0

ছোটগল্পঃ সুভাষ মিত্র

Posted in


ছোটগল্প


অবশেষে 
সুভাষ মিত্র



ভূতপূর্ব বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, নাম “সিজুয়া”। নানারকম সাইজের টিলা, সবুজ জঙ্গলে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ। শিল্প এলাকা, শিল্প বলতে কয়লা খাদ, আর গ্রাম্য কুটীর শিল্প। একদিকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কেবল গভীর কয়লা খাদান, কোনওটা গভীর কোনওটা অগভীর, বিরাট হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে, যেন পেলে এখনি গিলে খায়।

অন্য দিকে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মনোরম পাকা বাসস্থান। কিছু দূরে অধস্তন কর্মচারীদের কাঁচা পাকা বাড়ি যেন বেমানান। কিছু দূরে নিম্ন শ্রমজীবীদের কাঁচা বাসস্থান যেন আরও ভূ তুড়ে  লাগে। উচ্চপদস্থ ও অধস্তন শ্রেনীর বাসস্থানের পরিবেশ বেশ ভালো। তারা বিদ্যুৎ, জল রাস্তা সব সুবিধা ভোগ করছে, নিম্ন শ্রমজীবীদের অবস্থা অবর্ণনীয়। সরু কাঁচা রাস্তা, মাত্র দুটি টিউবওয়েল, হ্যারিকেনের আলো, খাপরার ঘর, এই তাদের প্রাপ্তি। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, সন্ধ্যা নামতেই ওই অন্ধকার পল্লী একটা মাদকতা , নেশাসাতে মত্ত হয়ে ওঠে।ওটা ছাড়া ওদের কোনও স্বাদ , আহ্লাদ , আনন্দ কিছু নেই। চোলাই, হাঁড়িয়া, খিস্তি, নারীদের ওপর স্বামীদের অত্যাচার, এটাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ কি তারা জানে না। 

অন্য দিকে বিত্ত ও মধ্যবিত্ত বসবাসকারীদের জীবন সম্পূর্ণ অন্যরকম, সন্ধ্যা হতেই ঘরে ঘরে বিদুতের আলো, পাশেই ক্লাব হাউসে বিনোদন, বিলাতি রঙিন বোতলের পানীয়ের ফোয়ারা, নাচ, গান, ঢলাঢলি, কিছু বাকি থাকে না। একটা অন্য জগৎ । এখানে এই এক একটি শ্রেণীর বাসস্থানের এলাকাকে শ্রেণী অনুযায়ী “কলোনি” বলা হয়ে থাকে। নামগুলি এই ভাবে রাখা হয়, অফিসারস কলোনি, স্টাফ কলোনি, লেবার কলোনি। এই লেবার কলোনি নিয়ে এই কাহিনী শুরু।

এই লেবার কলোনি তে সবরকম পেশার শ্রমিক থাকে। কাহিনিটা এক সাফাই কর্মীকে নিয়ে। মহেশ বাল্মিকি, লছমী বাল্মিকি, সংগীতা বাল্মিকি, আর মুন্নি বাল্মিকী। এদের সংসারে এই চার জন সদস্য।

মহেশের কাজ সকালে, লছমীর কাজ বিকালে, সংগীতা আর মুন্নি, দুই মেয়ে, একজনের বয়স পাঁচ, অন্য জন দেড় বছর। সকাল, বিকাল মা ও বাবা পালাপালি করে এদের প্রতিপালন করে। সংগীতার ব্যবহার খুব মিষ্টি ও শান্ত স্বভাবের, মহেশ সে তুলনায় বেশ রুক্ষ। বেশির ভাগ সময় নেশাগ্রস্ত। এই নিয়ে ওর সংসারে অনেক অশান্তি, ঝগড়া প্রায়শই লেগে থাকে, মাসের নিজের উপার্জন সব নেশাতে শেষ করে দেয়। ওর স্ত্রীর উপার্জনে কোনও রকমে সংসার প্রতিপালিত হয়। সন্তান দুটির ভরণপোষণ ঠিক মত হয় না। মহেশ নেশার টাকা না পেলে স্ত্রীকে মারধোর করে জোর করে টাকা কেড়ে নিয়ে নেশার ঠেকে হাজির হয়। একদিন তো লছমী টাকা দিতে না চাওয়ায় দেড় বছরের বাচ্চাটিকে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল। সে যাত্রা প্রতিবেশীরা রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাই রক্ষে, ওই ঘটনার পরে লছমী দুই সন্তান কে নিয়ে পিত্রালয়ে চলে গেল। 

মহেশ একা, নিয়মিত নিজের কাজ টুকুর সমাধান করা মহেশের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। দুই বেলা মহেশ কে সাফাইয়ের কাজ করতে হতো। দুই মাস পার হয়ে গেল। সহধর্মিণী বিহীন জীবন যে কি কষ্টের সেটা মহেশ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সময় মত খাওয়া নেই প্রচণ্ড পরিশ্রম, শরীর আর নিতে পারছে না। একদিন ঠিক করলো দু দিনের ছুটি নিয়ে লছমী কে ফিরিয়ে আনবে, আর ওই ছাই পাঁশ নেশা ছেড়ে দেবে। হলও তাই, ছুটি নিয়ে লছমী কে ফিরিয়ে আনল। সকলের সামনে দিব্যি কাটল এবার থেকে সুষ্ঠু ভাবে সংসার আর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে। এক মাস বেশ সুখে আনন্দে দিন যাপন হল। কিন্তু বিধি বাম, সে দিন পবিত্র দোল পূর্ণিমা, চারিদিক রঙে রঙিন, মিষ্টি বসন্তের মৃদু হাওয়া, পুরো মহল্লা খুশির আনন্দে ভাসছে, বিকেলে সিদ্ধির আসর বসবে, এটাই এখানকার রেওয়াজ, সেই সময় মহেশর কিছু পুরানো বন্ধু দেখা করতে হাজির, সকলেই অর্ধ নেশায় মগ্ন। পুরানো বন্ধু পেয়ে মহেশের খুব আনন্দ, কিছুক্ষণ হাসি গল্প মস্করার পরে মহেশ কে তারা নিয়ে গেল তাদের নিজেদের আখড়ায়। কি হোল কি জানি সেদিন রাতে মহেশ ফিরলো না। সারারাত লছমির দুশ্চিন্তায় কেটে গেল। পরের দিন কাকভোরে কয়েকজন বন্ধু মহেশ কে পাঁজকোলা করে বাসায় দিয়ে গেলো। তখন সে বেহুঁশ।

সবে দিনের আলো ফুটছে, কাক পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে, মহল্লার সকলে দেখল মহেশ তার সেই পুরানো দিনে ফিরে গেছে। স্বভাব মরলেও যায় না। একটু বেলার দিকে মহেশের একটু হুঁশ এলো। আসতেই আগের যে রূপ সেই রূপ, টাকার চাহিদা লছমীর কাছে, আবার ঠেকে যেতে চায়, ওতেই তার শান্তি, আনন্দ। ঘরে মাত্র সামান্য অর্থ সম্বল, সন্তানদের ক্ষুধা নিবৃত্তির পক্ষে ও যথেষ্ট নয়। এসব কিছুই মহেশের শোনার অবকাশ নেই। ওই অর্ধ নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই স্ত্রী কে প্রচণ্ড মার, সন্তানেরা ওই গোলমালে জেগে উঠল, ওই দৃশ্য দেখে তাদের মুখে কোনও শব্দ নেই, স্থানীয় ব্যক্তিরা অবস্থা সামাল দিল। মহেশ আবার বন্ধুদের ঠেকের দিকে রওনা দিল। যাবার আগে লছমী কে শাসিয়ে গেল যে আজ রাতে ফিরে এসে খাবে, না হলে গলা টিপে মারবে।

একটু বেলার দিকে লছমী বড় মেয়েকে ঘরে প্রতিবেশীর কাছে রেখে কিছু দূরে পরিতক্ত খাদানের ডোবায় ছোট সন্তান কে নিয়ে স্নান ও গতকালের রঙ খেলার বস্ত্র ধুতে চলে গেল, ছোট শিশুটি একটু দূরে নিজের মনে খেলা করছে, মা জলের কিনারায় বসে কাপড় ধুতে ব্যস্ত, এদিকে কখন যে শিশুটি হামাগুড়ি দিয়ে জলের কিনারায় এসে গেছে, লছমী খেয়াল করে নি, হঠাৎ শিশুটিকে স্নান করাবার জন্য পিছন ফিরে দ্যাখে মুন্নি নেই, কিছুটা হকচকিয়ে আশপাশ খুঁজে না পেয়ে হটাৎ চোখে পড়লো মুন্নির হাতের ছোট ভাঙা খেলনা, যেটা আঁস্তাকুড় থেকে মুন্নি কিছুদিন আগে কুড়িয়ে পেয়েছিল। মায়ের মন ব্যাকুলতার সঙ্গে কিছু ঈঙ্গিত জানাল, বুঝতে পারলো কি ঘটেছে , সব কিছু ভুলে লছমী ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, যদি মুন্নি কে পাওয়া যায়। বেশ অনেকখন পার হয়ে গেছে, এতক্ষণ দেরী সচরাচর হয় না, ঘরে সংগীতা চঞ্চল হয়ে পড়েছে। পাশের ঘরের এক দম্পতি সংগীতা কে নিয়ে লছমীর খোঁজ করতে ডোবার ধারে গেলো, সকলের চোখে জল, সংগীতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ডোবার ধারে দৌড়ে যেতে চায়, মা ছোটো বোন কে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে, আলুথালু চুল, ভেসে রয়েছে। আরও অনেকে ততক্ষণ জড়ো হয়েছে, সকলের চোখে বাঁধভাঙা জল।

সকলের প্রচেষ্টায় নিষ্প্রাণ দেহ দুটি নিয়ে আসা হল, বাসার সামনে দাওয়ায় রাখা হোল, কিন্তু মহেশ, সে কই? তাকে না পেলে তো কোনও কিছু করা যাবে না, এদিকে পুলিস ও এসেছে, খুঁজে পেতে মহেশ কে নিয়ে আসা হল, দৃশ্য দেখে মহেশ এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ নিষ্প্রাণ দেহ দুটির দিকে চেয়ে রইল, কারো কথা তার কানে যাচ্ছিল না, একটু পরে বড় মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো, চোখে অবিশ্রান্ত ধারা।

0 comments: