0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক

প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত



পেরো 

ধোঁয়ার আড়াল থেকে জোহার গলা শুনতে পেল পেরো। নিশ্চয় জোহা কোনো বিপদ নয় ঝামেলাতে পড়েছে। এই বিষাক্ত মৌমাছির কামড় খায়নি তো? পেরো এখানের বিজ্ঞ লোকদের কাছ থেকে এই ফুল ও মৌমাছির কথা যত শুনছে তত ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি এগোতে যেতেই সংগের সবাই বাধা দিলো। ধোঁয়া আরো ঘন হোক। হাতে ধোঁয়া মশাল ও সারা গায়ে কম্বল জড়িয়ে তবেই ওখানে কেউ যেতে পারবে। পেরো তাই করলো। ধোঁয়া থেকে এগিয়ে যেতে যেতে মানুষের শরীর ওর পায়ে লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলো। দুজন ফুলঝাড়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। টেনে সোজা করতেই দেখে মরে কাঠ হয়ে আছে। এদের পেরো চেনে। ওরা দুই জঙ্গল বস্তির ওঝা ছিল। সাপে কামড়ালে ওরা ঝাড় ফুঁক করতো। সাপের বিষ বেচত শহরে গিয়ে। পেরোর মনে পড়েছে,এরাই ওই বাচ্চা ছেলেটার আঙুল কেটে সেই রক্ত বীজধানের গাদাতে ছড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকজন দেখেছে। পেরোর পিছন থেকে বয়স্ক কয়েকজন এগিয়ে এসে আঙুল তুলে বলতে লাগলো,এরা তখন সবার কাছে হাতজোড় করে কেঁদেকেটে ক্ষমা চেয়ে ছেলেটাকে আদর করে মধু খাইয়েছিল। তারপর থেকে ওরা গায়েব। নিশ্চয় এরাই ওর খুনী। নাহলে দলছুট হয়ে এখানে কি করতে এসেছিল? নিশ্চয়ই এরা এখান থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে এসেছিল।

ওই দুটো মৃতদেহ নিয়ে কি করা যায় ভাবছিল পেরো। ঠিক সেইসময় আবার জোহার ডাক শুনতে পেলো। এবারে খুব কাছে। হাতের মশাল থেকে তখন ভুরভুর করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। চোখ জলে ভরে গেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। পথ নেই,সামনে পাথরের ছোটো বড় বোল্ডার ছড়ানো। তবু আওয়াজ শুনে হাতে পায়ে এগোতে লাগলো।কিন্তু একটু এগোতেই হঠাত্‍ করে ধোঁয়ার আস্তরন সরে গেল। সামনে যা দেখলো তাতে হতবাক। গোরাচাঁদ জোহার কাঁধে ভর দিয়ে গুহামুখের বিপজ্জনক পাথরের স্তুপে দাঁড়িয়ে। -গুরুজী গুরুজী? 

জোহার মুখে হাসি ফুটলো। পিছন ফিরে আঙুল বাড়িয়ে বলল,-একটা মানুষ গুহাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এখুনি ওকে নিয়ে গিয়ে চিকিত্সার দরকার। গোরাচাঁদ তখন আচ্ছন্ন অবস্থায় জোহার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। পেরোর ডাক শুনে স্মৃতিগুলো সব আরও তালগোল পাকিয়ে মাথার ভিতরে ঘুরছে। দেখলেন সামনে একটা ফর্সা সুন্দর ছেলে তাঁকে গুরুজী বলে ডাকছে। এই ছেলেটা কিছুতেই পেরো নয়। কিন্তু ওর গলা একদম পেরোর মত। আঃ পেরোর মুখটা এখন কেন যে মনে পড়ছে না? মাথার ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছে। এই ছেলেটা কি পেরোকে চেনে? আর এই মেয়েটাও তো আমাকে গুরুজী বলে সম্বোধন করছে। কিন্তু এরা কেউই বনবাসী অষ্ট্রিক প্রজাতির নয় মনে হচ্ছে। আর ওই ছেলেটার পিছনে ধর্মযাজকের বেশে ওরা কারা? সবারই মুখ চোখ নাক মুণ্ডারী। কিন্তু ওদের গায়ের রঙ হিমাচলিদের মত। আর আশেপাশের গাছপালা পাথর ফুল যেন অচেনা লাগছে। এ কোথায় এলাম?স্বপ্ন নয় তো? ভাবতে ভাবতে গোরাচাঁদ এগোতে গিয়েই জ্ঞান হারিয়ে এলিয়ে পড়লেন।

যখন জ্ঞান ফিরলো চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন তিনি একটা কুটিরের ভিতরে শুয়ে। এক অজানা মিষ্টি চন্দনের সুবাস ছড়িয়ে রয়েছে। পাশ ফিরতেই খাটের বাজুতে নাক ঠেকলো। অপূর্ব স্নিগ্ধ মন মাতানো গন্ধ। যদিও মনের ভিতরে একটু উত্কণ্ঠা থাকার কথা এখন আর নেই। চন্দনের এই গন্ধ তাঁর অজানা। তিনি জানেন হাওয়াই দ্বীপের চন্দন সবচেয়ে উত্কৃষ্ট। কিন্তু এই গন্ধের তুলনা হয়না। খাটের সাইজ ও তাতে কারুকাজ দেখে তিনি অবাক। পুরোটাই চন্দন হলে তার কি মূল্য হতে পারে? ভাবা যায়না। চন্দন এক ধরনের পরজীবী গাছ। অন্য কোনো বৃক্ষের রস টেনে পুষ্ট হয়। যেমন বৃক্ষ তার অন্নদাতা তেমনি তার সুগন্ধ। নিশ্চয়ই এই জায়গায় এমন কোনো বৃক্ষ আছে যার রস টেনে চন্দনের এমন মনমোহক সুবাস? 

গোরাচাঁদ দেখলেন যে একটা পাশবালিশ তার বিছানায় আছে সেটা এতো কোমল যে মনে হয় কোনো কচি শিশুর গায়ে হাত রেখেছে। খোলা দরজা দিয়ে একঝলক বাতাস আসতে তিনি পদ্মের গন্ধ পেলেন। কুটিরের কাছেই একটা সরোবর। দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাশি রাশি পদ্মফুল। আশ্চর্য! একরকম নয়। লাল হলুদ নীল কমলা সাদা নানা রঙের পদ্মফুলের মেলা। পুকুরের মাঝখানে খুব বড়বড় সাইজের পদ্মফুল। দূর থেকেই যেন মনে হয় হাজার পাপড়ির পদ্ম। গোরাচাঁদ পুলকিত হলেন। এমন স্বর্গও রয়েছে এই পৃথিবীতে? এই জঙ্গল এরিয়াতে? গোরাচাঁদের মনে পড়ল সেরগেই এর কথা। সে এলে যে কতো বিস্মিত হতো তার সীমা নেই। সেরগেই তাঁকে কন্টাক্ট নম্বর বলে দিয়ে গেছে সেটা তাঁর পরিষ্কার মনে আছে। এখান থেকে ফিরতে পারলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন এই মনস্থ করলেন। কিন্তু এই জায়গাতে এলেন কি করে? কোনোমতেই মনে পড়ছেনা সেই পথ। অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো মনে পড়ছে একটা ফর্সা ওরাওঁ মেয়ের হাতধরে একটা অন্ধকার আঁকাবাঁকা গলিপথ দিয়ে হাঁটছেন। পায়ের নিচে জলপ্রবাহ। আর মনে পড়ছে ওই ফর্সা মুণ্ডারি যুবকটি? একদম পেরোর মত তার গলা। ও গুরুজি বলে ডেকেছিল। কেন? কি করে? এই কথা ভাবতে ভাবতেই কানে গুরুজি ডাক স্পষ্ট শুনতে পেলেন। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। স্বপ্ন কি সত্যি হয়? কুটিরের বাইরে কাদের যেন পায়ের শব্দ? দরজা দিয়ে সেই যুবক যুবতী ঢুকলো।

0 comments: