0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















১৬

স্মৃতির শহর – ২

আগের বার কলকাতার ক্লাব ফুড সংস্কৃতির আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে লেখাটির অভিমুখ একরকম অনিবার্যভাবেই ঘুরে গিয়েছিল বিশেষ যে দিকে, তার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল চিংড়ি মাছ। পৃথিবীব্যপী যার সাম্রাজ্য। এমন কোনও রান্নাঘরের কথা কল্পনা করা যায়না, চিংড়ি মাছের অনুপ্রবেশ যেখানে ঘটেনি। আর কলকাতা এবং বঙ্গ রসনার প্রেক্ষাপটে হেঁশেলের গণ্ডী ছাড়িয়ে চিংড়ি পৌঁছে গেছে ফুটবল মাঠে। চিংড়ি আর ইলিশকে নিয়ে আকাশছোঁয়া আবেগ বঙ্গভাষী জনতার মধ্যে তৈরি করেছে তীব্র রেষারেষি। পুব আর পশ্চিম ভাগ হয়ে গেছে ঘটি বাঙালে! বাইশজন খেলোয়াড় এক বিপুল জনসংখ্যার প্রতিভু হয়ে প্রায় একশো বছর ধরে মৎস্যকূলের দুই সদস্যকে হাতিয়ার করে হারজিতের লড়াইটি ছড়িয়ে দিয়েছে খেলার মাঠ থেকে গেরস্থালির অন্দরমহল পর্যন্ত। কিন্তু চিংড়িকে মাছ বললাম কেন? ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এটি পোকাবিশেষ। অবশ্যই তাই এবং এক অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এই প্রাণীটির খাদ্যদুনিয়ায় এক বিশেষ উচ্চতায় উত্তরণের ইতিহাসটি জটিল এবং সুদীর্ঘ। অতীত ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিনা সম্প্রদায় চিংড়ি মাছ রোদে শুকিয়ে চিনে রপ্তানি করতো। তাহলে দেখা যাচ্ছে শুটকি খাওয়ায়ার মধ্যে দিয়েই চিংড়ির জনপ্রিয়তা। কিন্তু এরও আগে অষ্টাদশ শতকেও ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম হওগার্থের আঁকা এক বিখ্যাত ছবি ‘দ্য শ্রিম্প গার্ল’ এ আমরা দেখতে পাই লন্ডনের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক রমণীকে, মাথায় যার একটা বড়সড় ঝুড়ি, যার মধ্যে চিংড়ি, ঝিনুক ইত্যাদি নানান সমুদ্রজাত আহার্য।

ঝিনুকের কথায় মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। বাড়ির পাশেই ছিল পুকুর। সেখানে মাছ ধরা হলে জালে অন্য মাছের সঙ্গে চিংড়ি তো উঠতই, সঙ্গে উপরি হিসেবে জালে পড়ত অনেক গুগলি। আমাদের বাড়িতে সেই গুগলি খুব একটা খাওয়ার চল না থাকলেও পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে অনেকেই খেতেন। অনেক পরে যখন জ্ঞানগম্যি একটু বেড়েছে, তখন জেনেছি পশ্চিমী অভিজাত সমাজে এর বিশাল কদর। গুগলি বা শামুক খাওয়ার জন্য আলাদা রেস্তোরাঁ আছে, আছে বিশেষ রীতিনীতি। সে অনেক ব্যাপার!

যাই হোক, চিংড়ি নিয়ে বলছিলাম। বলছিলাম চিংড়ি বনাম ইলিশের দ্বৈরথের কথা। কিন্ত কেন? পুরো বিষয়টাই আমার কেমন চাপিয়ে দেওয়া মনে হয়। এর মধ্যে একটা মজা অবশ্যই আছে, সেকথা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাকিটা? একটা ‘মক ফাইট’। নকল লড়াই। আমি বড় হয়েছি একটু আলাদা পরিবেশে। সেখানে মোহনবাগান জিতলে আনন্দ করা ছিল বটে, খাওয়া-দাওয়াও হতো কিন্তু তার জন্য খাবার টেবিলে অদৃশ্য বিভেদরেখা তুলে দিতে দেখিনি কখনও। আর এ বঙ্গের সঙ্গে নাড়ির যোগ থাকা সত্বেও চিংড়ি আর ইলিশের মধ্যে বৈরিতা তৈরি করতে দেখিনি কোনওসময়। বরং বাড়িতে উৎসব মানেই জানতাম চিংড়ির মালাইকারি এবং ভাপা ইলিশ হচ্ছেই! এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই থাকত বাবার, একথা বলাই বাহুল্য। এখন পিছনদিকে তাকালে মনে হয় হয়ত চিংড়ির প্রতি সামান্য হলেও পক্ষপাত একটু বেশি ছিল বাবার। এবং সেটা সম্পূর্ণতই ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের বিষয়। আর এই পছন্দের তালিকায় একেবারে ওপরে ছিল যে পদটি, তা হচ্ছে চিংড়ি মাছের মালাইকারি। পাঁচটি জনপ্রিয়তম বাঙালি রান্নার যদি তালিকা করা হয়, চিংড়ির মালাইকারি অনায়াসে সেখানে জায়গা করে নেবে বলেই বিশ্বাস করি। কিন্তু আমরা কি সবাই জানি যে আমাদের একান্ত আপন এই পদটির সঙ্গে প্রতিবেশি রাজ্য উড়িষ্যার যোগ অতি গভীর। সেখান থেকেই সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের হেঁশেলে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার কোনও এক কালে – অনুমান করতে পারি ওই রাজ্যেরই পাচকদের সৌজন্যে। সত্যি কথা বলতে কি বহু বছর ধরে অনেক ভালবাসা দিয়ে আমাদের রসনা নির্মাণ করেছেন অসামান্য স্তরের এই পাচক শ্রেণী। যে বিশেষ ধরণের খাদ্যবস্তুগুলি আমরা বাঙালি বলে গর্ব করি, তার অধিকাংশেই উড়িষ্যার স্বাক্ষর চিরকালীন। এই চিংড়ির মালাইকারি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলে মনটা কেমন হয়ে যায়। আমার কম বয়সের স্মৃতি থেকে বলতে পারি চিংড়ি নিয়ে বাড়তি কোনও ভালোবাসা ছিল না। ভালো লাগত ইলিশ বা পাকা রুই কিংবা কাতলা ভাজা খেতে। আর টান ছিল ফিশ ফ্রাইএর প্রতি। তা সত্ত্বেও মালাইকারির মধ্যে চিংড়ির (বিশেষত গলদার) মাথার ঘিলু মিশে গিয়ে যে একটা অদ্ভুত নেশাধরা স্বাদ তৈরি হয় বা হতো, লালরঙা ঝোলের মধ্যে তৈরি হতো এক আশ্চর্য বর্ণের নকশা, সেটা কোনও অজ্ঞাত কারণে মাথার মধ্যে রয়ে গিয়েছিল, তাই নিজে যেদিন প্রথম মালাইকারি রান্না করলাম, সেদিন অজান্তেই ফিরে গিয়েছিলাম অনেক আগে ফেলে আসা দিনটিতে। সেদিনই এই রান্নাটির সঙ্গে মিশে থাকা আবেগ আর ভালোবাসার মিশ্র স্বাদটি ঠিকঠাক অনুভব করতে পারলাম। এর বেশি কিছু বাঙালির নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই প্রসঙ্গটি নিয়ে বলতে চাইনা।

কিন্তু চিংড়ির প্রভাব এমনই সর্বব্যাপী যে মালাইকারি বাদ দিলেও সসাগরা পৃথিবীর এমন কোনও রন্ধন সংস্কৃতি নেই, যার অন্তত নব্বই শতাংশ রান্নায় চিংড়ি মাছের ব্যবহার নেই। এই শতাংশের হিসেবটা একেবারে ব্যক্তিগত। আমিষ ঘরানার রান্নায় এটা আরও বেশিও হতে পারে। আমাদের সমস্ত রকম ডাল এবং সবজি রান্নায় তো বটেই, আমিষের সঙ্গে আমিষের সহাবস্থান যেসব পদে, সেখানেও এই বস্তুটির উজ্জ্বল উপস্থিতি। এমনও বলা হয় যে কোনও রান্নার জাত বদলে দিতে চিংড়ি তো বটেই, চিংড়ির গন্ধই যথেষ্ট। কথাটা একশোভাগ সঠিক। তুলনায় ইলিশ অনেকটাই যেন ‘শ্রেণী-সচেতন’! নির্দিষ্ট ঋতু, জল, তাপমাত্রা এরকম অনেক বিষয় আছে যার ওপর এর গুনাগুণ নির্ভর করে। স্যামন যেরকম। ইলিশের মতোই স্যামনেরও নানান শ্রেণীবিভাগ আছে। নরওয়ের সমুদ্রে যে স্যামন পাওয়া যায় তার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের নাকি বিস্তর ফারাক! সেকথা অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।

ইলিশ মাছের কথা যখন উঠলোই, তখন আবার ফিরে যেতে হবে কম বয়সে, যখনও মহানগরে পাকাপাকিভাবে থাকতে আসিনি। গঙ্গার খুব কাছেই ছিল আমাদের বাড়ি আর আরও কাছে ছিল বাজার। সে বয়সের আবছা স্মৃতির ছবিতে দেখতে পাচ্ছি বাবার সঙ্গে বাজারে গেছি, যেখানে সদ্য জালে পড়া ইলিশের ঝাঁক এসেছে। আলো ঠিকরে পড়ছে সেই মাছগুলির গা থেকে। তখনও যেন নড়ছে তারা একটু একটু। সেইসময় এবং তার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত দেখেছি দেড়/দু-কিলোর কম ওজনের ইলিশ মাছকে ইলিশ বলে গণ্য করা হতো না। আর সেই মাছ কাটা হতো গাদা-পেটি মিলিয়ে গোলাকার আকৃতিতে। সেই মাছ রান্নার পর প্রথমেই আমাদের চোখ গিয়ে পড়ত ডিমের দিকে। ইলিশ মাছের ডিম! দেবভোগ্য শব্দটার অর্থের মধ্যে কি মানুষকে বঞ্চিত করার একটা ইঙ্গিত আছে? তাহলে এই শব্দটির সঙ্গে সহাবস্থান মুশকিল। অন্যথায়, এর ইংরেজি অর্থ হিসেবে আমার সেইজন্য divine এর থেকে sublime শব্দটা বেশি পছন্দ। অন্য কোনও শব্দ দিয়ে এই বস্তুটিকে সংজ্ঞায়িত করতে পারছি না। দুঃখিত! একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কোনও এক আত্মীয়ের পারলৌকিক ক্রিয়া মিটে যাওয়ার পর নিয়মভঙ্গের দিন দ্বিপ্রাহরিক খাওয়া-দাওয়ার আগে অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করার জন্য ছিল শুধুই ইলিশ্ মাছের ডিম! হেরিং গোত্রভুক্ত এই মাছটি যতক্ষণ নোনা জলের বাসিন্দা, ততক্ষণ ইনি বঙ্গরসনার বিচারে এলেবেলে। কিন্তু যে মুহূর্তে গঙ্গার মিষ্টি জল লাগলো এদের গায়ে, কোনও অলৌকিক কারণে যেন ইলিশ হয়ে উঠলো আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলের সদস্য!

আজন্ম ইলিশের স্বাদে লালিত এই বঙ্গসন্তানের যখন জীবনের কোনও একটা পর্যায়ে এসে প্রথম স্যামন আস্বাদনের সুযোগ ঘটলো, কেন জানিনা মনে হলো এর সঙ্গে ইলিশের মিল আশ্চর্যজনক! আমার এই মন্তব্যে আমাকে কেউ কেউ মহামূর্খ ভাবতে পারেন। তাতেও আমি আমার ধারণায় অটল থাকবো। প্রথমত দুটি মাছেরই শারীরিক গঠন একইরকম। একাধিক স্তরের এক বিচিত্র বিন্যাস। কামড় দেওয়ামাত্র অনেকখানি চলে আসে মুখের মধ্যে। যদিও ইলিশের মধ্যে যে কাঁটার আধিক্য, স্যামনে তা নেই মোটেই। তবে স্যামন শুধুই উৎকৃষ্ট খাদ্য। ইলিশ শুধু খাদ্য নয় আবেগ। এক অনতিক্রম্য রোম্যান্টিসিজম। যার কোনও সমান্তরাল আর কোথাও দেখিনি। এর খুব কাছাকাছি হয়তো যেতে পারে পারমেজান চিজ বা পারমা হ্যাম নিয়ে ইতালিয় আবেগ। কিংবা কোনও বিশেষ অঞ্চলের ওয়াইন নিয়ে ফরাসি আদিখ্যেতা।

শত প্রলোভন থাকলেও এ লেখাকে চিংড়ি-ইলিশের যুগলবন্দীর বাইরে যেতে দেবো না। আর চিংড়ি দিয়ে যেহেতু এ লেখা শুরু করেছিলাম, শেষের আগে একটি বিশেষ রান্নার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। আটপৌরে অথচ অসাধারণ। চিংড়ি এবং নারকেল দিয়ে মুখি বা গাটি কচু। অনেককাল আগে আমার প্রয়াত শ্বশ্রূমাতা এই পদটি প্রথম রান্না করে খাইয়েছিলেন। তারপর বারবার খেয়েছি এবং একটা পর্বে এসে নিজেও রান্না করা শুরু করি। প্রথমে কচুগুলি ডুমো ডুমো করে কেটে নিতে হবে। তারপর প্রেশার কুকারে একটা সিটি। এরপর কিন্তু কুকারের ঢাকনা খুলে দিতে হবে নাহলে মুশকিল। এরপর আগে থেকেই নুন-হলুদ মাখানো চিংড়ি মাছ হালকা করে ভেজে নিতে হবে। তারপর সেই তেলেই দিতে হবে আস্ত জিরে, তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা। ফোড়ন তৈরি হয়ে গেলেই তাতে সিদ্ধ কচুর টুকরোগুলো দিয়ে সামান্য কষে তাতে দিতে হবে আদা বাটা, জিরে গুঁড়ো আর অল্প হলুদ আর চিনি। এরপর আর তেমন কিছু করার নেই। আরেকটু কষে পরিমাণমতো নুন আর একেবারে শেষে গরম মশলা আর নারকেল কোরা। আমি নামানোর সময় দিই দু-চামচ ঘি, যা আমার ব্যক্তিগত সংযোজন। এই পুরো প্রক্রিয়াটা যেকোনও ন্যুনতম দক্ষতা সম্পন্ন রাঁধুনির কাছে জলভাত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রান্না ব্যাপারটা যেহেতু এককভাবে দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল নয়, তাই ফলাফলের তফাৎ হতে পারে আকাশ-পাতাল। তাই একথা মেনে নেওয়াই ভালো যে অনেক যত্ন করে রান্না করার পরও সেই স্বাদটির অনুসন্ধান আজও করে চলেছি, যা সাড়ে তিন দশক আগে আমায় মুগ্ধ করেছিল। শীতকালে মিটসেফের মধ্যে দুপুরে রান্না করা কচু চিংড়ির ওপর পড়ে থাকতো অদ্ভুত একটা সর। সেই সর কেটে পদটির অন্তঃপুরে প্রবেশ করা ছিল এক অবর্ণনীয় ভালো-লাগার অনুভূতি।

চলবে

0 comments: