2

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in




















বঙ্গদেশে নাকি ইদানীং কারণবারির বিক্রি অনেকগুণ বেড়ে গেছে । নিন্দুকেরা বলছে সরকারের সংসারখরচের সিংহভাগ দায় নাকি আবগারী দপ্তরই মেটায় আজকাল। সেটা ভাল লক্ষণ নাকি খারাপ সেটা অর্থনীতিবিদরাই বলতে পারবে ।
আমার চিন্তা অন্য যায়গায় । মদের বিক্রি বাড়লেও রাস্তাঘাটে তো সেই সব মাতালদের দেখা যায় না যারা আগে টলটলায়মান পায়ে, তুরীয় মেজাজে , কাউকে তোয়াক্কা না করে ,গলা খুলে বেসুরে গান গাইতে গাইতে , সদর্পে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন।
তাহলে কি অন্য সব কিছুর মত মদেও ভেজাল থাকছে আজকাল । তাই মদ্যরসিকদের কিছুতেই সেই কাঙ্ক্ষিত মৌতাতটি হচ্ছে না বলে তারা আরো বেশি বেশি করে মদ খাচ্ছে আজকাল। আর তাতেই কি মদের বিক্রিবাটা বাড়ছে কিন্তু মাতলামি কমছে ? এমনটা হওয়া নেহাত অসম্ভব নয় , কারণ শুনেছি অনেক মাতালই থাকে যারা ঠিক পেগের হিসেব রেখে মদ খায় না । নেশা ঠিক কোন লেভেল অবধি পৌঁছেছে সেটা বুঝে মদ খায় ।
তেমনি এক মাতালের গল্প বলি, যে রোজ পানশালায় পকেটে করে একটা গিনিপিগ নিয়ে আসত। টেবিলে সেটাকে রেখে মদ খেত । আর মাঝে মাঝে সেটাকে তুলে দেখত। ওয়েটার একদিন এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে বলল , আমি যতক্ষণ না চোখে দুটো গিনিপিগ দেখি ততক্ষণ খেয়ে যাই । কিছুদিন পরে গিনিপিগটা মরে যায় । তারপরেও সেই লোকটি সে পানশালাতে আসত , সাত আট পেগ মদ খেয়ে চলে যেত ।
ওয়েটার একদিন জিজ্ঞেস করে এখন কী করে বুঝতে পারেন ? লোকটি বললে এখন ঐ সামনের চেয়ারে বসা লোকটাকে দেখি । ওই লোকটাকে ডবল দেখালেই মদ খাওয়া বন্ধ করে দিই । মোটামুটি এই রকমই চলছিল । একদিন ওয়েটার দেখে লোকটি দু পেগ খেয়েই চলে যাচ্ছে । ওয়েটার বলে সে কি এত তাড়াতাড়ি ? লোকটি বলে কি জানি কেন তাড়াতাড়ি নেশা হয়ে গেল , সামনের লোকটাকে দুটো দেখছি । ওয়েটার সামনে তাকিয়ে দেখে বলল , না না আপনি ভুল করছেন , সামনের চেয়ারে দুটো লোকই আছে , ওরা যমজ ভাই , দুজনকে এক রকম দেখতে । লোকটি আবার বসে পড়ে বললে ওঃ তাই বুঝি , তাহলে আজ দু দুগুনে চারটে দেখলে তখন উঠব , নিয়ে এসো একটা পাটিয়ালা ...।
মদ বিক্রি বাড়ার আর একটা কারণ হতে পারে বঙ্গদেশে সোবার-এর সংখ্যা বেড়ে গেছে । একটু বুঝিয়ে বলি। আমরা অনেক ইংরেজী কথার মত একটা ইংরেজী কথাকেও প্রায় বাংলা বানিয়ে ফেলেছি । সেটা হল সোবার ( sober ) । আমরা যখন বলে থাকি ছেলেটিকে বেশ সোবার দেখতে, তখন আসলে বোঝাতে চাই ছেলেটি শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র, নরম এই রকম কিছু ।আমি কিন্তু ইংরেজী sober এর কথা বলছি। ডিকশনারি ঘাঁটলে দেখা যাবে sober শব্দের মানে অন্য কিছু লেখা আছে । সেখানে বলছে মদ খেয়েও যে মাতাল না হয় , সেই হচ্ছে সোবার ।
একজন প্রাজ্ঞ মাতাল, মাতাল এবং সোবারের মধ্যে তফাতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন – ‘ আমি মাতাল এবং আমি বুঝতে পারছি আমি মাতাল তখন আমি সোবার , আর আমি মাতাল কিন্তু বুঝতে পারছি না আমি মাতাল, তখন আমি মাতাল ।তাই এটাও সন্দেহ জাগছে আসলে বোধহয় বঙ্গদেশে আসলে সোবারের সংখ্যা বেড়ে গেছে , তাই এই অবস্থা ।
অবশ্য এই মাতালের সংখ্যা কমে যাবার ব্যাপারটা অনেক কাল আগে কল্লোল যুগের বিখ্যাত লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর যুগেও লক্ষ করেছিলেন । তিনি লিখেছিলেন – ‘সে যুগে অর্থাৎ আমাদের ছেলেবেলায় কলকাতার রাস্তায় বেরুলে প্রায়ই মাতাল দেখতে পাওয়া যেত। তখনকার তুলনায় এখনকার দিনে মাতালের সংখ্যা অসম্ভব রকমের বেড়ে গেলেও পথে ঘাটে মাতালের কেলেঙ্কারী আর দেখতেই পাওয়া যায় না , বলা চলে। তার একটা প্রধান কারণ এই যে ডেকো-হেঁকো মাতালের চাইতে চোরা মাতালের সংখ্যা বেড়েছে বেশি।’’
জীবনানন্দ বলেছিলেন “সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি” । তার মানে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। ঠিক তেমনিই সকল মদ্যপায়ীই কিন্তু মাতাল নয় ।কেউ কেউ মাতাল । প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মতে - “অধিকারী ভেদ বাক্যটি যে নিশ্চিত সত্য তা আমরা জীবনের নানা ক্ষেত্রেই দেখতে পাই। যারা মদ্যপানের অধিকার নিয়ে সংসারে আসে তাদের ছাড়া মদ্য পানের অধিকার আর কারুর নেই । কিন্তু মুসকিল এই যে কে যে সত্যিকারের অধিকারী তা আগে থেকে জানবার উপায় নেই । সকলেই নিজেকে অধিকারী মনে করে সুরু করে দেয় । এবং অনাধিকতরত্ব প্রমান হওয়া সত্বেও ছাড়তে পারে না । তাইতেই মদ্যপায়ীর এত দুর্নাম ।”
তবে শুধু পথে ঘাটেই নয় সিনেমা থিয়েটারেও আজকাল সেই রকম হৈ হৈ করা মাতাল চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় না । তারাও কী তাহলে এই ট্রেন্ড ফলো করছে ?
আহা কি সব খানদানি মাতালদের দেখা যেত সিনেমা থিয়েটারে ।
প্রথমেই মনে পড়ছে একদিন রাত্রে ছবিতে ছবি বিশ্বাসের কথা । গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় বেলফুলের মালা পরে ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় , সব সত্যি’ গানে লিপ দিতে দিতে তাঁর সেই ক্ল্যাসিক্যাল মাতলামি। এই সিনেমাটির যখন হিন্দি ভার্সন হল তখন ছবি বিশ্বাসের জায়গায় এলেন মোতিলাল । তিনিও এক জব্বর অভিনেতা , চুটিয়ে মাতলামি করলেন । তবে মাতালের গলায় গানটা পালটে হল – ‘জিন্দগী খোয়াব হ্যায়/ অউর খোয়াবমে ঝুট হ্যায় কেয়া অউর বলা সচ হ্যায় কেয়া/ সব সচ হ্যায় ’ । আসলে বাংলায় সলিল চৌধুরী এই গানে যে উমদা স্যাটায়ারের প্রয়োগ করেছিলেন , সেটা হিন্দিতে শৈলেন্দ্রজী আনতে পারলেন না । তাই তার মধ্যে , মাতালের চোখে সবই সত্যি এই জায়গাটা অপরিবর্তিত রেখেও , অন্য রকম একটা মাতাল-দর্শন নিয়ে এলেন ।
মনে আছে এক সময় দুজনের অভিনয় নিয়ে তুলনা হত এবং এ রকম একটা তর্ক উঠত – কে বেশী মাতাল , ছবি না মোতিলাল।
বাংলা ছবিতে মাতালেরা এসেছেন , যুগে যুগে কালে কালে । এই মুহুর্তে আরো দুটি গানের কথা মনে পড়ছে – অদ্বিতীয়া ছবিতে বিকাশ রায় মশায়ের লিপে – এই মাল নিয়ে চিরকাল যত গোলমাল আর স্বয়ং উত্তমকুমারের লিপে শুধু একটি বছর ছবিতে – যে আমার মন নিয়েছে , সেকি হায় বলতে পারে । প্রথমটি মান্না দে , আর দ্বিতীয়টি হেমন্তবাবু গেয়েছিলেন। আহা, ও রসে বঞ্চিত দুই মানুষ, তবু কী চমৎকার সুরেলা মাতলামিই যে করেছিলেন তাঁরা।
আর হিন্দিতে তো প্রায় সব সুপারস্টারই মদিরা-গানে লিপ দিয়েছেন । কাকে ছেড়ে আর কার কথা বলি । তবে দিলীপকুমারের দেবদাস তো মাতালদের চিরকালীন আইকন ।
দেবদাস বলতে মনে পড়ল বাইপাসে রুবি হাসপাতালের কাছে একটি পানশালার নাম – দেবদাস । এও এক রকম ট্রিবিউট টু শরৎবাবু ।
তবে আমার ব্যাক্তিগত পছন্দের মদিরা-সঙ্গীতটিতে লিপ দিয়েছিলেন শাম্মি কাপুর , কাশ্মীর কী কলি ছবিতে । হ্যায় দুনিয়া উসিকা হ্যায় জমানা উসিকা , মোহব্বতমে যো হো গয়া কিসিকা ...। আহা রফিসাহেব , তিনিও সুরার গুণগ্রাহী ছিলেন না , অথচ কী মধুর নেশায় আমাদের ফেলে দিয়েছিলেন ।
হিন্দি সিনেমায় মাতালদের কথা উঠবে আর কেষ্টো মুখার্জির কথা হবে না ? এতো সেই- ফুলে গন্ধ নেই , এতো ভাবতেই পারিনা ।
ওই ভদ্রলোকও নাকি বিন্দুমাত্র মদ্য পান করতেন না । অথচ কত ছবিতে যে আমাদের মাতলামির মজায় মজিয়েছেন ।
হিন্দি থেকে আবার বাংলাতেই ফিরে আসি । আমাদের নাট্য জগতের দুই দিকপাল গিরীশ ঘোষ আর শিশির ভাদুড়ী । দু জনেই ওই ঐ দ্রাক্ষারসের রসিক ছিলেন । হয়তো বা একটু বেশিই রসিক ছিলেন। শিশিরবাবুর সম্মন্ধে একটি রসিকতা চালু ছিল – সন্ধের পর শিশির ভাদুড়ী বোতলের ভাদুড়ী হয়ে যান ।
আর গিরিশ ঘোষ নিয়ে যে গল্পটি চালু আছে সেটি এই রকম- এক রাত্তিরে গিরিশ ঘোষ খুব মাতাল হয়ে গেছেন! যেখানেই যাচ্ছেন কেউ তার জন্যে দরজা খুলে দিচ্ছেন না । এমন সময় তাঁর এক সাগরেতকে বললেন, “ দক্ষিণেশ্বরের কথা মনে পড়ে গেল। আমি জানি সেখানে ঠিক একজন আছেন, তিনি কখনও দরজা বন্ধ করেন না।”
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। অমনি জুড়ি গাড়িতে লাফিয়ে উঠলেন। কদিন আগে থিয়েটারের জন্যে একটা গান বেঁধেছেন পাহাড়ি পিলু রাগে। জুড়ি গাড়িতে চেপে উচ্চৈস্বরে সে গান- ‘ছি ছি ছি ভালবেসে,/ আপন বশে কি রয়েছো’ – গাইতে গাইতে চললেন দক্ষিনেশ্বরের দিকে।
গভীর রাতে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে পৌঁছালেন দক্ষিণেশ্বরে। গাড়ি থামতেই, খোঁয়ারি জড়ানো গলায় গিরিশ্চন্দ্র চিৎকার করলেন, ‘‘ঠাকুর, ঠাকুর!’’
বেরিয়ে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব! তিনি বুঝি অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ‘‘কাতর প্রাণে, এমন করে কে ডাকে? গিরিশ না!’’
ঠাকুরের ছোঁয়ায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন গিরিশ।এবং সম্বিতে ফিরেই খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন ।
রামকৃষ্ণদেব অভয় দিয়ে বললেন , ‘‘মদ খেয়েছিস তো কি, আমিও মদ খেয়েছি। ‘সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে, মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে।’’ গান গাইতে গাইতে গিরিশের হাত ধরে নাচতে লাগলেন ঠাকুর।
শুধু সিনেমা আর থিয়েটারে তো নয় ।এই যে আমাদের বঙ্গ ভান্ডারের বিবিধ রতন । এই সব সাহিত্য-রতনের আঁতুড়ঘর একেবারে সম্পুর্ন ভাবে মাদকবর্জিত ছিল , এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না । সেই মধুসুদন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, নবীন চন্দ্র সেনের যুগ পেরিয়ে ডি এল রায়, শরৎ চাটুজ্যে, মানিক বন্দোপাধ্যায় , সমরেশ বোস, সুনীল গাঙ্গুলি অবধি বাংলা সাহিত্যের উজ্বল যাত্রাপথে কোথাও কোথাও একটু আধটু , কোথাও বেশ ভালরকম দ্রাক্ষারসের সৌরভ যে মিলে মিশে আছে তা অস্বীকার করা যায় না।
শোনা যায় বঙ্কিম বাবুর বাড়িতে এবং ডি এল রায়ের বাড়িতে যে কবি লেখকদের আড্ডা বসত সে আড্ডা শুধু চায়ের আড্ডা ছিল না ।তার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। শিশিরকুমার ভাদুড়ির নাট্যমন্দিরে একটি আড্ডা বসত । সে আড্ডার এমনই টান ছিল যে সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাজেশিবপুর থেকে ট্রামে বাসে চেপে এসে হাজির হতেন।সে আড্ডাটিও নাকি একেবারে ‘শুষ্ক’ থাকত না ।
তবে বাংলা সংস্কৃতির যে তিনজন সব চেয়ে স্পর্ধাবান মাতালকে বাঙালি চিরকাল মাথায় করে রাখতে বাধ্য হবে, তাঁদের নাম , রামকিঙ্কর বেইজ , ঋত্বিক ঘটক এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।তাঁদের নিয়ে অনেক গল্প বাঙ্গালির মুখেমুখে ফেরে ।
সেই সব গল্প আর মিথ মিলে মিশে বাঙালির অন্তরে এক রোমান্টিক মাতাল বাস করে বা করত। ‘দেবদাস’ সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকদের দু একটা পিস পাড়ায় পাড়ায় কিছুদিন আগে অবধি দেখা যেত । এদের সম্মন্ধে এদের সম্মন্ধে কানাঘুষো কিছুটা এই রকমের গল্প শোনা যেত -
ফটিকদা নাকি পড়া পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল । দেখতে শুনতেও ভাল ছিল । সেই পাড়াতেই এক ভেঙ্গে পড়া তিনতলা বাড়িতে থাকতেন প্রাক্তন জমিদার ঘনশ্যাম মিত্র। তাঁর মেয়ে পুতুলের সঙ্গে নাকি ফটিকদার কিঞ্চিৎ আশনাই হয়ে ছিল । ঐ পাথরে মুড়ে দূর থেকে দু একটা প্রেমপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি, দুপুর বেলায় ফটিকদার সাইকেলের ঘণ্টি শুনে চিলেকোঠা থেকে পুতুলের উঁকি মারা , ঐ পর্যন্ত। ফটিকদার বাবার মুদির সোকান ছিল , তাদের পদবি ছিল সাধুখাঁ ।একে ঘনশ্যাম মিত্তিরের গায়ে বইছে জমিদারী রক্ত, তার ওপরে জাতে কুলীন । অতয়েব তিনি এই প্রেমের কথা জানতে পেরেই রাতারাতি পুতুলের জন্যে নৈকষ্য কুলীন কায়স্থ পাত্র খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিলেন । ফটিকদা তারপর থেকেই মদ ধরল । শোনা যেত পুতুল নাতি নাতনি নিয়ে শান্তিপুর না কোথায় যেন সুখে ঘর সংসার করে । কিন্তু ফটিকদা এখনো রোজ মাঝরাত্তিরে - এই কী গো শেষ গা...... ন , বিরহ দিয়ে গেলে...এ......এ গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরে ।
এখন অবশ্য এ রকম গল্প ঠাম্মির কাছে নাতনিরা শুনে বলে - বলে উফ , কী অসহ্য ন্যাকামি ছিল তোমাদের সময়ে ।
একটি খাঁটি বাঙালি মাতালের গল্প বলে শেষ করি । ধরা যাক তাঁর নাম ঝন্টুদা ।
ঝন্টুদা সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানী । ঝন্টুদার বিয়ের ঠিক হল । লক্ষ্মীমন্ত বৌ ঘরে এলো । কিছুদিনের মধ্যেই বৌ টের পেয়ে গেল , ঝন্টুদা সন্ধে বেলায় বেরিয়ে একটু ঢুকুঢুকু করে ফেরে ।নতুন বৌ একদিন পুরোনো হল। প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা, তার পর মান অভিমান তারপর চেঁচামিচি ঝগড়া । কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না । ঝন্টুদা সন্ধে সন্ধেবেলায় রোজ বেরিয়ে যান এবং স্থলিত চরণে বাড়ি ফেরেন । শেষ পর্যন্ত ঝন্টুদার বৌ অন্য রাস্তার কথা ভাবল । কিছুদিন আগে ঝন্টুদা তাকে ছুটির দিনে নুন শোয়ে হিন্দি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সিনেমাটি দেখতে নিয়ে গেছলেন । সেখানে দেখেছিলেন, যে স্বামী রোজ সন্ধেবেলা বারবাড়ি চলে যায়, তাকে মীনাকুমারী ‘না যাও সাঁইয়া চুরাকে বাঁইয়া’ গানটি গেয়ে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন । ঝন্টুদার বৌ ভাবলে সেই কায়দাটি করলে কেমন হয় ।
ঝন্টুদার কাছে সে রকম ইছা প্রকাশ করতেই ঝন্টুদা নিজেই সব ব্যবস্থা করে দিলেন । মা কালি মার্কা মদের বোতল নিয়ে এলেন । সঙ্গে নিয়ে সোডা এবং বরফ। আগে থেকে বৌকে দিয়েই কয়েকটা বেগুনি ভাজিয়ে রাখলেন । তারপর বেশ ঢিলে ঢালা পাজামা পাঞ্জাবি পরে ট্রেতে গ্লাস , বোতল সজিয়ে, মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে বসলেন দুজনে । দুটি গ্লাসে পানীয় ঢেলে এক গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন বৌয়ের দিকে । বৌ খানিক ইতস্তত করে গ্লাস থেকে এক ঢোঁক দিয়েই ফেললেন । দিয়েই তো গা গুলিয়ে উঠল । ও মা কী বিচ্ছিরি খেতে , কি বিচ্ছিরি গন্ধ , বলে হিক্কা তুলতে লাগলেন । ওরে বাবা এতো সারা বুক জ্বলছে , কেমন বমি বমি লাগছে , তুমি এই বিচ্ছিরি জিনিসটা কি করে খাও ?
ঝন্টুদা বললেন তা হলেই বোঝো , তুমি ভাবো আমি মদ খেয়ে খুব আনন্দ পাই , বুঝে দেখ কত কষ্ট করে আমাকে মদ খেতে হয় !
বলা বাহুল্য এর পর ঝন্টুদা আবার সেই পুরোনো রুটিনেই ফিরে গেলেন ।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে । ঝন্টুদার চাকরিতে উন্নতি হয়েছে । তিনি দেশী ছেড়ে বিলিতি ধরেছেন ।বাইরে যান না , বাড়িতেই খান। কিন্তু রোজ মদ খাওয়া ছাড়েন নি । ইতিমধ্যে লিভারটির অবস্থা খারাপ করে ফেলেছেন । অন্যান্য উপসর্গও দেখা দিয়েছে ।একদিন পেটের ব্যথা বাড়তে ডাক্তার ডাকা হল । ডাক্তার সব দেখে শুনে বললেন । মদ একেবারে বন্ধ করতে হবে । ঝন্টুদা বললেন পারবোনা ডাক্তারবাবু চল্লিশ বছরের অভ্যেস ,মদ না খেলে পেট ফুলেই মরে যাবো। ।ডাক্তার বললেন বেশ – কিন্তু দেড় পেগের বেশি নয় । কিন্তু ঝন্টুদা বললেন দেড় পেগে তো কিছুই হবে না একটু বাড়িয়ে দিন । শেষ পর্যন্ত রোজ তিন পেগে রফা হল ।
কিছুদিন পর ঝন্টুদার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল। আবার সেই ডাক্তারবাবু এলেন । বৌকে জিজ্ঞেস ঐ তিন পেগই খায় তো । বৌ তখন বলল কী আর বলব আপনি তিন পেগ বেঁধে দিয়েছিলেন । পরের দিন সকালে আরেক ডাক্তার ডাকিয়ে আনলেন , আর তাকে দিয়ে ঠিক একই ভাবে তিন পেগের বরাদ্দ করালেন । বিকেল বেলায় আরেকজন ডাক্তার ডালালেন তাঁকে দিয়ে ঠিক একই কায়দা খাটিয়ে করে তিন পেগ বরাদ্দ করালেন । তারপর আমাকে বললেন ডাক্তার আমাকে তিন ইনটু তিন ইজ ইকুয়াল টু নাইন পেগ পথ্য করেছেন । ডাক্তারের দেওয়া পথ্য না খেলে আমি মরে যাব । তারপর থেকে রোজ এক পাঁইট করে মদ খাচ্ছেন ।
ডাক্তার রেগে মেগে মদ খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলেন ।
তারপর কয়েকদিন পরেই ঝন্টুদা মারা গেলেন । মৃত্যুর কারণ কিন্তু মদ খাওয়া নয়।
মদ খাওয়া তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন । কিন্তু কয়েকদিন পরে তাঁর কাঁধে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয় । ডাক্তার সে ব্যাথার জায়গায় একটু করে অ্যালকোহল লাগাতে বলেন । বৌ সেই অ্যালকোহল লাগিয়ে রান্না করতে গেছেন । এদিকে বহুদিন পরে অ্যালকোহলের গন্ধ নাকে গেছে , আর তিনি থাকতে পারলেন না । তিনি মাথা উলটিয়ে পিঠ চাটবার চেষ্টা করছিলেন। আর তাতেই হল তাঁর মৃত্যু। ডাক্তারবাবু ডেথ সারটিফেকেটে লিখলেন - Abnormal movement of neck bones resulting in loss of sensation, paralysis and death.।
যতই লুকাবার চেষ্টা করিনা কেন এই লেখার ফাঁকে ফোঁকরে যে শ্রী তারপদ রায় ছায়া ফেলেছেন এমনটা অনেক পাঠকের মনে হতে পারে ।
তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি আসলে বাংলা সাহিত্যে মদ্যরসিক অনেক থাকলেও তারাপদ রায়ের মত আর মাতালদরদী আর কেই বা আছেন । তবে কিনা মাতালদের গল্পের কোনো কপিরাইট ব্যাক্তিবিশেষের কাছে নেই ।
আসলে সেই সব প্রবাদ বাক্য ,বটতলার চটি গল্প , ছেলে ভুলানো ছড়া এবং লোকগানের মত এই সব মাতালদের গল্পগুলো লোকের মুখে মুখে ফিরে এক যুগ থেকে আর এক যুগে, এবং এক দেশ থেকে আর এক দেশে পৌঁছে যায় । কিন্তু এ সব গল্পের স্রষ্টাদের নাম , সোশ্যাল মেডিয়াতে ভেসে আসা ‘মিম’গুলির মত, অজানাই থেকে যায় ।
তবুও রসিকচুড়ামনি তারাপদ রায় , অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন মাতাল-সমগ্র নামক বইতে এ রকম কিছু গল্পকে দুই মলাটের মধ্যে নিয়ে আসার। তাঁর প্রতিই শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর একটি উক্তি দিয়েই শেষ করি এই লেখা ।
“ মাতালের গল্পের শেষ নেই। বত্রিশ পুতুল, চল্লিশ চোর কিম্বা সহস্র এক আরব্য রজনীর চেয়েও দীর্ঘ সেই কথামালা। এই ধুলি মলিন, পাই পয়সা, শাকচচ্চড়ির গোমড়ামুখ পৃথিবীতে এখনো দু-একটি মজার গল্প মাতালেরাই রচনা করেন। তাঁরা আমাদের নমস্য, তবে দূর থেকে। ”
কেস খাবার ভয়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণটা দিয়ে রাখলাম- মদ্যপান স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর।

*****
সব ভাষাতেই সবচেয়ে বেশিবার যে গল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে সেটি ছিল স্বয়ং লেখকের সবচেয়ে অপছেন্দের গল্প। তার নাম দেবদাস – কারণটা কী পাঠকরাই বিচার করুন। ছবিতে ১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় নির্মিত ‘দেবদাস’ ছায়াছবির নামভূমিকায় দিলীপকুমার।

2 comments:

  1. প্রচ্ছদ নিবন্ধটি খুব ভালো লেগেছে। তথ‍্য ও তত্ত্বের সমাবেশ এবং লেখাটির ভারসাম‍্য প্রশংসনীয়।

    ReplyDelete
  2. জীবনে, চলচ্চিত্রে মাতালের বিবিধ মাতলামির মধ্যে যে সরসতা, তারই সন্ধান লেখাটির ছত্রে ছত্রে।

    ReplyDelete