0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





এবার দূর্গাপূজোর সময় আমাদের আশ্রমের 'এস্কার্সন' হবে দার্জিলিংয়ে। আচ্ছা, এস্কার্সন মানে কী? অমন খটোমটো কোন শব্দ তো ক্লাস নাইন অব্দি কোন বইয়ে পাইনি! কিন্তু বিপ্লব তো হেয়ার স্কুলের। ও আমাকে মানে বলে দিল। আমি গর্বিত। আমাদের ব্যাচে শুধু আমিই ওই কঠিন শব্দের মানে জানি।
থাকা হবে স্নোভিউ হোটেলে; স্বামীজি, মানে রামানন্দদা অর্থাৎ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ চিঠি লিখেছেন। যারা যারা যেতে চায় তাদের সবাইকে গার্জেনের চিঠি শুদ্ধু একটি নির্দিষ্ট টাকা ১৫ দিনের মধ্যে আশ্রমের অফিসে জমা দিতে হবে।
আমি ও বিপ্লব নানা রকম প্ল্যান করি, স্বপ্ন দেখি। দার্জিলিং!! হিমালয়! বরফ! শুধু ছবিতে দেখেছি। স্কুলের পাঠ্যবই 'কিশলয়' এ জলধর সেনের বর্ণনা পড়েছি; টয় ট্রেন! ওখানে তো শুধু বড়লোকেরা যায়। যেমন আমাদের কোলকাতার ভাড়াবাড়ির উল্টো দিকে বিশাল দোতলা বাড়ির দত্তদের ছেলেমেয়েরা। তবু আশ্রমের সুবাদে আমরাও যেতে পারব। স্টুডেন্ট কনসেশন, আরও কী কী সব। হটাৎ বুকের মধ্যে আশ্রমের জন্যে একটা ভালবাসার জোয়ার টের পাই। রামানন্দদার জন্যেও।
এখানের চারদেওয়ালের মধ্যে হাঁফিয়ে উঠি, খোলা আকাশের নীচে কী আনন্দ!
বাবার চিঠি এল। গত দু'বছর পরপর আমাদের দুভাইকে বাবা এস্কার্শনে পাঠাতে কোন আপত্তি করেন নি। রাজগীর-বোধগয়া বা ম্যাসানজোড়। এবার সম্ভব হবে না। আর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন আরও দু'লাইন। এখন ক্লাস নাইনে আমার পড়াশুনো নিয়ে আরও সিরিয়াস হওয়া উচিত , নইলে পরে পস্তাতে হবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে সমস্ত প্রশ্নপত্রে্র সেক্শন এ বা ৫০% প্রশ্ন তো নাইন-টেন থেকেই আসবে। আমি সিরিয়স না হলে পরের দু'ভাইয়ের কী হবে? ওরা বিপথগামী হবে।
রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যায়।
আমি তাহলে মেড়ার পালের সর্দার মেড়া। আমি যে দিকে যাব,ছোট দুভাইও সেদিকে? দুস্‌ শালা!
দুদিন পরে বিকেলে আমি ও বিপ্লব নতুন স্কুল বাড়ির আদ্ধেক তৈরি অংশটায় মিট করি। ও বলে--শোন, একটা রাস্তা আছে। আমি বাবাকে বলে তোর পয়সাটা জমা করিয়ে দেব। তুই বাড়িতে বলবি--তোকে কনসেশন দিয়েছে।
আমি মাথা নাড়ি। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার চোখে জল।
বলে-- আমিও যাব না। তোকে বাদ দিয়ে অন্য ফালতুগুলোর সঙ্গে !! সেবার রাজগীর আর বোধগয়া এস্কার্শনের সময় কত আনন্দ হয়েছিল ভাব তো!
সপ্তপর্ণী পাহাড়, বিপুলগিরি বা প্যাগোডায় আমরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। রোজ রাত্তিরে ক্যাম্প ফায়ারে দুজনে মিলে কোন স্কিট বানিয়ে অ্যাক্টিং করেছি। ও খুব ভাল মাউথ অর্গান বাজায়। বাজিয়েছিল-- এ অপনা দিল তো আওয়ারা, আর নতুন হিট ইংরেজি সিনেমা কাম সেপ্টেম্বরের থিম মিউজিক,
রামানন্দদা সংগীত নাটক বোঝেন, পছন্দ করেন। আপত্তি করেন নি।
তবে ফেরার পথে রাত্তিরে ট্রেনে আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা মনে পড়তেই দুজনে হেসে উঠলাম।
ওই প্যাসেঞ্জার ট্রেনে একটা গোটা কামরা আমাদের জন্যে রিজার্ভ ছিল; থার্ড ক্লাস। সন্ধ্যের পরেই ট্রেনের আলো নিভু নিভু হতে হতে একেবারে চলে গেল। রান্না তৈরি ছিল। সমবেত টর্চের আলোয় আমরা লুচি, আলুর শুকনো তরকারি ও তিনটুকরো মাংস দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম।
সবাই শুয়ে পড়েছে।
কিন্তু কোথা থেকে একটা গানের আওয়াজ আসছে না? আন্দাজে ভর করে এগিয়ে দেখি রামানন্দদা হারমোনিয়ামে বসেছেন। উল্টোদিকে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছেন শিবনাথ গোস্বামী ও তাঁর সঙ্গিনী মহিলা। উনি তখন অ্যাডভান্সড্‌ পাপেট শো করিয়ে কোলকাতায় বেশ নাম করেছেন। আমরাও দেখেছি।
একটা গান শেষ হল। শিবনাথ দূর্গা রাগের ফরমাশ করলেন। রামানন্দদা একটা সরগম বাজিয়ে আরোহ, অবরোহ, পকড় দেখিয়ে দিয়ে গান ধরলেন, অন্তরায় ছিল--"রামকৃষ্ণ বলে আপনার মনে , কালীনাম বিনা কর্ণে নাহি শুনে"।
এরপর টর্চের ব্যাটারি নিভে যাওয়ায় ওঁরা উঠলেন। রামকানাইদা আমাকে দেখে বললেন--- কী রে ব্যাটা! ভালো লেগেছে? আশ্রমে ফিরে চল, কথা হবে। এখন শুতে যা!
আমি ফিরে এসে দেখি আমার আর বিপ্লবের বিছানা মুখোমুখি দুটো বাংকে। নীচের বেঞ্চের একটায় কেউ ঘুমোচ্ছে আর অন্যটায় ক্লাস টেনের অসীমদা জানলার কাছে বসে টর্চ জ্বালিয়ে বাইরে ছুটে চলা ঘন জঙ্গল দেখছে। বললাম-- সেল ফুরিয়ে যাবে যে! ঘুমোবে না?
-- আর এক জোড়া এক্স্ট্রা আছে। ঘুম পাচ্ছে না। তুই শুয়ে পড়।
আমি ওপরে উঠে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবতে থাকি, ভেড়া গুণি, ঘুম আসে না।
একটা চাপা হাসির শব্দ; কী রে ? খুব গান শুনছিলি?
আরে? বিপ্লব ঘুমোয় নি!
তোর সঙ্গে কথা না বলে ঘুমোতে পারি?
মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। আমরা ফিসফিস করে গল্প শুরু করি। মনে হয় ট্রেনের গতি আর 'তুমি থাকো, আমি যাই" ছন্দের দোলায় কারও ঘুম ভাঙবে না,
কিন্তু একটু পরে অসীমদা চাপা গলায় ধমকায়-- আবে! তোদের ন্যাকড়াবাজি শেষ হয় না, অ্যাঁ? ঘুমো।
খানিকক্ষণ সব শান্ত। ফের শুরু হয় ফিসফিসানি।
অসীমদা তেতো গলায় বলে--বাঞ্চৎ গুলোর মাঝরাত্তিরে রস উথলে উঠেছে!
আমি বলি--আমরা কি লাকি রে! গোটা ট্রেন ঘুমোচ্ছে। শুধু আমরা দুজন জেগে আছি।
-- তাহলে তোর নাম হল লাকি।
-- মানে?
-- আরে কোলকাতা পুলিশের কুকুরের নামকরা একটা জোড়া আছে না? আজকাল কাগজে ওদের কথা খুব বেরোচ্ছে।--লাকি আর মিতা।
--- তুই তাহলে মিতা?
--হ্যাঁ; শোন, এটা আমাদের কোড নাম। এই নামে আমরা নিজেদের মধ্যে চিঠি লিখব। নিজেদের ডাকব। কেউ টের পাবে না। কী মজা!
ও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমিও বাড়িয়ে দিই। কিন্তু কেউ কাউকে ছুঁতে পারি না। ও বাংকের থেকে একটু কিনারার দিকে গড়িয়ে আসে। এবার ছোঁয়া যাচ্ছে।
আমার কী যে মনে হল-- আমি হাত বাড়িয়ে ওর কনুইয়ের ভাঁজে একটা চপ মারলাম। ও টাল সামলাতে না পেরে মাথা নীচের দিকে করে পড়ে গেল। কিন্তু ওর মাথা মাটি ছোঁয়ার আগে আমার দু'পা কাঁচির মত ভাঁজ হয়ে ধরে ফেলেছে ওর গোড়ালি। ও ঝুলছে বিপজ্জনক ভাবে, মুখে চাপা আর্ত চিৎকার!
নীচের থেকে অসীমদা লাফিয়ে এসে ধরে ফেলেছে ওর মাথা। ওদিকের বেঞ্চ থেকে ঘুমন্ত ছেলেটি অসীমদার ডাকে উঠে এসে ধরে ফেলেছে বিপ্লবকে। ওরা দুজনে আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয়।
আমি নীচে নেমে আসি। বিপ্লব স্বাভাবিক হতে একটু সময় নিল।
-- কী করে পড়ে গেলি বলত? আর একটু হলেই বিচ্ছিরি চোট লাগত। কেউ ধাক্কা দিয়েছিল?
আমি জনলা দিয়ে বাইরে তাকাই।
বিপ্লব কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-- ঝিমুনি এসেছিল, বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম। গড়িয়ে পড়েছি।
-- যত্ত সব ঢ্যামনামি! এসব হল নতুন বাল গজানোর চুলকুনি।
পরের দিন বিকেলের মধ্যে আশ্রমের সবাই জেনে যায় অসীমদার উপস্থিত বুদ্ধি ক্যাচ ধরার টেকনিক আর আমাদের দুজনের ঢ্যামনামির গল্প।
আমাদের নিজস্ব রইল শুধু দুটো শব্দ-- লাকি আর মিতা।

চলবে

0 comments: