0

অনুবাদ সাহিত্যঃ ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in








অনুবাদ সাহিত্য


Death of a boy
মূল ইংরিজি গল্পকারঃ জয়ন্ত মহাপাত্র

ঈশানী রায়চৌধুরী 




আমি বাবা | একসময় ছেলে ছিলাম | আজ কেমন ভূমিকা দুটোর অদলবদল , না ? এই যে ছেলেটা এখন হাসপাতালের বিছানায় | আমার ছেলে | ছোটই | মাত্র ন'বছর !


আচ্ছা, এই ইংরিজি ভাষাটা কিন্তু ভারী অদ্ভুত ! নাইন ইয়ার ওল্ড নাকি নাইন ইয়ার ইয়াং ? জানি না | আমি সত্যিই জানি না | যখন হেলান দেবার মতো কোনো শক্তপোক্ত স্মৃতি থাকে না অথবা বর্তমানটুকুকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে হয়, তখন এই বয়সের হিসেবনিকেশে কি খুব বেশি কিছু যায় আসে ? এই বয়স, এই সময় তখন সময়বিহীন এক শূন্যতাই তো শুধু ! 


কিন্তু ব্যথা আছে, কষ্ট আছে ...সব আছে | ঠিক আমার সামনে | ওই হাসপাতালের খাটে সটান শুয়ে | এই যন্ত্রণার দৈর্ঘ্য ঠিক একশ ' কুড়ি সেন্টিমিটার |এ কিন্তু যেমন তেমন কষ্ট নয় ! এতে অন্য কিছুর মিশেল আছে | ভয় ! এই দুই বোধ কেমন হাত ধরাধরি করে …. আর তার বিভাজন রেখাটি বরাবর আমার অস্তিত্ব শুয়ে আছে | একা ! 


হাসপাতালের খাট | অনেক খাট | পরপর | একটার সঙ্গে অন্যটার ফারাক শুধু ক্রমিক সংখ্যায় | দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নম্বর | খাটের মাথার কাছে..ওই নম্বর সর্বময় কর্তা ! হালকা হলুদ বিছানার চাদর , লাল চৌখুপী কম্বল , হিম হিম ইস্পাতের ফ্রেম... খাট মানে তো এই ! এই স্থলভূমি এখন আমাদের বাসভূমি | 


আমি বিড়বিড় করে মুখস্ত করে নিচ্ছিলাম আমার ছেলেটার খাটেরর নম্বরটা | যদি কেউ জানতে চায়..কত নম্বরে আছে , যদি দেখতে আসতে চায় ! এই একটু সমবেদন, নীচু গলায় মন খারাপের টুকিটাকি.. আমাদের শেষ পারানির কড়ি ! না হলে আমার কিচ্ছুটি যায় আসে না | মানে ওই নম্বরের কথা বলছি আর কী ! আমি ঠিক চোখ বন্ধ করে হাসপাতালের লম্বা করিডর ধরে স্রেফ একটা কুকুরের মতো ওর কষ্টের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ওই বিছানার কাছে পৌঁছে যাবার হিম্মত রাখি | এই শিশুবিভাগে কত কত বাচ্চারা আর তাদের বাবারা ... নীহারিকাপুঞ্জ যত কষ্টরা .. আমার আর কোনো কিছুতেই কোনো হেলদোল হয় না | 


তিনদিন | এই তো তিনদিন আগে আমরা ওকে এখানে এনেছি | হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে | উফ.. কী তীক্ষ্ণ সাইরেন বাজিয়ে ছুটছিল গাড়ি ! কেমন ককিয়ে ককিয়ে হাহাকার করে ! ওর কী যে কষ্ট ! কী বলি আমি ওকে ? জানি কষ্ট, দেখছি কষ্ট | ওর হাসির রুপোলি জরি আমাদের আকাশে .. এখন কালো রাগী মেঘের আড়ালে | মেঘ আর কাটেই না..কাটেই না... 


খোকা, কী ভাবিস তুই শুয়ে শুয়ে ? ভাবিস কি আদৌ কিছু ? তুই বুঝিস আমার কষ্ট.. এই যে চোখ রাখি না তোর চোখে..ভয়ে..কী ভীষণ ভয়ে..যদি তুই তোর আয়ু ফুরোবার নিভু নিভু আলো দেখতে পাস আমার চোখের তারায় ? সেই আলো, সেই ছায়া ? 


তুই তো আমারই মতো | আমার মুখ , আমার চোখ , আমার হাত . কিন্তু আমার আয়ু তো তোর নয় ! আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল সরীসৃপ নেমে যায় এই কথা ফিসফিস করে বলতে বলতে | আমি এই এক কথা পড়তে পারি অক্লেশে..তোর খাটের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা তোর মায়ের ওই মরা মাছের মতো নিষ্প্রভ চোখে | 


"ডাক্তারবাবু ..." কথা শুরু করি | কিন্তু কী যে বলি ! কত কথাই যে জানার আছে , বলার আছে ! মন এলোমেলো | দৃষ্টি উদভ্রান্ত | আমার | 


ডাক্তার বলছেন , " ঘুমের ওষুধের মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিতে হবে, বুঝলেন ! ওর ঘুমটা গভীর হওয়া দরকার | " 


ডাক্তারবাবু পাশেই সাদা ধবধবে পোশাক পরে থাকা নার্সের হাত থেকে চার্টটা নেন | কী সাদা পোশাক ! এক ফোঁটা ময়লা নেই | চৌকোণা কাগজে খানিক কলমের হিজিবিজি | 


ছেলেটা আমার আচমকা বালিশ থেকে মাথাটা তুলল | তোশক থেকে নিজেকে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে মরণঝাঁপ দিতে গেল বুঝি ! পুরো শরীরটা অসহ্য যন্ত্রণায় বেঁকে ধনুকের মতো | চোখ দুটো কেমন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে , ভয়ে | হাঁ করে খাবি খাচ্ছে ...আরও বাতাস চাই ফুসফুসে , আরও বাতাস. অনেক অনেক ... ওর শীর্ণ আঙুলগুলো টানটান হয়ে গেল, তারপর পুরোপুরি বেঁকে ...শিরাগুলো দপদপ দপদপ ...শুকনো পাথরের গায়ে | 


নারীকন্ঠের ওই আর্ত চিৎকার ? এই নারীটি আমার সঙ্গে আজ তো বড় কম দিন নয় ! এতগুলো বছর ! নার্স ওর কাঁধ চেপে ধরেছে...আহা, সান্ত্বনা ...সান্ত্বনা.. নার্সের ঠোঁট দুটোও কেমন দুমড়ে মুচড়ে একাকার | দু:খে, সহানুভূতিতে | ডাক্তারবাবু ঝুঁকে পড়েছেন খাটের ওপর | 


নারীটির দু'চোখের মণি .কালো কাচের বুদবুদ | ওরা বলছে, " আমার ছেলে নয় |ওই খাটে যে শুয়ে , সে এক অচেনা পশু ...খিদেতে তোলপাড় করে দিল সব |" 


ছটফটানি এল | গেল | খুব দ্রুত | ছোট্ট কালচে মুখটা ভেসে গেল ঘামে | আর আমার মুখের ভেতরে লোনা জলের বান | নার্স অভ্যস্ত হাতে ওই ফুটি ফুটি কালো বিন্দুতে আবার ... ওখানেই তো..মরফিন ইনজেকশন | আমি কী করে যে শুনতে পাচ্ছি ওর মায়ের হৃদপিণ্ডে দুরন্ত দামামা | ওর মা ডাক্তারকে বলছে...স্খলিত স্বরে , " খোকা ভালো হয়ে যাবে তো ?" 


কোনো মানে হয় ?


নির্বোধ নারী ! 


জানি না | আমি সত্যিই জানি না | মুখে নয় | আমার চোখ দুটো সে কথা বলে | ডাক্তারবাবুও জানেন না | আর এই ছোট্ট নিরীহ প্রশ্নটা কী বিপুল তরঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে ফিরে যায় হাসপাতালের দেওয়াল জুড়ে | 


ডাক্তারের চোখ পাশে বিছানার রোগীর দিকে | একটু কি অধৈর্য দেখাচ্ছে ? জুনিয়র ডাক্তাররা ছেঁকে ধরেছে... ডাক্তারবাবু কী বলবেন এবার ? 


আমি আর আমার স্ত্রী | খোকার মা আর আমি | দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে | কিছুই তো মাথায় ঢোকেনা ছাই..কী সব সাপ ব্যাং শক্ত শক্ত ডাক্তারী পরিভাষা যে বলে এরা ! বাতাসে ভাসে ভারী ভারী শব্দের দুর্বোধ্য ভয়াল গন্ধ | আমরা শুধু পারি এভাবেই অপেক্ষায় অপেক্ষায় বার্ধক্যে পৌঁছতে... দাঁড়িয়ে ..দাঁড়িয়ে.. 


আমাদের প্রথম সন্তান কেমন ডুবে যায় কষ্টের অতল অন্ধকারে... 


ওর মা ওর পাখির মতো হালকা শরীরটা ঢেকে দিল চাদর দিয়ে | এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল শরীরটা | চোখ বন্ধ | এখন তো আর অলৌকিক কিছু ঘটে না ! এখন জীবনটাই অলৌকিক | বেঁচে থাকাটাও | ওর মা সেই অলৌকিকের স্বপ্ন দেখে | প্রথম ভোরের নরম মায়াবী আলোয় পাখিদের উড়ান , আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে খোকার অপরিণত হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি প্রথম অনুভব করে রক্তে লোহিতকণিকাদের দুরন্ত ছুটোছুটি ... 


আমি ওকে বলতে চাইছিলাম , "এভাবে নিজেকে অচল করে রেখো না |"  পারলাম না ! মুখ খুলি, মুখ বন্ধ হয়ে যায় | আমার হৃদপিণ্ড এখন শুধুই একতাল অবুঝ যন্ত্রণা | আমার কাঁধে কেউ হাত রাখে না কেন ? আমার বাবা...না না..তা কী করে হয় ! বাবা তো সেই কবেই... 


এখন যে আমিই বাবা ! আমার ছেলেটা শুয়ে গভীর অন্ধকার গহ্বরে | ওর নি:সঙ্গ শরীর আমি স্পর্শ করতে অপারগ | ওর মাও তো পারে না | ডিমালো মুখটি তার নরম শান্ত চোখদুটিকে সম্বল করে তাকিয়ে থাকে ছেলের পাণ্ডুর মুখের দিকে | কেউ ছুঁতে পারে না ওকে | যারা ওকে দেখতে আসে ভিজিটিং আওয়ার্সে.. তারাও না ! তারাও প্রাণপণে এই চিন্তাটাকে আড়াল করতে চায় যে কী ভয়ঙ্কর তমসা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য | দেখতে পাই , বুঝতে পারি..সবাই হিম হয়ে যায় ...যখন অসহনীয় যন্ত্রণা নখ দাঁত বের করে হামলে পড়ে ওই ছোট্ট জীর্ণ শরীরে ...


ঝড়ের তাণ্ডব ! 


" খোকা , খোকা রে .." 


উত্তর এল না | শুধু অবোধ চাউনি মাথার কাছে বসে থাকা মায়ের মুখে | একটু কি ঝিলিক খেলে যায় খোকার চোখে ? চোখদুটি তো এখন সম্পূর্ণ খোলা | সব জেনে যাওয়ার কষ্ট , সময় ফুরিয়ে ফেলার কষ্ট ...ও কি দেখতে পাচ্ছে..অন্য চোখের আলোয় ? 


" এই দেখ , কে এসেছে তোর কাছে..." 


"খোকা .." 


খোকা শোনে | শোনে | একটা ক্লিষ্ট হাসি | খুব বাধ্য ছিল | আমাদের সব কথা শুনত | এখনও পারছেই না আমাদের কথার অবাধ্য হতে ! ওর চোখ ভিজেছে জলে | ঘাসের মাথায় শিশিরকণা জ্বলে | 


" জল. মা গো , একটু জল ! " 


ওর মা এখন আমার দিকে তাকিয়ে | আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিই | এক চামচ জল..ওর আধখোলা ঠোঁটের ফাঁকে | আরও জল চায় | আরও | 


ওর মা বলে, "খুব কষ্ট হচ্ছে, খোকা ? " 

আঁচলে মুছে যায় খোকার কপালের ঘাম | আমি বুঝি !

হায়...নির্বোধ নারী !

আমাদের সর্বাঙ্গ ঢেকে দেয় নৈ:শব্দ্য | ভারী সীসের চাদরের মতো | কিংবা যে নিস্তব্ধতা ছুঁয়ে থাকে দিগন্তরেখাটিকে ...রাত্রিশেষ আর অহনার অমলিন সন্ধিক্ষণে | 


আর একটা দিন আসে | যায় | আমার পাশের নারীর চেহারায় বয়সের সর | দুশ্চিন্তার পলিমাটি | ও কেমন শান্ত হয়ে গেছে ! অন্ধকারে খোকার কষ্টের হাতে হাতটি রেখে চুপটি করে বসে থাকে | আমি দেখি..সাদা পোশাকে নার্সরা আসে, যায় .. কী সন্তর্পণে পা ফেলা . নিখুঁত ছন্দে ! এভাবেই দেখি ধূসর অস্বচ্ছ মৃত্যুর ছায়ামুখ মার্জারভঙ্গিতে এগিয়ে আসে আমাদের সবার জীবনে ! আমার খোকার বিছানার দিকেও...নি:শব্দচরণে | আর আমি অবাক হই না | আমি কি তবে ভয় পাই ..সেই সব স্বপ্নকে ..যারা আমার কষ্টের ক্ষতমুখে শীতল কুয়াশা মাখিয়ে দেয় ? হয়ত না | ঘরে কত ফিসফিস কথা ! ভরসা দেয় সবাই | আমি ওই খড়কুটো আঁকড়েই তো বেঁচে থাকি ... রোজ ! নীলচে হিমেল বাতাস আমাদের মুখে গায়ে লেপটে থাকা ছায়াগুলোকে আলিঙ্গন করে | এই বাতাসে আমি শ্বাস নিই আর এই বাতাস আমার খোকার ফুসফুসের আওতা থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যায় | 


জানি আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেব নির্ঘুম রাত | সবাই তখন ঘুমে | ও যে আমার ! আমার নিজের ! তীব্র ঘুমের ওষুধ গরলধারা হয়ে পুড়িয়ে দেয় ওর শীর্ণ শরীর আর আমি ওকে আগলে রেখে স্বপ্নে থাকি ! ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ওর মানসিক বিকলন ঘটেছে | ওর ঘূণধরা হাড়ের অন্ধকার খাঁচাটার ভেতর পাক খেয়ে মরে ওর স্বপ্নরা | ওই স্বপ্নরা ঠিক দেখতে পায় আমি কেমন শ্যেনদৃষ্টিতে নজর রাখছি ওর ওপর , আমাদের জীবনের ওপর... নিছক
নিয়মনিষ্ঠায় | 

বিছানায় খাবি খায় ছেলেটা | এত কম বাতাস কেন ? একঝলক বিষব্যথা ওকে নিয়ে নিষ্ঠুর আনন্দে লোফালুফি খেলে শূন্যে | লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় হাসপাতালের শিশুবিভাগের কুড়িটা খাটে শুয়ে থাকা বাচ্চাগুলো | সময় ফুরিয়ে আসার আর্তি ...বোধশক্তি ঝিমিয়ে আসারও |

শরীরটা নিশ্চল , শান্ত | আমিও তো তেমনটাই | ওর হাতের নীচে , পায়ের নীচে, পুরো শরীরটার নীচে আলস্যে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে আমাদের ফাঁকা হয়ে যাওয়া পাখির বাসা | ওর ঘষা কাচের মতো চোখের মণিজোড়া , ওর ঈষৎ খোলা ঠোঁট ...আমাকে অজান্তেই এক অদৃশ্য আততায়ীর মুখোশ পরিয়ে দেয় | 

একা একা শ্লথ গতিতে সামান্য আওয়াজ তোলে অক্সিজেন সিলিণ্ডারের গাড়িখানা | চার দেওয়াল জুড়ে কী ভয়ানক সে প্রতিধ্বনি ! গাড়িটা গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসে বিছানার দিকে ! দু:খী মুখের নার্সটি ত্রস্ত পায়ে ছুটে যায় বাইরে ..... 

আমার চোখের সামনে ওয়ার্ডের রাতবাতিগুলো কেমন নিষ্প্রভ হয়ে আসে | নিষ্প্রভ আর ক্ষয়াটে | অথচ বাইরে ওই অন্ধকারের আলো জানান দিয়ে যায়... ভোর হয়নি | এখনও |







0 comments: