0

প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রাচীন কথা



বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন
কৃষ্ণদেব রায়



বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মানুষের ধারণা ছিলো যে, ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটে বৈদিক যুগ থেকে। বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ এবং পুরাণ প্রভৃতিকে বলা হতো বৈদিক সাহিত্য। যদিও এই বৈদিক সাহিত্য শ্রুতি এবং স্মৃতির মাধ্যমে বংশপরম্পরায় বহুযুগ ধরে চলে এসেছে যতদিন না এটি লিপিবদ্ধ হয়। বৈদিক সাহিত্যের বৈচিত্র এবং বিশালতা এতটাই, যে কেবল মাত্র স্মৃতির সাহায্যে, কোনওও রকম লেখ্য নথি ছাড়াই বংশপরম্পরায় চলে এসেছে, এটা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টসাধ্য। অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতন অনেকটা! আরও বেশি করে এটা মনে হতো, কারণ সাধারণ ধারণা ছিলো যে আর্যরা বহিরাগত এবং পরিব্রাজক সম্প্রদায়। আচ্ছা ভাবুন তো, একদল লোক ক্রমাগত এদেশ থেকে ওদেশ হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে, হাজারও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে এমন একটা জায়গায় বা দেশে এসে পৌঁছেছে যেটা তাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত আর তারা নাকি এখানে এসেই অমন বিশাল একটা বৈচিত্র্যময় সাহিত্য রচনা করে ফেলল মাত্র এইটুকু সময়ে? নাকি এটা আগেই রচিত হয়েছিলো আর তারা ভবঘুরের মতন ঘুরতে ঘুরতে, হাজারও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে লড়তেও বংশপরম্পরায় তাদের সঙ্গেই তা রেখে দিয়েছিলো?

হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আবিষ্কৃত হলেও, ১৮৫০ সালেই প্রথম এ কানিংহাম তাঁর পাওয়া শিল্পদ্রব্যগুলির একটি তালিকা প্রকাশ করেন। কানিংহাম-এর ধারণায়, হরপ্পার শিলমোহরে যে বিশেষ ধরণের লিখন পদ্ধতি রয়েছে সেটি ‘নিশ্চিত রূপেই ভারতীয় নয়’। তাই একে তিনি ‘ভারতের ভিনদেশী’ একটি পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দয়ারাম সাহনি হরপ্পাতে একটি প্রণালীবদ্ধ খননকার্যের সূচনা করেন। তারপরে ১৯২১ সালে আর ডি ব্যানার্জি মহেঞ্জোদাড়োয় খননের কাজ শুরু করলেন। এবার আসুন, আমরা আস্তে আস্তে পরিচিত হই আমাদের প্রাচীনতম সভ্যতার সঙ্গে। আর হতবিহ্বল হয়ে যাই এর অচেনা রূপ দেখে।

সভ্যতা বা civilisation কথাটা এসেছে ল্যাটিন civitas বা ‘city’ থেকে। সুতরাং ধরেই নেওয়া যেতে পারে যে সভ্যতা কথাটির সঙ্গে শহরের একটা যোগাযোগ আছে। ১৯২০ সালে মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কারের পর থেকে সিন্ধ-এর মহেঞ্জোদাড়ো আর পাঞ্জাবের হরপ্পাকে ভারতের প্রাচীনতম শহর ও সভ্যতার আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রাচীন মানবের যে সব বসতির কথা আমরা সিন্ধু সভ্যতার আগে শুনেছি, সে সবই ছিলো কৃষি নির্ভর ও পশুপালনের জন্যে স্বল্পকালীন মেয়াদে গড়ে ওঠা কোনও শিবির বা গ্রাম। তাই শহর বা নগরের এই হঠাৎ উপস্থিতির কারণ কি? আর একটি শহর আর গ্রামের মধ্যে মূলগত কিছু পার্থক্য থাকে। প্রথম তফাৎটা হলো আয়তনের। সম্পূর্ণ রূপে কৃষি এবং পশুপালন ভিত্তিক কোনও গ্রাম আকারে সুবৃহৎ হয়না। যদি কোনও গ্রামে কৃষি ও পশুপালনের কাজে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কোনও কারণে বেড়ে যায়, তবে অনেক বাসিন্দাকেই মূল গ্রাম থেকে কোনও দূরবর্তী স্থানে গিয়ে চাষ আবাদ বা দূরের কোনও কোনও চারণ ক্ষেত্রে পশুদের নিয়ে যেতে হয়। এবং এর ফলে তাদের নতুন কৃষিক্ষেত্র বা চারণভূমির কাছাকাছি আর একটা নতুন গ্রাম গড়ে ওঠে।

কিন্তু একটি শহর গড়ে ওঠার পিছনে কিছু মৌলিক শর্ত আছে। সেগুলি ব্যতিরেকে কোনও শহর গড়ে উঠতে পারেনা। প্রথমত, অ-কৃষিজ, হস্তশিল্পীর সংখ্যার বেশ বাড়বাড়ন্ত হওয়া প্রয়োজন, যেটার জন্যে তাদের এক নতুন ক্রেতাসমষ্টি খুঁজতে হবে। এরাই সাধারণত কোনও শহরের প্রথম নাগরিক হয়। দ্বিতীয়ত, শহরে বসবাসকারী মানুষেরা নিজেদের জন্যে খাদ্যোৎপাদন করেনা। তারা গ্রামে উৎপন্ন খাদ্যের ওপরই নির্ভরশীল এবং হস্তশিল্প ছাড়াও অন্যান্য পরিষেবা দিতে পারদর্শী। এখন, এমন একটা পরিস্থিতি একমাত্র তখনই সৃষ্ট হতে পারে যখন কৃষক সমাজ তাদের প্রয়োজনের বেশ কিছুটা বাড়তি খাদ্য উৎপন্ন করতে পারে। কারণ, তাদের উৎপাদিত সেই বাড়তি ফসলই শহরে বসবাসকারী মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করবে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাছাকাছি কোনও শহর থাকলে এবং শস্যপরিবহন ব্যব্যস্থা থাকলে তবেই কৃষকেরা উৎসাহিত হবেন নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি ফসল উৎপাদন করতে শহরে বিক্রির জন্যে। কিন্তু, মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা শহর দুটি গড়ে ওঠার আগে কেনই বা একজন কৃষক তার প্রয়োজনের বাড়তি উৎপাদন করবেন? আর তা যদি না করেন, তাহলে কিসের ভরসাতেই বা একটা শহরের গোড়াপত্তন হয়?আবার অন্যদিকে, মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার নিকটস্থ এবং দূরবর্তী গ্রামগুলোতে নানা ধরণের অ-কৃষিজ হস্তশিল্প, নানা ধরণের উদ্ভাবন, যেমন মাকু ও তাঁত, কুম্ভকারের চাকা, তামাগলানোর কাজ, গোরুর গাড়ির চাকা, বাঁকা তুরপুন, পোড়ানো বা কাঁচা ইঁট তৈরি জাতীয় কাজে যুক্ত মানুষের সংখ্যা লক্ষনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেতে হবে। কারণ এরাই ভবিষ্যৎ শহরের ভবিষ্যৎ বাসিন্দা হবেন। এবং আয়তনে ছোটো, স্বল্প সংখ্যক গ্রামবাসীদের প্রয়োজনের তুলনায় এইসব জিনিসের উৎপাদন বেশি হতে হবে।

ফিরে যাই আবার প্রথম প্রশ্নে। একটা সমাজ কেন তার প্রয়োজনের চেয়ে বাড়তি ফসল উৎপাদন করবে সজ্ঞানে? আমার বাড়িতে রোজ চার জনের ভাত রান্না হয়। মাথা খারাপ না হলে কেন আমার গিন্নি একদিন সকালে উঠে কুড়ি জনের ভাত চাপাবেন? তাহলে সজ্ঞানে যেমন আমার গিন্নি চারজনের বদলে কুড়ি জনের ভাত রান্না করবেন না, একটা কৃষক সমাজও ঠিক সেই কারণেই তার প্রয়োজনাতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করবে না সজ্ঞানে। তাহলে কি ব্যাপারটা কৃষকসমাজের অজ্ঞাতসারেই ঘটে গিয়েছিলো? ঠিক তাই। আর এর জন্যে দায়ী অ-কৃষিজ শিল্পে নিযুক্ত মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতা অথবা প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। এই প্রাকৃতিক খামখেয়ালিপনা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। অবশ্য, এ যাবৎকাল মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা এবং সিন্ধু সভ্যতা নিয়েই বেশ কিছু বিতর্ক চলছে। 

সে যাই হোক, বলা হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২২৩০ (ক্যা)₁ সময়কালে আজকের তুলনায় অত্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় সে অঞ্চলে দীর্ঘকাল আর্দ্রপর্ব স্থায়ী হয়েছিলো। পরিবেশের এই সহায়তার কারণে সিন্ধু উপত্যকায় পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কালের তুলনায় সেই সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছিলো। ১৯৭০ সালে গুরদীপ সিং নামে এক গবেষক রাজস্থানের হ্রদের পলি নিয়ে পরাগরেণু সংক্রান্ত একটি গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন এবং সেটি বেশ কিছুকাল ধরে গ্রহণীয় ছিলো। কিন্তু পরে থর মরুভূমিতে পরাগরেণু সংক্রান্ত উপাত্ত (pollen data) থেকে শুষ্ক ও আর্দ্র চক্রের যে অনুমিতি পাওয়া গেছে, প্রাক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক কালপর্বে উত্তর পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তান, বিশেষত রাজস্থানের জনবসতির প্রত্নতাত্বিক ক্রমপর্ব এবং ছাঁচটি তদনুরূপ নয়। ডি এন মিশ্রের মতে, ‘হরপ্পা সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাতের বৃদ্ধি কোনও নির্ধারক কারণ নয়।’ এছাড়া, ইরফান হাবিবের মতে, মহেঞ্জোদাড়ো এবং কালিবাঙ্গানের নিকাশী ব্যবস্থার সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত মোটেই মানানসই নয়। তাহলে কি কৃষি হাতিয়ারের মৌলিক অগ্রগতির কারণেই হঠাৎ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিলো? এই ব্যাপারেও কিন্তু বিতর্ক আছে। এখনও পর্যন্ত মহেঞ্জোদোড়ো বা হরপ্পায় লাঙ্গলের সন্ধান পাওয়া না গেলেও, কালিবাঙ্গানে (উত্তর রাজস্থান) হলচিহ্ন বা সীতার রেখা দেখতে পাওয়া গেছে। পরিণত সিন্দু সভ্যতার ভগ্নসামগ্রীর নীচে এর কিয়দংশ অবস্থিত। সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা এটিকে প্রাচীন সিন্ধু সময়কালের চিহ্ন হিসাবে শনাক্ত করেছেন। (যদিও হলচিহ্নের চেহারাটা যথেষ্ট আধুনিক এবং তার উপর আড়াআড়ি ভাবে সমদূরত্বে অবস্থিত আরো এক প্রস্থ হলরেখায় দ্বিতীয় আর একটি শস্য বপনের ইঙ্গিত মেলে) 

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এখনো ধোঁয়াশামুক্ত নয়। কিন্তু বেশ কয়েকটি ব্যাপারে এখন সব গবেষকই একমত। প্রথমত, জৈবপ্রযুক্তির সাহায্যে ষাঁড়েদের নিবীর্যকরণ সম্ভব হয়েছিলো। ফলে বলদকে ভারবাহী পশু এবং কৃষিকাজে নিয়োগ করা সম্ভব হয়েছিলো আর এর ফলে মনুষ্যশ্রমের সাশ্রয় হওয়ায় বেশি পরিমাণে জমিতে চাষ করা সম্ভব হয়েছিলো। প্রাচীন সিন্ধু সংস্কৃতিতে লাঙলের ব্যবহার ছিলো কিনা এ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও, গাড়ি টানা পশু হিসেবে ষাঁড় বা বলদের ব্যবহার কৃষিতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি। হরপ্পার প্রাক সিন্ধু স্তরে গোরুর গাড়ির চাকার দাগ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে পশ্চিম পাঞ্জাবের জলিলপুরে পোড়ামাটির গাড়ির চাকা, কাঠামো এবং ষাঁড়ের প্রতিমূর্তি নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির অগ্রগতি, এবং তার ফলে বলদকে দিয়ে কৃষি এবং কৃষিজাত দ্রব্য বহনের সাক্ষ্য বহন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের আগে, যে সময়ে ইরাকে উরুক-এর চিত্রলিপিতে চাকালাগানো গাড়ির খোঁজ মিলেছে, সম্ভবত তার অল্পদিন পরেই সিন্ধু উপত্যকায় ষাঁড়ে টানা দু’চাকার গাড়ির ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। আর একবার যে মানুষ গাড়িটানার কাজে ষাঁড়কে ব্যবহার করবে, সে যে অচিরেই তাকে দিয়ে লাঙল বা হল টানার কাজেও ব্যবহার করবে, সেটা খুব একটা কষ্টসাধ্য কল্পনা নয়। আর যে কাঠমিস্ত্রি বা ছুতার গোরুর গাড়ির চাকা বানাতে পারে, তার পক্ষে একটা কাঠের হাল বা লাঙল বানানো একজন ফার্নিচার-বানানো ছুতোরের পিঁড়ি বানানোর মতনই সহজ কাজ। তাছাড়া শুধু গোরুর গাড়ির চাকাই নয়, তারা যে কাঠের নৌকা বানাতেও সক্ষম ছিলো, এরওপ্রমাণ মিলেছে।এদুটি বিরাট ব্যাপার ছাড়াও, কৃষিতে আনুষঙ্গিক জলের জন্যেও শুধুমাত্র বৃষ্টির জলের পরিবর্তে ভূমিতে সঞ্চিত জল এবং কূপের জল কাজে লাগানোর অজস্র নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এছাড়া, কৃষিতে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা গেলো যখন এক ধরণের শস্যের পরিবর্তে একাধিক শস্যের চাষ একাধিক মরসুমে শুরু হলো। কেবলমাত্র রবি শস্যের সঙ্গে যোগ হলো খারিফ শস্যের চাষও। এই সবকিছুর পরিণতিতে, কৃষক তার নিজের প্রয়োজনের জন্য চাষ করলেও দেখা গেলো যে উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ বেড়ে তিন গুণ কি চার গুণ হয়েছে!!

তাহলে নগরায়নের জন্যে যা যা প্রাথমিক শর্ত, তার সবগুলোই পূর্ণ হয়েছে এখন। প্রয়োজনাধিক খাদ্যশস্য, তার চলাচলের বা পরিবহণের ব্যবস্থা- স্থলপথে গোশকটের দ্বারা এবং জলপথে নৌকার দ্বারা, অ-কৃষিজ এবং কৃষি শিল্পের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বানানোর কারিগর বৃদ্ধি, তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের বিপণনের জায়গার বা ক্রেতার অভাব স্বাভাবিক ভাবেই নগরায়নের জন্ম দিলো। আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো সওদাগর, কাঁচা মালের যোগানদার আর বিভিন্ন গ্রাম থেকে এমন কি সুদূর বিদেশ থেকেও ক্রেতার দল। শুরু হলো মহেঞ্জোদাড়ো আর হরপ্পার পথ চলা। (চলবে)



টীকা₁: ক্যাবা kya এর অর্থ হাজার বছর আগে।


সৌজন্য— শুভজিত গাঙ্গুলী, ইরফান হাবিব, শিরিন রত্নাগর, ডি এন মিশ্র, জোনাথন মার্ক কেনোয়ার।



0 comments: