে অসংলগ্নভাবে ছড়িয়ে থাকা মালবের পদাতিক সৈনিকরা তাঁর দুরন্ত গতিকে বাধা দিতে অপারগ বুঝে বেশিরভাগই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করলো; সামনে যারা পড়লো, তারা অনতিবিলম্বে শমন-সদনে প্রেরিত হল। রাজ্যবর্ধন প্রথমেই কনৌজের মন্ত্রী, সেনাপতি প্রভৃতি রাজপুরুষদের গৃহবন্দীদশা থেকে মুক্ত করে বীরদর্পে রাজপুরীর দিকে অগ্রসর হলেন।

মালবরাজ দেবগুপ্ত তখনও তাঁর চিরাভ্যাস মত সুরাপান ও কনৌজের কয়েকজন সদ্যযুবতী সুন্দরী বন্দিনীর কুমারীত্বহরণের আনন্দ উপভোগ করতে ব্যস্ত। আর যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে তিনি তো একরকম নিশ্চিত! আর হবেন নাই বা কেন! গুপ্তচরের দেওয়া সংবাদে জেনেছেন, স্থান্বীশ্বরের এক অষ্টাদশবর্ষীয় সমর-অনভিজ্ঞ বালক রাজকুমার মাত্র কয়েকশত ঘোড়সওয়ার নিয়ে কনৌজ পুনরুদ্ধার করতে এসেছে। তাঁর রণনিপুণ সৈন্যার্ণবের কাছে তা নিতান্তই সাগরের সম্মুখে গোষ্পদতুল্য! দেবগুপ্ত নগর রক্ষার জন্য মাত্র এক সহস্র সৈনিককে রেখে বাকি সৈন্যদের পাঠিয়ে দিয়েছেন স্থান্বীশ্বরের আক্রমণ প্রতিহত করতে। মাত্র ক’ দিন আগেই অতি সহজেই স্বর্ণপ্রসবিনী কান্যকুব্জ তাঁর অধিকৃত হয়েছে। একদিকে মালব, অন্যদিকে কান্যকুব্জ --- আর্যাবর্তের দুটি সমৃদ্ধিশালী রাজ্য এখন তাঁর করায়ত্ত, এরপর চাই স্থান্বীশ্বর। আর্যাবর্তের সম্রাটের সিংহাসন আর খুব বেশি দূরে নেই! সেই সুখস্বপ্নে তিনি বিভোর। শুধু একটাই আক্ষেপ, কান্যকুব্জের পরমাসুন্দরী রাণীকে এখনও তিনি নিজের অঙ্কশায়িনী করতে পারেননি। বিশ্বাসী ভৃত্য দ্বারা পরিবেষ্টিত সেই বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত বন্দীগৃহটিতে কি করে যে আগুন লাগলো এখনও তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না। সেই রাত্রে যে একটু বেশিই মদিরাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি; কোন রকমে যে নিজের প্রাণরক্ষা করতে পেরেছেন সেটাই যথেষ্ট। কনৌজ-মহিষী আর কয়েকজন দাস-দাসীকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা জীবিত না সেই অগ্নিকাণ্ডে মৃত, তা কে জানে!

কান্যকুব্জের তোরণদ্বারের প্রতিহারীরা স্থ্বান্বীশ্বরের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত বা পলায়িত। উন্মুক্ত তোরণ অতিক্রম করে রাজ্যবর্ধন বীরপদভারে মেদিনী কম্পিত করে সসৈন্যে রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন। অকস্মাৎ চোখের সামনে অষ্টাদশবর্ষীয় এক লাবণ্যময় তরুণকে কালান্তক শমনের মত অনলপ্রভ মূর্তিতে কোষমুক্ত অসি হাতে দণ্ডায়মান দেখে নেশাতুর, স্খলিত-বেশ মালবরাজ প্রমাদ গুনলেন। আশেপাশে চেয়ে দেখলেন দেহরক্ষীরা কেউ নেই, তাঁর সাধের লীলাসঙ্গিনীরাও সুযোগ বুঝে অন্তর্হিত হয়েছে। দেবগুপ্ত বুঝলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন, তিনি অধিজানু হয়ে বারংবার নিজের প্রাণভিক্ষা করতে লাগলেন। মনে তাঁর ক্ষীণ আশা, মিত্র শশাঙ্ক হয়তো যথা সময়ে এসে তাঁর জীবন রক্ষা করবেন।

‘‘ওহে ক্ষত্রিয়কুলকলঙ্ক কাপুরুষ মালবাধিপ, এখন নিজের প্রাণভিক্ষা করতে তোমার লজ্জাবোধ হচ্ছে না?’’ রাজ্যবর্ধন জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘পররাজ্য লোভে রাত্রির অন্ধকারে নিশাচর উলূকের মতন কনৌজ নগরী ছারখার করে অসহায় গ্রহবর্মাকে হত্যা করতে তো তোমার ওই কলুষ হস্ত কম্পিত হয় নি! তোমার মতন পাতক এই ধরণীর ভার স্বরূপ, তোমাকে ক্ষমা করাও মহাপাপ।’’ বলতে বলতে রাজ্যবর্ধন মহাক্রোধে তাঁর তীক্ষ্ণধার অসি উত্তোলন করেও নামিয়ে নিলেন।

এরপর মহামাত্য ভণ্ডি নানাভাবে রাজ্যশ্রীর সংবাদ জানার চেষ্টা করে বিফল হয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘‘হে অধিরাজ, জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে গিয়েছেন, ঋণ, অগ্নি, ব্যাধি আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই, এখনই হত্যা করুন ক্ষমার অযোগ্য এই পাষণ্ডকে।’’

‘‘না মিত্র, আমি পুষ্পভূতি বংশের গৌরব মহাবীর প্রভাকরবর্ধনের পুত্র হয়ে নিরস্ত্র শত্রুর প্রাণনাশ করতে পারবো না, তা সে যত বড় পাতকীই হোক না কেন! একে শৃঙ্খলিত করে অন্ধকূপ কারাগারে নিক্ষেপ করো। যথা সময়ে এর বিচার হবে।’’

ভগ্নীপতি গ্রহবর্মার হত্যাকারী মালবরাজকে কনৌজের কারাগারে নিক্ষেপ করে রাজ্যবর্ধনের বিক্ষুব্ধ চিত্ত কিছুটা শান্ত হয়েছে। শত্রুপক্ষের যারা বাধা দেবার চেষ্টা করেছে, তাদের তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ড দিতে স্থান্বীশ্বর-সৈনিকরা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি। বাকিরা বন্দী দশা প্রাপ্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে কুন্তল মালব-বাহিনীকে পরাজিত করে রাজধানীতে চলে এসেছেন। রাজ্যবর্ধনের আদেশে রাজ্যশ্রীর সন্ধান করতে কুন্তলের অধীনস্থ সৈনিকরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু নগরী ও তার আশপাশের সমস্ত স্থান তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁর কোনও সন্ধান পাওয়া গেলো না।

যুদ্ধে জয় লাভ করার পর রাজ্যবর্ধন আর এক মুহূর্ত কনৌজের রাজপুরীতে থাকতে চাইলেন না। একদা যে রাজনিকেতন স্নেহের ভগ্নী রাজ্যশ্রী ও তাঁর পতি মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার সুখের সুরম্য নিবাস ছিলো, যা সতত সুখ ও আনন্দময় বৈজয়ন্তীধাম সদৃশ সম্পদ-প্রাচুর্যে ভরা ছিলো, তা এখন যেন এক প্রেতপুরীতে পর্যবসিত হয়েছে। পবিত্র গৃহমন্দির এখন এক রক্তপিপাসু লম্পট দানবের বিলাসকুঞ্জে পরিণত হয়েছে, সমস্ত মহল জুড়ে তার সহগামীরাও পুষ্পকুঞ্জে হিংস্র শ্বাপদের মতন বিচরণ করেছে।

কুমারকে চিন্তান্বিত দেখে পার্শ্বচর ভণ্ডি বললেন, ‘‘হে অধিরাজ, রণশাস্ত্র অনুসারে শত্রুর বিজিত রাজ্য পুনরাধিকার করে সেখানেই কিছুকাল যাপন করাই বিধেয়, অন্যথায় তা আবার পরহস্তগত হতে পারে বা শত্রুপক্ষ অন্য পথে আঘাত হেনে প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে পারে। তাছাড়া শত্রু-মুক্ত রাজ্যের রাজ-প্রতিনিধিদের উপযুক্ত কার্যভার অর্পণ করে প্রজাদের স্বাভাবিক নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে সহায়তা করারও বিশেষ প্রয়োজন।’’

‘‘তোমার কথার আমি সব সময়ই মর্যাদা দিই, মিত্র।’’ রাজ্যবর্ধন বিমর্ষমুখে বললেন, ‘‘কিন্ত তুমিই বলো, এই পুরীতেই প্রিয় গ্রহবর্মা গতায়ু হয়েছেন, এই ভবন থেকেই আমার একমাত্র ভগ্নী অপহৃতা হয়েছে, সে যে কোথায় কি অবস্থায় আছে, তার কোন সন্ধানও পেলাম না! আমার পরম প্রিয়জন-বিহীন এই মৃত্যুপুরীতে আমি কিভাবে রাত্রিযাপন করতে পারি? তোমার কথামতন আমি এই রাজভবন পরিত্যাগ করলেও এখনই স্থান্বীশ্বরে প্রত্যাগমন করবো না, নগরী-প্রান্তে মালভূমির সেই স্কন্ধাবারেই কিছুকাল অবস্থান করব, এবং সেখান থেকেই সমস্ত কর্তব্য-কর্ম নিরূপণ করব। তুমি সেই অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করো।’’

‘‘যথা আজ্ঞা দেব, আপনার আদেশ অবশ্যই পালিত হবে।’’



******



সংবাদকের দেওয়া সংবাদে একটি মাত্র ভুল ছিল। সে মালবরাজ দেবগুপ্তর দ্বারা কান্যকুব্জ অধিকারের সময় সন্ন্যাসীবেশী গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককে চিনতে বা তাঁর ভূমিকার কথা জানতে পারেনি। তাই স্থান্বীশ্বরের রাজপুরুষদের তাঁর কথা না বলায় কেউ তাঁর কথা জানতে পারেন নি। সুতরাং অভিযানে রণকৌশল ইত্যাদির পরিকল্পনার সময় শশাঙ্কর বিষয়ে কোনও চিন্তাই কেউ করেননি। সকলের অজান্তে ঈশান কোণের একটি অজানা মেঘ থেকে যে কি ভীষণ দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে পারে, তা ছিলো সবার কল্পনাতীত। --- (ক্রমশ প্রকাশ্য)



1 comment:

  1. দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় এবং দৃষ্টি জনিত সমস্যায় ভোগার ফলে এই ধারাবাহিক টির বেশ কয়েকটি পর্ব আমার অপঠিত থেকে গেছে ! কিন্তু, এটি পড়ে বুঝলাম যে আমি কি মিস করেছি !!

    ReplyDelete