ছোটগল্পঃ স্ফুলিঙ্গ সেন
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
ভয়
স্ফুলিঙ্গ সেন
টিভি দেখতে দেখতে একবার জানলার দিকে চোখ গেলো স্বাতীর। বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ঘড়ি দেখলো। সাতটা বাজে প্রায়। পার্থ’র অফিস থেকে বেরনোর সময় হয়ে গেছে।
টিভিটা বোর করছিলো কিছুক্ষণ ধরে। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ একটা নিউজ চ্যানেলের পর্দায় চোখ আটকে গেলো। একটা ন্যাড়া মাথা, অদ্ভূত দেখতে লোকের ছবি। দু’চোখে কি তীব্র হিংস্রতা! খবরে বলছে, জেল-পালানো এই অপরাধীটি একজন সিরিয়াল কিলার। কোনও কারণ বা প্ররোচনা ছাড়াই নৃশংসভাবে একটার পর একটা মানুষ খুন করেছে। জেলেও দু’জন সহবন্দীকে হত্যা করে। গত বছর তিনেক বিপজ্জনক অপরাধীদের সলিটারি কনফাইনমেন্টে ছিলো। আজ সকালে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় রক্ষীদের অসাবধানতা বশত পালায়। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর অনুযায়ী, শেষ দেখা গেছে...
অঞ্চলটার নাম দেখেই স্বাতীর বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো! এ তো এ পাড়ার নামই দেখাচ্ছে। পুলিশের তরফ থেকে অধিবাসীদের বারবার সাবধান করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কোওরকম সন্দেহজনক আভাস-ইঙ্গিত পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করতে।
স্বাতীর মনে পড়লো, ঘন্টাখানেক আগে প্রতিমা কাজ সেরে চলে গেছে। দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করে গেছে কিনা দেখা হয়নি নীচে গিয়ে। মাঝে মাঝেই এই কাণ্ডটা করে প্রতিমা। দরজাটা খোলা রেখে চলে যায়। কতদিন বলেছে স্বাতী...
নীচের লিভিং রূম থেকে উপরের লবিতে উঠে আসা সুদৃশ্য কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে তাড়াতাড়ি নামলো স্বাতী। সিঁড়িটা এমনভাবে নেমেছে, যে নীচে এসে পিছনে না ফিরলে লিভিং রূমের বাঁদিকের কোণটা দেখা যায়না। স্বাতী স্বভাবতই সেদিকে না তাকিয়ে দ্রূত পায়ে দরজার দিকে এগোলো।
যা ভেবেছিলো, তাই-ই। দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করেনি প্রতিমা। বিরক্তিতে স্বাতীর ভ্রূ কুঁচকে গেলো। কাল বকতে হবে মেয়েটাকে।
দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করার আগেই পিছনের বাঁদিকের কোণটা থেকে একটা মৃদু গলা খাঁকড়ানির আওয়াজ পেলো স্বাতী।
-----------------------------
গাড়ি চালাতে চালাতে এফ এম রেডিওটা অন করেছিলো পার্থ। আপাতত গাড়িটা মহানগরীর অফিস-ফেরতা জ্যামে আটকে আছে। মহম্মদ রফির গানটা শেষ হতেই রেডিও থেকে বিজ্ঞাপনের বদলে হঠাৎ একটা ঘোষণা ভেসে এলো। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, আজ সকালে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় রক্ষীদের মুহূর্তের অসাবধানতা বশত জেলের গাড়ি থেকে পালিয়েছে অত্যন্ত বিপজ্জনক এক স্বভাবখুনী। অপরাধতত্ত্বের ভাষায় যাদের বলে সিরিয়াল কিলার। শহরের একটি বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসীদের পুলিশের তরফ থেকে সাবধান করা হচ্ছে, কারণ বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, সেই অঞ্চলেই বিকেলের দিকে শেষবার দেখা গেছে লোকটাকে...
অঞ্চলের নামটা শুনে পার্থ’র ভ্রূ কুঁচকে গেলো। তাদেরই পাড়া। ছবির মতন সুন্দর ছোট্ট দোতলা বাড়িটা সস্তায় কিনে বছর তিনেক আগে সেখানে উঠে এসে্ছিলো সদ্যবিবাহিত পার্থ-স্বাতী। সিকিউরিটির একটু সমস্যা আ্ছে বটে নির্জন অঞ্চলটাতে, কিন্তু নিরিবিলি থাকার লোভটা সামলাতে পারেনি দু’জনের কেউ। পিছনের ছোট্ট কিচেন গার্ডেনটা ছিলো স্বাতীর জন্য উপরি পাওনা...
জ্যাম ছাড়তেই গাড়িতে স্পীড তুললো পার্থ। আধ ঘন্টার রাস্তা মোটামুটি কুড়ি মিনিটে পার হয়ে এসে গাড়িটা পার্ক করলো বাড়ির সামনে। গ্যারাজে পরে ঢোকানো যাবে। পুরোটা রাস্তা রেডিওতে বার বার ঘোষণাটা হয়েছে। এমনিতে এই জাতীয় ঘোষণা এফ এম রেডিওতে হয়না। কিন্তু এমার্জেন্সি সিচুয়েশন বলে হচ্ছে।
পার্থ জানে, নতুন কাজের মেয়েটার অভ্যাস মাঝে মাঝে দরজা খোলা রেখে চলে যাওয়া। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে বিরক্তিতে পার্থ’র ভ্রূ আবার কুঁচকালো। দরজাটা খোলা!
প্রায় হুড়মুড়িয়ে পাল্লা ঠেলে ঢুকতেই ভিতরের অন্ধকার ফুঁড়ে স্বাতী এসে দাঁড়ালো সামনে। দু’চোখে অদ্ভূত একটা উত্তেজনার ঝিলিক। প্রথমেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আওয়াজ করতে নিষেধ করলো। তারপর ইশারায় সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং-এর ওপাশে রান্নাঘরের দিকে দেখালো, আর কানে হাত দিয়ে ফোন করতে ইঙ্গিত করলো।
পার্থ’র মাথা কাজ করছিলো না।এসব কি হচ্ছে? স্বাতী কি বলতে চাইছে? লোকটা কি সত্যিই এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে? পার্থ কিছু ভেবে ওঠার আগেই স্বাতী আবার ইশারা করলো ফোন করতে। পার্থ বুঝলো, পুলিশে খবর দিতে বলছে স্বাতী।
যন্ত্রচালিতের মতন পকেট থেকে ফোনটা বার করলো পার্থ। পুলিশের নম্বর স্টোর করাই আছে। ডায়াল করতে করতে স্বাতী আবার ইশারা করলো, বাইরে গিয়ে কথা বলতে। পার্থ নিঃশব্দ পায়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
ফোনের ওপাশের উৎকন্ঠিত অফিসারকে বাড়ির ঠিকানা জানাতে জানাতে পার্থ’র কিছুটা সম্বিৎ ফিরলো। ওরা বলেছে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছে। স্বাতী ভিতরে আছে। পার্থ আবার ঢুকলো বাড়িতে। স্বাতীকে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার লিভিং রূম, সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং, পর পর বাথরুমের দরজা দু’টো পেরিয়ে পার্থ রান্নাঘরের দিকে এগোলো। স্বাতীও কি ওইদিকেই গেছে?
রান্নাঘরেও আলো জ্বলছে না। তবে উত্তরদিকের জানলাটা দিয়ে রাস্তার আলো এসে পড়ায় মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। ঢোকার পর ডানদিকে লম্বাটে ধরনের কিচেন। পার্থ ঢুকে ডানদিকে ঘুরেই পাথর হয়ে গেলো।
সিঙ্কের সামনে মাটির উপর লোকটা বসে আছে। ন্যাড়া মাথা। পোষাকের রং এত কম আলোয় বোঝা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে, জামার উপর কিসের যেন ছোপ ছোপ। সম্ভবত রক্তের। কারণ লোকটার হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরি।
পার্থ’র চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো বার বার। তার মধ্যেই ছুরিটা চিনতে পারলো। ওদেরই বিয়েতে উপহার পাওয়া কাটলারি সেটের সব থেকে বড় ছুরিটা। বোধহয় মাংস কাটার ছুরি। লোকটা সেটাহাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে আস্তে আস্তে। দু’চোখে কি অসম্ভব তীব্র জিঘাংসা! সেই সঙ্গে মুখে একটা হিংস্রহাসি। শিকার বাগে পাওয়ার হাসি।
পার্থ’র পা দু’টো যেন মেঝেতে গেঁথে গেছে। লোকটা এগিয়ে আসছে। জীবনে এই প্রথম মৃত্যুভয় টের পাচ্ছে পার্থ। শরীরটা যেন জমে গেছে। কোনও বোধ নেই। লোকটা আক্রমণ করলে বোধহয় সামান্য প্রতিরোধটুকুও করতে পারবে না...
ফুট তিনেক দূরে এসে লোকটা হঠাৎ থেমে গেলো। দৃষ্টি পার্থ’র বাঁদিকে পিছনে। পার্থ দেখতে পাচ্ছে না। স্বাতী এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। স্বাতীকে দেখে হিংস্র, রক্তলোলুপ মানুষটা কেমন থমকে গেছে। পার্থ’র দৃষ্টি ঝাপসা। তবু যেন মনে হচ্ছে, লোকটার চোখের হিংস্রতা কেমন যেন দ্রূত ভয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। চোয়ালটা ঝুলে গেলো। তারপর ঠিক ছুরিটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাইরে দরজার কাছে তীব্র স্বরে পুলিশের হুইসল বেজে উঠলো...
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একজন রিভলভারধারী অফিসার ও জনা চারেক কনস্টেবলের একটি দল হুড়মুড় করে কিচেনে ঢুকে এলো। এসে দেখলো পার্থ আর তাদের পলাতক আসামী মুখোমুখি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে।পার্থ মৃত্যুভয়ে আড়ষ্ট... আর হিংস্র পাগল খুনী লোকটার চোখেমুখে কেমন এক রকম অদৃষ্টপূর্ব ত্রাস। ভয়ে, বিস্ময়ে দু’চোখ বিস্ফারিত। মুখটা হাঁ করা। পায়ের কাছে রক্তমাখা ছুরিটা পড়ে আছে।
অফিসার ভদ্রলোক চটপট আলোগুলো জ্বালালেন। কনস্টেবলরা অতি দ্রূত লোকটাকে ধরে একটা মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো। পুলিশের লোকদের অবাক করে দিয়ে ভয়ংকর লোকটা কোনওরকম প্রতিরোধ না করে একদম বাধ্য ছেলের মতন আত্মসমর্পণ করলো। যেন ধরা পড়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো।কনস্টেবলরা যখন তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, লোকটা বারবার কেমন একটা অবিশ্বাসের চোখে পার্থ’র পিছনে বাঁদিকে, যেখানে একটু আগে স্বাতী দাঁড়িয়েছিলো, সেই জায়গাটা দেখছিলো।
অফিসার ভদ্রলোক পার্থকে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে ওর কাঁধটা ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিলেন। পার্থ চমকে উঠে সম্বিৎ ফিরে পেলো। একবার চারপাশ দেখে নিয়ে যেন পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো। ওর মুখ দিয়ে প্রথম কথা বেরলো, ‘‘স্বাতী...!’’
অফিসার পার্থকে ধাতস্থ হবার জন্য কয়েক মুহূর্ত সময় দিয়ে বললেন, ‘‘আপনার স্ত্রী? তিনি কোথায়? মাটিতে রক্ত কেন? লোকটা কতক্ষণ ধরে ছিলো এখানে?’’
পার্থ’র শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেলো। স্বাতী? স্বাতী কোথায়? সত্যি, মেঝেতে রক্ত কিসের? এতক্ষণ অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিলো না...
রক্তের দাগ অনুসরণ করে পুলিশ অফিসার এগোলেন। তাঁর পিছন পিছন হতভম্বের মতন পার্থ। ছুরি বেয়ে পড়া রক্তের দাগটা সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং-এর পাশে বাথরূমের দিকে গেছে...
বাথরূমের দরজাটা খুলেই অফিসার দু’হাত পিছিয়ে এলেন। ততক্ষণে পার্থও দরজার সামনে পৌঁছে গেছে। নিজের দৃষ্টিকে পার্থ রোধ করতে পারলো না। দেখতে পেলো শরীরটা। ঘাড়টা অস্বাভাবিক রকম বাঁকা। গলাটা একদম মাঝখান দিয়ে দু’ফাঁক হয়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া চাপ চাপ রক্তের মধ্যে শুয়ে আছে স্বাতী!
0 comments: