গল্প - সৌমিত্র চক্রবর্তী
Posted in গল্প
গল্প
তিন নম্বর লোক
সৌমিত্র চক্রবর্তী
জগন্নাথ মারা গেছে। বাজার কেন বন্ধ জানতে গিয়ে কথাটা শুনে জীবনবাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল দুম করে। এ হে! বড় ভালো মানুষ, থুড়ি বড় ভালো মাছওয়ালা ছিল লোকটা। একই পাড়ায় বাস বলে একটু আধটু বাড়তি দিত কখনও সখনও। ধারে মাছও দিয়েছে বার কয়েক। "কি যে হচ্ছে পরপর। গত বুধবার ২৬/বি র নরেশবাবু গেলেন, আজ জগন্নাথ। আরেকটা টানবে।" "মানে?" পাশ থেকে বলা শ্যামেনদার কথাগুলো বোধগম্য হলনা জীবনবাবুর। "মানে আর কি হে? মা ঠাকুমার মুখে শোননি গেলে এক পাড়ায় তিনটে প্রাণ পরপর যায়? দুজন মরল মানে আরেকটা পটল তোলবার খবর পাওয়াটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর"। জীবনবাবু মনে করবার চেষ্টা করলেন এমন কথা আগে শুনেছেন কিনা। ঠিক মনে পড়লনা। ব্যাপারটাকে আমল না দিয়ে জীবনবাবু তপনের দোকানের দিকে পা বাড়ালেন। ক'টা ডিম অন্তত কেনা দরকার। ততাই আমিষ ছাড়া একদম খেতে পারেনা। গন্ডগোলটা বাঁধল দুপুরে।
অফিসে টিফিন সেরে চেয়ারে গা এলানোটা জীবনবাবুর বিশ বছরের অভ্যাস। আজ চোখ বুজতেই খুব পুরোনো একটা স্মৃতি ভেসে উঠল। ১৯৮০ সাল, জানুয়ারী মাস। এক শীতের ভোরে হঠাৎ মারা গেলেন বটঠাকুমা। ঠিক দুদিন বাদে মানে চোদ্দ তারিখ চলে গেলেন পাশের বাড়ির লজেন্স জেঠু আর উনিশ তারিখে রান ওভার হল খেলার সঙ্গী তপনদা। "জানিস জীবু, যম যখন টানে, এক পাড়ায় তিন জনকে নিয়ে যায়", গা ছমছমে শীতের রাতে জেঠীমা বলেছিলেন এক লেপের তলায়। শুনে খুব অবাক লেগেছিল সেই বয়সে। জীবনবাবু চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। আরে, কবেকার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল! আজ সকালে শ্যামেনদাও বলছিলেন ওই একই কথা। জীবনবাবু ভাবতে লাগলেন এমন উদাহরণ তাঁর জীবনে আরও আছে কিনা। হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার বেশ মনে পড়ছে। ততাই হওয়ার বছরে একই পাড়ায় পরপর গিয়েছিল শাশুড়ি, খুড়শ্বশুর আর পাশের বাড়ির আরেকজন কে। তারপর ধরো, এই তো পাঁচ বছর আগে অফিসের রবীনের পাড়ায় পরপর তিনজন মারা গিয়েছিল। রবীন করেছিল তখন গল্পটা। আচ্ছা, সত্যিই কি তাহলে তাঁদের পাড়াতেও আরেকজন কেউ মারা যাবে? বলা মুশকিল। সারা পাড়ায় কার কপালে আর কুষ্ঠিতে যে কি লেখা আছে, কে জানে! কুষ্ঠি! কথাটা মনে পড়তেই একটা ঠান্ডা স্রোত হিসহিসিয়ে বয়ে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। জীবনবাবু বুঝলেন হঠাৎই ব্লাড প্রেশারটা লং জাম্প দিতে শুরু করেছে তাঁর শরীরে।
"একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করো মেজদা। জল, আগুন আর যানবাহন থেকে সাবধান।" "কেন রে?" "বৌদি তোমার কুষ্ঠিটা দেখতে বলেছিল। তাতেই দেখলাম। ফাঁড়া আছে একটা। একটু সাবধানে থাকাই ভালো।" জীবনবাবু হো হো করে হেসেছিলেন, "তোরা পারিসও বটু। জল আগুন গাড়ি ঘোড়া কিছুই বাদ দিলিনা যে! যা বললি তাতে তো রাস্তাতেই বেরোনো চলেনা রে।" বটু তাঁর পিসতুতো ভাই। বিয়ে-শাদি করেনি, মরা বাপ-মার থেকে মালকড়ি পেয়েছে ভালোই। কাজেই খায়-দায়, বগল বাজায় আর থেকে থেকে আজ জ্যোতিষ কাল প্ল্যানচেট পরশু রাজনীতি -এইসব নিয়ে পড়ে। "যা দেখলাম তাই বললাম গো মেজদা। হার্টের দিকটাও একটু ঝামেলা আছে কিন্তু।" "আর কি বাকি রইল বাপ আমার?" গিন্নির ভ্রুকুটি অগ্রাহ্যই করেছিলেন জীবনবাবু। এসব কোনওকালে মানেননা তিনি। যত্ত সব বুজরুকি। কিন্তু এখন মনের ভেতরটা কেমন যেন অন্যরকম নড়ছে চড়ছে। আচ্ছা, বটু যে বলল তাঁর এখন কিসব ফাঁড়া চলছে, যদি পাড়ার তিন নম্বর লোকটা তিনিই হন? জীবনে প্রথমবার হেসে উঠতে গিয়েও হাসতে পারলেন না জীবনবাবু। উল্টে গলার কাছটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। এই তো খেয়ে দেয়ে জল খেলেন। জীবনবাবু হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে আরও আধ বোতল জল খেলেন। এখন স্বস্তি লাগছে খানিকটা। দুর, কি সব ছাইপাঁশ ভাবছিলেন এতক্ষণ! ছিঃ ছিঃ! জীবনবাবু নিজের ভীতুমিতে লজ্জা পেয়ে গেলেন।
সেদিন বিকেলবেলা পিঠটা কেমন যেন ব্যথা করে উঠল। সঙ্গে হালকা মাথা ঘোরা আর বাঁ হাত চিনচিন। অম্বল-টম্বল নাকি? নাঃ, তা কি করে হবে? জীবনবাবু ভেবেই পেলেননা শেষ কবে অসুখ-বিসুখ হয়েছিল। বলতে নেই, ছোটবেলা থেকেই শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালোই তাঁর। তাহলে এমন অস্বস্তি হচ্ছে কেন? জীবনবাবু মনে জোর আনলেন এবং তাতে খুব একটা সুবিধা হলনা। কারণ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরবার পথে মিনিবাসে জানলার ধারে বসেও বলা নেই কওয়া নেই দরদরিয়ে ঘেমে চান করে গেলেন। সেদিন রাতে খুব হালকা খেয়ে শুয়ে পড়লেন তাড়াতাড়ি। একটু ভাববার সময় দরকার কেন এমন হচ্ছে। কিন্তু শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন জীবনবাবু এবং সেই ঘুম ভাঙল এক্কেবারে ভোররাতে বিদিকিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখে। তিনি মারা গেছেন আর কয়েকটা অচেনা লোক তাঁর বডিটাকে চ্যাংদোলা করে পাঁইপাঁই ছুটছে আগুনের দিকে। জীবনবাবু ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন আর তখনই চোখ পড়ে গেল উল্টোদিকের দেওয়ালে টাঙানো তাঁর মৃত বাবার ছবির দিকে।
একটা বাস তাঁকে চাপা দিচ্ছে ভোরবেলা স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা। ঘুম ভেঙে গল্পটা বলেছিলেন বউ-ছেলেকে। আর সেদিনই সন্ধ্যাবেলা রাস্তা পেরোতে গিয়ে হঠাৎ একটা বাস...। জীবনবাবু বুঝলেন তাঁর ভয় করছে, খুব বড় মাপের একটা আতংক দানা বাঁধছে মনে। আসলে পরপর ব্যাপারগুলো মিলে যাচ্ছে এমন! হিসেব মতো পাড়ায় এখনও একটা লোক মরতে বাকি, কুষ্ঠীতে ছাইপাঁশ ওসব লেখা, তার ওপর আবার এই ভোরের স্বপ্ন। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে, ওই তিন নম্বর লোকটা হওয়ার চান্স তাঁর ক্রমশ বাড়ছে। নাঃ, ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিলে চলবেনা। সব কিছু অমন দুচ্ছাই করলে চলেও না। সতর্ক থাকতেই হবে,রাস্তাঘাটে বিশেষ করে। কোনওরকমে ফাঁড়ার পিরিয়ডটা কাটাতে পারলেই ব্যাস! সেদিন চান করতে ঢুকে গিন্নির ওপর বিস্তর চেঁচামেচি করলেন জীবনবাবু। বাথরুমের মুখটায় সাবান জল পড়েছিল যে! বাসে জানলার ধারটা পেয়েও বসলেন না। রেষারেষির সময়ে বাসগুলো পাশাপাশি ঘষটে যায় প্রায়ই। দুপুরটা মুড়ির ওপরেই কাটালেন, অন্যদিনের মতো কচুরি বা চাওমিনের দিকে এগোলেন না। জীবনবাবু অবশ্য এসবে বেশী উৎফুল্ল হলেন না। কারণ তিনি জানেন আসল পরীক্ষাটা ফেরবার সময়ে তাঁর বাড়ির সামনের মোড়ে। সন্ধ্যাবেলা যেন হাট বসে জায়গাটায়, এদিক দিয়ে গাড়ি, ওদিক দিয়ে টোটো, তার মাঝে রকেটের গতিতে বাইক, রাস্তা পেরোনোই দায়।
মোড়ের মাথায় নামতেই মেজাজ বিগড়ে গেল আজ। রাস্তার সবকটা সোডিয়াম ভেপার জ্বলছে না। জীবনবাবু খুব সাবধানে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামলেন। ধ্যাত, আধো অন্ধকারে বিপত্তিটা বাড়ছে আরও, চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ডানদিক থেকে বাস আসছে একটা, জীবনবাবু যেতে দিলেন সেটাকে। রাস্তার মাঝামাঝি পৌঁছতেই বাঁদিক থেকে একটা ছোটা হাতি। অন্যদিন ছোট্ট একটা স্প্রিন্ট টেনে ওপাশটায় চলে যান, আজ কনফিডেন্স পাচ্ছেন না। জীবনবাবু মাঝরাস্তাতে দাঁড়িয়ে ছোটা হাতিকে পাস দিতে গিয়ে সভয়ে শুনলেন ডানদিক থেকে তীব্র একটা ফটফট আওয়াজ। এক ছোকরা রেস দেওয়ার স্টাইলে বাইক নিয়ে খুব জোরে এঁকে-বেঁকে বেরোচ্ছে দুটো গাড়ির মাঝখান দিয়ে। নির্ঘাত ধাক্কা মারবে। জীবনবাবু হুড়মুড়িয়ে বাকি রাস্তাটা পেরোতে গেলেন আর তখনই -"আরে দাদা দেখে" - একটা টোটো আচমকা ঘাড়ের ওপরে। জীবনবাবু টাল সামলাতে পারলেননা। রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে জ্ঞান হারানোর আগে তাঁর কানে এল খালি একটা হইচই আর ক্যাঁচ ক্যাচ করে অনেকগুলো ব্রেক কষার শব্দ।
একটা হালকা কথাবার্তা কানে আসছে বটে, কিন্তু জীবনবাবু চোখ খুলতে ভরসা পেলেননা। তিনি জানেন কি চলছে। রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি পড়ে আর তাঁকে ঘিরে নির্ঘাত একটা জটলা। মারা গেছেন কিনা ঠিক বুঝতে পারলেননা, তবে মারাত্মক আহত হওয়াটা নিশ্চিত। চোখটা খোলা দরকার মনে জোর এনে, পরিস্থিতিটা তো বুঝতে হবে। চোখ মেলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন জীবনবাবু। রাস্তায় মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে কি করে? "কি গো, এখন শরীর ভালো লাগছে?" গিন্নির গলা। আরে, এটা তো তাঁর বেডরুম, নিজের খাটে শুয়ে আছেন তিনি। "রাস্তায় পড়ে গেছিলে কেন গো? মাথা-টাথা ঘুরছিল নাকি? ভাগ্যিস টোটোটায় বটু ছিল। ওই তো নিয়ে এলো তোমায়। কি কপাল, একটু হাত পা ছড়ে যাওয়া ছাড়া কিছু হয়নি!" জীবনবাবু আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। শরীরটা ঠিকই লাগছে। কনুইয়ের কাছটা একটু জ্বলছে শুধু। "হ্যাঁ, কি করে যে হল! মনে হয় গ্যাস-ট্যাস থেকেই।" আসল কথাটা চেপে গেলেন তিনি। "তোমার আর গিয়ে কাজ নেই আজ। আমিই একবার ঘুরে আসি বরং।" জীবনবাবু এতক্ষণে লক্ষ্য করলেন গিন্নি বেশ সেজেগুজে রয়েছেন। "কোথায় যাওয়ার আছে?" "ও মা, সুকোমলবাবুর বাবার নিয়মভঙ্গে নেমন্তন্ন না আজ। ভুলে গেলে?" গিন্নি হাসলেন। আরে তাইতো তাইতো! সুকোমলের বাবা মারা গেছেই তো বটে! একদম মাথায় ছিলনা তাঁর। তার মানে জগন্নাথ মাছওয়ালা দু নম্বর নয়, তিন নম্বর। কোটা কমপ্লীট! জীবনবাবু লজ্জায় আনন্দে একদম জড়ামড়ি হয়ে গেলেন। ওফ্, কি ভয়টাই না পেয়ে বসেছিল তাঁকে। আরেকটু হলে তো...। "বলেছিলাম মেজদা, ফাঁড়া আছে..." বটুর কথা শেষ হতে না হতেই জীবনবাবু দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন ভাইয়ের হাত, "দেখলাম বৈকি, একেবারে হাড়ে হাড়ে দেখলাম। উফ্, খুব জোর ফাঁড়া কেটে গেল বটু বুঝলি!"
0 comments: