4

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ স্বপন দেব

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



বাঙালির দুর্গাপূজা কি নিজেদের পূর্বপুরুষ হত্যার উৎসব?
স্বপন দেব 


বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজা-----অনেকদিন ধরেই কিছু হিন্দু মৌলবাদী, বুদ্ধিজীবী আর বেশ কিছু শিক্ষিত বাঙালি এই প্রচারটা চালিয়ে আজ এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যে শুধু দুই বাংলায় নয়, বিশ্বে যেখানেই বাঙালিদের একটা কমিউনিটি গড়ে উঠেছে, সেখানেই সাড়ম্বরে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। ইদানীং আবার রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের অংশগ্রহণে এবং কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় এখন এটা একটা মাত্রা ছাড়া হুজুগে পরিণত হয়েছে।

বাঙালির প্রায় অর্ধেক অ-হিন্দু। পশ্চিমবাংলাতেও সব বাঙালি হিন্দু নয়। এছাড়া অনেক বাঙালিই এখন যুক্তিবাদী, নিরীশ্বরবাদী এবং নাস্তিক। তাই দুর্গা পূজা কিছুতেই সামগ্রিকভাবে সমস্ত বাঙালির নয়। বরং বলা যেতে পারে কিছু আত্মবিস্মৃত হিন্দু বাঙালির পুজো। হঠাৎ এই প্রসঙ্গে, বাঙালির আত্মবিস্মরণের কথা আনলাম কেন ? আনলাম, কারণ ধর্ম ও সাংস্কৃতিকইতিহাসের গবেষণা আজ আমাদের অনেক নতুন তথ্য জানাচ্ছে। প্রাকবৈদিক ধর্ম ছিল দেবী প্রধান। নারীকে সৃজনী শক্তির আধার ভেবে উর্বরতামূলক যাদুবিশ্বাসে দেবী পূজার শুরু। বৈদিক ধর্মে কিন্তু নারী পূজিতা ছিলেননা কোনদিনই। এঁরা ছিলেন পুরুষ দেবতাদের সঙ্গিনী। ঋগ্বেদে দুর্গা নেই। দুর্গা পৌরাণিক। প্রাকবৈদিক ও বৈদিক ধর্ম সংশ্লেষে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তির চরম পর্যায়ে দুর্গার আমদানি করেন বৈদিকরা। সংশ্লেষের শুরু প্রাকবৈদিক বিষ্ণুকে ঋগবেদে অন্তর্ভুক্ত করে বৈদিক ছাপ দিয়ে। নামটা বৃষ্ণি থেকে বিষ্ণু। এরপরে শিবকে বৈদিক রুদ্রের সঙ্গে সমীকরণ করা হয়। রুদ্রও ঋগবেদে নবীন, শেষের দিকের। চরম পর্যায়ে প্রাকবৈদিক দেবীদের বৈদিকরা স্বীকৃতি দিতে থাকেন নাম, রূপ, কর্ম, ইত্যাদি নিজেদের ছক মতন পরিবর্তন করে করে সমীকরণ করে। ততদিনে ঋগবেদের অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, মিত্র, বরুণ, পর্জন্য পিছু হটে গেছে। এই অভাব পূরণে এলেন প্রাকবৈদিক দেবীরা। কারণ, জয় করতে হবে অজেয়, অগম্যভূমি, নারীপূজক পূর্ব ভারতকে। দ্বারবঙ্গ থেকে কিরাতভূমি হল বঙ্গভূমি। চলছে বৈদিক তথা হিন্দুভক্ত গুপ্তযুগের শাসন। তখন এ অঞ্চলে সমাজের সঙ্গে ধর্ম সম্পৃক্ত, জ্যোতিষে আক্রান্ত। ব্যক্তি সমাজবদ্ধ, ধর্মভীরু। আর্থসামাজিক ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া প্রবল নাস্তিক্যবাদ। তখনই দুর্গা ও তাঁর সঙ্গে সমীকরণ করে বহু দেবীর আগমন ঘটলো পুরাণে। বাসন্তী, চণ্ডী, পার্বতী, গৌরী, মহালক্ষ্মী, কালী, বিন্ধ্যবাসিনী, ইত্যাদি। আরও পরে মনসা, শীতলা, পর্ণশবরী, চণ্ডিকা, বাশুলী, ইত্যাদি এলো মঙ্গলকাব্য যুগে। এই চণ্ডীর সঙ্গে দুর্গাকে সমীকরণ করা হয়েছিল পুরাণে। মঙ্গলকাব্যযুগ একদিকে বৈদিক ও প্রাকবৈদিক সংশ্লেষের শেষ পর্যায়; যেখানে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এবং হিন্দু মুসলিম সংশ্লেষ শুরুর পর্যায়; যা যুক্তসাধনা। এইসময়েই এল ওলাবিবি, বনবিবি, কালুপীর, ধর্মগাজন, সত্যপীর, ইত্যাদি। এই সত্যপীর শেষে হল সত্যনারায়ণ। এইভাবে, ধর্মীয় সংশ্লেষের চরম পর্যায়টি হয় এই বঙ্গভূমিতেই। তখনও বঙ্গভূমি প্রাকবৈদিক ধর্ম ও নাস্তিক্যবাদে সমৃদ্ধ। মূলস্রোত নাস্তিক্যবাদ। বঙ্গের সাংস্কৃতিক মান ও ভাষাজ্ঞান দক্ষিণ এশিয়ায় সু-উন্নত ও সমৃদ্ধ। হিন্দুকুশ পেরনোর পরে প্রায় দীর্ঘ দেড় হাজার বছরে বৈদিকরা এই বঙ্গে দাঁত ফোটাতে পারেননি। বরং বঙ্গসংস্কৃতিকে এক শ্রেণীর বৈদিক শ্রদ্ধা করতেন। বাকি বৈদিকরা বঙ্গের শক্তিকে সমীহও করতেন, আবার ঘৃণাও করতেন। বৈদিক সাহিত্যে এর উদাহরণ প্রচুর। বৈদিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গুলিতে পারস্পরিক বিরোধিতা চরম।

অভিধানমতে, দুর(দুঃখ) গম(গমন করা, জানা) + অ (কর্মবাচ্যে/কারকে) = দুর্গ + আ =দুর্গা। যাঁকে দুঃখে জানা যায়, যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট থেকে ত্রাণ করেন। তন্ত্রমতে, দ‌-এ হসন্ত = দৈত্যনাশ সূচক, উ = বিঘ্ননাশ সূচক, র-এ হসন্ত = রোগনাশ সূচক, গ-এ হসন্ত = পাপঘ্ন বাচক,আ = ভয়বাচক ও শত্রুনাশ বাচক। পুরাণ মতে, দুর্গ নামক অসুর বিনাশকারী হলেন দুর্গা। মহাশক্তি মহামায়া দুর্গা।

নৃতাত্ত্বিক মতে আলপীয়রাই অসুরজাতি। এরাই বাঙালিদের অন্যতম পূর্বপুরুষ। অসুর ছাড়াও বঙ্গভূমে এসে এরা শিব-শিবানী, ষাঁড়-মহিষ পূজাও করতো। ঋগবেদে এদের অসুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ভাষাও মাগধি-প্রাকৃত-অষ্ট্রিকের সঙ্গে সংশ্লেষিত হয়ে বর্তমান বাংলা ভাষায় আছে। বাঙালির বাহন ষাঁড়, মহিষ, বলদ প্রভৃতি।

ষাঁড়-মহিষ নিয়ে এখনও উপজাতিদের মধ্যে বিখ্যাত এবং বহুল প্রচারিত বাঁধনা পরব। বাঙালির আদি দেবতা শিবের বাহন ষাঁড়। অসুরজাতির প্রতীক হিসেবে মহিষাসুরকে, অর্থাৎ ‘মহিষ পালক অসুরজাতি’কে বধের গল্প দিয়ে বৈদিক বেশ্যা “আনা”কে দুর্গা নামে বাঙালির মধ্যে প্রচার করা হয়। উদ্দেশ্য, বৈদিক তথা হিন্দুত্বে বশ্যতা স্বীকার করানো। এটা প্রাকবৈদিক-বৈদিক ধর্ম ও সামাজিক আচার সংশ্লেষের চূড়ান্ত পর্যায়। এর পরে হিন্দু ব্রাহ্মণেরা প্রচার শুরু করে। গোড়ারদিকে উপজাতিদের অসুর হিসেবে চিহ্নিত করে ও দুর্গাকে দুর্গতিনাশক হিসেবে বোঝানো শুরু হয় বাঙালিদের। পরে রাজা জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রমরম করে চলতে থাকে বঙ্গে। বাঙালি মুখস্থ করে নেয়, দুর্গতিনাশক মাতৃত্বের প্রতীক হল দেবী দুর্গা আর অসুর হল অনুন্নত, কদর্য, ঘৃণ্য জীব, যেমন ভাবতেন বৈদিকরা। অর্থাৎ বাঙালি এখন প্রতি দুর্গাপূজায় যে মহিষাসুর কে বধ করায় দেবী দুর্গাকে দিয়ে, সেই মহিষাসুরই কিন্তু বাঙালির পূর্বপুরুষ!!

কথিত আছে, মৈমনসিংহের জনৈক স্থানীয় জমিদার কংস নারায়ণ চৌধুরী এই পূজার প্রচলন করেন। কিন্তু এটা সঠিক নয়। এই পূজা বঙ্গে দশ এগারো শতকে হতো, এর প্রাচীন প্রমাণ আছে। চৌদ্দ শতকে আন্দুলে ও পনেরো শতকে রংপুরে দুর্গা পূজা হয়েছিল। কলকাতায় শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭-তে এ পূজার প্রবর্তক। হুগলির গুপ্তিপাড়ায় প্রথম বারোয়ারী পূজা হয় ১৭৬১ সালে। আর দুর্গাপূজার এই বারোয়ারীকরণের ফলে, যা ছিল একান্তভাবেই রাজা-রাজড়া, জমিদারদের বৈভব দেখানোর উৎসব, তা পরিণত হল আপামর বাঙালির সামাজিক উৎসবে। আর অদৃষ্টের পরিহাস এমনই যে বৈদিক সভ্যতা হিন্দুকুশ পেরনোর ১৫০০ বছর পরেও বঙ্গভূমি জয় করতে পারেনি, আজ তাদেরই এক কল্পিত দেবীর হাতে নিধন হচ্ছে বাঙালির পূর্বপুরুষের। বাঙালির পূর্বপুরুষ মহিষ পালক আলপীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা তাদেরই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচিত হলেন, ঘৃণ্য মহিষাসুর রূপে !! 






4 comments:

  1. দুর্গা যে বৈদিকদের কল্পিতা দেবী নন, তার বেশ কিছু প্রমাণ আছে। তার মধ্যে যেটি প্রধান ও প্রায় অখণ্ডনীয়, সেটি হলো দুর্গার বাহন। বৈদিকদের প্রধান যুদ্ধবাহন ছিলো অশ্ব। দুর্গা বৈদিক দেবী হলে তাঁরও বাহন নিশ্চিতভাবেই অশ্বই হতো, সিংহ নয়। আর এছাড়া মহিষাসুরকে আমাদের নিকটতর পূর্বুপুরুষ দাবি করাটাও একটু অতি সরলীকরণ, কারণ বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ভারতবর্ষের জটিলতম জাতি-সন্নিবেশগুলির মধ্যে একটি, এবং তাতে অস্ট্রিক (ভারতীয় আদিবাসী), দ্রাবিড় (আর্য ও অস্ট্রিকদের সংমিশ্রণে উদ্ভূত জাতি), আর্য এবং মোঙ্গলীয় রক্তেরও প্রভাব আছে। তাই লেখাটি চিত্তগ্রাহী হলেও তথ্যগতভাবে একটু দুর্বল।

    ReplyDelete
  2. আমি কিন্তু কোথাও দুর্গাকে বৈদিক দেবী বলিনি। বলেছি দুর্গা একটি পৌরাণিক দেবী। মহিষাসুর সম্পর্কে এক নৃ-তাত্ত্বিকের বিশ্লেষন হল, মহিষাসুর আসলে মহিষ-পালক একটি উপজাতি যা প্রাগার্য এবং আর্য সংশ্লেষণের পরেও নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিল। এরাই বাঙ্গালির আদিপুরুষ। আজকের মিশ্রিত বাঙ্গালিদের কথা আমি বলিনি। আর যদি মেনেও নি যে মহিষাসুর বাঙ্গালীর পূর্ব পুরুষ নয়। তাহলেও শুধুমাত্র এটুকু ছাড়াও কিন্তু এই নিবন্ধে আরো প্রচুর তথ্য আছে। তাই, লেখাটি তথ্যগত ভাবে দুর্বল বলাটা একটি অতি সরলীকরণ হয়ে গেল না ?

    ReplyDelete
  3. ‘‘অসুরজাতির প্রতীক হিসেবে মহিষাসুরকে, অর্থাৎ ‘মহিষ পালক অসুরজাতি’কে বধের গল্প দিয়ে বৈদিক বেশ্যা “আনা”কে দুর্গা নামে বাঙালির মধ্যে প্রচার করা হয়। উদ্দেশ্য, বৈদিক তথা হিন্দুত্বে বশ্যতা স্বীকার করানো।’’ এই বক্তব্যে কিন্তু দুর্গাকে বৈদিক দেবীই দাবি করা হচ্ছে, যেটা ঠিক নয়। দুর্গা এক প্রাকবৈদিক প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজের দেবী, এবং সে সমাজের ধারকরা ছিলেন ভারতবর্ষের ভূখণ্ডে বহিরাগত। মহিষাসুর অবশ্যই ভারতীয় আদিম জনজাতির প্রতিভূ। কিন্তু তিনি ভারবর্ষের কোন প্রদেশের মানুষ ছিলেন, সে কথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। দুর্গার হাতে তাঁর নিধনও কোথাকার ঘটনা, সে কথাও এখন অনির্ণেয়। আজকের বাঙালির জটিল নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে তাই মহিষাসুরকে বাঙালির পূর্বপুরুষ দবি করাটাও ঠিক ধোপে টেঁকে না। এই দু’টি বিষয়ই যে এই রচনার প্রধান উপজীব্য, তাই নিয়ে আশা করি পাঠককুলের বিশেষ দ্বিমত নেই। তাই বাদবাকি ‘প্রচুর তথ্য’ প্রাসঙ্গিক হলেও নিবন্ধের মূল পরিসরে ভুল আছে।

    ReplyDelete
  4. সেটা বোধহয় ঠিক নয়। আমি কিন্তু সচেতন ভাবেই বলেছি যে আর্যরা দেবী উপাসনা করতেন না। এও বলেছি যে প্রাকবৈদিক ধর্ম ছিল দেবী প্রধাণ। প্রাকবৈদিক ও বৈদিক ধর্ম সংশ্লেষের পর্যায়ে যখন ইন্দ্র, অগ্নি বরুণেরা পিছু হটে গেছেন, তখন ই নানারকম দেবীকে বৈদিক আখ্যা দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু ধর্মে।

    ReplyDelete