0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

ধারাবাহিক


আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়


৯) 

রূপেশ বর্মা যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল! মঙ্গলবার দিনের শুরুতে ভারি ভীড়। সোমবার সাপ্তাহিক অবকাশের পর আজ প্রথম কামকাজ কা দিন। তাই প্রথম দুটো ঘন্টা কাউন্টারের সামনে ঠেলাঠেলি দেখার মত। এই কয়মাসে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা বেশ বেড়ে গেছে। ভিলেজ প্রোফাইল রেজিস্টারে অন্ততঃ ১৫টি গ্রামের নাম। সবচেয়ে দূরের গ্রাম সতরেঙ্গা আহিরণ নদী পেরিয়ে প্রায় ২৭ কিলোমিটার। বর্ষার মরসুমে ও অনুমতি পেয়েছে ছোট ও সীমান্ত কৃষক পরিবারকে কৃষি ঋণ দেওয়ার। ট্রেনিং এর সময় বলা হয়েছিল এ হলো সবচেয়ে সোজা; একর প্রতি কত টাকা সেটা ঠিক করে দেওয়া আছে। তুমি শুধু ওর জমির কাগজ দেখে ধারাপাতের হিসেবে গুণ ভাগ কর আর জমির টাইটেল ডীড এর দস্তাবেজ ব্যাংকে জমা রেখে নাও। 

কিন্তু হাতেকলমে করতে গিয়ে দেখল মহা খিটকেল ব্যাপার। আগে দস্তাবেজ এ দেখ ক’জন লোক; কে লম্বরদার বা কর্তা এবং সব্বাই বেঁচে আছে কিনা। তারপর দেখ, কোন নাবালিগ অথবা মাইনরএর নাম রয়েছে কিনা। সেসব মিটলে দেখ ওর পেছনের কোন পাতায় কোন মারপিট বা ঝগড়াঝাঁটির জন্যে আদালতে কেস খেয়ে এটাতে জামিনের সীল মোহর লেগেছে কিনা। সে জামিন নিজের বা পরিবারের কারও জন্যে হোক বা বন্ধুবান্ধব পাড়াপড়শির জন্যে হোক—একই কথা। দস্তাবেজের ঝামেলা মিটলে শুভঙ্করের আর্যার হিসেবে যতটুকু লোন দেওয়া যায় তা বেশির ভাগ সময় গ্রাহক ব্যক্তিটির মনোমত হয় না। সে বেশি আশা করে। ম্যানেজারকে ভুল বোঝে; লোভ দেখায়। নগদ পাঁচ পারসেন্ট অথবা মূর্গা ও এক বোতল ঘরে তৈরি মহুয়ার মদ। 

কিন্তু এই শেষ নয়। এর পরে যেতে হবে প্রি-ইন্সপেকশন করতে। দেখতে হবে সত্যিই চাষি পরিবারটি দস্তাবেজে লেখা গাঁয়ে থাকে কিনা। গত কয়েকবছর ধরে চাষ করছে কিনা; পাটোয়ারির রেকর্ড থেকে পাঁচসালা বলে একটি কাগজে লেখা থাকে গত পাঁচ বছর ধরে ও জমিতে কোন টুকরোয় কী কী ফসল ফলিয়েছে। আর কতটুকু জমিতে বাস্তবে চাষ হয় এবং কতটুকু পতিত জমিন। গাঁয়ে গিয়ে বৈঠক করলে ,চায়ের দোকানে ভাজিয়া খেতে খেতে গল্প জমালে জানা যায় যে অমুক পরিবারের কী রেপুটেশন, স্বভাব-চরিত্তির—মানে জুয়ো খেলার মদ খাওয়ার মেয়েমানুষের পেছনে ছোটার বাই আছে কী না। শালা ! ব্যাংকের ম্যানেজার নাকি বিয়ের সম্বন্ধ করতে আসা ব্রাহ্মণ ঠাকুর? আগে জানলে কি ব্যাংকের নৌকরি করতে আসত? 

না; ও আসত, ওকে আসতেই হত। ওর সামনে আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না। 



সে না হয় হলো। কলেজের পড়া আর সত্যিকারের চাকরি, তা ও এমন মেঠো চাকরি –জমিন আসমান তফাৎ। তবে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো ফোর্থ ডাইমেনশন—টাইম। 

একটা লোন দেবার আগে যদি এত পাঁপড় বেলতে হয়—চাষির ইনটারভিউ, ডকুমেন্ট চেক, ফিল্ড ভিজিট এসব একাহাতে করবে কী করে? কোন ক্লার্ক নেই,ওকেই ক্যাশ গুণে গুণে জমা নেওয়া ও পেমেন্ট করা –সবই করতে হবে। ক্যাশ বুক, ডে বুক, জেনারেল লেজার লিখে ট্রায়াল ব্যালান্স করে তবে ব্যাংকের লাইট নিভিয়ে ঘরে আসতে পারবে। 

ও হো, তার আগে তো ওকেই ক্যাশ মেলাতে হবে; যা তিনবারে গিয়ে মেলে। হয় পয়সা, নয় ছোট নোট, নয় নতুন একশ’ টাকার বান্ডিলে গড়বড়ো। এরপর চাষিদের ভীড়; মেজাজ অজান্তেই তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। কিন্তু চাষের সময়,ফসল বোনার সময়—কাউকে ফেরানো যাবে না। কবিদের কী! ওরা গান লিখেই খালাস – 

“ ধান কী কটোরা ভাইয়া, ধান কী কটোরা। 

মোর ছত্তিশগড়িয়া কহথে ভাইয়া, ধান কী কটোরা”।। 

‘ধানে ভরা ডালা আমার, ধানে ভরা ডালা। 

আমার ছত্তিশগড়, জেনো রে ভাই—ধানের ভরা ডালা’। 



কিন্তু রূপেশকে লোনও মেপে মেপে দিতে হবে। সবটা নগদ দিলে চলবে না। খাদ বা ফার্টিলাইজার ডেলিভারি অর্ডারে দিতে হবে, তারপর চাষি ঘরে ওই রাখড় (সুপার ফসফেট) ও ইউরিয়া (নাইট্রোজেন) ‘বোরা’ বা বস্তাভরে ঘরে নিয়ে এলে সারের ব্যবসায়ীকে চেক দিয়ে পেমেন্ট করবে। বীজধান ও হালবলদের খর্চা নগদে দেওয়া যায়। চাষি চায় সবটাই নগদে; ঝগড়া করে, বলে নগদা-নগদি নিলে শেঠ কিছু ক্যাশ ডিসকাউন্ট দেয়। চেকে পেমেন্ট হলে ব্যাংকের কমিশন চাষির ঘাড়ে চাপায়। 

রূপেশ নিরুপায়। নতুন চাকরি, সার্কুলারের বাইরে কোন কিছু করবে না; কোন নিষিদ্ধ জানলা খুলবে না। ‘ হে কুমির তোর জলকে নেমেছি’—খেলবে না। 

সবই ঠিক, কিন্তু হেড অফিস এত নির্দয় কেন? কেন এত অবুঝ! ও বারবার লিখছে অন্ততঃ একটা ক্লার্ক দাও। আমিও তো মানুষ। ঠিক আছে, আমি ভিলাইয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনের ছেলে হয়েও ন’মাসে ছ’মাসে বাড়ি যাই। চাপরাশির বাবা রসেলু প্যাটেলের রাস্তার ধারের হোটেল থেকে পাঠানো টিফিন ক্যারিয়ারের একঘেয়ে রান্না করা ভাত-রুটি –ডাল- একটা শুকনো তরকারি-আচার খাই। বাজার রান্না এসব করি না। মাসে একটাও সিনেমা দেখি না। সেই সময়ে ছুটির দিনগুলোতে পেন্ডিং পেপার ওয়ার্ক কমপ্লিট করি; লোন দেওয়ার আগে প্রি- ও পরে পোস্ট ফিল্ড ভিজিট করি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন টানতে হবে? কুবের দেবতা কি বোবা ও কালা? 

ক্লার্ক-কাম –ক্যাশিয়ারের নতুন ব্যাচ রিক্রুট হয়েছে দু’মাস হলো। কিছু কিছু ব্যাংকে আমার ব্যাচ ফেলোরা ক্লার্ক পোস্ট হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু আমি? মুঝকো ভী তো লিফট করা দেঁ। মেরা ক্যা কসুর? উইক এন্ডে চেয়ারম্যান অথবা জেনারেল ম্যানেজারের বাড়ি গিয়ে হেঁ-হেঁ করি না,তাই? করব কী করে? আমার ব্র্যাঞ্চ যে রোববারে নয়, সোমবারে বন্ধ হয়। কর্তারা ভাবেন আমি নিঘঘাৎ ছুটির দিনে ভিলাইয়ে আমার বাড়িতে মায়ের আদর বাবার প্রশ্রয় পেতে যাই। কিন্তু ওদের সত্যি কথাটা বলা যাবে না। বলতে পারব না যে সে রাস্তাটা আমি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছি; হ্যাঁ, নিজের হাতে দরজায় পেরেক ঠুকে। 

কিন্তু সপ্তাহের কামকাজের দিন মঙ্গলবারে প্রথম দু’ঘন্টা ওর মাথায় এসব চিন্তা থাকে না। কাউন্টারের বসে খালি একের পর এক ভাউচার চেক করা, ক্যাশ গোণা, লেজারে পোস্ট করে পাসবুকে এন্ট্রি করে গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া। পরের জন? 

এর মধ্যে কখন চাপরাশি ঠুল্লু এসে কাঁচের গ্লাসে চা রেখে যায়। আদ্দেক চুমুক দেওয়া হয়, আদ্দেক চায়ে সর পরে যায়; তারপর অবধারিত ভাবে একটা মাছি এসে গোঁত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। 

আজ একঘন্টাও কাটে নি, প্রথম রাউন্ড চা আসবে আসবে এমন সময় ঠুল্লু এসে বলল—সাব, এক আদমি আপসে মিলনা চাহতে হ্যাঁয়। 

ও খিঁচিয়ে ওঠে। আভি নহীঁ, শাম কো, চার বাজে। 

--নহী সাহাব; দুসরা আদমি, হেড অফিস সে আয়া হ্যাঁয়। 

মরেচে, স্ন্যাপ অডিট করতে এল? এই পিক আওয়ারে। হেড অফিসেরও কোন গাঁড়-গর্দানের হোঁশ নেই। ও শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। 

একটি ছিপছিপে চেহারা এগিয়ে আসে। ওর পরনে ফুলহাতা সাদা শার্ট, ডার্ক স্ট্রাইপড ট্রাউজার,গলায় কেতাদুরস্ত টাই, পায়ে লেদারের ব্রাউন শু। অডিট? রিজার্ভ ব্যাংক? 

ছেলেটি ব্রিফকেস খুলে একটি বন্ধ লম্বা খাম বের করে। রূপেশ হাত বাড়ায়, কিন্তু ও খামটা ধরে রেখে ইংরেজিতে বলে—আমি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। 

--আমিই ম্যানেজার। 

--না,মানে আমি এই ব্র্যাঞ্চের যিনি ইনচার্জ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমাকে খামটি তাঁর হাতেই দিতে বলা হয়েছে। 

উৎসুক ভীড় নতুন কোন তামাশা দেখার আনন্দে অধীর। 

রূপেশ রাগটা চেপে রেখে কেটে কেটে বলে—আমিই ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার বা ইনচার্জ রূপেশ বর্মা। আপনার পরিচয় ? 

ছেলেটি হকচকিয়ে যায়। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রূপেশকে দেখে। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটু হতাশ হয়। তারপর খামটি রূপেশের দিকে বাড়িয়ে বলে – মাই নেম ইজ টি পি পি রাজন। আই অ্যাম ইয়োর নিউ কাশিয়ার –কাম-ক্লার্ক। দিস ইজ মাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট অ্যান্ড পোস্টিং লেটার অ্যাজ ওয়েল; অ্যান্ড দিস ইজ জয়েনিং রিপোর্ট। 

রূপেশ খাম ছিঁড়ে কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখে। রাগটা কমে আসছে, পাওয়া গেছে। একজন সাথী, হোকগে সাউথ ইন্ডিয়ান। তবু ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর নিজের মত কিছু কথা তো বলা যাবে। এবার ও হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর বলে টি পি পি? পুরো নামটা কী? আর বাড়ি কোথায়? 

--তুন্ডি পরমপিল্লে পাচন রাজন। আপনি আমাকে রাজন বলেই ডাকবেন। আমার বাড়ি ভিলাইনগর। স্টিল সিটি, নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আপনার বাড়ি? 

ভিলাইনগর! দশ হাজার ভোল্টের শক! উঃ ভগবান, আর কত পরীক্ষা নেবে? 

ও উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলে --- ও কে, রাজন। খাওয়া হয় নি নিশ্চয়ই; ঠুল্লুর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ওর বাবার হোটেলে খেয়ে নিন। দাম দিতে হবে না। এটা আমার ওয়েলকাম ট্রিট মনে করুন। মালপত্রগুলো ঠুল্লু এখানে নিয়ে আসবে। তারপর কাজের কথা হবে। 

আজ রূপেশের কাছে ভিড় খুব হালকা মনে হলো। ও সবার সঙ্গে খুব ভাল করে হেসে কথা বলল। একজন সম্পন্ন কৃষককে ধৈর্য্য ধরে বোঝাল যে এই ব্যাংক খালি গরীবদের লোন দেওয়ার জন্যে খোলা হয়েছে, তাই আপনাকে দিতে পারছি নে। আপনি ঘরের বাড়তি পয়সা এখানে জমা খাতা খুলে তাতে রাখতে পারেন, চোর-ডাকাতের ভয় নেই আবার সুদে বাড়বে। 

রাজন খেয়েদেয়ে মালপত্র নিয়ে ফিরে এসে হাজিরি খাতায় সই করতে গেলে রূপেশ বলল— জাস্ট এ মিনিট! এই লেটারে নির্দেশ দেওয়া আছে যে আপনার থেকে সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে দু’হাজার টাকা নিয়ে ফিক্সড করে হেড অফিসে জানাতে হবে। এটা আপনার জয়েনিং রিপোর্ট এর সঙ্গে যাবে। 

রাজন ব্রিফকেস খুলে একটি চেক বাড়িয়ে দেয়। 

রূপেশ মাথা নাড়ে, হয় ড্রাফট নয় ক্যাশ। বিব্রত রাজন বলে আমার দাদার বুঝতে ভুল হয়েছে। আমি মালয়ালী; উইনাদের কাছে গাঁয়ে বাড়ি। ভিলাইয়ে দাদার সংসারে থেকে পড়াশুনো করেছি। ঘরে ক্যাশ ছিল না তাই চেক দিয়েছেন। 

--তাহলে ভিলাই ফিরে যাও; গিয়ে ক্যাশ নিয়ে এস। তারপরে জয়েন করতে পারবে। 

রাজন স্পষ্টতঃ হতাশ। ব্রিফকেসে চেক ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে –বস, আমাকে ভিলাই গিয়ে ব্যাংক থেকে ক্যাশ তুলে আবার ছুরিকলাঁ গাঁয়ে এসে আপনার কাছে ডিপোজিট করতে তিনদিন লেগে যাবে। আমার সিনিয়রিটি মার খাবে। দাদা বলছিল--। ঠিক আছে, আপনি কী আর করবেন, আমার লাক। 

রূপেশ কিছু দেখছে না। ব্যাংকের সাদা দেওয়াল, তাতে টাঙানো রিজার্ভ ব্যাংকের জারি করা লাইসেন্স; মন্ত্রীর উদ্ঘাটনের ছবিগুলো—কিস্যু না। ওর যেন গরম লোহার ছ্যাঁকা লেগেছে। দুটো শব্দ –‘দাদা বলছিল’। 

ও চেকটা চেয়ে নেয়। তারপর নিজের সেভিংস খাতা থেকে দুহাজার উইড্র করে ফিক্সড ডিপোজিটের ফর্ম ও ভাউচার ভরে রাজনকে বলে—সাইন কর; এখানে, এখানে –আর এখানে। 

হতভম্ব রাজন কলের পুতুলের মত সাইন করে। হাজিরি খাতাতেও। 

-আমি তোমার চেক আমার কাছে জমা রেখে ধার দিলাম। এখানে সোমবার বন্ধ থাকে। তুমি রোববার রাতে বাড়ি যাও, সোমবার ভিলাইয়ের ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মঙ্গলবার ফিরে এসে আমাকে দিয়ে চেকটা ফেরত নাও। 



সাতদিন কেটে গেছে। রাজন যথারীতি মঙ্গলবারে ফিরে এসে রূপেশের দু-হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে আর নতুন কাজটা শিখে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু একবারও ওই টাকাটা দেওয়া নিয়ে কিছু বলে নি। রূপেশ কি একটা ধন্যবাদ অথবা ওইরকম কিছু আশা করেছিল? অন্ততঃ ওর দাদার কাছ থেকে? 

নাঃ; দাদাদের ভূমিকা নিয়ে ওর কোন মোহ নেই; তবু? 

সপ্তাহ দুই যেতেই রাজন একটা প্রস্তাব দিল যে ওরা মাত্র দু’জন, হলোই বা একজন অফিসার আর একজন ক্লার্ক, তবু কি একসঙ্গে মেস করে থাকা যায় না ? বস, আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি রাঁধতে জানি, খেয়ে দেখুন --আঙুল চাটবেন। খালি ঘর মোছা, কাপড় কাচার জন্যে একজন লোক রেখে নিন। নইলে ঠুল্লুকে কিছু এক্সট্রা টাকা মাসে মাসে দিয়ে এগুলো করিয়ে নিন। বাসন মাজা আর রান্না আমার জিম্মায়। মেসের খরচা, ইলেক্ট্রিক বিল দুজনে সমান ভাগ করে নেব। খামোকা বাসরাস্তার মোড়ে রসেলুর কামচালাউ হোটেল থেকে অখাদ্য খাবার খেয়ে পেটের বারোটা কেন বাজাচ্ছেন? পরে স্টাফ বাড়লে তখন দেখা যাবে। 

শুরু হলো নতুন সংসার। রাজন ঘর থেকে নিয়ে এসেছে একটা টেবিল ফ্যান আর প্রাইমাস স্টোভ, রূপেশ কিছু থালাবাসন আর কড়াই কিনে নিল। গাঁয়ের থেকে কেনা হলো দুটো নেয়ারের খাট। শুরুটা মন্দ হয় নি। 

তবে দুটো সমস্যা দেখা দিল। 

ব্যাংকে বাথরুম নেই,রয়েছে খাটা পায়খানা। একজনের যেমন তেমন করে চলে যায়,কিন্তু দু’জন হলে? নাকে কাপড় বেঁধে? পরিষ্কার করতে একজন মেথরাণী আসে, সকাল নটায়। ছোট বাইরের জন্যে পাশের গলিতে একটা চট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার আড়ালে একটা স্লেট পাথর পাতা, পাশে জলের হাঁড়ি ও বনস্পতি ডালডার টিন কেটে তৈরি মগ। কিন্তু ব্যাংকের সময় তাতে ওরা দুজন ছাড়া দূরের গ্রাম থেকে আসা লোকজনও চলে যায়, কে বারণ করবে! 

স্নানের জল, রান্নার জল ও খাওয়ার জল ঠুল্লুকে আনতে হয় মকানমালিক কলেশরাম গৌঁটিয়ার পেছনের উঠোনের কুয়ো থেকে, বালতি ভরে। কিন্তু মাঝেমাঝে কলেশরামের ভাই কুয়োর ঢাকনায় তালা লাগিয়ে দেয়,বলে জল নেমে যাচ্ছে। 

রাজন রোজ একবার করে তাগাদা দেয়—বস, এটা কী হচ্ছে! আপনি ল্যান্ডলর্ডকে বলুন পায়খানা পাকা করে দিতে, বাথরুম বানিয়ে দিতে, কলের ট্যাপ লাগিয়ে দিতে। এসব তো বেসিক নেসাসিটি। এগুলো না দিলে আমরা ব্যাংক অন্য বিল্ডিঙয়ে নিয়ে যাব। 

রূপেশ হেসে ফেলে। এটা ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের কোয়ার্টার নয়। এখানে গোটা গাঁয়ে কোন কলের জলের ব্যবস্থা নেই। রাস্তার ওপরে আর বামনদীঘির পাড়ে এজমালি কুয়ো আছে, পঞ্চায়েত বানিয়ে দিয়েছে। বাকি সবাই নিজের বাড়ির কুয়োর জল খায়, রান্না করে; স্নান করতে কাপড় কাচতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে পুকুরে যায়। গাঁয়ে কোন বাড়িতে পাকা পায়খানা নেই। কলেশরাম গৌটিয়ার মত সম্পন্ন লোকজনের বাড়িতে খাটা পায়খানা। আম জনতা এমনকি স্কুলের টিচার সবাই লোটা নিয়ে মাঠে যায়; মেয়েদের তিনটে ব্যাচ হয়। খুব ভোরে, দুপুরে স্নানের আগে আর সূর্য ডুবলে। ওরা যায় দলবেঁধে, বসে ঘোমটা টেনে। আর নিত্যকম্ম সেরে পুকুরে ডুব দিয়ে কাপড় কেচে ভিজে কাপড় গায়ে জড়িয়ে আব্রু রক্ষা করে বাড়ি ফেরে। গরীবঘরের মেয়েরা পুকুর থেকে কলসি ভরে খাবার ও রান্নার জল নিয়ে আসে। 

রাজনের ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে রূপেশ একবার কলেশরামের কানে কথাটা তোলে। কিন্তু গৌটিয়া মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নেড়ে বলে বাড়িভাড়ার একরারনামা বা এগ্রিমেন্টে পায়খানা বাথরুম নিয়ে কিছু বলা নেই। আর বিলাসপুরের হেড অফিস থেকে বড়োকর্তারা এসে বাড়ির অবস্থা দেখে শুনে তবে ব্যাংকের জন্যে বায়না দিয়েছিলেন। এখন নতুন করে কিছু করা মুশকিল। 

রাজন রেগে মেগে মগ নিয়ে পুকুরপাড়ে বেশরমের ঝাড়ের নীচে নিজেকে শুদ্ধ করে পুকুরে ডুব দিয়ে আসা শুরু করল। রূপেশ কিছু বলল না। তবে ওর জল ও পায়খানার চাপ অনেক হালকা হয়ে গেল। 

কেটে গেল পনের দিন। 

রাজন ব্যাংকে এসে কাজ করছে কিন্তু কথা বলছে ভাববাচ্যে। হলোটা কী? 

রূপেশের এসব ন্যাকামি অসহ্য লাগে। দুপুরে লাঞ্চের সময় বেগুনপোড়া আর ডাল দিয়ে আধপোড়া চাপাটি খাবার সময় একটা লংকায় কামড় দিয়ে ও জানতে চাইল ব্যাপারটা কী? 

রাজন নিরুত্তর। অন্যদিকে তাকাচ্ছে, মাথা নীচু করে খাচ্ছে, চোখের কোণে একটু জলের আভাস কি? 

রূপেশ খিঁচিয়ে উঠল—কা বাত হ্যাঁয়? তুম মেরি গার্লফ্রেন্ড হো ক্যা ? ইতনা নখরা তো মৎ দিখাও। সাফ সাফ বাতাও। 

রাজন কিন্তু কিন্তু করে বলল যে ও আবার কাল থেকে ব্যাংকের খাটা পায়খানা ব্যবহার করার অনুমতি চায়। রূপেশ হাসি চেপে বলল যে কেন, খোলা মাঠে কী অসুবিধে? এতদিন তো ভালই চলছিল। 

রাজন মাথা নেড়ে বলল যে আজ একটা কান্ড হয়েছে। ঘুরে ঘুরে সাত তালাওয়ের এক একটার পাশে গিয়ে কাজ সেরে স্নান করে আসে। সাঁতারও জানে; ভিলাইয়ের সুইমিং পুলে শিখেছে। 

কিন্তু আজ পেটে মোচড় লাগায় একটা ডোবা মত পুকুরের পাশে বেশরমের ঝাড় আর একটু জমা জল দেখে বসে পড়েছিল। পুকুরে দুদিকে দুজন ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল। ওরা হটাৎ ওর দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ছত্তিশগড়ি ভাষায় কিছু বলছিল। রাজন ভিলাইয়ে পড়াশুনো করা মালয়ালি ছেলে, হিন্দির জ্ঞান কাম-চলাউ আর স্থানীয় ভাষার কিছুই বোঝে না। একটু পরে কিছু পরিচিত হিন্দি গালি কানে আসায় বুঝল যে ওই দুজন রেগে গেছে এবং ওকেই গাল পাড়ছে। কারণ ও নাকি ঠিক জায়গায় না বসে রাস্তার উপর বসে হাগছে এবং রাস্তাটি মেয়েদের পুকুর থেকে জল নিয়ে যাওয়ার জায়গা। ওর এই বেয়াক্কেলেপনায় গাঁয়ের মেয়েরা কি সারাদিন মাথায় কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? সর উঠাকে দেখলে ঠাকুর! 

ও চোখ তুলে দেখে পুকুর পাড়ে তিনজন মহিলা মাথায় কলসি নিয়ে ঘোমটায় আধখানা মুখ ঢেকে প্রায় হিন্দি সিনেমার নাচের ভঙ্গিতে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

কেন দাঁড়িয়ে আছে, চলে গেলেই পারে। 

আরে গোমুখ্যু ! তুই ব্যাটা যে ‘সব খোলখালকে বৈঠে হস।‘ এভাবে কেউ খোলা রাস্তায় বসে? 

রূপেশ এঁটো হাত ওর মাথায় আলতো করে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ছুঁইয়ে দেয়।

0 comments: