2

গল্প - ব্ল্যাকি

Posted in

গল্প


টুটুলের হিজিবিজি
ব্ল্যাকি



স্কুল সেরে দুপুরের ভাত খেয়ে ঘুমোচ্ছিল টুটুল। মা চাকরি করতেন। দুপুরে টুটুলের জিম্মা ছিল কালি পিসির। স্কুল থেকে ফিরলে, স্নান করিয়ে, খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তারপর কালি পিসি নিজে একটু জুড়াতো।

বুকের উপর হাল্কা কিছু একটার খরখরানি আর সাথে মুখ চাটার সুড়সুড়িতে ঘুমটা ভেঙে গেলো টুটুলের। চোখ খুলে দেখে বুকের উপর তুলতুলে একটা মাংস পিণ্ড কুতকুত করে তাকিয়ে আছে আর সপাৎ সপাৎ করে তার মুখ চাটছে। খাটের মাথায় দাঁড়িয়ে মেসোমশাই হাসছেন।

"নে, তোকে দিলাম।"

ওই ছিল টুটুলের সাথে ব্ল্যাকির প্রথম শুভদৃষ্টি। মেসোমশাই-এর কাজ কারবার বরাবর এরকমই ছিল। অ্যাকশন ম্যান। যেটা মনে হত, করে ফেলতেন। পরে মাসীর কাছে বেদম ঝাড় খেতেন, কিন্তু দমে যাননি কোনও দিন। বাবা মা দুজনে কেউ বাড়ি থাকে না, টুটুল স্কুলে যায়। টুটুলকে কে দ্যাখে তার নাই ঠিক, উনি ব্ল্যাকিকে টুটুলের বুকে ঝেড়ে দিয়ে দাঁড় করানো ট্যাক্সি নিয়ে আবার হা হা হা হা করে বেরিয়ে গেলেন।

এটা কি ব্যাপার? কোত্থেকে এল? কি খাওয়াতে হবে? কে দেখবে... এসব ক্ষুদ্র চিন্তা ওনার নয়, ছিলও না কোনদিন। বড় বড় এক্সিকিউটিভ ডিসিশন উনি নিতেন। টুটুলের মাসীর বাড়ি ছিল দত্তপুকুরে। টুটুল শুনেছিল একবার ওর আরো দুই ছোট মাসিকে নিয়ে হঠাৎ ঠিক করে "শোলে" দেখতে কলকাতায় নাইট শো-তে এসেছিলেন। রাত্রে বাড়ি ফিরবেন কিভাবে এই চিন্তায় মাসীরা যখন অস্থির, তখন নাকি মেসো, শো শুরু হওয়ার আগেই একটা ট্যাক্সি ডেকে পূরবী সিনেমার সামনে পার্ক করিয়ে মিটার অন করিয়ে, সর্দারজী ট্যাক্সি ড্রাইভারের টিকিট কেটে তাকে শুদ্ধু নিয়ে "শোলে" দেখতে ঢুকে গেছিলেন। যাতে ট্যাক্সি ড্রাইভার পালাতে না পারে। বলা বাহুল্য, সেই সর্দারজীর পাশে বসে টুটুলের তিন মাসি শোলে কেমন দেখেছিলেন আর তারপর মেসো বাড়ি পৌঁছে নিজে কেমন ঝাঁসির রাণী র জিভের তরবারিতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিলেন, সে আরেক গল্প।



প্রথম দর্শনে প্রেম যদি কিছু হয়, সেটা টুটুলের হয়েছিল ব্ল্যাকির সাথে। মার আসতে তখনো ঘন্টা খানেক দেরি। কালি পিসি গজ গজ করছে, "পাগলের বাড়িতে কাজ করছি। একটা বাঁদর নিয়ে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, আবার একটা কুকুর।"

কিন্তু ওই কুট্টুকুট্টু একটা প্রাণকে দেখে অতি বড় পাষন্ডেরও মন গলতে বাধ্য। কালি পিসিই একটু দুধ গরম করে আবার ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করে নিয়ে এল। ব্ল্যাকি যতক্ষণ চুকচুক করে দুধটা খেল, টুটুল আর কালি পিসি চূড়ান্ত বাৎসল্য নিয়ে সেটা দেখতে দেখতে পরম তৃপ্তি লাভ করল। এটা পরিষ্কার বোঝা গেল, মেসো যেখান থেকেই আনুক না কেন, অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি ব্ল্যাকির।

মেসো দিয়ে গেছে, বোঝানোর দায়িত্ব মেসোর। মা এলে ঝাড়ের চান্স কম টুটুলের। বারান্দায় নিয়ে খেলা শুরু করল ব্ল্যাকির সাথে।

"দুপুরে না ঘুমিয়ে সন্ধ্যে বেলায় ঢুলে দেখো। মা তোমার চামড়া গুটিয়ে ছাড়বে।"

কালি পিসির ওয়ার্নিং কানেই নিল না টুটুল।



মা এসেই ক্ষেপে ব্যোম।

"বোনটার জীবন তো অতিষ্ঠ করেছেই, এবার আমারটাও অতিষ্ঠ করার ইচ্ছা!"

টুটুল আর ব্ল্যাকি দুজনেই চোরের মত তাকিয়ে আছে। টুটুল তো জানেই, ব্ল্যাকিও ওর অ্যানিমাল ইন্সটিংক্ট থেকে বুঝে গেছে, রাখলে এই রাখবে, আর তাড়ালে এই তাড়াবে। মা অফিসের শাড়িও ছাড়েনি, গুম হয়ে বসে আছে খাটের ওপর। টুটুল মেঝেতে বসে দেওয়ালে টিকটিকি খুঁজছে, কালি পিসিও কার দল নেবে একটা কনফিউজড অবস্থায় আছে, ঠিক এই সময় মাস্টার স্ট্রোকটা ব্ল্যাকিই দিল। সটান মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে তেড়ে হিসু নামিয়ে দিল। সে হিসু গড়িয়ে গড়িয়ে খাটের তলায় রাখা আলু পেঁয়াজের ঝুড়ি টাচ করে করে প্রায়। সে কি যুদ্ধ! হিসু গড়াচ্ছে, মা সারাঘর জুড়ে ছেঁড়া ন্যাকড়া খুঁজছে। টুটুলও মস্তি নিচ্ছে, "কে জেতে দেখি, মা না ব্ল্যাকির হিসু।" ব্ল্যাকিটাও আবাল বাচ্চা, খেলা খেলা ভেবে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। প্রায় ফোটফিনিশে মা ঠিক সময়ে সেই স্রোতস্বিনী ধারাকে আটকে যেই না ঘুরে ব্ল্যাকির দিকে রক্তচক্ষুতে তাকাতে যাবে, সর্বনাশ! ব্ল্যাকি পটির পজিশন নিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। হাওয়া খুব খারাপ বুঝে কালি পিসি তক্ষুনি ব্ল্যাকির ঘাড়ের চামড়াটা ধরে ঝুলিয়ে ঘরের বাইরে না নিয়ে গেলে যে কি হতো সেদিন!!!



একটা স্টেটাসকোতে কেসটাকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা শুরু হল বাবার। বাবার সাথে ফাইনাল আলোচনা করে তারপর ব্ল্যাকির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কেসটা যতটা সম্ভব ব্ল্যাকির ফেভারে আনার জন্য চটপট বই নিয়ে বসে পড়ল টুটুল। মাকে ওভারইম্প্রেস করার জন্য যেচে দুগাছা জানা পড়া ধরিয়ে এল। মা খুন্তি নাড়তে নাড়তে যতক্ষন পড়া ধরলো, ততক্ষণ ব্ল্যাকি একটা পিচবোর্ডের বাক্সে ফুরর ফুরর আওয়াজ করে পাওয়ার ন্যাপ দিয়ে নিল একটা।

সন্ধ্যের পরে বাবা এন্ট্রি নিল সীনে। টুটুলের বাবা, জ্যাঠা, কাকা সবাই অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিলেন। যে কোনও বিষয়ে মিনিমাম দশ-বিশটা অ্যাঙ্গল থেকে না ভেবে সিদ্ধান্ত নিতেন না, এবং অধিকাংশই ভুল সিদ্ধান্ত নিতেন। এত রকম সম্ভাবনা ওঁদের মাথায় ঘুরতো যে আসল ইস্যুটাই হারিয়ে গুলিয়ে ফেলতেন সবাই। একবার নয়, বারবার।

ধরুন, আলোচনা শুরু হল ছোটপিসির জন্য পাত্র বাছা নিয়ে। ছ ভাই ঘন্টা দুই মারাত্মক আলোচনা পর্যালোচনা এমনকি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে ক’কেজি কাতলা কোন বাজার থেকে কেনা হবে বিয়ের দিন, সেটা ঠিক করে ফেলে যে যার মত বেরিয়ে যেত। আর ছোট পিসি চুপ করে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। পাত্র নিয়ে কোনও আলোচনাই যে হল না। পিসির যে শ্যামবাজারের পিসাকেই ভাল লেগেছে সেটা দাদারা কেউ জিজ্ঞাসা করলে তবে তো উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাবে। দাদারা তো কাতলা ফাইনাল করেই যে যার মত বেরিয়ে গেল।

ছোটপিসি চুপ করে দাদুর কাছে গিয়ে বসত, আর দাদু ঠাম্মাকে ঠুসতো, "কতগুলান গাধারে প্যাটে ধরসে ফরসে" বলে।

ঠাম্মা চুপ করে শুনতো। টুটুল শুনেছে দাদু সেই ঢাকা না ফরিদপুর কোথায় জানি ঠাম্মাকে বিয়ে করে কোলে করে নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। এতটাই বয়সের ফারাকজনিত সম্ভ্রম ছিল সম্পর্কটার মধ্যে, ঠাম্মা উলটে কিছু বলতে পারতো না। সেই ক্ষমতাটা এসেছিল পরের জেনারেশনের। জ্যেঠিরা, মা, কাকিমারা যখন তখন ধুনে দিত রেস্পেক্টিভ জ্যেঠুদের, বাবা, কাকাদের...... থাক সেই দুঃখের কথা।

বাবা এন্ট্রি নিয়েই বুঝে গেলো সিদ্ধান্তটা খুব কঠিন। দুদিকেই খ্যাঁকানি খাওয়ার চান্স আছে। রাখলেও মা ঝাড়তে পারে, না রাখলেও মা ঝাড়তে পারে। হাওয়া বুঝে, জামাকাপড় ছেড়ে লুংগি জড়িয়ে বাবা চলে গেল ওর পেটেন্ট স্টাইলে। মাছির মত একটা গোঁফ ছিল। সেটা চুলকাতে চুলকাতে পিচবোর্ডের বাক্সে শোয়া ব্ল্যাকির দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে এক কাপ চা হাতে সোফায় বসে পড়লো। টুটুল, মা, কালি পিসি, সবাই অপেক্ষা করছে সিদ্ধান্তের জন্য। দু মিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট, দেওয়ালের বড় ঘড়িটা টিক টিক করছে। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়... ওঃ, এই না হলে বাবা?!!

গম্ভীর ভাবে প্রথম ডায়ালগটা ছাড়লো... "থাবা গুলো বেশ মোটা মোটা, দেখেই বোঝা যায় ভালো ব্রীড।"

লাও, টুটুলের দম বন্ধ হয় হয়, আর উনি পাঁচ মিনিট বাদে থাবা নিয়ে থেবড়ে গেলেন।

"আপদ" বলে মা চলে গেল রান্না ঘরে, কালি পিসি ভাইকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে চলে গেল, টুটুল আর বাবা দুজনে ফুরর ফুরর করে ঘুমোতে থাকা ব্ল্যাকির দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।



ঠিক এই সীন দু’ হপ্তা আগে বাবার সাথে বাজারে গিয়ে দেখেছিল টুটুল। বড় ইলিশ চাতালে ফেলে ভোলা কাকু বসে আছে, বাবা গভীর দৃষ্টিতে মাছি গোঁফ চুলকাতে চুলকাতে ইলিশটার দিকে তাকিয়ে আছে। ভোলা কাকু বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সময় চলে যাচ্ছে। আশে পাশের পাড়ার কয়েক কাকু জেঠু ও বাবার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। বাবা ছেড়ে দিলে ওনাদের চান্স আসবে ইলিশটার ব্যাপারে। টিক টিক করে সময় চলে যাচ্ছে। ঠিক সাত মিনিটের মাথায়... "আমাদের দেশের বাড়ীতে এর চেয়ে অনেক বড় ইলিশ আসতো" বলে টুটুলের হাত ধরে হাঁটা দিলেন সবজি বাজারের দিকে।

নেহাৎ ভোলাকাকু "আপদ"টা বলতে পারে না, তাই।



তা সে যাই হোক, একটা স্পষ্ট হ্যাঁ বা না ছাড়াই ব্ল্যাকি রয়ে গেল বাড়িতে। হয়ে গেল টুটুলের প্রাণের সঙ্গী।

খুব ভোরে স্কুল চলে যেত, ও তখন ঘুমোত। দুপুরে যখন ফিরতো স্কুল থেকে, ব্যাগটা কালি পিসি নামাতে পারতো না পিঠ থেকে, ব্ল্যাকি ঝাঁপ দিয়ে পড়তো। চেটে চেটে অস্থির করে তুলতো টুটুলকে। তারপর এক সীন হত। খালি গায়ে গামছা পড়ে সারা মাঠ দৌড়চ্ছে টুটুল, ব্ল্যাকি হ্যা হ্যা করতে করতে টুটুলের পিছনে আর তার পিছনে হাতে এক মগ স্নানের জল নিয়ে কালি পিসি আর তারও পিছনে পাড়ার কিউরিয়াস দেশী কুকুরের দল। টুলি, ভুলি, ঝন্টু সব, "ভুক ভুক ভাউ ভাউ" হল্লা করতে করতে। সে এক মহোৎসবের চেহারা। সব্বার মস্তি, একমাত্র কালি পিসি ছাড়া। রোজ বিকেলে বাড়ি ফিরে মা কালি পিসির গজ গজ শুনতো। হপ্তায় হপ্তায় পালা করে টুটুল আর ব্ল্যাকি দু ঘা খেত। কিন্তু দুপুর আসলেই আবার সেই "হি হি হ্যা হ্যা ভুক ভুক ভাউ ভাউ।"



এরপর টুটুলের জীবনে এল রঞ্জিত মাস্টারমশাই। দুপুর আর বিকেলের বাঁদরামো কমানোর জন্য নিয়োজিত হলেন উনি। টুটুল আর ব্ল্যাকি দুজনেই সহ্য করতে পারতো না ওঁকে। এক তো দুপুরভোর খেলাটা মাঠে মারা যেত। দুই, সারাবছর স্কেলের বাড়িতে টুটুলের সর্বাংগ লাল করে রাখতেন। আর তিন যেটা ব্ল্যাকি সহ্য করতে পারতো না, সেটা হল, উনি বেঁটে ছিলেন আর তার ওপর মস্ত মোচ রাখতেন। টুটুলের জেঠুরা,বাবা, কাকারা সব ছ ফিট,মাছি গোঁফ। তাদের দেখে দেখে ব্ল্যাকির এমন চোখ সয়ে গেছিল যে বেঁটে আর গুঁফো লোক দেখলেই গুন্ডা ভেবে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করতো। মাস্টার মশাই ঘরের ভিতরে স্কেলের বাড়ি দিতেন, আর ব্ল্যাকি ওঁর বাইরে ছেড়ে রাখা চটি হিসুতে ভরিয়ে ছেড়ে দিত।



টুটুল, ওর ভাই আর ব্ল্যাকি মায়ের তিন ছেলের মত গুটি গুটি বড় হচ্ছিল। সারা বাড়িতে টিভি ছিল মেজো জেঠুর ঘরে। চিত্রহার বা ভালো সিনেমা থাকলে সবাই মিলে জেঠুর ঘরটাকে হলঘর বানিয়ে বসা হত। একদিকে জেঠুরা, বাবা, কাকারা, আরেক দিকে জেঠিরা, মা, মাঝে টুটুলরা, ল্যান্ডা গ্যান্ডা গুলো। বড়দা, মেজদা, ছোড়দা, মেজদি সবাই। তখনকার সিনেমা। দিলীপ কুমার, সায়রা বানু গাছের পাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে, মেহেবুবা টুবা বলে, ব্ল্যাকি মেজ জেঠুর ইজি চেয়ারের তলায় বসে মেজাজে জেঠুরই চটি চেবাচ্ছে। ঘন ঘন চা আসছে রান্নাঘর থেকে। জেঠুর টিভি বলে জেঠির হাবেভাবে দেমাক ঠিকরে বেরোচ্ছে। পানের সুপুরি কাটছে কট কট করে এমন শব্দ করে যেন "দেখতে হলে দেখ, নয়তো যা, দূর হ। টিভি আমার, সুপুরি আমার, জাঁতা আমার, ঘর আমার। যা খুশি করবো।"

মা, পিছলে যাওয়া ঘোমটা বার বার ঠিক করে নিচ্ছে। ঠিক এমন সময়, হঠাৎ দিলীপ কুমার আর সায়রা বানু দৃষ্টিকটু ভাবে গান গাইতে গাইতে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে। ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সবাই দম বন্ধ করে বসে আছে। দুই কাকা, বড়দা, মেজদার চোখ উত্তেজনায় চক চক করছে। স্যাট করে ক্যামেরা জুম আউট করে চলে গেল দুটো পায়রার দিকে। ধড়ে প্রাণ এলো সবার। ভোঁস করে আওয়াজ করে দম ছাড়লো সবাই। এরকম ছিল সেই জমানা। টুটুল এক ক্লাস বেড়ে পঞ্চম শ্রেণী, তো ব্ল্যাকি হু হু করে বেড়ে পূর্ণ যুবক। রংবাজিই আলাদা তার। পাড়ার টুলি, ভুলি, নুলিদের কাছে ড্রীমবয় ব্ল্যাকি তখন। রাস্তায় বেরোলেই টুলি ভুলি ব্ল্যাকির সামনে এসে চার ঠ্যাং উপরে করে চিৎ হয়ে শুয়ে পটাং পটাং করে ল্যাজ নাড়ায়। লক্ষণ সুবিধার নয় টুটুলের মা বোঝেনি তখনো। তখনকার দিনে পোষ্য পালন এর সহজলব্ধ জ্ঞান ই বা কোথায়? তার কাছে তো বড় ছেলেই ক্লাস ফাইভে, তো ছোট ছেলে ব্ল্যাকি তো অনেএএএক দেরী।

এরকম এক দুপুরে, সেদিন মা অফিস যায়নি, স্কুল থেকে ফিরে টুটুল দেখে ব্ল্যাকি বেধড়ক মার খাচ্ছে। একটা কঞ্চি দিয়ে মা এক ঘা করে দিচ্ছে, সাথে ডায়লগ চলছে "অল্প বয়সে বেশি পেকেছো তুমি? ঘাড় ধরে বের করে দেবো বাড়ি থেকে। নষ্টা ছেলে, বাঁদর কোথাকার" ইত্যাদি । টুটুল তো কিছু বুঝতেই পারছে না কেসটা কি?

বন্ধুদের মধ্যে বাবুয়া একটু তাড়াতাড়ি সব অজানার সন্ধান পেয়েছিল। সেই আলাদা করে ডেকে নিয়ে বোঝাল কেসটা। ওই টুলি, ভুলিতে ব্ল্যাকি সায়রাবানু খুঁজে পেয়েছিল। পুজোর আগে আগে ওই দিনটিতে টুলি বা ভুলি কোনও একটার সাথে রাস্তায় মেহেবুবা গাইতে গাইতে আবেগ আর বাধ মানেনি দুজনেরই। বেচারার দূর্ভাগ্য, ক্যামেরা জুম আউট করে কোনও পায়রা দম্পতি খুঁজে পায়নি। যা দুর্ঘটনা ঘটার, মায়ের চোখের সামনেই ঘটে গেছে। তারই ফল এই কঞ্চির বাড়ি।

দিনে দিনে শিকল, বেল্ট চলে এল। স্বাধীন ব্ল্যাকি বাঁধা পড়ল। সেটাই যে কাল হবে, কে জানতো? মা আর্জেন্ট খবর পাঠালো মেসোকে। তৎক্ষণাৎ ব্ল্যাকির বংশ, গোত্র মিলিয়ে পাত্রী খুঁজতে। স্কুলে পুজোর ছুটি হতে আরো কয়েকদিন বাকি। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরছে টুটুল। বাস থেকে উড়ের চপের দোকানের সামনে নেমে দেখে মেজদা, ছোড়দা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে মিলে জড়িয়ে ধরে বাড়ি ফেরার ধরণটা খুব খুব অচেনা লাগছিলো টুটুলের। বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট জটলা। বাবুয়া, ভাইটি সব ভিড় করে কিছু একটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠলো। হাত ছাড়িয়ে এক দৌড় দিল টুটুল বাড়ির দিকে। ভিড় ঠেলে মুখটা গলিয়ে দিতেই চোখ ফেটে জল চলে এলো টুটুলের। ব্ল্যাকি শুয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনও ভারি গাড়ি চলে গ্যাছে পেটের উপর দিয়ে। ওই টুটুলের জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম আপনজন বিয়োগ। মেসোকে সময় দিতে পারেনি ব্ল্যাকি। আবার কোনও টুলি বা ভুলিকে দেখে চেন ছিঁড়ে ধাওয়া করতে গিয়ে রাস্তায় ট্রাকের তলায় এসে গেছিল ব্ল্যাকি। মা বসে আছে থম মেরে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল নামছে। বড়দা আলোচনা করছে, লেকের কোন কোণায় নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করা হবে ব্ল্যাকিকে। টুটুল তখন মা কে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। মেজদা বলছে, আজ বিকেলেই ও আবার একটা কুকুর নিয়ে আসবে টুটুলের জন্য। টুটুল মনে মনে ফুঁপাচ্ছে, "আমার আর কাউকে দরকার নেই। আমি আর কোনদিন কুকুর পুষবো না জীবনেও।"



পরের কয়েকটা মাস, কি ভাবে কেটেছিল টুটুল ই জানে। দমবন্ধ করে স্কুলে যেত। স্কুল থেকে ফিরে লক্ষী হয়ে স্নান করেই ঘুমিয়ে পড়ত। খেলার সাথীটাই ছিল না যে।



কয়েকমাস পরের কথা। টুলি উঠোনের মিটার হাউসটায় কদিন বাসা বেঁধেছিল। কেউ তাড়ায়নি। একদিন ভোরে, মেজদি চিৎকার করে ডাকলো "টুটুল, শিগগিরি আয়, দেখে যা।" দৌড়ে উঠোনে নেমে চলে গেল টুটুল মিটার হাউসে। টুলি মহাযত্নে সাত সাতটা বাচ্চা কে চেটে পরিষ্কার করছে, আর মেজদি টুটুলের গলা জড়িয়ে ধরে দেখাচ্ছে "বল তো কোনটা কোনটা ব্ল্যাকির মত হয়েছে দেখতে?" টুটুলের দুচোখে জল,সেই সাত সাতটা ব্ল্যাকি আজ কুত কুত করে তাকিয়ে আছে ওর আর মেজদির দিকে। মিটার হাউসে টুলি লেজ নেড়ে নেড়ে খুব গর্ব নিয়ে দেখাচ্ছে ওর ছানা পোনাদের টুটুলের কাছে।

2 comments:

  1. কাছাকাছি অভিজ্ঞতা !

    ReplyDelete
  2. তবে ব্ল্যাকির বদলে লোমঝোলা তিব্বতি কুকুর।

    ReplyDelete