ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বানরায়ণ, পর্ব ৫
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
তখন রাত গভীর। আমি বুড়ো সোমুকের ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে থানের দিকে গেলাম। গাঁয়ের একটেরে কোনে, বসতি থেকে অনেকখানি দূরে,হাজার বছরের বুড়ো বটগাছের নীচে একখানা লম্বাটে গোছের পাথর আধখানি মাটিতে পোঁতা। সেই আমাদের জন্তা বাবার থান। বুড়ো সোমুক রোজ সূয্যি ডোবার মুখে সেই পাথরে কুঁকড়োর রক্ত মাখিয়ে জন্তা বাবার পুজো করে। সেই মাংস নৈবেদ্য হয়।সে পুজোয় অবহেলা হলে জঙ্গলে শিকার পাওয়া যায় না, ঝর্ণা শুকিয়ে যায়, গাঁয়ে মড়ক হয়...
আঁধার নামার পর কারও থানের আশেপাশেও যাওয়া ঘোর নিষেধ। সবাই জানে, সেই সময় জন্তা বাবা মাংস খেতে আসে। কেউ যদি সেই সময় তার চোখে পড়ে যায়, তাহলে সেও তার খাদ্য হয়ে যাবে! রোজ ভোরে দেখা যায় সবটুকু রক্ত-মাংস চেটেপুটে সাফ। সবাই জানে, জন্তা বাবার অন্তহীন খিদে।
আমি জানি, নৈবেদ্যের মাংস কে রোজ গভীর রাতে থান থেকে নিয়ে আসে।আমি দেখে ফেলেছিলাম এক রাত্রে। জন্তা বাবাকে চাক্ষুষ দেখার কৌতূহল আমার ভয়কে ছাপিয়ে গেছিলো। লুকিয়ে ছিলাম গিয়ে বুড়ো বটের ডালে, ঝুপসি পাতার পিছনে। গভীর রাতে, যখন চোখ একটু লেগে এসেছে, হঠাৎ দেখলাম ভয়ংকর একটা মুখ... হাতে বাঘের মতন নখ, সারা শরীরে রক্ত মাখা কি যেন একটা দু’পয়ে প্রাণী দূর থেকে আসছে। প্রথমটা ভয়ে আমারও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো, গাছ থেকে পড়ে যাবো বুঝি! কিন্তু জীবটা আরেকটু কাছে আসতে হাঁটার ভঙ্গীটা যেন চেনা চেনা লাগলো। তারপর যখন গাছের তলায় থানের কাছে এসে দাঁড়ালো, তখনই বুঝে গেলাম। তারপর সে থান পরিস্কার করে মাংস শালপাতার মোড়কে বেঁধে যখন রওনা দিলো, তখন আমিও নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে তার পিছু নিলাম, এবং এক সময়ে এসে উপস্থিত হলাম বুড়ো সোমুকের ঘরের সামনে।
আমাকে দেখে বুড়ো ভূত দেখার মতন চমকে উঠেছিলো। ততক্ষণে সে ঘরে ঢুকে মাংসটা রেখে মুখোশ খুলে ফেলেছে। আমার মুখ দেখেই বুড়ো বুঝেছিলো যে আমি সবটা দেখে ফেলেছি, বুঝতে পেরে গেছি।তাই আর খুব বেশি সময় নষ্ট না করে আমাকে সোজাসুজি বুঝিয়ে দিলো এটা করা কেন প্রয়োজন। মনে শাস্তির ভয়, অভিশাপের ভয় না থাকলে মানুষ স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। জন্তা বাবা সেই ভয়েরই সঞ্জিবীত রূপ। সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাকে ওই রহস্যময় ভয়াবহতার আবরণের ভিতর লুকিয়ে রাখা প্রয়োজন।আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ভয় দেখানো ছাড়া কি মানুষকে ঠিক পথে রাখার আর কোনও উপায় নেই? ঠাকুর্দা প্রসাদের মাংস আগুনে সেঁকতে সেঁকতে একটু হেসে বলেছিলো, ‘‘সবাই তোর মতন নয় রে ঋচিক। বেশির ভাগ সুযোগসন্ধানী। একটু ফাঁক পেলেই নিয়ম ভাঙবে। যা ইচ্ছে করবে।’’
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, নিয়ম ভাঙলে কি হয়? বুড়ো সোমুক মাংস সেঁকা থামিয়ে খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে আমার দিকে চেয়ে থেকে তারপর হিমশীতল গলায় বলেছিলো, ‘‘তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে সত্যি আজ রাতে জন্তা বাবার খাবার হয়ে যেতো... মনে রাখিস।’’
তার পর দু’শীত কেটে গেছে।জন্তা বাবা নিয়মিত নৈবেদ্যের মাংস খেয়ে গেছে। গাঁয়ের কেউ কোনওদিন রাতের পর থানের দিকে ঘেঁষেনি। আমিও না। শুধু সেই রাতে ঠাকুর্দা আমাকে বললো গিয়ে থান পরিস্কার করে প্রসাদটুকু নিয়ে আসতে। মুখোশ পরে যাবো কি না জিজ্ঞেস করাতে একটু ভেবে বললো, প্রয়োজন নেই।
আমি খুব আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম। সবটা জানা সত্ত্বেও কেমন গা শিরশির করছিলো। সেই কোন আদিম যুগ থেকে এই দেবতার পুজো হয়ে আসছে! হোক সে ফাঁকি! হোক সে মনগড়া! তবু এত মানুষের এত আবেদন, এত আর্তি, এত নিবেদন... এ সবের কি কোনও পরিনতি নেই? ঠাকুর্দা মুখোশ পরে রক্ত মেখে যেরকম ভয়ংকর সাজে, জন্তা বাবা সেরকম... মানতে মন চায় না। দেবতা কি কখনও বীভৎস হতে পারে? কি জানি! আমি কতটুকুই বা জানি!
ভাবতে ভাবতে এক সময় পৌঁছে গেলাম থানে। তারার আলোয় দেখলাম, পাথরের সামনে পড়ে আছে রক্তমাখা মাংসের টুকরোগুলো। পাথরের গা-ও রক্তে মাখামাখি।প্রথমে মাংসটুকু পাতার মোড়কে বেঁধে নিলাম। তারপর ঠাকুর্দার দেওয়া চামড়ার টুকরোটা দিয়ে পাথরের গায়ের আর তার সামনের রক্তটুকু মুছে পরিস্কার করে দিলাম। সেটা করতে গিয়েই ঘটনাটা ঘটলো।
ঘটনা মানে, হঠাৎ বুড়ো বটের গোড়ার কাছে একটা ফোঁকড়ের মতন চোখে পড়লো। ছোট্ট এক টুকরো ফোকলা হাসির মতন একটা ফোঁকড়। আগে কখনও নজরে পড়েনি জায়গাটা। বোধহয় রাতের অন্ধকারে আরও ওরকম লাগছিলো। কিন্তু ওটা চোখে পড়তেই আমার মনটা হঠাৎ ভীষণ ভালো হয়ে গেলো।আরে! ওই তো জন্তা বাবা! সেই কবেকার বুড়ো হাবড়া দেবতা আমাদের! ফাঁকিটা আমি ধরে ফেলায় ছেলেমানুষের মতন ফোকলা দাঁতে হাসছে। নাকি অন্য কোনও কারণও আছে হাসির?
আরেকবার দেখলাম। এবার মনে হলো হাসিটা কেমন চেনা চেনা! একটু আগে বুড়ো সোমুক যেমন বিষন্ন একটা হাসি হাসছিলো, অনেকটা যেন সেই রকম। খানিকটা অসহায়তা, অনেকখানি প্রশ্রয় আর একটুখানি রহস্য মাখানো... অস্বচ্ছ, অথচ সম্পূর্ণ অদৃশ্য নয় এমন এক ভবিষ্যতের রহস্য।
হাসিটা বোধহয় আমার মুখেও সংক্রমিত হলো। কথাগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বেরিয়ে এলো... ‘‘এতদিনে তোমায় চিনলাম, জন্তা বাবা। তুমি মোটেই ওরকম ভয়ংকর নও।’’ পাথরটার উপর হাত রাখলাম আমি... ‘‘এটাকে সবাই তুমি ভাবে। এটা তো আসলে তোমার পাহারাদার। সবাইকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখে। ভয়টুকু না পেলে যে সবাই যথেচ্ছাচার শুরু করবে।’’ নিজের মনেই কথা বলছিলাম আমি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো... মনে হচ্ছিলো না... আমি অনুভব করছিলাম, জন্তা বাবা আমার প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনছে। ‘‘তুমি তো আসলে একটা ফোকলা বুড়ো। সবাইকে ভালোবাসো, আমি জানি। আমাকেও বাসো। আমি চলে যাচ্ছি বলে সেটা আমায় জানিয়ে দিলে কি? আচ্ছা, তুমি কি জানো, আমি ফিরে আসবো কি না?’’ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম গাছের গোড়ার ফোঁকড়টার দিকে। কিছু বলছে কি জন্তা বাবা? ঠিক বুঝতে পারলাম না। হাসিটা আগের মতনই রহস্যময়... অনেকখানি প্রশ্রয় আর ভরসা মাখানো। একবার যেন মনে হলো বলছে, ‘‘নির্ভয়ে যা।’’ আবার মনে হলো যেন বললো, ‘‘সাবধানে থাকিস।’’
আমি ধীরে সুস্থে মাংসের মোড়কটা নিয়ে থান ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে একবার শেষবারের মতন আমার নিজের আবিস্কৃত দেবতার দিকে চাইলাম। আবছা আলো-আঁধারিতে শিকড়গুলোকে মনে হচ্ছিলো যেন এক বলিষ্ঠ পুরুষের পেশীবদ্ধ বাহু। হঠাৎ আমার মনে পড়লো একটু আগে বলা ঠাকুর্দার কথাগুলো। সে এক অনির্বাণ জ্যোতির্ময় পুরুষ...
কে সে? সম্বর্ত আর তার লোকজন যাদের কথা বলে গেলো, তাদের মধ্যেই কেউ কি? অযোধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র ‘ত্রিভুবনের প্রভু’ রামচন্দ্র, তার ভাই লক্ষ্মণ, কিষ্কিন্ধার রাজা সুগ্রীব...? না কি সে অন্য কেউ? জন্তা বাবা কি জানে তার কথা? চেনে তাকে?
চিনলেই বা আমাকে বলবে কি করে? কোনও রকম ভাবে যদি বলতেও পারে, আমি বুঝবোই বা কি? বুঝে হবেই বা কি? বুড়ো সোমুক তো বললো, সে নাকি তার নিজের জ্যোতিতেই চিনে নেবে আমায়। আমার তবে আর চিন্তা কিসের? আমাকে শুধু যেতে হবে, দেখতে হবে, চিনতে হবে পৃথিবীটাকে... আর আমি বুঝে গেছি, আমার যাওয়ায় জন্তা বাবা সায় দিয়েছে।যদি না দিতো, তাও আমি যেতাম। যেতে আমাকে হবেই। সেটাই ভবিতব্য।
পরদিন সকাল থেকে তাম্বলি গাঁয়ে সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। সব থেকে লম্বা সময়ের জন্য গ্রাম ছাড়তো শিকারীরা। ওই পাহাড়ের ওধার থেকে শিকার করে ফিরতে ফিরতে ছ’সাত দিন লেগে যেতো। চামড়ার তাঁবু, অস্ত্রশস্ত্র আর কয়েক দিনের রসদ নিয়ে যেতে হয়।আমিও গেছি বার দুয়েক ওদের সঙ্গে।
কিন্তু এবারের যাওয়া অন্যরকম। শিকারের দলে বড়জোর দশ-বারো জন থাকতো। এবার প্রায় জনা তিরিশেক পুরুষ চলেছে... এবং তারা যে কোথায় চলেছে, আদৌ কোনওদিন ফিরবে কি না, সে সবের কোনও ঠিক নেই। তাদের অনেকেরই ঘরনী আছে, সন্তান আছে। যদিও আমাদের সমাজে সম্পর্কের বাঁধন খুব পোক্ত কখনোই ছিলো না, তবু নাড়ির টান তো ছিলো। যারা ভাগ্যান্বেষণে যাচ্ছিলো, তাদের জন্য সে টান ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়া ততখানি কঠিন ছিলো না, যতখানি ছিলো যারা পড়ে থাকবে, তাদের জন্য। বেশির ভাগ শক্ত সমর্থ জোয়ান পুরুষই যাবে।পড়ে থাকবে শুধু নারী-শিশু-বৃদ্ধরা।
এমন পরিস্থিতি তাম্বলি গ্রামে এর আগে কোনওদিন হয়নি। তাম্বলি কেন, বিন্ধ্য পাহাড়ের আরণ্যক গ্রামগুলির মধ্যে কোনওটাতেই হয়নি। আমাদের, মানে বিন্ধ্যারণ্যের মানুষদের একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিলো পাহাড়ের ওপারের জাতিদের সম্বন্ধে। তাদের গায়ের রং, চোখের রং নাকি আমাদের মতন নয়। তারা নাকি কাঠ-পাথর দিয়ে বড় বড় বাড়ি তৈরি করে তাতে থাকে... আর বড় বড় দল বেঁধে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে।
সেই প্রথম তাদের যুদ্ধের রেশ পৌঁছলো বিন্ধ্য পাহাড়ের এপারে, আমাদের জঙ্গলে... আর আমাদের ঘরছাড়া করলো... কিসের যে অমোঘ টানে, আমরা কেউ বুঝলাম না ভালো করে।
তারপর ?? ঋতবাকের প্রকাশ এর জন্যে হা-পিত্যেস করে বসে থাকি এই ধারাবাহিকটি শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় সেটা জানার জন্য !!
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ, দাদা। আপনাদের ভালোলাগাই পাথেয়...
Delete