প্রবন্ধঃ কেয়া মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
হে স্বাধীনতা
কেয়া মুখোপাধ্যায়
আমাদের স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন শিখাদি। তখন ক্লাস ফোর। শিখাদি ক্লাস-টিচার। খুব সমীহ করার মত ব্যক্তিত্ব। ইংরেজি ক্লাসে একটাও বাংলা কথা নয়, উচ্চারণ ঠিক হওয়া চাই, ছোটদের ইংরেজি ক্লাসিক পড়ে ক্লাসে এসে গল্প বলতে হবে- এরকম হরেক নিয়ম। অনেকেই একটু ভয় পেত। আবার গানের ক্লসে তিনি অন্যরকম। রবীন্দ্রনাথের গান করেন আত্মস্থ হয়ে। সে বছর ১৫ই অগাস্ট সকালে স্কুলে গেছি। পতাকা উত্তোলনের পর ছোট অনুষ্ঠান। পরাধীনতার সেইসব দিনগুলি নিয়ে বললেন শিখাদি। বললেন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কথা। মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা। মাস্টারদার নেতৃত্বে অসমসাহসী ৬৫ জন তরুণের এক বিপ্লবী বাহিনী, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার কথা।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অস্ত্রাগার দখলের পর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সূর্য সেন। ঘোষণা করেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের। ক’দিন পরেকয়েক হাজার ইংরেজ সৈন্য ঘিরে ফেলল জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া বিপ্লবীদের। ব্রিটিশ সৈন্য তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করল। সম্মুখযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের রীতিমত পর্যুদস্ত করলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অসম যুদ্ধে শহীদ হলেন ১২ জন বিপ্লবী। তাঁদের একজন শিখাদির কাকা, হরিগোপাল বল। টেগরা নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি। আরো এগারো জন বিপ্লবীর সঙ্গে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হল তাঁর বাবার। বিপ্লবী লোকনাথ বল। তারপর ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬- চোদ্দ বছরের বন্দীদশা সেলুলার জেলে। সেদিন শিখাদি বলেছিলেন তাঁর ঠাকুমার কথা। দেশের জন্যে বিপ্লব করতে গিয়ে জীবন-সংশয় হতে পারে বুঝেও যিনি কখনো পিছিয়ে আসতে বলেননি ছেলেদের। ইতিহাসের পাতায় আমরা জন্মভূমিকে ভালবেসে, দেশকে স্বাধীন করার জন্যে এমন লক্ষ লক্ষ তরুণের জীবন উৎসর্গের কথা পড়েছি। কিন্তু এই যে স্বাধীন দেশে আমরা জন্মেছি, বড় হয়েছি – সে স্বাধীনতা যে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে এসেছে, সে কি সত্যিই আমরা মনে রাখি? রেখেছি?
ঊনিশ বছরও বয়স হয়নি, ফাঁসি হল ক্ষুদিরামের। অনেক বছর পরে, তাঁর দিদি, অপরূপা দেবী নিজের মনের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন:
“দেশের লোক হায় হায় ক’রে উঠল। দেশের লোক গান বাঁধল আমার ক্ষুদিরামকে নিয়ে। আমি সামনাসামনি কাঁদতে পারিনি, লুকিয়ে কাঁদতে হয়েছে। আর পাঁচটা বাঙ্গালীর মতোই চাকুরীসম্বল আমার স্বামী, তাও আবার ব্রিটিশরাজের ঘরেই চাকরী। প্রকাশ্যে কাঁদবার কি জো ছিলো? বছরের পর বছর গেছে, একের পর এক ক্ষুদিরামের নাম নিয়ে এগিয়ে গেছে দেশের ছেলেরা। যে যেমন বুঝেছে তেমনি করে এগিয়ে গেছে। তিনমুঠো খুদ দিয়ে ক্ষুদিরামকে কিনেছিলাম আমি- মনে মনে লোভ ছিল ক্ষুদিরামকে একা ভোগদখল করব। কিন্তু কখন যে আমার অগোচরে সে দেশের লোকের কাছে বিকিয়ে গেছে, জানতেও পারিনি। তিনমুঠো খুদ দিয়ে আমি কিনেছিলাম। দেশের ছেলেরা তাকে কিনলো আঁজলা আঁজলা রক্ত দিয়ে...।”
কখনো কি আমরা ভাবি, যে পরিবারের একটি তরুণ হারিয়ে গেল দেশের জন্যে তাদের জীবন কীভাবে চলে? সত্যি চলে কি? সেদিন হয়তো অত বুঝিনি। শুধু দেখেছি কথা বলতে বলতে চিকচিক করছিল অমন রাশভারি শিখাদির চোখের কোল। আবেগে ধরে গিয়েছিল গলা। পরে ভেবেছি, যে মায়ের একটি ছেলে ওভাবে সম্মুখ সংগ্রামে প্রাণ দিল, আর একটি ছেলে চলে গেল দ্বীপান্তরে- কেমন থাকেন সেই মা? কেমন থাকেন বিপ্লবীদের মায়েরা? দিদিরা? স্ত্রীরা? এঁদের আত্মত্যাগের জন্যেই তো স্বাধীন দেশের নাগরিক আমরা।
জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি স্তরে জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তি স্বাধীনতার নিরিখেই স্বাধীনতার বোধ-এর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। স্বাধীনতা তখনই মূল্যবান, যখন তা থাকে না। আমরা যারা স্বাধীন দেশে জন্মেছি, পরাধীনতার গ্লানিময় জীবন, বিদেশি শাসকের অসহনীয় অত্যাচারের দিনগুলো যারা দেখিনি, তাদের পক্ষে সামাজিক নানা প্রত্যাশা-পূরণের ব্যর্থতা দেখে নিজেদের ক্ষোভ, দুঃখ, অভিযোগ, অসহায়তার অনায়াস প্রকাশ আজ সম্ভব দেশটা স্বাধীন বলেই।
পরাধীন জীবন একরকম। সে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তিটুকু চায়। কিন্তু স্বাধীন হবার পরে আসে অধিকারের কথা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলকে কী কী অধিকার দেবে স্বাধীনতা? কোন্ কোন্ স্বপ্নপূরণ হবে? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রাথমিক নিরাপত্তাটুকু তখন আর যথেষ্ট নয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, পরিশ্রুত পানীয় জল, সকলের জন্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান- এই সব স্বপ্ন আর লক্ষ্য পূরণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার সার্থকতা। সেই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে ফাঁক থেকে গেছে অনেকখানি। আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নীচে ধুঁকছে বিশাল জনগোষ্ঠী।গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি এখনো। পরিষ্কার পানীয় জলের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন মানুষ। জলে আর্সেনিকের বিষ। খাদ্যে, এমনকি শিশুখাদ্যেও ভেজাল। শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পারিনি ঘরে ঘরে। বিনা চিকিৎসায় মারা যান অসহায় রোগী। ধর্মের নামে হানাহানি, খুনোখুনি অব্যাহত।বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথাচাড়া দেয় নানাদিকে। বর্ষায় বানভাসি হয় অগুন্তি মানুষ। অকপট সামাজিক বিশ্লেষণের জন্যে হাতে কলম তুলে নিয়েছেন যে মানুষটি- প্রতি মুহূর্তে প্রাণের ঝুঁকি তারও। নারীর নিরাপত্তা আজও সুনিশ্চিত নয়। একটি কিশোরী, তরুণী কি গৃহবধূ বাড়ি থেকে বেরোনোর পর না ফেরা অবধি দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকে তার বাড়ির লোকজন। সকালের খবরের কাগজ-জোড়া ভয়ের খবর, জয়ের নয়। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এ কেমন স্বাধীনতা!।
কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউতে আমার এক বন্ধুকে পরীক্ষক বলেছিলেন, “একটা ডায়েট চার্ট বানাতে পারবেন, আমলাশোলের জন্যে?” থমকে গিয়েছিল সে। স্বাধীন ভারতের সেই আমলাশোল, সেখানে কোন এক অনাগত ভবিষ্যতে পেটভরে দু’বেলার গরম ভাত খাওয়ার সুখস্বপ্নটুকুই বুঝি স্বাধীনতা। বেলপাহাড়ি হয়ে কাকরাঝোড় গিয়েছিলেন এক বন্ধু। নিঝুম এক গ্রামের একটি কুটিরের আগল নাড়িয়ে জল চেয়েছিলেন দুপুরবেলা তেষ্টা মেটাতে। কুটিরের দরজা ফাঁক করে, একটি বৃদ্ধ আর তার মেয়ে, জল চাওয়ার কথা শুনে, ম্লান হেসে বলেছিল, “আপনাদের কাছে জলের পাত্র আছে?” ওদের খাবার জল আছে ঝরণায়। কিন্তু শহুরে ভদ্রলোককে সে জল পান করতে দেবার মত কোন পাত্র নেই ঘরে। বটপাতা মুড়ে তাতে জল ভরে পান করে ওরা। জলের একটি পাত্রই কি ওদের কাছে স্বাধীনতার অন্য নাম! স্কুলছুট্ না হয়ে, জঙ্গল মহলের মেয়ে-বিটিরাও একদিন নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার স্বপ্ন দেখবে- সেখানেও লেগে থাকে স্বাধীনতার গন্ধ। বৃহত্তর ভারতের কাছে এই ভারত অপরিচিত। পরমাণু শক্তি, মঙ্গল অভিযান, সামাজিক নেটওয়ার্ক, হার-জিতের ক্রিকেট সিরিজ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই এই ভারতের। তবু এই ভারতের কাছেও স্বাধীনতার গুরুত্ব কম নয়। স্বাধীনতা তাদের এইটুকু মর্যাদা দিয়েছে যে তাদের সন্তান আর উত্তরপুরুষও অন্তত পরাধীনতার গ্লানিহীন একটা স্বাধীন দেশে বাস করবে, অনেকখানি আশা আর স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
অন্যদিকে, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের কাছে স্বাধীনতা দিবস এখন শুধু আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতই। আলাদা কোন অনুভব নেই একে ঘিরে। শুক্রবার বা সোমবার দিনটা পড়লে লং উইকএন্ডে স্বজন-বন্ধু নিয়ে হুল্লোড়। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া। লং ড্রাইভে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। মাল্টিপ্লেক্সে নতুন ছবি দেখা, তারপর ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে উপলক্ষ্যে বিশেষ ছাড়ে শপিং মলে কেনাকাটা। ব্যতিক্রম শুধু স্কুলে ছোটদের পতাকা তোলা, রেডিও আর টিভির পর্দা থেকে ভেসে আসা স্বদেশি গানের সুর। এই চেনা ছকের বাইরে কোন অন্যরকম ভাবনার আলো, আশার আলো চোখে পড়ে না বড় একটা আজকাল।
আমাদের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে রীতিমত সচেতন আমরা। কিন্তু সচেতন নাগরিক হয়ে উঠে নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্বগুলো পালন করার কথা ভাবি কি? বোধহয় না। স্বাধীন দেশে অনেক অপ্রাপ্তি নিয়ে শুধু ক্ষোভটুকু উগরে না দিয়ে, নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্বগুলো ঠিকঠাক পালন করার চেষ্টা করতে পারি তো! বছরের নির্দিষ্ট দিনে ‘ও আমার দেশের মাটি’ কি ‘সার্থক জন্ম আমার’ গানে দেশপ্রেমকে আটকে না রেখে দেশের জন্যে, আশেপাশের মানুষের জন্যে কিছু করার কথা ভাবতে পারি তো!
এই দেশ আমাদের জন্মভূমি। পরাধীনতার গ্লানি মুছিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করায় আমরা অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে কিছু করিনি। কিন্তু যে সুসন্তানরা আত্মত্যাগ করেছেন, যে মায়েরা আঁচলের আড়াল থেকে আত্মজদের দেশের কাজে এগিয়ে দিয়েছেন- তাঁদের প্রতি আমাদের অপার কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা। স্বাধীন দেশে আজও বিপুল সংখ্যক মানুষ ন্যূনতম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই মনে হয়, স্বাধীনতার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে আজও! তবু অনেকদিকে পিছিয়ে থেকেও, স্বাধীনতার ধারণাটিকে তুচ্ছ করা, অবজ্ঞা করা “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়”-এর স্লোগান বড় অর্থহীন মনে হয়। স্বাধীনতা নিয়ে অহঙ্কার না থাক, ভরসাটুকু থাকুক অন্তত।
দেশ মানে শুধু ইঁট, কাঠ, পাথর, মাটি নয়। দেশ মানে দেশের মানুষ, তাদের সবটুকু ভালো-মন্দ নিয়ে। পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতি হলে তবেই দেশের উন্নতি। এই দেশকে, এই দেশের সংস্কৃতিকে, এই দেশের মানুষকে ভালোবেসে নিজেদের প্রাপ্তির খানিকটাও যদি আমরা দেশকে ফিরিয়ে দিয়ে চেষ্টা করি- তাহলে কোনও একদিন হয়তো আকাশ ছুঁতে পারব! তখন আমাদের সকলের কাছে, হে স্বাধীনতা, প্রতিটিদিনই স্বাধীনতা দিবস। প্রতিদিনই মুক্তির দিন।
আমাদের দেশে এখনও স্বাধীনতা শব্দটার মানে প্রত্যেকের কাছে আলাদা| রোটি-কপড়া-মকান পৌঁছে দেওয়া যায়নি এখনও অগণিত মানুষের কাছে এটা ঠিক, তবু আমরা এই আকালেও স্বপ্ন দেখি|
ReplyDeleteলোকনাথের বল এর পরিবার পরে ঠিক আমার উলটো দিকের বাড়িত্তে থাকতেন। কেয়া দেবী, বুকে হাত রেখে, বলুন তো, ভারতীয় সংসদীয় ব্যব্যস্থায় কি কোন দিন আমাদের দেশের আমূল পরিবর্তন সম্ভব ? আপনি বিশ্বাস করেন এ কথা ? আপনার লেখায় নকশালপন্থীদের উল্লেখ নেই কেনো ? যারা মন্ত্রী হওয়ার জন্যে নয়, গদি দখলের জন্যে নয়, শুধুমাত্র একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যব্যস্থার জন্যে তাঁদের ক্যারিয়ার, জীবন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কে অবলীলায় বিসর্জন এবং মেনে নিয়েছিলেন ?
ReplyDelete