0

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ 



নতুন পথের সন্ধানে বাঙালীর নববর্ষ
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য



শ্রবনেন পথ দুঁহু লোচনেন লে ল। চলতি কোথায় আড় চোখে দেখা। আমাদের সবারই একটা বয়স আসে যখন চোখ আপনা থেকেই উঠে যায় বিপরীতের মেয়ে বা ছেলেটির দিকে। কেন যে ওঠে, কোন হরমোনের খেলা সেগুলো তখনো আমার জানা হয়নি। শুধু সামনে থেকে কোনো মেয়ে এলে তার দিকে তখন সদ্য চোখ চলে যায় আমার। আর একটা ভালো লাগা কাজ করে। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে যাচ্ছি ধর্মতলার দিকে ট্যাক্সি করে। শোভাবাজার এ বিডন স্ট্রিট ক্রসিং এর কাছে পেট্রল পাম্প-এর পাশ দিয়ে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একদল মেয়ে। যথারীতি আপনা থেকে চোখ ডানদিকে ঘুরে গেল। কিন্তু কোথাও যেন একটা অস্বস্তি রয়ে গেল। এদের বেশ-ভুষা যেন একটু আলাদা। লিপস্টিক এর কালার। রুজ। ঝকমকে তেলচিটে জামা। চলন চাওনি সবই যেন একটু আলাদা। আর মুখময় যেন লেখা বেদনার করুণ কাহিনী। এরা কারা ? কিছুটা যে অনুমান করতে পারলাম না তা নয়। একটা জিনিস বুঝলাম - এরা সমাজের মধ্যে থেকেও যেন সমাজের মধ্যে নয়। সেদিন GPS কল্প বিজ্ঞানের কল্পনাতেও বিরল। আজকের দিন হলে GPS বলে দিত সোনাগাছির রাস্তা এটা। শোভাবাজার-এর সাথে সেদিন আমার পরিচয়টা কিন্তু মনে একটা দাগ কেটে দিল। 

যব চার্নক যেদিন পা রাখলেন বাংলার মাটিতে সেদিন কলকাতা শহর মানচিত্রে ছিল না। সাবর্ণ চৌধুরী এগিয়ে এলেন স্বাগত জানাতে সেই ব্রিটিশ সাহেবকে। তৈরী হলো কলকাতা শহর। 1690 সাল। শোভাবাজার -সুতানটি সেদিন উঠে এলো বিশ্বের ইতিহাস়ের পাতায়। এরপর আসা যাক 1800 সালে । শোভাবাজার এর অনতিদূর এ জোড়াসাঁকোতে দ্বারকানাথ ঠাকুর-এর মন কে দোলা দিয়েছিল চার্লস ব্যাবেজ এর বানানো প্রথম কম্পিউটার। দ্বারকানাথ ঠাকুর এক বিরল বাঙালী প্রতিভা যিনি বানিজ্যে বসতে লক্ষ্মী-র সার্থক রূপকার। সেই সময় থেকে প্রায় পরবর্তী সত্তর বছরের ইতিহাস বাঙালীর জীবনে  ভীষণ বৈচিত্রময়। এক দিকে ছিল বাবু সম্প্রদায়। সুরা, নারী আর কবুতর -এই ছিল বাবু সমাজের পরিচয়। বাইজীর ঘুঙুরের ঝংকারে ছড়িয়ে পরেছে স্বর্ণ আর দর্পের বুদবুদ। বৌবাজারের রাতের রৌনকে জলসার জাজিমে বেশ্যার হাতে সুরা পান আর টাকার ফোয়ারা। - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ভাষায় ‘তখন একজন তার উত্তাল বক্ষদ্বয়ের ওপর এক হাত রেখে সুমধুর হাস্যে বলল, এই দেখো কেমন বুক কাঁপছে, দেখুক দেখুক নিজে হাত দিয়ে দেখুক|’ - এরই মধ্যে বাবুর বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ আজ ও বাঙালীর প্রাত-স্মরণীয়। আবার সেই সমাজ এই বিদ্যাসাগর রেড়ির তেলের প্রদীপে শাস্ত্রীয় পথে শুনিয়ে গেছেন নারী মুক্তির বার্তা। 

শোভাবাজারের সাথে আমার পরিচয় আরো বাড়লো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'সেই সময়' উপন্যাসের হাত ধরে। সাথে যুক্ত হলো বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ। তৎকালীন বঙ্গ সমাজের একটা ছবি ফুটে উঠলো। প্রবন্ধ আর উপন্যাসের তত্ত্বগত পার্থক্য এখানে বিচার্য বিষয় নয়। তবে উপন্যাসে সীতা রামের বোন হতে পারে, কিন্তু প্রবন্ধতে সীতা রামের বউই হয়। কিন্তু প্রবন্ধ বা উপন্যাস দুটোতেই ফুটে ওঠে সমাজের প্রতিচ্ছবি। প্রবন্ধ আর উপন্যাসের পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যাক খ্রীষ্টপূর্ব 500 বছর আগে। ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে এক নর্তকী, আম্রপালি। চৌষট্টি কলায় পারদর্শী। সমাযে গণিকার সম্মানের সাক্ষ্য। ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের আগে বেনারসে গনিকা সম্প্রদায় সযত্নে পালন করেছে নৃত্য আর সঙ্গীতের ঘরানাকে। ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনা কালে পর্তুগিজদের হাত ধরে গোয়াতে প্রথম ঢুকে পড়ে পণ্যবাহী সেনার যৌন লালসা মেটাতে কিশোরী নারী শরীরের নিলামি। বিক্রি হয়ে যায় কাশীর বিধবা নারী সুরাটের বন্দরে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে বাংলায় বাবু সম্প্রদায় গণিকা, বেশ্যা আর রেন্ডি -এই শব্দ গুলোকে সমার্থক করে ফেলে। বদলে যায় সমাজের চিত্র।

আজকের এই টেকনোলজি নির্ভর সমাজে বিপণন এখন ম্যানেজমেন্ট এ রিসার্চের বিষয় । কাস্টমারের শুধু চাহিদা মেটানো নয়, পূর্ণ তৃপ্তি মেটাতে এসেছে অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাতে কার্যকলাপ ভিত্তিক মূল্য নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে এসেছে ব্যবসা মূল্যায়নের নতুন মাপ কাঠি। কিন্তু এই সমস্ত তত্ত্বতে হার মানিয়ে দেয় এক বিশেষ পেশা যার অর্থনৈতিক অঙ্ক 30 বিলিয়ন ডলার কেও চাপিয়ে যায়। যেখানে বিনিময় প্রথা একটাই - অর্থের বিনিময় এ যৌন সুখ। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে এসেছে নতুন বৈচিত্র। এসেছে বিপণনের বিভিন্ন রঙ - বাহারি রকমারি। কিন্তু সেই আলোর নিচে জমে আছে আঁধার। কোনো মেয়ের কান্না। কত ব্যাথা। কত প্রবঞ্চনা। হিউম্যান ট্রাফিকিং নিয়ে বিশ্ব জুড়ে ILO র পরিসংখ্যান আর প্রতিনিয়ত প্রতিরোধের প্রয়াস। 

ইংরেজি 15th মার্চ 2015। বাংলার নববর্ষ। 'সূর্য সিদ্ধান্ত' কে অনুসরণ করে বাংলার নতুন বছর। পয়লা বৈশাখ। বাংলা ১৪২২ সাল। হিমের রাতে আকাশের দীপ গুলির দীপালিকা ম্লান হয়ে গেছে | বসন্তের ফুল তার জয়মাল্য গেঁথেছে। এখান মন্দ গতি ক্লান্ত তপ্ত বাতাসে বৈশাখকে স্বাগত জানাচ্ছে বাঙালী - এস হে বৈশাখ। কিছুদিন পর পঁচিশে বৈশাখ এ বাঙালী বরণ করবে জন্মের সেই প্রথম শুভক্ষণ কে, যখন কবি সার্বভৌম পেয়েছিলেন প্রথম সূর্যের আহবান। পয়লা বৈশাখে ঘুচে যায় পুরনো স্মৃতি, মুছে যায় অশ্রু মাখা গান। চির নূতনের ডাক ছুটে চলে বৈশাখের আকাশে বাতাসে। তাপস নিশ্বাসে মৌন মুখর আনন্দ ধ্বনি নিয়ে আসে নতুন উল্লাস। এই শুভ মুহুর্তে আমাদেরই এই সমাজে কিছু মুখ থেকেই যায়, যারা বুকের মাঝে বয়ে বেড়াচ্ছে শত শতাব্দীর বেদনার অব্যক্ত ভাষা। সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের দিকে আমরা কি বাড়িয়ে দিতে পারি না আমাদের সহানুভূতির হাত ? সামান্য সামাজিক স্বীকৃতি। পেশা গত সামান্য মান্যতা হয়ত ফুটিয়ে তুলতে পারে একটু হাসি সেই সব মুক মুখে। আমরা আশাবাদী। আমরা আশার দীপ জ্বেলে কাব্যের দীপিকায় বসে আছি। বসে থাকব। এক নর্তকীর গান যদি স্বামী বিবেকানদের মনে ভাবোদয় করতে পারে তাহলে আমরাই বা আজ কেন পেছনে রেখে দেব সেই মানুষ গুলোকে যাদের মাটিকে সমাজ লাল আলোর এলাকা বলে বন্দী রেখেছে। অথচ সেই মাটি ছাড়া শরতের অঞ্জলি মা দুর্গার পায়ে দেওয়া যায় না। 








0 comments: