0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 

৯ 

ফ্রান্সেস্কো অনেক চেষ্টা করে এটুকু বুঝতে পারলো যে লুসিনো ভীষণ কাকুতিমিনতি করে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। কথার জট ছাড়িয়ে যে মর্মার্থ সে উদ্ধার করতে পারলো তা হল যে লুসিনো কখনো কোনোদিন শয়তানের পাল্লায় পড়বেনা, গোটা পাহাড়ে যত শয়তান আছে, তাদের থেকে চিরকাল দূরে থাকবে সে। 

তরুণ সাত্ত্বিক যাজক ফান্সেস্কোর অবশ্য ঐ পাহাড়ে শয়তান এবং অপদেবতার অস্তিত্ব ও ক্ষমতার ব্যাপারে বিশেষ পরিষ্কার ধারণা ছিলনা। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই জগতে দেবদূত আর শয়তান, এই দুয়েরই সমান আধিপত্য ছিল। যে দেবদূত ছিল, হয়ত সেইই শয়তান হয়ে গিয়েছিল। যেমন লুসিফারের গল্পে সে ঈশ্বরের অভিশাপে স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হয় এবং শয়তানে পরিণত হয়। ফ্রান্সেস্কোর মনে হঠাৎ আতঙ্ক উপস্থিত হল। সে বুঝতে পারছিলনা ঠিক যে তাকে কিসের সঙ্গে লড়তে হবে! কুসংস্কারের সঙ্গে, নাকি অজ্ঞতা, অশিক্ষার সঙ্গে। তার হঠাৎ মনে হল সে এক অদ্ভুত অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার অধীত বিদ্যার সাহায্যে এরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা সে করতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে তার মনে সন্দেহ উপস্থিত হল। কারণ, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই বন্য, অবহেলিত মানুষটির ঈশ্বর কিংবা যীশু এসব সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। দেবদূত, আধ্যাত্মিক ভাবনা এসব একেবারে অচেনা, অজানা জিনিস লুসিনোর কাছে। বরং সে হয়তো কোনো কুসঙ্গে অথবা শয়তানের পাল্লায় পড়েছে। ফ্রান্সেস্কোর মধ্যে যে সে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করছে এমনটি ভাবার কোনো মানে হয়না, কারণ ঈশ্বর সম্বন্ধে লুসিনো কিচ্ছুটি জানেনা। খুব বেশি হলে সে হয়তো ফ্রান্সেস্কোকে যাদুকর গোছের কিছু ঠাউরেছে, ভেবেছে তার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে হয়তো বা। এক তুড়ি মেরে সে লুসিনোর সব সমস্যা গায়েব করে দিতে পারবে, এরকম ধারণা হয়েছে তার। ফ্রান্সেস্কো ওকে টপকে বেরিয়ে আসতেও পারছিলো না, কারণ লুসিনো কাকুতিমিনতি করতে করতে তার সামনে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে তার পুরু ফোলা ঠোঁট দিয়ে তার জুতো ভরিয়ে দিচ্ছিল অজস্র চুম্বনে; ভিজে উঠছিল তার জুতো। 



ফ্রান্সেস্কো এরকম পরিস্থিতিতে জীবনে কোনোদিন পড়েনি। পাহাড়ের হাল্কা বাতাস, বসন্তের আগমন, সভ্যজগতের স্তর থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, এই সবকিছুই সম্ভবত তার যুক্তিবুদ্ধিকে কিছুটা গুলিয়ে দিচ্ছিলো। স্বপ্নের মত যেন এক ইন্দ্রজাল আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তার আত্মার পরিমণ্ডল। বাস্তব আর কল্পনা অনেকখানি মিশে যাচ্ছিল সেই পাহাড়ের আলো- আঁধার পরিবেশে। তার এই দ্বিধাবোধের সঙ্গে কিছুটা ভীরুতাও হয়ত মিলেছিল, কারণ সে কিছুতেই এই জায়গাটার থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলোনা। তার হয়ত তখনি পাহাড় থেকে নেমে নিচে গির্জার ঘণ্টাধ্বনির দিকে ঈশ্বরের সুরক্ষাবলয়ের মধ্যে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে সেটা করে উঠতে পারছিলোনা। হয়তো বা শয়তানের আকর্ষণ আরও অপ্রতিরোধ্য যা এই সাত্ত্বিক ধর্মপ্রাণ যাজককে এক বিচ্যুতির খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। 

ফ্রান্সেস্কো এটা কখনো শেখেনি যে বিধর্মীদের ঈশ্বরের মূর্তিগুলি পুরোপুরি কল্পনাসঞ্জাত। চার্চ খ্রিস্টানদের ঈশ্বরবিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজের শক্তির বিস্তার ঘটিয়েছে এবং অন্য যেকোনো ধর্মকে ঈশ্বরের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দ্রব্য বলে দাগিয়ে দিয়েছে; সেগুলো সব ঈশ্বরবিশ্বাসের পরিপন্থী- এই ভাবনা নিয়ে খ্রিস্টানরা লড়ে গেছে অন্য ধর্মের সঙ্গে। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হয়তো পৃথিবীতে কোথাও বসে দেখছেন এই লড়াই আর ঝগড়া। ফ্রান্সেস্কো নিজেও এইরকম ভাবনারই ফসল; অতএব যখন লুসিনো তার ঘরের এককোণ থেকে একটা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে এসে ফ্রান্সেস্কোকে দেখাতে লাগলো, সে তখন ভয়ে, আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়লো। সেই কাঠের উপরে অদ্ভুত দেখতে খোদাই করা এক মূর্তির ছবি। উফফ, এ কেমন ঈশ্বর! মানুষের মূর্তি নাকি ড্রাগনের? জাগতিক বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার স্বাভাবিক নির্মোহী দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও সে আরও খুঁটিয়ে সেই মূর্তিটা দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলোনা। বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়ে সে দেখতে লাগলো ভয়ঙ্কর সেই পাগান দেবতার মূর্তি। আদিম বিচারব্যবস্থা, ইত্যাদির প্রতিভূ, গ্রাম্য উর্বরতা এবং সৃষ্টির রহস্য হয়তো বা নির্দেশ করে এই মূর্তি। ফ্রান্সেস্কো একটুখানি দেখেই আর সহ্য করতে পারলোনা। সোজা ফায়ারপ্লেসের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ঐ কাঠের টুকরোটা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই লুসিনো তড়িৎগতিতে তুলে নিলো সেটা আগুনের ভেতর থেকে। এক দুটো জায়গা একটু ধরে উঠলেও সেটা লুসিনো তাড়াতাড়ি নিবিয়ে দিয়ে প্রায় আগের অবস্থায় নিয়ে এসে সেটাকে যথাস্থানে বসিয়ে রাখলো। ফ্রান্সেস্কো ভেবে পাচ্ছিলোনা কীভাবে, কোন কথা বলে লুসিনোকে শোধরানো সম্ভব। সে নানা ঐশ্বরিক উপদেশ দিতে শুরু করলো এত কিছুর পরেও। 

লুসিনো জানে না ঈশ্বর আসলে কি? কাঠের টুকরোর ঐ অদ্ভুতদর্শন মূর্তি নাকি যিনি রক্তমাংসের মানুষ হয়েও ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মানুষের জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন! লুসিনো অদ্ভুতভাবে চেয়ে রইলো ফ্রান্সেস্কোর দিকে। একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস মিশে আছে সেই দৃষ্টিতে। ফ্রান্সেস্কোর ভয় করতে লাগলো। সে আতঙ্কিত হয়ে চেয়ে রইলো সেই মূর্তিটার দিকে। তবুও সে নানা কথা বলে লুসিনোকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলো। তার আধ্যাত্মিক যাত্রাপথে এরকম কোনো বাধা কোনোদিন আসেনি। এক এবং একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোনোদিন প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েনি, তাও আবার তাকে এরকম একজন অবহেলিত মূর্তিপূজকের ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনে। সে এখন বুঝতে পারলো যে লুসিনোর পাপ পুণ্য সম্পর্কে কোনো সচেতন সঠিক ধারণা নেই। 

তার কথার মধ্যেই এসে উপস্থিত হল লুসিনোর বোন। ফ্রান্সেস্কোর ভাষণের মাঝেই প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে শুরু করলো সে। ফ্রান্সেস্কো একটু দূর থেকে দেখতে লাগলো এই উগ্র মহিলাকে। ফ্যাকাসে এবং বিরক্তিকর চেহারা, কতজন্ম চান করেনি কে জানে! ছেঁড়াফাটা পোশাকের মধ্য দিয়ে শরীরের অনাবৃত অংশ দেখা যাচ্ছিল। ফ্রান্সেস্কোর ভাষণ শেষ হবার পরেই ঐ মহিলা ফিসফিস করে কী যেন বলে লুসিনোকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিলো। কোনো প্রতিবাদ না করে পোষা কুকুরের মত লুসিনো বেরিয়ে গেলো। তারপর সেই নোংরা মহিলা, যার বিশাল লম্বা চুল জট হয়ে ঝুলে আছে কোমর ছাপিয়ে, সে ফ্রান্সেস্কোর হস্ত চুম্বন করলো, তারপর বলে উঠল, ‘আপনার যীশুখ্রিস্ট আমারও বড় প্রিয়!’ 

ঠিক তার পরক্ষণেই সেই মহিলা হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। 




(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments: